ফোরম্যান কে চটজলদি কাজ বুঝিয়ে দিয়ে লিফটের জন্য অপেক্ষা না করে চার তলার সিঁড়ি ভাঙ্গতে থাকি। রাত দুটো সাতচল্লিশ। তিন মিনিট পরেই ৫৫ বাস ছেঁড়ে দেবে।দৌঁড়ে এসেও চোখের সামনে দিয়ে ৫৫ বাস চলে গেল। দুঃখে রাগে চোখে জল চলে আসে।প্রচন্ড ঠান্ডা, সাথে হিম বাতাস।এই বাস মিস করা মানে এই রাত দুপুরে আরো পৌনে এক ঘন্টা পরবর্তী বাসের জন্যে অপেক্ষা। এভাবে বাসের জন্যে অপেক্ষা করার চেয়ে হাঁটবো বলে স্হির করি। ভারী পোশাকের ভারে জুবুথুবু আমি লম্বা পা ফেলে হাঁটতে থাকি।প্রচন্ড বাতাসের ঝাপটায় চোখে মুখে পিনের খোঁচা খাচ্ছিলাম। সেই সাথে তুষারপাত। তুষারে আমার ভারী পাওয়ারের চশমা ঝাপসা হয়ে আসছিল।দুই একবার হোঁচটও খেলাম। মাঝে মাঝে টিস্যু পেপার দিয়ে চশমার কাঁচ মুছে নিচ্ছিলাম।না, ভাবছি এবার কনট্যাক্ট লেন্স কিনে নেব।তাহলে অন্ততঃ এরকম ভোগান্তি হবে না। হাত ঘড়ি জানান দিল দুটো সাতান্ন। ১৯৩ বাস ষ্টপেজ। বাস সিডিউল দেখি, সোয়া তিনটায় বাস। মানে আরো আঠার মিনিট অপেক্ষা। ক্লান্তির ভারে শরীর নুয়ে আসছে। তবু এই নির্জন রাতে একা একা দাঁড়িয়ে থাকার চেয়ে হেঁটেই বাড়ি যাব বলে স্হির করলাম। ভারী গ্লাভসের ভিতরেও হাত দু’খানা অবশ হয়ে আসছিল। চোখ-নাক দিয়ে টপটপ করে পানি ঝরছে। হঠাৎ করে মায়ের কথা মনে পড়ে গেল। মাগো, তুমি যদি দেখতে তোমার সেই দুর্দান্ত ডানপিঠে ছেলেটি শীতের প্রকোপে জড়সড় হয়ে কি ক্লান্ত ভঙ্গিঁতে হেঁটে চলেছে! আমি জানি না কি সেই সোনার হরিণ যার খোঁজে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে এই সাত সমুদ্দুর পাড়ি দেয় মায়ের কোল ঘেঁষে বেড়ে ওঠা ছেলে গুলো। আমি কোনো সোনার হরিণের খোঁজে পাড়ি দেইনি। আমি পালিয়েছি। চেনা জানা আত্নীয় স্বজন,আমার একান্ত নিজস্ব পরিমন্ডল থেকে পালিয়েছি। কারও জন্যে তো আমার কষ্ট হয় না, শুধু মা’টিকে ছাড়া। এই মা’টির জন্যেই বেঁচে থাকা,না হলে কবেই শেষ হয়ে যেতাম। কতবার মরতে মরতে বেঁচে এসেছি অসম্ভব ভালবাসার আধার মা’টির জন্যে। এসব ভাবতে ভাবতে চোখের কোণ ভিজে উঠে। রাত্রিটা দেখলে অবাক হয়ে যেত, বলতো-“দোলন তোর চোখে জল?পাথর চাপা বুকে ঝরনাও আছে তা হলে!”
রাত্রি খুব সুন্দর(কথা বলে)। ও যখন কথা বলে আমি মুগ্ধতায় ওর দিকে তাকিয়ে থাকি। ফোলা ফোলা ঠোঁটে কেমন এক আদুরে ভঙ্গিতে ও কথা বলে; আমার ভারী ইচ্ছে হয় –অই ফোলা ফোলা ঠোঁটে আমার পোড়া ঠোঁট চেপে ধরি। ইচ্ছেটা ‘ইচ্ছে’ হয়েই ছিল। কখনো অই ঠোঁট ছোঁয়া আমার হয়ে ওঠেনি।
মাঝে মাঝে ঘুম ভেঙ্গে গেলে প্রচন্ড তেষ্টায় গলা শুকিয়ে আসে। গ্লাস গ্লাস জল ঢালি তবু মেটে না,বরং বাড়ে। রাত্রির ঠোঁট স্পর্শ না করা পর্যন্ত আমি বুঝি আজীবন তৃষ্ণার্তই রয়ে যাবে। কিন্ত রাত্রি ও ঠোঁট অনেক যোজন দূর। কখনোই আমার অই ঠোঁটে তৃষ্ণা মেটানো হবে না। রাত্রি কি জানে আজীবন আমি তৃষ্ণার্তই রয়ে যাব? রাজা মাইডাসের মত! নির্জন রাস্তায় একা একা হাঁটতে হাঁটতে ভাবনার রাজ্যে চলে যাই, পথ হারাই।পথ হারানোতে আমি এক ধরনের অনাবিল সুখ পাই।
সোজা সাপটা পথে হাঁটতে আমার ভাল লাগে না।কখন যে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির
রাস্তা পেরিয়ে রকল্যান্ড মলের নামনে এসে দাঁড়িয়েছি ,খেয়াল নেই।আমার চরিত্রই খেয়ালে খেয়ালে ভরা। আবার ঘুরে বাড়ি মুখো হতে থাকি। পুরো মন্ট্রিয়লে এই আমার এক ভূবন। দোর খুলতেই সেনোফলিস আন্টি নীচের লাইট জ্বালিয়ে বেরিয়ে আসেন। ভাঙ্গা ইংরেজীতে জিজ্ঞেস করলেন-“ হাউ আর ইউ ডোলন? সব কিছু ওকে? ঘাঁড় নেড়ে সম্মতি জানিয়ে ত্রুমে উপরের সিঁড়ি ভাঙ্গতে থাকি। কোন এক সময় সেনোফলিস আন্টিকে বলেছিলাম- তুমি আমার মায়ের মত। তারপর থেকেই সে অনেকটা মায়ের মত দৃষ্টি রাখে। সিঁড়ি ভেঙ্গে উপরে উঠতেই জুতোর স্তুপ গুলোর সাথে হোঁচট খেলাম। তুষারে ভেজা বুট জুতো খুলতেই মোজার বিচ্ছিরি গন্ধ! বহুদিন ধোয়া হয়না, টের পাই। এক জোড়া মোজা পাঁচ ছয় দিন পড়ি। মাঝে মাঝে বিশ্রি গন্ধে ভরা মোজায় সুগন্ধি ঢালি, এভাবেই চলছে। ছড়ানো ছেটানো জুতো গুলো গুছিয়ে রাখি। দশ বারো জুতো। এই একটি জিনিষের প্রতি আমার প্রচন্ড আকর্ষণ। মাঝে মাঝে জুতো গুলো নেড়ে চেড়ে দেখি,পরিস্কার করি। ভালো লাগায়। আমার কাপড় চোপড় যতই এলোমেলো থাকুক না কেন জুতো সব সময় চকচকে।আমি মানুষের মুখ দেখার আগে তার জুতো জোড়া দেখি। যদি তার জুতো জোড়া পছন্দ হয় তাহলে ধীরে ধীরে তার মুখখানা দেখি, মুখখানা যেমনই হোক না কেন তার প্রতি আমার এক ধরনের ভালোলাগা জন্মে যায়। বুট জুতো জোড়া পরম মমতায় মুছি, জায়গা মত রেখে দেই। ক্লান্তি ও আমি একসাথে ঘরে ঢুকি, আলো জ্বালি। ভারী কোটটি খুলে ক্লোজেটে রেখে প্যান্ট বদলে শর্টস পড়ে ওয়াশ রুমে ঢুকে পড়ি।যত রাত হোক না কেন কিংবা যতই ক্ষুধার্তই থাকি না কেন বাথটাবে ঈষদুষ্ণ জলে নিজেকে না ডোবালে ভালো লাগে না।
কল ছাড়ি, তরল সাবান ঢেলে দেই ও ধীরে ধীরে নিজেকে ভেজাই। সমস্ত শরীরে সাবানের ফেনা লুটোপুটি খেতে থাকে,সাথে আমি ও। স্নান করতে করতে কল্পনার ডানা মেলে মায়ের কাছে চলে যাই, রাত্রির কাছে যাই। ফিস ফিস করে ওদের সাখে কথা বলি। ওরা কি আমার কথা শোনে? আমি জানি না। রাত্রি কি এখনো আমার জন্যে তীব্র ঘৃনা পুষে রেখেছে? ওর সেই তীব্র রাগ ঘৃনা মেশানো রক্ত জবার মত টকটকে মুখখানা দেখতে পাই। প্রচন্ড ঠান্ডায়ও ঘামতে থাকি। এই দূর প্রবাসে পালিয়ে এসে ও নিজের কাছ থেকে কি পালাতে পারলাম? সেই মনরক্ত দিনটির কথা মনে এলেই মাথাটা কেমন এলোমেলো হয়ে যায়। নিজেকে রক্তাক্ত করতে ইচ্ছে হয়। কমতো নিজেকে রক্তাক্ত করিনি।আর কতখানি রক্তাক্ত সমস্ত কস্ট বিলীন হয়ে যাবে? আর কতখানি নিজের মনের কাছে নত হলে আমি অপরাধ বোধ থেকে মুক্তি পাব? আমি জানি না । কারো কাছে আমি আমার মনের দরোজা খুলতে পারিনা। আগে পারিনি এখন তো আরও পারিনা। শুধুমাত্র ঐ শ্বেত মিউটার সাথে ফিসফিসয়ে কথা বলি। কেবল আমি বলে যাই। ও বুঝুক না বুঝুক শুধু মিউ মিউ করে।ওর মিউ মিউ শব্দ শুনতে শুনতে আমি ঘুমিয়ে পড়ি। ঘুম থেকে উঠে দেখি ও চলে গেছে। প্রায় ছয়মাস হয়েছে ওর সাথে আমার নিবিড় সখ্যতা। গেল সামারে জুলাই এর কোন এক গভীর রাত্রিতে কাজ সেরে বাড়ি ফিরে নিত্য নৈমিত্তিক কাজ গুলো সেরে অভ্যেস মত সিগারেট নিয়ে জানালার সামনে দাঁড়িয়ে যুতসই টান দিতেই চোখ পড়লো ছোট্ট সাদা মিষ্টি এক বেড়াল জানালার কার্নিশে জ্বল জ্বলে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মনে হলো ও আমার মতই নিঃসঙ্গ।জানালা খুলে হাত বাড়িয়ে অবলীলাক্রমে ওকে ভিতরে নিয়ে এলাম। অবাক কান্ড ও পালাতে চাইল না। শান্ত হয়ে আমার কোলে বসে রইল আর আমি তুলতুলে সাদা বেড়ালটিকে কোলে নিয়েই প্রতি দিনের মতো রাত্রি ও মন্ট্রিয়ল দেখতে লাগলাম। প্রায় রাতেই আমার ঘুমহীন কেটে যায়। শরীরে এত ক্লান্তি তারপরও ঘুম দেবী যে কোথায় পালিয়ে বেড়ায় জানি না শহর জুড়ে যখন কাজ ও ব্যস্ততার ঢল নামে। আমার দুচোখে তখন ঘুম নেমে আসে। যতক্ষন ঘুম না আসে সিগারেট পুড়তে থাকে আর পোড়ে আমার মন। কিন্ত যেদিন শ্বেত বেড়ালটি এলো সেদিন থেকেই আমার নিঃসঙ্গতা অনেক খানি ঘুঁচে গেল। কাজ থেকে ফিরে এসে দেখি সে আমার বিছানায় তার তুলতুলে শরীর বিছিয়ে আদর হয়ে বসে আছে। আমাকে দেখলে নেমে এসে আমার পায়ের কাছে পাক খায়। আমি তাকে হাতের মুঠোয় তুলে নেই। সে তার নরম থাবা দিয়ে আমার নাক ঘষে দেয়, আমার মুখ ঘষে দ্যায়,আমার সমস্ত ভালবাসা সে তার নরম পায়ের থাবায় তুলে নেয়।
আমি নিজের মনে ওর সাথে কথা বলি। “কিরে কেমন আছিস? আজ সারা দিন কি করলি? জানিস আজ মায়ের চিঠি পেয়েছি। মা বলেছে, চলে আয়। ও শুধু মিউ মিউ করে। ও কি বলে ফিরে যাও দোলন? নাকি বলে নিঃসীম নিঃসঙ্গতায় আমায় ফেলে যেও না । আমি কিছুই বুঝিনা। শুধু পরম মমতায় ওর কানে কানে বলি,মিউ, মিউ। ও কি বোঝে আমি বলি, ভালবাসি?
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা ফেব্রুয়ারি, ২০০৯ ভোর ৬:১৩

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




