অন্য সব ধর্মানুষ্ঠানের মত মুসলমানদেরও বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান রয়েছে।এর মধ্যে উল্লেখ্য ঈদুল ফিতর,ঈদুল উল আযহা ইত্যাদি।প্রায় দুই মাস ব্যাবধানে ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আযহা পালিত হয়।ঈদুল আযহা সন্নিকটে।আমাদের আানন্দ এই দুই ঈদকে ঘিরেই। ঈদুল ফিতরকে আমরা রোজার ঈদ এবং ঈদুল আযহাকে কোরবানীর ঈদ বলে থাকি।ছেলে বেলায় ঈদকে ঘিরে ছিল অপার আনন্দ।তবে এই দুই ঈদের মধ্যে আমার ভাল লাগতো বেশী রোজার ঈদ। কেননা কোরবানীর ঈদ ঘিরে চলে রক্তের লীলা।ছোট বেলা হতে রক্ত আমায় আশংকিত করে।
ছোটবেলায় ছিল আমাদের অনেক পোষা প্র্রাণী। তার মধ্যে ছাগল অন্যতম।আমাদের ছাগলের সংখ্যা ছিল প্রায় পয়ঁত্রিশ চল্লিশটি।এদের আবার বিভিন্ন নাম ছিল,যেমন শ্যামলী,বুদ্বু,মংলা ইত্যাদি।ওদের জন্মদিন অনুসারে প্রত্যেকের আলাদা নাম ছিল। প্রতি বছরই একটি গরু ও একটি কি দুটি ছাগল কোরবানী দেওয়া হতো।ওদের যখন কোরবানীর জন্য নিয়ে যাওয়া হতো আমি আমার দুই ভাই অনেক কান্না কাটি করতাম।আমার বাবার মায়েরও মন খারাপ হতো,কারণ সবার প্রিয় প্রাণীকে তাদের উৎসর্গ করতে হতো।তারা যেহেতু ধর্ম প্রাণ ছিলেন তাই তারা আল্লাহর ইচ্ছাকেই গুরুত্ব দিতেন। কোরবানী ঈদে কোরবানী দেয়া হতো সকাল নয়টা সাড়ে নয়টায়।কোরবানী দেয়ার আগে অবশ্য নামাজ পর্ব হতো ।একটা মসজিদ ছিল আমাদের কোম্পানির ভিতর । সকালবেলায় বাবা,ভাইরা,আংকেলরা মিলে নামাজ পড়তে যেতেন।নামাজ শেষে কোরবানীটা হতো।গোশত বাসায় এলে মা বাবা ভাগ বাটোয়ারা করতেন।আমরাও তাতে অংশ গ্রহন করতাম।আমরা যেহেতু বিটিসির ক্যাম্পাসে থাকতাম সেহেতু সেখানে ফকিরদের প্রবেশ নিষিদ্ব ছিল।তাই তাদের ভাগের মাংস সন্ধ্যা বেলায় বিভিন্ন মাজারে বিলি করা হতো। এখানে উল্লেখ্য দুই ঈদেই আমরা খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠতাম। গোসল সেরে আমি মাকে রান্নায় সাহায্য করতাম।আর বাবা ভাইরা নামাজ পড়তে যেতো।আমার বাবা খুব ভাল রাঁধুনী ছিলেন। এই দুটি ঈদেই বাবা মাকে রান্নায় সহযোগিতা করতেন।কোরবানী ঈদে সারা দুপুর গোশতের ভাগ বাটোয়ারা চলতো।মা কোরবানীর গোশত ভালো করে কসিয়ে কসিয়ে দুই তিন মাসের জন্য রেখে দিতেন।বিকেলে চলতো সব পরিচিত বাসায় বিতরণ।কোরবানী ঈদে নতুন জামা কাপড়ের তেমন গুরুত্ব ছিলনা। কোরবানীটাই মুখ্য ছিল।কিন্ত আমি এক মাত্র মেয়ে বলে আমার নুতন জামা কাপড় জুতা ইত্যাদি জুটে যেতো।আমার দাদা সেই ঊনসত্তরে আমার মাকে একখান জরির পাড়ের লাল শাড়ি দিয়েছিলেন। মা সেটা প্রতি কোরবানী ঈদে পড়তেন। তিন দিন ধরে আমরা কোরবানী ঈদ উদযাপন করতাম।প্রত্যেক কোরবানী ঈদের পরদিন আমরা তাহমিনা আপা ওরফে মিনু আপার কুমিরায় অবস্হিত মামার বাড়ি ঈদ করতাম। বিটিসির সব আংকেল আন্টি এবং তাদের ছেলে মেয়েরা মহা উৎসবে,সবাই মিলে সেখানে ঈদ উদযাপন করতাম। প্রত্যেক ঈদে সিনেমা হল গুলো তে নুতন নুতন ছবি আসতো। আমি মা বাবা দুই ভাই মিলে সেই সব ছবি দেখতাম। টেলিভিশন ছিল আরেকটি মূল আকর্ষণ। ঈদ উপলক্ষে নুতন নুতন নাটক অনুষ্ঠিত হতো।রাত জেগে আমরা সেই সব অনুষ্ঠান দেখতাম।ঈদ উপলক্ষে আমজাদ হোসেন অভিনীত জব্বার আলী উল্লেখ্য।আমাদের ছেলেবেলায় আরেকটি আকর্ষণ ছিল-সেলামী।সকাল সকাল সেজে সেলামী সংগ্রহে বের হয়ে যেতাম।প্রথম ঘর থেকেই সেলামী গ্রহন। তারপর বাইরে বেড়িয়ে পড়া। অনেক টাকা আমাদের সেলামী হিসাবে জুটতো কিন্ত দূর্ভাগ্য যে যা সেলামী পেতাম মা আমাদের কাছ থেকে তা নিয়ে নিতেন এবং তা দিয়ে প্রাইজ বন্ড কিনে দিতেন।আমাদের ঈদের সব জামা কাপড় মা-ই সেলাই করে দিতেন।সেই জামা কাপড় আমরা লুকিয়ে রেখে দিতাম যাতে করে আমাদের জামার ডিজাইন কেউ নকল করতে না পারে।সবসময় বৈচিত্রপূর্ণ থাকাটাকেই বৈচিত্রময় মনে করতাম।
প্রসঙ্গত রোজার ঈদের কথা না বললেই নয়।এবার চোখ ফেলি রোজার ঈদে।এক মাস রোজা রাখার পর রোজার ঈদ আসতো অনাবিল আনন্দ নিয়ে।ঊণত্রিশ রোজা থেকেই প্রতীক্ষা কখন শাওয়ালের সরু রুপালী চাঁদ উঠবে।চাঁদ দেখবার মাহেন্দ্রক্ষণটুকুই আলাদা।দেখা মাত্রই আমাদের মাঝে হুড়োহুড়ি লেগে যেত,শুরু হয়ে যেত প্রতীক্ষার পালা কখন আসবে ভোর,কখন পড়বো নুতন পোশাক,যা এতদিন লুকিয়ে রেখেছিলাম।রোজার ইফতারী পর্বটাও ছিল মজার।একেকদিন থাকতো একেক বন্ধুর বাসায় ইফতার পার্টি।আমার বন্ধু রুমানা প্রায়ই ঈদের রাতে ওর বাসায় জোর করে রেখে দিত।সেসব আড্ডায় শরীক হতো মুন্না,দূরদানা,মেখলা ওরা।হইচই চলতো সেই ভোর পর্যন্ত।কী যে আনন্দ উত্তাপে ভরা থাকতো সেই সব দিনগুলো।
আমার এক বন্ধু ছিল ঝুমকি,প্রত্যেক ঈদে আমাদের বাসায় আসাটা ছিল ওর বাঁধা।কিন্ত ১৯৮২ কি ১৯৮৩ সালে ঈদের আগেরদিন রাঙ্গামাটিতে এক সড়ক দূর্ঘটনায় ও নিহত হয়।২রা জুলাই ছিল ঈদের দিন।এক বন্ধু যখন খবর দিল ঝুমকি আর নেই,মাথায় উঠলো ঈদ,আমরা সব বন্ধুরা ওর বাড়ি দৌঁড়ে হাজির।ঝুমকির মৃতদেহ দেখা তখন পর্যন্ত ছিল আমার দ্বিতীয় মৃতদেহ দেখা,প্রথমটা আমার দাদার।ঈদ এলেই আচমকা ঝুমকি আর ওর হাসি আমার সামনে এসে দাঁড়ায়।আমি ভিজে উঠি।
বাংলাদেশে থাকাকালীন ঈদ ছিল উচ্ছ্বসিত আনন্দ উল্লাস।এই বিদেশ-বিভুঁইয়ে এই আনন্দ ছোয়া থেকে আমরা অনেক দূরে।তবু যতদিন বাবা বেঁচে ছিলেন,আমি রকমারী খাবার রান্না করতাম।বাবা মন ভরে খেয়ে সুখময় ঢেকুর তুলতেন।বাবা মনে করতেন তার এই কন্যাটি রান্নার কিছুই জানে না।তাই ঈদে আমি যখন তাকে রকমারী খাবার পরিবেশন করতাম,তিনি খুব অবাক ও খুশী হতেন।মন্ট্রিয়লে বাবার সাথে আমার মাত্র দুটি ঈদ করা হয়েছিল।বাবা মারা যাবার পর আমরা অনেকদিন ঈদ করিনি।তবে সুতপা-আমার ছোট ভাইয়ের বউ মন্ট্রিয়লে আসার পর,কিছুটা হলেও আমার মাঝে আবার ঈদের পরশ লেগেছে।সুতপা-সমরু(আমার ছোট ভাই)’র দুই মেয়ে(আমার কন্যা সম) দিঘি ও দিয়া(ওরা আমাকে পুষিমা আর আমার বর কে পোষা বাবা ডাকে)এসে আমাদের কদমবুসি করে।সমরু,সুতপাও বাদ যায় না।সুতপার ঈদের মজাদার রান্না’র কথা বলতে গেলে আরেক পৃষ্ঠা লেগে যাবে।হয়তো দিঘি ও দিয়া আমাদের কাছে সেলামী প্রত্যাশা করে আমার নিজের সেই ছোটবেলাকার মতো।কখনো সেলামী দিতে পারি,কখনো না। ।সমরুদের বাসা ছাড়াও আমরা ঈদ উদযাপন করি চিত্রকর রাকীব হাসান এবং কবি নাহার মনিকার বাসায়,তাদের দুই মেয়ের সাথে।
কোরবানীর ঈদ আসন্ন।এখনো নিশ্চিত নই কি করে উদযাপন করবো।মুষ্টিমেয় কিছু লোক এখনো লোক দেখানো ঈদ উদযাপন করে।একে অপরের সাথে পাল্লা করে পোশাক ও ফ্যাশন প্রদর্শনে লেগে যায়,কেনে পাল্লা দিয়ে গরু-ছাগল,প্রতিযোগিতা চলে একে ওপরে টপকানোর।এই প্রতিযোগিতায় অপচয় হয় বিপুল অর্থ।চাই না এরকম অসুস্থ প্রতিযোগিতা,প্রার্থনা করি-প্রতিযোগিতা নয়,মঙ্গলময় সংস্কৃতির অংশ হিসাবে ঈদ ঠাঁই পাক আমাদের সবার জীবনে ।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা ডিসেম্বর, ২০০৮ রাত ১১:১৫

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




