সহপাঠীদের সঙ্গে ভাব না জমলে যা হয়, এককোণে চুপ করে বসে থাকি। আগেকার দিনে নারীরা যেমন করে কমন রুম থেকে শিকের পেছন পেছন কাশে ঢুকে আবার কাশ শেষে শিকের পেছন পেছনই বেরিয়ে যেতেন, অনেকটা সেই দশা আমার। আমি কারো সঙ্গে কথা বলি না, কেউ আমার সঙ্গে কথা বলতেও আসে না। কেউ আমাকে তেমন চেনে টেনেও না। অথচ দু'বার গোঁত্তা খেয়ে আমি তখন রীতিমতো ডিপার্টমেন্টের আলোচনার বস্তু। আমার পাশেই নতুন সহপাঠীরা আমাকে নিয়ে আলোচনা করে, আমাকে চেনে না! কী মজা! এভাবেই দিন কাটছিলো। হঠাৎ একদিন এই নিরুপদ্রব জীবনে পরিচিতির হাওয়া লাগলো। প্রফেসর মুস্তাফিজুর রহমানের কাশ। স্যার আসেননি তখনো। বেঞ্চের এক কোণে বসে আছি। হঠাৎ করে কোত্থেকে লাট্টুর মতো পাক খেয়ে লিলিপুট সাইজের এক ছেলে হাজির। আমার দিকে ঝুঁকে পড়ে ফিস ফিস করে জিজ্ঞাসা করে, আপনি কি শিবলী ভাই? নিজের নামটা আসলেই খুব খারাপ জিনিস। কেউ ডাকলে ইচ্ছা না থাকলেও হঠাৎ করে মুখ ফস্কে সাড়া বেরিয়ে যায়। হলোও তাই। তারপরেই ঘটলো ভয়াবহ ঘটনা। পায়ে ছুঁয়ে সালাম করা বাকি রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাঙা বাসে 100 গতিবেগ তোলার মতো করে সে যা বললো তাতে অনেক কষ্টে আসল কথাটুকু উদ্ধার করে বুঝলাম, সে আমার নিউজ পড়ে আমাকে খুঁজে বেরিয়েছে। অবশেষে আমাকে পেয়েছে। সে সাংবাদিকতা করতে চায়। আমার সঙ্গে থাকতে চায়। ধান্দা টং করে মস্তিস্কে বেজে উঠলো। পাইছি! এইডা তো নতুন কাশমেটগো দলে! এরে কাইত করবার পারলেই! খানিকটা গুরুত্বের সঙ্গেই তার নাম জানতে চাইলাম। ফস করে দেশলাইয়ের কাঠির মতো নিঃশ্বাস ফেলে জবাব দিলো, কামরুল, কামরুজ্জামান। ডাক নাম? আগের বার যতোটা ফস করে জবাব এসেছিলো এবার ততোটা দেরি করে জবাব আসলো, শাহীন।
এখান থেকেই শুরু শাহীন কাহিনীর। সোনালী সংবাদ যেদিন ছেড়েছিলাম, সেদিন শাহীনকে সেখানে ঢুকিয়েছিলাম। খুব কম সময়েই শাহীন বিশ্ববিদ্যালয়ে আলোচিত হয়ে উঠলো। শাহীন আমার সঙ্গ নিলো আঠার মতো। খুব কম সোর্স আমার ছিলো। তারপরেও সবগুলোই শাহীনও পেয়ে গেলো। ধীরে ধীরে কাজের সম্পর্কের গণ্ডি পেরিয়ে বন্ধুত্ব গড়লাম। শাহীনের সমস্যা, ছুটে যেতাম। আমার কোনো সমস্যা, ডাকার আগেই শাহীনকে পাওয়া যায়। পরীার আগে দু'জন মিলে নোট খুঁজতে বেরুতাম। ক্যাম্পাসে হয়ে গেলো শাহীন মানে আমি, আমি মানেই শাহীন। গণযোগাযোগ বিভাগের এক ছাত্রীর প্রেমে পড়লাম। মারিয়া নাম। মধ্যস্থতাকারী ওই শাহীন। বিয়ে করলাম বাড়িতে না জানিয়ে। অন্যতম স্বাী ওই শাহীন। আমার সংসার জীবনের সবচেয়ে বড় শক্তি শাহীন। এর মধ্যে শাহীন সোনালী সংবাদ ছাড়লো, যুগান্তরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি হবার জন্য কঠিন লড়াইয়ে নামলো। আমি আজকের কাগজের রাজশাহী প্রতিনিধির দায়িত্ব পেলাম। মনে আছে, শাহীন যেদিন যুগান্তরে নিয়োগ পায় সেদিন ভরা ক্যাম্পাসে আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলো ছুটে এসে। বিয়ের পর শাহীন সবচেয়ে বড় বন্ধুর কাজটি করলো। আজকের কাগজে বেতন বন্ধ। সংসার চালানো দায়! শাহীন আমার জন্য যুগান্তরের তখনকার বু্যরো প্রধান বুলবুল হোসেনের কাছে সুপারিশ করতে শুরু করলো। বুলবুল ভাই ডাকলেন। আমার কাজে সন্তুষ্ট হলেন। সবকিছু ঠিকঠাক, যুগান্তরে ঢুকবো। হঠাৎ করেই বুলবুল ভাই শাহীন সমেত সমকালে যোগ দিলেন। আমাকেও নিলেন স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে। চাকরি হলো। বেতন নিশ্চিত। সংসার বাঁচলো। আমিও হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। আমার একটি ফুটফুটে সন্তান হলো সমকাল প্রকাশের কিছুদিন আগে। আমার সন্তানটির জন্মের পর থেকে চেনে চাচ্চু একটাই, শাহীন। আমার কোনো ভাই নেই। তাই শাহীনই আমার ছেলেটার চাচ্চু।
সমকালে আর ভালো লাগে না। শাহীন আমার পাশে আছে। কিন্তু বু্যরো প্রধান বুলবুল ভাইয়ের অনেক বিষয় আমাদের ভালো লাগে না। কাগজ ছেড়ে দেয়ার পরিকল্পনা নিলাম। যায়যায়দিনে চলে গেলাম। শাহীন হতাশ। মাত্র 3 দিনের মধ্যেই আবার সমকালে ফিরলাম। বুলবুল ভাই যায়যায়দিনে গেলেন। ঢাকা থেকে ফোন করে শাহীনকে প্রশ্ন করলাম, যদি আমি সমকালের বু্যরো প্রধান হয়ে রাজশাহী ফিরি তাহলে ক্যামন হয়? শাহীন আনন্দে নেচে উঠলো। সেই রাতে ফিরলাম। বা টার্মিনালে শাহীন আর ফটোসাংবাদিক অপু ভাই আমাকে নিতে এলেন। শাহীন যেনো আনন্দে নাচছে। এই পর্যন্ত একটি বিশ্বাসের গল্প।
তারপর হঠাৎ কী যে হলো! বুলবুল ভাই সমকাল ছেড়ে যায়যায়দিনে বসেন। আমি দায়িত্ব নেয়ার পরেও পুরানো সেটআপ নিয়েই কাজ করতে চাইলাম। কিন্তু হঠাৎ করে একদিন সাহেববাজার জিরে াপয়েন্ট বিএনপি-আওয়ামী লীগ সংঘর্ষ হলো। আমি অস্ত্রধারীর ছবি পাঠালাম। ছাপা হলো। আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করে নজরুল পদত্যাগ করলেন। বললেন, আমি নাকি ভুয়া ছবি ছাপিয়েছি। নিউজটিও নাকি ঠিক ছিলো না। শাহীনও বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো আমাকে এসে রাতে বললো সেও আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে। আমি তাকে বোঝালাম অনেক রাত পর্যন্ত। অবশেষে যে আমাকে আশ্বাস দিলো সে আমার সঙ্গেই থাকছে। সমকালকে ধরে রাখার যে চ্যালেঞ্জ আমি নিয়েছি, সেই চ্যালেঞ্জে সে আমার সঙ্গে থাকবে সব সময় এই আশ্বাস দিয়ে সে চলে গেলো। পরেরদিন সকাল থেকে তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলাম। কিন্তু মোবাইল আর ধরে না। ক্যাম্পাসে তাকে কুঁজতে চষে বেড়ালাম। টিকিরও নাগাল মিললো না। দুপুরে ফোন করলো শাহীন, জানালো, সেও পদত্যাগ করেছে। ঢাকা থেকে আমাকে জানানো হলো শাহীনও আমার বিরুদ্ধে একই অভিযোগ এনে পদত্যাগ করেছে। খবর পেলাম, একটি বিশেষ পত্রিকা অফিসে অন্নন্দ। দুপুরে সেই অফিসে বসে শাহীনসহ আরো ানেকে খাবার খেয়ে উল্লাস করলেন। এমন বিশ্বাস ভঙ্গের গল্প কতোদিন কতোভাবে যে আমাকে পুড়িয়েছে!
...এরপর? শাহীন এখন যায়যায়দিনে। ভালো কাজ করছে। আমার দুর্দিন কেটে গেছে। সমকালকে আমি শক্ত হাতে ধরে রেখেছি। নতুন লোক এসেছে আমার সঙ্গে। শাহীন কিছুদিন দূরে দূরে ছিলো। একদিন এসে সেই প্রথম দিনের মতো হঠাৎ করে জো7কের মতো ঠেসে ধরলো। মা করে দিলাম। বিশ্বাস কিংবা বিশ্বাসভঙ্গের চেয়েও এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ গল্প যে আছে! সেই গল্প ভালোবাসার গল্প। সেই গল্পেই এখনো শাহীন আমার সঙ্গে। শাহীন আবার আমার পাশে থাকে, আমি ওপর পাশে থাকি। এই ভালোবাসার গল্পটির কারণেই বোধহয় দেবীপ্রসাদ লিখেছিলেন, যে গল্পের শেষ নেই। আমাদের এই গল্পেরও শেষ নেই...
ছবিটি যখন তোলা তখন আমি সমকালে আর শাহীন যায়যায়দিনে। নিউজটি কীভাবে করলে আরো ভালো হয় সে ব্যাপারে আমাদের বাধাহীন আলোচনায় হঠাৎ করে আমার দেশের ফটোসাংবাদিক আসাদ বেরসিকের মতো ক্যামেরা চালিয়ে দিলেন! যাক, ছবিটাও যে আসাদ ভাইয়ের ভালোবাসার ছবি!
ঘুরে আসুন :
[লিংক=িি.িংযরনষববহড়সধহ.পড়স][/লিংক]

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


