মেঘ মালায় ঘুরে ঘুরে,স্বপ্নের মীড়ে মীড়ে গলা আমার ভরে দিয়েছি সুরে সুরে।আমার উপস্থিতি সবর্কালে অতীতে বতর্মানে ও ভবিষ্যতে।সময়কে ধারণ করেছি বিশ্বের সকাল আলোয়।যতদিন আমি থাকব,ধরে রাখব আমাকে সবর্কলে।আমি ছিলাম,আমি আছি।যদিও আমি নীরব অনেকটা কাল।আমি দিগন্ত জুড়ে আছি,ভাষার আলোয় ও আন্দোলনে আছি,সংস্কৃতির গ্রন্থলোকে আছি। দেখেছি উণসত্তর এর গণআন্দোলন,একাত্তরের ৭ই ও ২৬ শে মার্চ,১৪ ই ডিসেম্বরের রক্ত ছোয়াঁ দিন,দেখেছি মহান বিজয়ের দিন ১৬ ই ডিসেম্বর।মন ভাঙ্গা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছি জাতির পিতা শেখ মুজিব ও তাঁর পরিবারের করুণ মৃত্যুতে।কবিতা ও পথনাটক কে অস্ত্র করে বিদ্রোহে মেতে উঠেছিলাম এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে।নব্বইয়ে ঘটিয়েছি স্বৈরাচার এরশাদের পতন।চলেছি মুক্ত চিন্তায় ঘটমান আনন্দ অনিন্দ সুন্দর ধারায়।বসেছি প্রাথর্নায় সুকুমার পরিচর্যায়।কত মানুষ এলো,গেলো অনন্ত আবাসে।কিছু মৃত্যু আমি নিবির্কার মনে গ্রহন করি,কিছু মৃত্যু আমাকে জলোচ্ছ্বাসে ভাসায়।আমি প্লাবিত হই।আমার নিভর্রতার শিকড় মা বাবা দুজনেই আজ নেই।এই নাই শব্দটি আমাকে রিক্ত করে দেয়।কেবল কাঁদি আর কাঁদি।মনে পড়ে তাঁদের সাথে ঘিরে থাকা স্মৃতিগুলো।শুধু তারা নয়,আরো কত মৃত্যু আমার আশেপাশে।এসব মৃত্যু আমাকে মানসিক অসুস্থ করে দেয়।আমি ঘুমহীন হই।
মনে পড়ে আমার প্রিয় নাট্যজন কবি জিয়া হায়দার স্যারের কথা।স্যারের সাথে আমার পরিচয় অনেক দিনের।আমি তাঁকে চিনি আমার বয়স যখন আট কি নয়।তাঁকে আমার মনে থাকলেও ইদানীং মনে পড়েনি। তবে দোসরা সেপ্টেম্বর কবি নাহার মনিকার দুরালাপনি ডাক পেলাম। ও জানালো স্যার আমাদের মাঝে আর নেই। এই হারানোর বোধ আমাকে অনেক ক্ষণ ভাবালো। মনেমনে অঝোরে কাঁদলাম। কেঁদে কিছুটা শান্ত হলো আামার মন। স্যারের সাথে আমার পরোক্ষ ভাবে পরিরচয় লেখক শংকরের এপার বাংলা ওপার বাংলার মাধ্যমে। তরুণ কবি নাট্যকার জিয়া হায়দার তখন আমেরিকায়। সেখানেই তাঁর সাথে শংকরের পরিচয় ঘটে। এভাবেই তাঁর সাথে আমারও পরিচয়। আমি আট নয় বছর বয়স থেকেই বইয়ের পোকা। ঊপন্যাস গল্প কবিতার প্রতি ছোট বেলা থেকেই প্রচন্ড আগ্রহী ছিলাম তবে পাঠ্য বইয়ের প্রতি আগ্রহ কম ছিল। এই জন্য বেশ বকা ঝকা খেতে হতো।এবার আসি স্যারের সাথে আমার সম্পৃক্ততায়।
স্যারের জন্ম পাবনা জেলের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। তিনি ছিলেন সবার বড়। তার সমস্ত ভাইরাই প্রখ্যাত কবি সাহিত্যিক। তারা হলেন রশিদ হায়দার,মাকিদ হায়দার,জাহিদ হায়দার,দেশান্তরিত দাউদ হায়দার প্রমুখ। এবার আসি তাঁর সাথে প্রত্যক্ষ ভাবে পরিচয়ে। আমি তখন চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যলয়ে দ্বিতীয় বর্ষে পড়ি। দ্বিতীয় বর্ষে আমাদের একটি গবেষণার বিষয় ছিল যৌতুক প্রথার প্রতি ছাত্র ছাত্রীর মনোভাব। আমি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম অর্থনীতি ও পদার্থ বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে। সেই সাক্ষাৎকার নিতে গিয়েই পরিচিত হই হাজী মুহসীন কলেজের প্রিন্সিপাল মোবাশ্বের আলীর ছেলে মাহবুব আলীর সাথে। ও কেমন করে যেন জেনে গিয়েছিল যে আমি কবিতা আবৃত্তি করি।ও আমাকে আমণ্ত্রণ জানাল কবি ফরিদা পারভীনের একটি কাব্যগ্রণ্থ প্রকাশনা অনুষ্ঠানে। সেখানে উপস্থিত ছিলেন ডঃ আনিসুজ্জমান,কবি আল মাহমুদ,আবৃত্তিকার কাজী আরিফ এবং প্রজ্ঞা লাবনী।সেখানেই আমার সাথে পরিচয় ঘটে মানচিত্রের সদস্য নাট্যকর্মী মধুদার সাথে। ওই অনুষ্ঠানের পরেই আমি মানচিত্রের সাথে জড়িত হই।মানচিত্রের এরকম একটি অনুষ্ঠানে সুকান্তের 'দিয়াশলাই' কবিতা পড়ে বেশ প্রশংসিত হই।এই অনুষ্ঠানই আমার সাথে জিয়া হায়দার স্যারের পরিচয়ের সোপান।তাঁর একটি কবিতা 'তৃতীয় মানব সন্তান' আমাকে আন্দোলিত করেছিল।আমরা জানি সাদা কলো বিপরীত দুটি ধারা।তাঁর এই কবিতার দুই ধারা একই রক্তের সম্মেলন।
সাদা মেয়েটি কালো ছেলেটিকে ঘৃণা করে।
কালো ছেলেটি সাদা মেয়েটিকে ঘৃণা করে।
একদিন সন্ধ্যায় তুষারপাতের ভেতরে দুজনকেই একটা
গ্যারেজের ভেতর আশ্রয় নিতে হলো।
সাদা মেয়েটির ঘৃণা ক্রমশ উত্তপ্ত হলো।
কালো ছেলেটির ঘৃণা ক্রমশ ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলো।
বরফে ঢাকা গাছেরপাতাগুলোতে হলদে চাঁদের শীতার্ত জোৎস্না
গলে গলে পড়তে থাকলো।
দুজনে একটা পুত্র সন্তানের জন্ম দিলো।
কালো মেয়েটি সাদা ছেলেটিকে ঘৃণা করে।
সাদা ছেলেটি কালো মেয়েটিকে ঘৃণা করে
একদিন মাঝ রাত্তিরে সাবওয়ের বারান্দায় দুজনেই শেষ ট্রেনের
অপেক্ষা করছিলো।
কালো মেয়েটির সমস্ত শরীর রি রি করে উঠলো।
সাদা ছেলেটির সমস্ত শরীর উত্তেজনায় ফেটে পড়লো।
নগর সীমান্তের বাইরে ট্রেনের গুমগুম শব্দের সাথে সাবওয়ের
নিঃশব্দতা ক্লান্ত হয়ে পড়লো।
অনেক দিন পর সেই পুত্র ও কন্যার সাথে সাক্ষাৎ হবে কোনো
সমুদ্র তীরে।ভোর বেলায়। দুজনেই তরতাজা প্রকৃতির সমস্ত রূপ
রস গন্ধ বর্ণলাবণ্য মাধুর্যকে শরীরে হৃদয়ে অস্তিত্বে মেখে নেবে।
সমুদ্র,বাতাস আর সূর্যালোকে ধন্য ও পরিতৃপ্ত হবে।
এবং তারা তৃতীয় একটি মানব সন্তানের জন্ম দেবে।
(শিকাগো,৯ সেপ্টেম্বর ১৯৮২)
এভাবে জিয়া হায়দারের কবিতার সাথে আমার সখ্যতা।তো মানচিত্রের ওই অনুষ্ঠানর পর স্যার আমাকে ডেকে পাঠালেন এবং আমাকে অবাক করে দিয়ে সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহর লাল সালু নাটকে অভিনয় করবার আমন্ত্রণ জানালেন। তিনি লাল খান বাজারের একটি বাড়ির ঠিকানা দিলেন এবং সেখানে উপস্থিত থাকার জন্য অনুরোধ জানালেন ।আমার লাজুক মন বাধ সাধলো সেদিন সেখানে যেতে । কিন্তু তার পরের দিনই তিনি আমায় ডেকে পঠালেন এবং মৃদু ভৎসর্না জানালেন,বললেন যে আজ
অবশ্যই তুমি যাবে। সেদিন সন্ধ্যে বেলায় মাকে সঙ্গে করে লালখান বাজারে অবস্থিত অরিন্দম নাট্য গোষ্ঠীর কার্যালয়ে হাজির হলাম।স্যার আমাকে লাল সালু নাটকের ছোট্ট একটা চরিত্র হাসুনির মা'র জন্য নির্বাচিত করেন।চরিত্রটি ছিল জোতদার মজিদের স্ত্রী রহিমার সাথে কথোপকথন।এখানে হাসুনির মা তার সন্তান ও নিখোঁজ স্বামীর কথা রহিমার কাছে বলতে বলতে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে।এক সময় কাঁদতে কাঁদতে তার চৈতন্য হয় বাড়ি ফেরার।সে উঠে দাঁড়ায় এবং যাওয়ার জন্য উদ্যত হয়।ঠিক তখনি রহিমা তাকে হাসুনির জন্য একটা পুতুল দেবে বলে অপেক্ষা করতে বলে।হাসুনির মা যখন পুতুলটির জন্য অপেক্ষা করিছল তখন আচমকা পেছন ফিরে খেয়াল করে যে রহিমার স্বামী মজিদ তার দিকে এক লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। হাসুনির মা চমকে উঠে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং দ্রুত মঞ্চ ত্যাগ করে।রিহার্সেলে সবই ঠিকঠাক হচ্ছিল শুধু হচ্ছিল না মজিদের ওরকম লোলুপ তাকানো দেখে হাসুনির মার (আমার) অপ্রস্তুত হয়ে যাবার অভিনয়টুকু।তখন জিয়া হায়দার স্যার একটি অসাধারন উদাহরন দিলেন আমাকে সিকোয়েন্সটি বোঝার জন্য-"ধরো,একদিন তুমি ইউনিভার্সিটির একটা নির্জন করিডোর ধরে একা একা হাঁটছো,হঠাৎ খেয়াল করলে যে আমি (জিয়া হায়দার) তোমার দিকে একজন টিচার সুলভ না তাকিয়ে এক ধরনের লোভী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি।তখন আমাকে ওরকম দেখে তুমি যেভাবে অপ্রস্তুত হবে,অভিনয়ে সেরকম অপ্রস্তুত ভাবটা আনবার চেষ্টা করো।"বলা মাত্রই আমি ঠিক অভিনয়টুকু করতে পেরেছিলাম।স্যার খুব খুশী হয়েছিলেন।বলা বাহুল্য স্যারের সুনিপুণ নির্দেশনার কল্যানে হাসুনির মা ছোট্ট একটু চরিত্র হওয়া স্বত্তেও তখন খুব সুনাম অর্জন করে।এরপর ১৯৮৪ কি ১১৯৮৫ সালে অরিন্দম নাট্যগোষ্ঠী আমন্ত্রিত হয় ঢাকা থিয়েটার আয়োজিত নাট্য উৎসবে।ঢাকা শিল্পকলা একাডমীতে লাল সালু নাটকটি মঞ্চস্ত হবার পর তৎকালীন সাপ্তাহিক বিচিত্রা পত্রিকায় সাংবাদিক নীলু হাসনাত হাসুনির মা চরিত্রের অভিনয় নৈপুণ্য নিয়ে বেশ দু'কলম লিখেছিলেন।
লাল সালু আমার জীবনের একটি আলোক আন্দময় স্মৃতি।সেই স্মৃতি আমায় দিয়েছে নির্ভীকতা ও মঞ্চের প্রতি আকুলতা। মঞ্চ নাটকের প্রতি আমার ভালোবাসার বিশাল মহীরূহের বীজ তিনি বপন করেছিলেন।পরে সেটা বিকশিত হয়েছে অরিন্দম নাট্য গোষ্ঠী ও কামাল উদ্দীন নীলু'র সহযোগিতায়।তাঁর নাট্য নির্দেশনার চমৎকার গুনটি হচ্ছে অভিনতা অভিনেত্রীদের মাঝ থেকে তাদের নিজস্ব অভিনয় প্রতিভাটুকু তিনি বের করে আনতে পারতেন।পাত্র পাত্রীদের বলতেন একই অভিনয় দুই তিন ভাবে করিয়ে দেখাতে,যেটা সবচেয়ে ভাল হতো সেটা মঞ্চে ব্যবহার করতেন।ব্যক্তি জীবনেও তিনি চমৎকার মানুষ।এ প্রসঙ্গে একটা ঘটনা উল্লেখ করছি-
১৯৮৬ সালে এক নাট্যোৎসবে আমরা (অরিন্দম নাট্য গোষ্ঠী) কোলকাতা যাচ্ছিলাম,প্রচন্ড বৃষ্টির কারনে চট্টগ্রমে আমাদের বাসায় পানি উঠেছিল বলে আমি মূল দলের সাথে যেতে পারিনি,পরদিন জিয়া হায়দার স্যার,আমি আর আমার মা চট্টগ্রম থেকে ঢাকা যাচ্ছিলাম।যাত্রা পথে আমার ও মা'র হাজার নিষেধ স্বত্তেও স্যার আমাদের ঢাউস ব্যাগটা টানছিলেন।সেবারে শুধু কোলকাতায় ও যাদবপুরে আমাদের শো হয়েছিল। দিল্লি যাবার কথা ছিল কিন্তু আমাদের এক নাট্যকর্মীর বাবা মারা যাওয়াতে সফর সংক্ষিপ্ত করে চট্টগ্রমে ফিরে আসতে হয়েছল।স্যারের কল্যানেই কোলকাতায় পরিচয় হয়েছিল আলোক সম্রাট তাপস সেন,জন্মই আমার আজন্ম পাপ খ্যাত কবি দাউদ হায়দারের সাথে।
পংকজ বিভাস তাঁর অন্যতম একটি নাটক।এ নাটকে স্যার আমাকে অভিনয়ে না রেখে সহকারী নির্দেশক হিসাবে নিয়োগ করলেন।মঞ্চ নাটকের নেপথ্যেও যে বিশাল কাজের জায়গা আছে তা তখনি শিখেছিলাম।এ নাটকের হাতে কলম শিক্ষা পরবর্তীতে মন্ট্রিয়লে ছোট্ট বন্ধুদের নিয়ে নাট্যদল অভিব্যক্তি গড়তে সাহায্য করেছিল।
শেষবার স্যারের সাথে আমার যখন দেখা হয়েছিল তিনি আমাকে কানাডা থেকে একটা বই এনে দিতে বলেছিলেন।নানা কারনে আমার আর বইটি যোগাড় করে দেয়া হয়নি,তিনি অভিমান করেছিলেন। আর এই অভিমানের সাঁকো বেয়েই তাঁর অনন্তের যাত্রা।
১৯৯৯ সালে আমি তাঁকে একটি চিঠি লিখেছিলাম।অনেকের কাছে লেখা চিঠির মতোই চিঠিটি আমার পান্ডুলিপির খাতায় রয়ে গেছে।চিঠিটি কি আমি তাঁর অপার মৃত্যুলোকে পাঠাতে পারবো?
রচনা: ২ রা নভেম্বর,২০০৮
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই নভেম্বর, ২০০৮ ভোর ৫:৪৫

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




