আজ থেকে প্রায় ২০ বছর আগের একটি ঘটনা পাঠক বন্ধুদেরকে শোনাতে আমার খুব ইচ্ছা হচ্ছে। আমার পাঠক বন্ধুদের এটি কতটুকু ভালো লাগবে তা জানি না। তবে চেষ্টা করবো প্রাণবন্ত ও আকর্ষণীয় করে লিখতে।
১৯৯১ সালে আমি এস ই ডি পি (স্মল এন্টারপ্রাইজেস ডেভলপমেন্ট প্রজেক্ট) নামে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি প্রকল্পে প্রশিক্ষন উপদেষ্টা (ট্রেনিং কনসালট্যান্ট) হিসাবে প্রকল্পের ফরিদপুর অফিসে যোগদান করি। এই প্রকল্পটি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে উদ্যোক্তা উন্নয়ন করে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ব্যক্তিদেরকে উত্তরা ব্যাংকের মাধ্যমে ঋণ বিতরণ করতো। এটি নোরাড, বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিসিকের য়ৌথ প্রকল্প ছিল। আমার কাজ ছিল আগ্রহী ব্যক্তিদেরকে ব্যবসায় ব্যবস্থাপনা প্রশিক্ষণ দেয়া, প্রশিক্ষণের উপকরণ প্রণয়ন ও সংরক্ষণ এবং প্রশিক্ষণ শেষে প্রশিক্ষণের প্রতিবেদন প্রণয়ন ও কর্তৃপক্ষের কাছে দাখিল করা।
প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে। কিন্তু প্রশিক্ষণের কোন ম্যানুয়েল ছিল না। এই প্রকল্পের প্রশিক্ষণ দেয়ার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল মাইডাসকে। পরবর্তীতে প্রকল্প তাদের নিজেদের প্রশিক্ষণ টিম গঠণ করার প্রয়াসে ৩জন প্রশিক্ষণ কনসালট্যান্ট নিয়োগ দেয়। আমি তাদের একজন। প্রথম কয়েকটি প্রশিক্ষণ মাইডাস করায়। এই প্রশিক্ষণে এস ই ডি পি-র কিছু কর্মকর্তা উপস্থিত থাকেন। এদের মধ্যে কল্পনা আহমেদও ছিলেন। তিনি প্রশিক্ষণের একজন অংশগ্রহণকারী হিসাবে যে নোট নেন সেই নোটের উপরে ভিত্তি করে একটি প্রশিক্ষণ সিডিউল তৈরী করেন ও প্রশিক্ষণ পরিচালনা গাইড লাইন তৈরী করেন। কিন্তু তা কোন লিখিত গাইডলাইন বা ম্যানুয়েল ছিল না। আমি আমার প্রথম প্রশিক্ষক প্রশিক্ষণ এই ব্যক্তির কাছ থেকে পাই। প্রশিক্ষক প্রশিক্ষণ শেষে ফরিদপুর অফিসে প্রশিক্ষণ পরিচালনা করার দায়িত্ব পাই।
এস ই ডি পির দুইটি অফিস ছিল। ফরিদপুর এবং মাদারীপুরে। স্বাভাবিকভাবে দুই অফিসে দুইজন কনসালট্যান্ট কাজ করতাম। প্রশিক্ষণের কোন লিখিত গাইডলাইন বা ম্যানুয়েল না থাকায় আমরা দুইজনে আমাদের মাথায় যা ছিল তাই নিয়ে প্রশিক্ষণ পরিচালনা করতাম। এক পর্যায়ে কর্তৃপক্ষ প্রশিক্ষণের সামর্থ্য, সীমাবদ্ধতা, সুযোগ ও হুমকীসমূহ বিশ্লেষণ করা ও এই প্রশিক্ষণের ফলাফল বিচারের জন্য ডঃ রওশন কামালকে নিয়োগ দিলেন। তিনি আমাদের পরিচালিত প্রশিক্ষণ ক্লাশে উপস্থিত থেকে তার বিজ্ঞ মতামত জানালেন। তাতে বোঝা গেলো আমাদের প্রশিক্ষণ পরিচালনা মধ্যে কিছু দৃর্বলতা রয়েছে। আমি তা খুব মন দিয়ে শুনলাম এবং সেই উপদেশগুলি ও গাইডলাইনগুলি মাথায় নিলাম ও প্রশিক্ষণে ব্যবহার করে প্রশিক্ষণকে আরও সমৃদ্ধ করলাম। ইতোঃমধ্যে ময়মনসিংহে প্রকল্পের আরও একটি অফিস খোলা হলো। সেখানে আরও দু'জন প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হলো। তাদের দুজনের প্রশিক্ষণ পরিচিতি প্রশিক্ষণের ভার পড়লো আমার উপরে। আমি তাদের দু'জনকে প্রশিক্ষণ দিলাম। এই সময়ে আমার মনে হলো এই প্রশিক্ষণের জন্য একটি ম্যানুয়েল থাকা প্রয়োজন। আমি তখন রিউম্যাটিক আথ্রাটিস-এর রোগী। হাত দিয়ে লিখতে পারি না। আমার বস আমাকে বললেন,"আপনি প্রশিক্ষণ ম্যানুয়েল লিখতে পারেন। তাতে আমি বাধা দেব না। কিন্তু আমি কোন কম্পিউটার সার্ভিস দিতে পারবো না।" আমার প্রশিক্ষণ টিমে আমরা ৩ জন কাজ করতাম। আমি, সিফির ও পলাশ। সিফির ও পলাশের পুরো নাম এই মুহূর্তে মনে করতে পারছি না। যাহোক সিফির কিছু বই সংগ্রহ করে আনলো। আমি ডিকটেশন দিলাম আর পলাশ হাতে লিখতে লাগলো। এভাবে আমাদের প্রথম প্রশিক্ষণ ম্যানুয়েল তৈরী হলো। এটি মুদ্রণ হয় নি। হাতের লেখা পান্ডুলিপিটি ফটোকপি করে বাধাই করে হেড অফিসে জমা দেয়া হয়। পরবর্তীতে জেনেছি এই বইটি বাংলাদেশ টেক্সট বুক বোর্ডের নবম ও দশম শ্রেণীর পাঠ্য পুস্তক ব্যবসায় উদ্যোগ নামে বইটি লেখার সময় লখকদ্বয় জনাব নীলুফার আহমেদ করিম ও ডঃ হাবিবুর রহমান এই প্রশিক্ষণ ম্যানুয়েলটিকে ৩ নয় রেফারেন্স হিসাবে ব্যবহার করেছেন।
যাহোক এভাবে আমার প্রশিক্ষণ কন্সালট্যান্ট হিসাবে কাজ এগিয়ে চলছিল। ১৯৯৩ সালে আমাকে নারী উদ্যোক্তা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে ভারতের আহমেদাবাদে ১মাসের জন্য পাঠানো হলো। প্রশিক্ষণ প্রদানকারী সংগঠনটি হলো ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর এন্টারপ্রেনিয়রশীপ এ্যান্ড ক্যারিয়ার ডেভলপমেন্ট সংক্ষেপে আই সি ই সি ডি। এই প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে আমি ঢাকা ত্যাগ করি। এই প্রশিক্ষণের খরচ বহন করে নোরাড। বাংলাদেশ থেকে আমরা ৫জন এই প্রশিক্ষণে অংশ গ্রহণ করি। এই ৫ জনের মধ্যে আমার মনে আছে কৃষ্ঞা চন্দ, দীপালী ও মৌসুমী এই ৩টি নাম।
আমি যেহেতু বাংলাদেশে এই প্রশিক্ষণ প্রদান করছি সেহেতু এই প্রশিক্ষণটি আমি খুবই গুরুত্রের সাথে গ্রহণ করি। প্রশিক্ষণের প্রতিটি ধাপ, বিশ্লেষণ, তথ্য প্রদান, প্রশিক্ষণের পদ্ধতি, প্রশিক্ষণার্থীদের প্রতিক্রিয়া ইত্যাদি আমি খুব মনযোগ সহকারে অবলোকন করি ও আমার মধ্যে ধারণ করি। এই প্রশিক্ষণের প্রতিটি বিষয় আমাকে গভীরভাবে নাড়া দেয়। আমি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটকে আমার মনের পর্দায় চিত্রায়িত করি। তার সাথে ভারতের প্রেক্ষাপট তুলনা করি। আমি বোঝার চেষ্টা করি কিভাবে এরা উন্নতি করছে। আমি কিভাবে বাংলাদেশে এই বিষয়টি বাস্তবায়ন করতে পারি। যদি আমি এই প্রশিক্ষণ কার্যক্রমটি বাংলাদেশে চালু করি তাহলে কি উপকার হবে তা নিয়েও বিশেষ ভাবে চিন্তা করি। এবং ধীরে ধীরে আমি আমার অন্তরের অন্তঃস্থলে বদলে যেতে শুরু করি। এবং মনের অজান্তে কখন যেন সত্যিকারেই বদলে যাই।
এখানে দুটি ঘটনার কথা আমি বলতে পারি। একটি হলো কেনা কাটা। এটি ছিলো একটি আন্তর্জাতিক প্রশিক্ষণ। এখানে পৃথিবীর প্রায় ৬টি দেশ থেকে অংশগ্রহণকারী এসেছিলো প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করতে। প্রত্যেকের কাছে ডলার ছিলো। প্রশিক্ষকরা চাইলেন এই ডলারগুলি যেন ভারতে থেকে যায়। তবে খুবই কৌশলে। অবশ্য এটি দেশকে ভালোবাসার একটি জ্বলন্ত উদাহরণ। এজন্য প্রথম দুদিন তারা আমাদেরকে নিজেদের গাড়ীতে করে বাজারে নিয়ে গেল। কোন বাজারে কোন জিনিস কি দামে পাওয়া যায় সে বিষয়ে ধারণা দিলো। কিন্তু খুব কমদামে অল্প সময়ে কিভাবে মার্কেটে যাওয়া যায় সে সম্পর্কে কোন ধারণা দিলো না। আমরা একটি স্যাটেলাইট শহবে থাকতাম। এই জায়গাটি মুল শহর থেকে বেশ দুরে। কাজেই আমাদেরকে স্কুটারে, ট্যাক্সিতে কিংবা বাসে যেতে হ'তো। ৩য়দিন প্রশিক্ষণ শেষে নিজ দায়িত্বে মার্কেটে যাওয়ার জন্য চেষ্টা করলাম। আমাদেরকে গাড়ীতে করে নামিয়ে দেয়া হলো। ফিরে আসার সময় স্কুটার বা অটোরিক্সায় আসার জন্য বলা হলো। এরপর আমরা প্রায় প্রতিদিনই মার্কেটে যেতাম স্কুটারে করে। একমাস শেষ হতে যখন মাত্র কয়েকদিন বাকি তখন আমরা বাস সার্ভিস সম্পর্কে জানতে পারলাম। ততদিনে আমাদের কেনাকাটা সব শেষ।
২য় ঘটনাটি হলোঃ আমাদেরকে নারী উদ্যোক্তা পরিচালিত শিল্প কারখানা দেখানোর জন্যে নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে একজন নারী উদ্যোক্তা ফোমের গদি উত্পাদন করেন। তো আমাদের ভিজিটের ফাঁকে ফাঁকে তিনি আমাকে বললেন কিভাবে এই পণ্যটি আমি বাংলাদেশে চালু করতে পারি, আমি যদি বাংলাদেশে এই পণ্যটি চালু করতে চাই তাহলে তিনি আমাকে কি কি সুবিধা দেবেন ইত্যাদি। আমি এখান থেকে শিখলাম নেটওয়ার্কিং কিভাবে করতে হয়। একজন ব্যবসায়ী হিসাবে খুব ছোট্ট একটি সুযোগও হাতছাড়া করা উচিত্ নয় তা শিখলাম। এভাবে আমি বদলে যেতে লাগলাম।
২৮ দিনের প্রশিক্ষণ শেষে বাংলাদেশে ফিরে এলাম। পরিবর্তিত আমি। আমার মধ্যে একটি প্রতিজ্ঞা, একটি আবেগ, একটি ব্যস্ততা কুরে কুরে খাচ্ছে। আমি অস্থির হয়ে উঠলাম কবে এই কার্যক্রমটি বাংলাদেশে চালু করতে পারবো। বিশেষ করে ব্যাংক লোন কিভাবে নারী উদ্যোক্তাদের মধ্যে আনা যায়, ব্যাংক ঋণ পরিশোধের হার কিভাবে বাড়ানো যায় এই বিষয় নিয়ে কাজ করার জন্য আমি ভিতরে ভিতরে অস্থির হয়ে উঠতে লাগলাম। বাংলাদেশে ফিরে আমি নোরাডকে একটি প্রতিবেদন জমা দিলাম। সেই প্রতিবেদনে দুটি প্রস্তাব ছিলো। একটি প্রশিক্ষক তৈরী করার জন্য প্রশিক্ষক প্রশিক্ষণ, অন্যটি উপকারভোগীদের নিয়ে একটি প্রশিক্ষণ। নোরাড প্রথম প্রস্তাবটি সাদরে গ্রহণ করলো। আই সি ই সি ডি থেকে প্রশিক্ষক এনে বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি প্রশিক্ষক প্রশিক্ষণ করানো হলো। কিন্তু উপকারভোগীদের নিয়ে কোন প্রশিক্ষণের আয়োজন করা গেলো না। এমন কি যে প্রতিষ্ঠানে আমি চাকরী করেছি তারাও আমাকে পরীক্ষামূলকভাবে এই প্রশিক্ষণ কোর্সটি চালু করতে অনুমতি দিলো না। তারা বললোযে এটি একটি দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়ন কার্যক্রম। আমাদের এতো সময় ও সম্পদ নেই যে আমরা এই প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু করতে পারি। শেষ পর্যন্ত অনেক চেষ্টা ও সাধনার পরে ১৯৯৬ সালে সপ্তডিঙ্গা প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশে আমি প্রথম নারী উদ্যোক্তা উন্নয়ন প্রশিক্ষণের আয়োজন করি। এই প্রশিক্ষণ পরিচালনা করার জন্য প্রিপ ট্রাস্ট আমাকে টাকা দেয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তত্কালিন নির্বাহী পরিচালক -২ জনাব আব্দুর রকিব ( এস ই ডি পি-র প্রজেক্ট ডিরেক্টর আমার প্রথম প্রশিক্ষণের প্রশিক্ষণার্থীদেরকে সার্টিফিকেট বিতরণ করেন। তিনি আমাকে বেসিক ব্যাংক লিমিটেডের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দেন। আমি প্রায় ১০০ নারী উদ্যোক্তাকে সরাসরী বেসিক ব্যাংক লিমিটেড থেকে ঋণ নিয়ে দেই। এই ঋণ বিতরণের সময় আমি ব্যক্তিগত জামানত দেই এবং ঋণ আদায়ের দায়িত্ব নেই। কিন্তু এর বিনিময়ে কোন সার্ভিস চার্জ নেইনি। এই ঋণ পরিশোধের হার ছিল ১০০%। পরবর্তীতে বেসিক ব্যাংক লিমিটেড সপ্তডিঙ্গাকে মাইক্রো ক্রেডিট সংগঠন হিসাবে তালিকাভুক্ত করে। আর সপ্তডিঙ্গা হয়ে যায় ক্ষুদ্র ঋণ প্রদানকারী একটি সংস্থা। সপ্তডিঙ্গা তার সকল স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলে।
একজন সম্ভাবনাময় নারী উদ্যোক্তাকে চিহ্নিত করা, তাকে নির্বাচিত করা, প্রশিক্ষণের মাধ্যমে উন্নত করা, পুঁজির জন্য অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দেয়া, অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে উদ্যোক্তার পক্ষে জামানত প্রদান করা ও ব্যাংকের পক্ষে ঋণ আদায় করে দেয়া, উদ্যোক্তার পণ্য নিয়ে বাজারে পরিচিত করানো ইত্যাদি কাজ যে কত কঠিন তা কি কেউ বুঝতে পারে। আমি সেই কাজটি করেছি। কিন্তু বর্তমানে বেসিক ব্যাংক লিমিটেডের ঋণটি নিয়ে কি সমস্যার মধ্যে দিয়ে দিন কাটাচ্ছি তা আর বলে বোঝানো যাবে না। তারপরেও এই প্রতিষ্ঠানটি নিয়ে আমি এখনও আমার সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছি। আমাকে সকলে দোয়া করবেন।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে মে, ২০১০ সকাল ৮:৪৭

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।





