নয়
বিপদ যখন আসে তখন নাকি সব দিক থেকেই আসে ।
এমি'র বুদ্ধি মত্তায় শিপটা প্রায় দুই হাজার কিলোমিটার উপরে উঠে গেলেও হুট করে বেড়ে যাওয়া মাধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রভাবে কয়েক মুহূর্ত স্থির থেকে তারপর ধীরে ধীরে নিচের দিকে নেমে যেতে লাগলো । আমি আতংকে হই হই করে উঠলাম । শক্তিশালী ইঞ্জিনের প্রচণ্ড শব্দে কানে তালা লেগে যাবার যোগার হলো । নিচে আঁচড়ে পরার আশংকায় এমি, এমি বলে চিৎকার করে উঠতেই , এমি বলল, "তুমি হেলমেট পড়ে নাও । মনে হচ্ছে, গ্রহটি আমাদের যেতে দিতে চাচ্ছে না । চুম্বকের মতো টেনে নিচে নামাচ্ছে । "
এমি'র কথা শুনে আমার আতংক রীতিমতো ভয়ে রূপ নিলো । সত্যিই যে গতিতে শিপ'টা নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে, তাতে গ্রহ পৃষ্ঠে আছড়ে পরার সাথে সাথে বিস্ফোরিত হয়ে যাবার কথা। হয়তো আমার মনোভাব বুঝতে পেরে এমি বলল, ভয় পেও না । নভোযানটি এমন ভাবে তৈরি করা হয়েছে যে, হাজার কিলোমিটার উপর থেকে আছড়ে পরলেও কিছু হবে না । এমি'র কথায় কিছুটা আশ্বস্ত হয়ে, ককপিট থেকে নিচের দিকে তাকিয়ে রইলাম । কিন্তু বুকের ভেতটা ক্যামন ধুকধুক করতে লাগলো। কি যানি, কি যানি একটা অমঙ্গেল আশংকায় মনটা মনটা ঠিক স্থির হতে পারছে না। ভয় হচ্ছে, এমন একটা জিনিস যা একবার যদি কারো ভেতর ঢুকে যায় তাহলে সহজে আর ছেড়ে যেতে চায় না।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে । উঁচু, নিচু শক্ত পাহাড়ের ভাজে ভাজে সূর্যের মতো গোলাকার নক্ষত্রগুলো একটু একটু করে ডুবে যাচ্ছে । ঘোলাটে লাল আলো একটু একটু করে গ্রাস করে নিচ্ছে সবকিছু । মনে হচ্ছে, অনন্ত কালের অন্ধকার গহব্বরে হারিয়ে যাচ্ছে সব। অদ্ভুত প্রাণীগুলো তখানো এখানে, ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাড়িয়ে শিপটার দিকে তাকিয়ে আছে ।
এন্ডোমিডা ! বুক ছিঁড়ে একটা দীর্ঘ শ্বাস বেড় হয়ে এলো আমার ।
বেশ কিছুটা সময় ধরে যন্ত্র ও মাধ্যাকর্ষণ শক্তিতে টানাটানির পর নভোযানটি মাটি থেকে প্রায় দু'শো গজের মধ্যে নেমে এলো । পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনের বাহিরে চলে যাচ্ছে দেখে , আমি চিৎকার করে উঠলাম , আর নামতে দিও না, আর নামতে দিও না । খোদার দোহাই তোমার । কিন্তু কোন কিছুতেই কিছু হলো না । ধীরে ধীরে নভোযানটি নেমে এলো এন্ডোমিডার টেলসা নামক গ্রহে ।
আমি বিস্ফোরিত চোখে ককপিট থেকে নিচের দিকে তাকিয়ে রইলাম । অপেক্ষারত হাজার হাজার অদ্ভুত প্রাণীদের জমায়েতের দিকে । তাদের সকলের মধ্যে এক ধরনের উল্লাস দেখা যাচ্ছে । নিজেদের বিজয়ে খুশি হয়ে উঠেছে সবাই । কেউ কেউ হাতে থাকা লাঠিগুলো উঁচিয়ে উল্লাস প্রকাশ করছে । কেউ আবার ঘোড়া সদৃশ প্রাণীর পিঠে চড়ে ছুটে আসছে নভোযান বরাবর ।
ভবিষ্যতের শঙ্কায় মনে হলো বধির হয়ে গেলাম । কি করবো বুঝে উঠতে পারছি না । হায়! ঈশ্বর, এ কোন পরীক্ষার মধ্যে ফেললে আমায়? হয়তো আমার হতাশগ্রস্ত অবস্থা দেখে শান্তনা দেবার জন্য এমি বলল, ভয় পেও না । ওরা আমাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না ।
এমির কথায় কিছুটা আশ্বস্ত হলেও ধীরে ধীরে বললাম, নিরাপত্তা, নিরাপত্তার জন্য কি কি ব্যবস্থা আছে আমাদের?
আমার প্রশ্নে এমি একটু হাসির মতো শব্দ করে বলল, চাইলে এই গ্রহটি উড়িয়ে দেবার মতো যথেষ্ট বিস্ফোরক মজুদ রয়েছে আমাদের । কিন্তু সে সবের প্রয়োজন হবে বলে মনে হয় না ।
নামতে নামতে শিপটা গৃহ পৃষ্ঠ হতে প্রায় পঞ্চাশ গজ উপরে এসে একটা ঝাকুনি দিয়ে নিশ্চল হয়ে গেলো ।
আমি বললাম , কি হলো ?
এমি বলল, লক করে দিলাম । ওরা চাইলেও আর নিচে নামাতে পারবে না । বিশেষ টেকনোলজি ব্যবহার করে নভোযানের চারপাশে ইলেকট্রন শক্তির প্রভাবে একটা বলয় সৃষ্টি করে সেটাকে ভর শূন্য করে ফেলা হয়েছে । ফলে নভোযানটি কোন প্রকার জ্বালানি ব্যবহার না করেই বছরের পর বছর অবস্থান করতে পারবে। শুধু তাই নয় নভোযানের চারপাশে সৃষ্টি হওয়া ইলেকট্রন শক্তির প্রভাবে নভোযানটি যেমন মাধ্যাকর্ষণ শক্তির টান হতে মুক্ত তেমনি বাহি শক্রুর আক্রমন হতেও মুক্ত । তাই তুমি নিশ্চিত থাকতে পারো । কোন প্রকার যান্ত্রিক গুঞ্জন ছাড়া শিপটাকে এক জায়গায় স্থির হয়ে থাকতে দেখে মনে মনে টেকনোলজিকে ধন্যবাদ না দিয়ে পারলাম না ।
নভোযানটি হঠাৎ থেমে যাওয়ায় নিচে অপেক্ষারত প্রাণীগুলোর মধ্যে চাঞ্চল্য দেখা দিলো । দলে বেঁধে তারা নভোযানের নিচে এসে জড়ো হতে লাগলো । কেউ কেউ হাতে থাকা লাঠিগুলো থেকে অদ্ভুত এক ধরনের আলো ছুড়ে মারল নভোযানটি লক্ষ্য করে । কিন্তু তাতে নভোযানটির কোন ক্ষতিই তো হলোই না উল্টো নভোযানের বাহিরে তৈরি হওয়া ইলেকট্রন বলয়ে আঘাত প্রাপ্ত হয়ে সেগুলো তীব্র গতিতে ছুটে গিয়ে পাল্টা আঘাত করলো মাটিতে দাড়িয়ে থাকা প্রাণীগুলোকে । অপ্রত্যাশিত পাল্টা আঘাতে ও ঝলকে উঠা বিস্ফোরণের ছটায় তারা হতবিহ্বল হয়ে পরলো। তারপর কয়েক মুহুর্তের মধ্যে ছত্রভঙ্গ হয়ে এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়লো । আমি বাচ্চাদের মতো হাত তালি দিয়ে বলে উঠলাম, বেশ হয়েছে, ভালো হয়েছে নিজেদের বোমাতে নিজেরাই ঘায়েল হয়েছে।
পৃথিবীর সন্ধ্যার মতো আলো কমতে কমতে একসময় গ্রহটি জুড়ে ঘুটঘুটে অন্ধকার নেমে এলো । ককপিটের গ্লাস দিয়ে টেলসা নামক গ্রহটিকে রহস্যময় মনে হতে লাগলো । মনে হলো যা দেখছি সব ভুল, সব মিথ্যে। হয়তো আমি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছি। ঘুম ভেঙ্গে গেলেই দেখবো আমি আমার চির পরিচিত পৃথিবীতে বসবাস করছি। কিন্তু হায়! বাস্তবতা যে কতটা ভিন্ন,নির্মম ও কঠিন তা এই মুহুর্তে আমার চাইতে আর কে ভাল বুঝবে?
তাপমাত্রা পরিমাপের যন্ত্রের দিকে তাকিয়ে দেখি দ্রুত কমে যাচ্ছে গ্রহটির তাপমাত্রা । এবং তা এতোটাই দ্রুত যে , অবাক না হয়ে পারলাম । দেখতে দেখতে সেখানে তুষার পাত হতে লাগলো । বৃষ্টির ধারার মতো নামতে থাকা তুষারপাতের সে এক অদ্ভুত দৃশ্য ।
প্রাণীগুলো অনেক আগেই ঘায়ের হয়ে গেছে । খুব সম্ভব তারা ভূ-ত্বকের নিচে কিংবা পাহাড়ের ভাজে নিজেদের নিরাপদ আশ্রয় স্থল তৈরি করে নিয়েছে । যদি ভূত্বকের নিচে একটা জরিপ চালাতে পারতাম তাহলে এই সব প্রাণী সম্পর্কে আরো ব্যাপক তথ্য পাওয়া যেতো ।
বিজ্ঞান এদের স্বীকৃতি দেখ কিংবা না দেখ তাতে আমার কিছু আসে যায় না । কোনদিন যদি পৃথিবীতে ফিরে যেতে পারি তাহলে এদের কথা অবশ্যই পৃথিবীর মানুষকে জানাবো । চোখের সামনে এলিয়েন দেখেও তাদের এলিয়েন বলে স্বীকার না করে মরীচিকার পেছনে কোটি কোটি ডলার ব্যয় করার কোন মানে হয় না । প্রতারণা নামক যে কাচের দেয়াল তুলে এলিয়েনদের সম্পর্কে পৃথিবী বাসীর কাছে থেকে প্রকৃত সত্য থেকে আড়াল করা হচ্ছে। সে কাচের দেয়াল ভেঙ্গে সকল দূরত্ব ঘুচিয়ে দেবো একদিন।
ভোরের দিকে অদ্ভুত একটা ঘটনা ঘটলো । ভোর বলছি এ কারণে যে, ধীরে ধীরে অন্ধকার কেটে গিয়ে একটু একটু করে আলো ফুটে উঠছে । তাপমাত্রার যন্ত্রে দেখলাম, উষ্ণতা বাড়তে বাড়তে আবার ৩০ ডিগ্রী সেলসিয়াসে উঠে এসেছে । পৃথিবীর মতো টেম্পারেচার । কিন্তু অক্সিজেনের কোন রিডিং পাচ্ছি না ।
পেলে ভালো হতো । সবচেয়ে ভালো হতো যদি গ্রহটিতে নামতে পারতাম । তাহলে, আমি হতাম এন্ডোমিডা গ্যালাক্সির টেলসা নামক গ্রহে পদার্পণ করা প্রথম কোন মানব সন্তান । কথাটা মনে আসতেই আপন মনে হেসে উঠলাম।
আমার মনোভাব বুঝতে পেরেই যেনো, এমি বলল, তুমি কি গ্রহটিতে নামতে চাইছো ? আমার ভেতর কি হলো জানি না । আমি বললাম, হ্যাঁ , আমি গ্রহটিতে নামতে চাইছি । প্রাণীগুলোকে আরো কাছ থেকে দেখতে চাই । ওদের সম্পর্কে আরো জানতে চাই । হতে পারে আমরা ওদের যতোটা ভয়ংকর মনে করছি ওরা আসলে ততোটা ভয়ংকর নয় ।
কিছু সময় চুপ থেকে এমি বলল, বেশ, তাহলে তুমি এই সময়টাকেই গ্রহটিতে নামার জন্য বেছে নাও । গ্রহটিতে নেমে সর্ব প্রথম যে কাজটি করবে সেটি হচ্ছে , মাটি সংগ্রহ করা । যা পৃথিবীর কল্যাণে ভবিষ্যৎ গবেষণায় কাছে লাগবে । তা থেকে গ্রহটি সম্পর্কে সব রকম তথ্য পাওয়া যাবে ।
স্কুটার আকৃতির ছোট্র একটি যানের ভেতর ঢুকতেই সেটিকে বাচ্চাদের খেলনার মতো মনে হলো । সেটি পরিচালনা করাও খুব সহজ । অনেকটা মোটরসাইকেলে মতো । পিক আপ দিলেই গতি বাড়ে আবার পিক কাপ কমালে গতি কমতে কমতে একেবারে স্থির হয়ে যায় । পায়ের কাছে ব্রেক প্যাড এর জায়গায় ব্রেক প্যাড ছাড়াও আরো দুটো প্যাড রয়েছে । সেগুলোর একটাতে চাপ দিলে যানটি নিচে নামে অন্যটি চাপ দিলে উপরের দিকে উঠে যায় ।
যানটিতে বসে বেশ মজা পেয়ে গেলাম । টেলসার বুকে এই যানটিতে চড়ে ঘুরে বেড়াবার লোভ বেড়ে গেল । তবে যানটির পুরো বর্ডি খুব শক্ত এক ধরনের বিশেষ ম্যাটেল দিয়ে তৈরি মনে হলো । খুব জোরে আঙুল দিয়ে চাপ দিয়ে একটুও ধাবাতে পারলাম না ।
মিনিট বিশের প্রাকটিস শেষে নেমে গেলাম টেলসার বুকে ।
মাটি থেকে বেশ কিছুটা উপর দিয়ে উড়তে লাগলাম পাখির মতো । সব কিছু স্বপ্নের মতো মনে হতে লাগলো । হঠাৎ মুক্তির আনন্দ পেয়ে বসলো আমায়। মোটরসাইকেলের মতো কখনও তীব্র গতিতে আবার কখনো ধীরগতিতে শব্দহীন ভাবে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম ।
শিপ থেকে গ্রহটিকে যতোটা রুক্ষ মনে হচ্ছিলো, সেটা আসলে তার চাইতেও অনেক অনেক বেশি রুক্ষ । পানির অভাবে চৌচির হয়ে যাওয়া ফসলি জমির মতো সর্বত্র মাটি ফেটে জ্বালামুখীর মতো হা করে রয়েছে। খন্ড বিখন্ড মাটির ফাকে ফাকে কোথাও কোথাও জমে থাকা বরফের চাকের মতো জমে থাকা পানির আধার দেখা যাচ্ছে । হঠাৎ করে তাকালে জলাশয় বলে ভুল হবে।
বিষয়টা আমাকে খুব অবাক করলো । পানি থাকা মানে ই তো প্রাণের অস্তিত্ব । অবশ্য প্রাণীর দেখা তো ইতিমধ্যে পেয়েই গেছি । আর একটু ভালো করে দেখার জন্য , প্রায় ১৫ ফুটের মধ্যে নেমে এসে ছবি তুলতে লাগলাম । ঝরনার জলের মতো টলটলে পানি জলাশয়গুলোর পানি । দেখেই মনের ভেতর সাতার কাটার ইচ্ছে জেগে উঠলো । নিজের হাস্যকর ভাবনায় নিজের ই হাসি পেয়ে গেলো।
উপড়ে উঠে গিয়ে কয়েকটা চক্কর দিয়ে. এমি'র উদ্দেশ্যে বললাম,এমি, এখানে নামতে চাই । তাহলে মাটি এবং পানি দুটোই নিয়ে আস্তে পারবো । এমির খুব ক্ষীণ কণ্ঠে কি যেন বলার চেষ্টা করলো । কিন্তু ওর কথা কিছুই বুঝতে পারলাম না । মনে হচ্ছে, ইলেট্রো বলয়ের কারণে ওর কথা শোনা যাচ্ছে না ।
চারপাশটা খুব ভাল করে পর্যবেক্ষণ করে ধীরে ধীরে নেমে এলাম টেলসার বুকে । মাটি ছোঁয়ার পর ইঞ্জিন বন্ধ না করেই বেশ কিছুটা সময় অপেক্ষায় রইলাম, কি হয় তা দেখার জন্য । কিন্তু অনেকটা সময় কেটে যাবার পরেও যখন কিছুই ঘটলো না তখন আমার সাহস বেড়ে গেলো। ইঞ্জিন বন্ধ করে ধুরুধুরু বুক নিয়ে নেমে এলাম। বুকের ভেতর হৃদপিণ্ডটা এমনভাবে লাফাচ্ছিল যে,স্পেস স্যুটের ভেতরে সে শব্দ পৌছে যাচ্ছিল কর্ণকুহরে । হায়! তখন যদি জানতাম নিজের অজান্তেই কি ভয়ংকর পরিনতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছি আমি ।
চলবে .........
এখানে থেকে সবগুলো পর্ব পড়তে পারেন ।
৮ম পর্ব
৭ম পর্ব
৬ষ্ঠ পর্ব
৫ম পর্ব
৪ থ পর্ব
৩য় পর্ব
২য় পর্ব
১ম পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই অক্টোবর, ২০২২ সকাল ১০:০৮