নাটক সিনেমা দেখা, বই পড়া আমার ছোটবেলাকার হবি। অন্যান্য আর সকলের মত গল্পের বই পেলে আমি পড়তে শুরু করি। পড়তে পড়তে গল্পটা যদি আমার একবার ভালো লেগে যায় তাহলে তার মধ্যে আমি ডুব দেই। আমার আশে পাশে কি হচ্ছে, কে বকছে, কে গালাগালি করছে, কে আনন্দ করছে, আমার চাকরী, আমার কাজ সব সব কিছুই আমি ভুলে যাই। শুধু মনে থাকে আমার পড়া। এক বসায় বই পড়া শেষ না করতে পারলে আমার স্বস্তি নেই। সিনেমা নাটক সব কিছুই একইভাবে আমাকে নাড়া দেয়, আমাকে আন্দোলিত করে। প্রবন্ধও পড়ি। তবে প্রবন্ধ আমাকে ততোটা টানে না। প্রবন্ধ পড়তে পড়তে ঘুম এসে যায়। কিন্তু সেখানে যদি কোন ইন্টারেস্টিং আলোচনা থাকে তাহলে আর কথা নেই। আমি তাতেও ঝাঁপিয়ে পড়ি।
গল্প উপন্যাসগুলো আমাকে এতোটাই আকৃষ্ট করে যে আমি গল্পের প্রতিটি ছত্রে ছত্রে আমাকে খুঁজে পাই। নায়ক বা নায়িকা, গল্পের অন্যান্য চরিত্রের সুখ দুঃখ আনন্দ বেদনা সব কিছুই আমাকে প্রবলভাবে নাড়া দেয়। সেই চরিত্রের সাথে মিলে মিশে একাকার হয়ে যাই। নায়িকা যখন হাসে আমি তখন হেসে উঠি। নায়িকা যখন কাঁদে আমি তখন কাঁদি। আজও মনে পড়ে যখন আমি এইচ এস সি-র ছাত্রী তখন রিক্তের বেদন নামে বিখ্যাত সেই বইটি পড়েছিলাম । গ্রামের বাড়ীতে মাটির ঘরের মধ্যে বসে বই পড়ছি। বাইরের জগৎ আমার মাথা থেকে স¤পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। নায়িকা কাঁদছে আমিও কাঁদছি। নায়িকার ছোট্ট দেবরটি কাঁদছে, আমিও কাঁদছি। চোখের পানি মুছতে মুছতে চোখ নাক মুখ একেবারে লাল হয়ে গেছে। আমার মা তার কাজের ফাঁকে ফাঁকে ঘরে আসছেন আর আমাকে কাঁদতে দেখছেন। উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞাসা করছেন, কিরে তোর কি হয়েছে? ও ভাবে কাাঁদছিস কেন? আমি কথা বলতে পারি না। আমার তখন রীতিমত হেঁচকী উঠছে। কোন মতে বললাম, এমনিই। মা তখন আমার দিকে আর আমার বইএর দিকে তাকিয়ে একটু হাসলেন। বাইরে যেয়ে তার অন্যান্য যা'দেরকে বললেন, আমার মেয়ে বই পড়ছে আর কাঁদছে। পরের বার আবার এসে বললেন, যে বই পড়লে এত দুঃখ লাগে তা না পড়লেই হয়। কিন্তু আমি যে বই পাগল। যতণ এই বই শেষ না হবে ততণ আমি খাব না নাব না। কিছুই করবো না। এমনি ভাবে বই আমাকে নাড়া দিয়েছে, আমার মর্মকে স্পর্শ করেছে।
ছোট বেলায় যে বইগুলো পড়েছি তা বিশ্বাসও করেছি। আনোয়ারা, মনোয়ারা, মকসুদুল মমিনিন, দস্যু বনহুর ও দস্যু বাহরামের সব গুলি খন্ড পড়েছি। কাশ সেভেনে যখন পড়ছি তখন আমার আব্বা চাকরী ছেড়ে গ্রামে চলে যান। আমি পড়ার উদ্দেশ্যে যশোর শহরে আমাদের এক আত্মীয়ের বাসায় থেকে যাই। সেই বাড়ীতে নিয়মিত দৈনিক পত্রিকা রাখা হতো, সাপ্তাহিক বেগম রাখা হতো। অনেক ভালো ভালো লেখকের বই ছিলো যেমনঃ সৌরীন সেনের ভিয়েতনাম, তেতো কফি, রাশিয়ান গল্পের কিছু বাংলা অনুবাদ ইত্যাদি। এই বাড়ীতে মাসুদ রানা ও ছিলো। আমি এই সব বইগুলি পড়েছি। আর নিজেকে এদের নায়িকাদের সাথে কল্পনা করেছি।
একইভাবে সিনেমা দেখেছি। সিনেমার নায়িকা চরিত্রটি বিশেষভাবে নাড়া দিতো। তখনতো বাড়ীতে টেলিভিশন থাকতো না থাকতো রেডিও। রেডিওর প্রতিটি নাটক খুব মনযোগ দিয়ে শুনতাম। আর নাটকের কিছু বিশেষ চরিত্র আমাকে নাড়া দিতো। বিশেষ করে নায়িকারা বাবা মায়ের সাথে রাগ করে বাড়ি থেকে পালিয়ে চলে যেত। গরীব ঘরের মেয়ে ধনী পরিবারে চলে যেতো, সেখানে সে কত যতœ পেতো, তারা মেয়েটিকে পড়ালেখার খরচ দিতো, এমন কি বিয়ে পর্যন্ত দিতো। এগুলির মতো করে নিজেকে দেখেছি। আর মনে মনে তার মতো হওয়ার কল্পনা করেছি। কতবার বাড়ি থেকে চলে যেতে চেয়েছি। কখনও কখনও গেছিও, কিন্তু বাস্তব জগৎটিকে বইএর জগতের মতো করে পাই নি। স্বপ্ন ভঙ্গ হয়েছে। পায়ের নীচ থেকে মাটি সরে গেছে। তারপর গুটি গুটি পায়ে আবার বাড়ীতে মা বাবার স্নেহের ছায়ায় ফিরে এসেছি।
তখনকার উপন্যাস গুলিতে লেখক মানব সমাজের বিভিন্ন জটিলতা, মনের চিন্তা ও অলি গলি নিয়ে লিখতেন সে সব গল্পে ইতিবাচক চরিত্র ও নেতিবাচক চরিত্র থাকতো। বিখ্যাত ঔপন্যাসিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তার প্রতিটি রচনায় সেই সময়কার সমাজ চিত্র, তার সবল দিক, দুর্বল দিকগুলি বিভিন্ন চরিত্রের মধ্যে দিয়ে কি সুন্দর করে চিত্রায়িত করেছেন। সেই লেখাগুলি কখনও পাঠককে হিংস্র করে তোলেনি। মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং তার সমসাময়িক প্রত্যেকের লেখায় সমসাময়িক পারিবারিক, সামাজিক ও ধর্মীয় জীবন তার ইতিবাচক দিক ও নেতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরেছেন। এর মধ্যে যেমন হাস্য রসাত্মক বা কৌতুক চরিত্র আছে তেমনি আছে গুরুগম্ভীর চরিত্র। কিন্তু ইতিবাচক ও নেতিবাচকের মধ্যে এত তীব্র লড়াই দেখা যায় নি। আর প্রতিটি লড়াই-এ নেতিবাচক চরিত্রের এতো জয়জয়কার দেখিনি। সৎ ও নীতিবান মানুষ হয়তো বিপদে পড়েছে কিন্তু তা সে বুদ্ধিমত্তার সাথে সামাল দিতে পেরেছে।
উপন্যাসের চরিত্রে লেখক যে চিত্র আঁকেন তা মানব মস্তিষ্কে একটি প্রভাব রেখে যায়। আর সে প্রভাব হয় চিরস্থায়ী। তাই লেখককে সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ হতে হয়। কিন্তু আজকালকার গল্পগুলি বিশেষ করে টিভি নাটক সিনেমা গুলি সবসময় নেতিবাচক চরিত্রগুলিকে খুবই শক্তিশালী রুপে এবং বিস্তারিতভাবে দেখায়। দেখা যায় যে প্রতিটি গল্পের ধারাবাহিকতা প্রায় একই। এখানে নেতিবাচক চরিত্র খুবই শক্তিশালী, কৌশলী এবং বুদ্ধিমান। সে যা করে তা খুব চিন্তাভাবনা ক’রে করে। দাবা খেলার মতো করে প্রতিটি চাল চালে যেখানে আগাম কয়েকটি চালের ফলাফল বিবেচনা করা হয়। তেমনি করে নেতিবাচক চরিত্রকে আগাম ৪থেকে ৫টি ধাপের পদপে ও ফলাফল চিন্তা করে তারপর সে একটি পদপে নেয়। সে পরিকল্পনা করে, আলোচনা করে, ইতিবাচক চরিত্রকে পদে পদে বিপদে ফেলানোর জন্য, তাকে পীড়ন করার জন্য, কষ্ট দেয়ার জন্য যতরকমের কৌশল আছে তা খাটায়, কিন্তু বাড়ী বা সমাজের অন্য কেউ সেটা দেখতে পায় না বা বুঝতে পারে না। তার প্রতিটি পদপে খুবই বিস্তারিতভাবে দেখায়। আর ইতিবাচক চরিত্রটি কোন কৌশল বোঝে না। বোকার মতো তার সকল ফাঁদে আটকা পড়ে যায় এবং কষ্ট পায়। এই বিষয়টি ধারাবাহিকভাবে চলতেই থাকে। একসময় অনেক মার খেয়ে, কষ্ট পেতে পেতে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তখন সে কোনরকম বুদ্ধিমত্তা না দেখিয়ে, কোনরকম বিশ্লেষন না করে ইতিবাচক চরিত্রটি শুধুমাত্র গায়ের জোরে একজন ১০ জনের সাথে যুদ্ধ করে জিতে যায়। এতদিন এতো কষ্ট করে বুদ্ধিমত্তা খাটিয়ে নেতিবাচক চরিত্রটি জেতার জন্য যে চিত্র এঁকেছে শুধু গায়ের জোরে ইতিবাচক চরিত্রটি সেখান থেকে বের হয়ে এসে সফল হয়। এবং তারা সুখে শান্তিতে জীবন যাপন করতে থাকে। লেখক বা গল্পকার এখানে গল্পের ইতি টানে। ইতিবাচক চরিত্রগুলি কিভাবে, একটু একটু করে তার বুদ্ধিমত্তা দিয়ে দারিদ্র, মানসিক পার্থক্য, সাংস্কৃতিক পার্থক্যগুলি জয় করে জীবনকে সফল করে তোলে তা দেখানো হয় না।
অবশ্য পাঠকেরাও এভাবেই দেখতে পছন্দ করে। মানুষ ছোটবেলা থেকে তার মধ্যে যে মূল্যবোধ তৈরী হয় তা থেকে সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে শেখে। কিন্তু তার মধ্যে যে পাশব চেতনা ও উল্লাস থাকে তা থেকে সে কখনও মুক্তি পায় না। শক্তিশালী সব সময় দুর্বলের উপর আধিপত্য বিস্তার করতে চায়। ছলে বলে কলে কৌশলে সে অন্যের উপর আধিপত্য বিস্তার করে নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায়। আরাম আয়েস, বিলাস ব্যসনে গা ভাসিয়ে দিতে চায়। মানুষের মনের চিরন্তন চাওয়া সে অমর হবে। সমস্ত বিশ্ব তার পদানত হবে। সব মানুষ তার প্রভুত্ব মেনে নেবে সেই ল্েয পদপে নেয়। অবশ্য এই ধরণের মানুষের সংখ্যা খুব কম। কিন্তু তারাই এই সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করে। বেশীরভাগ মানুষ নিরীহ ও নির্বিরোধী। তারা ৩বেলা পেটভরে খাওয়া, নিজের লজ্জ্বা নিবারণ ও রৌদ্র ও শীত থেকে বাঁচার জন্য সাধারণ কাপড় এবং রাত্রে নিশ্চিন্তে ঘুমানোর জন্য একটু নিরাপদ আশ্রয় পেলেই সুখী হয়। সাধারণভাবে ধর্মকর্ম করে জীবন যাপন করতে চায়। কিন্তু বাস্তবে তা হয় না। অতি লোভী সেই সব মানুষের জন্য সাধারণ এই মানুষগুলিকে কষ্ট পেতে হয়।
পৃথিবীতে হঠাৎ হঠাৎ করে কিছু মানুষ আসে যারা এই সব অপশক্তির হাত থেকে সমাজকে তথা পৃথিবীকে বাচানোর জন্যে কাজ করে। তারা সংখ্যায় কম থাকে। ফলে তাদেরকে কষ্ট, উপো, কটা সহ্য করতে হয়। দীর্ঘ দিনের কষ্ট ও আত্মত্যাগের ফলে একদিন সে কৃতকার্য হয়। তখন আবার তাকে মানুষ দেবতার আসনে বসিয়ে ফেলে এবং পুজা করে।
মানুষের মনের এই বিচিত্র গতিকে পুঁজি করে আজকালকার কিছু নাট্যকাররা সমাজের নেতিবাচক অপশক্তিগুলিকে এমন জঘন্যভাবে উপস্থাপন করে যে দেখলেই খারাপ লাগে। কখনও কখনও একই ধরণের বিষয়গুলি বার বার বিভিন্ন আঙ্গিক থেকে দেখাতে থাকে। কিন্তু কেন? কেন আমরা ইতিবাচক চরিত্র তৈরী করি না, সেই চরিত্রে জীবনের সুন্দর, সুকুমার চিত্রগুলি ফুটিয়ে তুলি না? ইতিবাচক চরিত্রটি তার বুদ্ধিমত্তা দিয়ে অপশক্তির নেতিবাচক চরিত্রগুলির সব কুট কৌশল, তার অপচেষ্টাগুলিকে ভন্ডুল করে দিচ্ছে এভাবে দেখায় না।
আজকাল খবরের কাগজ খুললেই প্রতিদিন হত্যা, গুম, মানুষকে ঠকানো, আত্মহত্যার জন্য প্ররোচন দেয়া বিশেষ করে নারীদেরকে আত্মহত্যার জন্য প্ররোচনা দেয়া, নারীর সম্ভ্রম নিয়ে পাশব উল্লাসে মেতে ওঠা এই গুলিই প্রধান খবর হিসাবে আসে। এর মধ্যে বড়, ছোট, এমন কি কোলের শিশুও বাদ যায় না। খুনের যে পদ্ধতিগুলো দেখা যায় সিনেমার গল্পগুলোকে অনুসরণ করে তৈরী করা হয়েছে। মানুষকে পীড়নের জন্য প্রতিদিন নিত্যনতুন কৌশল আবিষ্কার করছে। সা¤প্রতিক কালে দিল্লীর একটি আন্তর্জাতিক হোটেলে সন্ত্রাসীরা যে আক্রমণ চালায় তার পদ্ধতি ছিলো একটি সিনেমার হুবহু নকল। মানব মনের এই বিকৃত পাশবিক উল্লাসকে এই সব সিনেমা ও নাটক যে কতটা প্রভাবিত করে তা এই ঘটনা থেকে প্রতীয়মান হয়।
ইতিবাচক চরিত্রটি সুকুমার সুন্দর মনের কিন্তু সে বোকা নয়। সে নেতিবাচক চরিত্রের প্রতিটি পদপেকে বুদ্ধিমত্তা দিয়ে ভন্ডুল করে দিয়ে সমাজে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করে, সমাজে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা হলে মানব জাতি কি উপকার পায়, সভ্যতার বিকাশসাধন হয়, আমাদের এই সুন্দর পৃথিবী যে শুধু খারাপ মানুষের আস্তানা নয়, এখানকার অধিকাংশ মানুষ নির্বিরোধী এবং সঠিকপথে সুন্দরভাবে জীবন যাপন করে ঠিক এইভাবে গল্পগুলি চিত্রিত করার জন্য লেখক ও সাংবাদিকদের প্রতি আমার বিনীত অনুরোধ রইলো।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।





