১.
২০১৪ সালে আব্বার হার্নিয়া অপারেশন হয়।খুব খারাপ পর্যায়ে চলে গেছিলো।ভয়াবহ অসুস্থতার সময় বেশ কিছু অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছি, বেশ কিছু অনুভূতির জেগেছে কুষ্টিয়া সদর হাসপাতালে কাটানো রাত গুলোতে!
বাঁচা মরা সন্ধিক্ষণে যখন বন্ডে সাইন করতে হচ্ছে ছেলে হিসেবে তখন হাত থেকে কলম পড়ে যাওয়ার মত ঘটনা ঘটলো। রতন দা পিঠে হাত দিয়ে বললো, মানসিকভাবে প্রস্তুত হও!
দুঃসময়ে অনেকমানুষের মধ্যে একা মনে হয়েছিলো সে সময়। ধরে নিয়েছিলাম ভয়াবহ দুঃসংবাদ নিয়ে ভেড়ামারা ফিরে যেতে হবে। অবশেষে আব্বা আল্লাহর অশেষ রহমতে বাড়ি ফিরে আসেন।
হাসপাতালে বিভিন্ন রকমের রুগীর আনাগোনা ছিলো। বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ, বিচিত্র মানুষ, বিচিত্র অসুখ।
এক দাঁড়িওয়ালা মুরুব্বী রুগী ভর্তি হলো রাত বারোটার দিকে। একপাশ সম্ভবত পরে গেছে। রাত চারটার দিকে উঠে বলতে লাগলো , "আমারে অজু করায় দাও! আজান দিবো।" ফরজের ওয়াক্তে একহাত কানের কাছে দিয়ে তিনি অতি কষ্টে আজান দিলেন। আমি করিডোরে দাঁড়িয়ে আজান শুনছি। আজান শেষ হলে ওয়ার্ডে ঢুকে দেখি তাঁর চোখে পানি। বুড়ো মানুষটার বয়স ৭০। তিনি ৫০ বছর ধরে আজান দেন।
আমার আব্বা ঘোরের মধ্যে ক্লাস নেন। আমি চুপচাপ বসে বসে শুনি! ভালোই লাগে, গিয়াস কি ক্লাসে গ্যাছে? ভগবানের স্কুলের রেজাল্ট তো ভালো না।
তিনি আছেন স্কুল নিয়ে শিক্ষা নিয়ে। তাঁর চোখেও পানি দেখা যায়।
৫০ বছর আজান দেয়া মুরুব্বীর চোখের পানি আর ৪০ হেডস্যারের দায়িত্ব পালন করা চোখের পানিই এক। কোথাও কোন আনন্দ লুকিয়ে আছে কিংবা কোথাও কোন আক্ষেপ। নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালনের আনন্দজল অথবা... থাক, সবকিছু বলতে হয় না।
২। ১৮ই নভেম্বর ১৯৮৮ সালের জন্মদিনের ছবি। আমাদের সেই মাটির ঘর। রাতে রেডিওতে বাংলা নাটক আর আমার অসংখ্য রাশিয়ান বইয়ের দিনগুলি। পিছের মাটির দেয়ালে জন্মদিনের ডেকোরেশন দেখা যাচ্ছে । হ্যাপি বার্থডের আর্ট ওয়ার্কটা মেজচাচা করে দিয়েছিলেন। শৈশবের মূহুর্ত গুলো একেকটা গল্প । ছবিটা দেখতে দেখতে খেয়াল করলাম , আমার ছেলেটা মাঝে মাঝে আমার মতোই তাকায়। ঐ চোখেরো একটা গল্প আছে । সেই গল্প বাবু বড় হয়ে নিজেই লিখবে।
৩.
১৯৯৬ সালের মে মাসের ৩ তারিখের ছবি। ছবিতে আম্মা আর আব্বা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে । আম্মার চুল ছোট। না আসলে ছোট করে কাটা নয়। ক্যামোথ্যারাপির পর চুল ফেলে দেয়া হয়েছিল। চুল বড় হতে শুরু করেছে কেবল। একজন ক্যান্সার রুগীর মুখে হাসি। হাসিমুখে পাশে দাঁড়িয়ে আব্বা।
এই ছবির একটা গল্প আছে। হার না মানার গল্প । ক্যান্সার সারভাইবের গল্প । পাশে থাকার গল্প । জীবন যুদ্ধের গল্প । শিক্ষক আন্দোলনের গল্প । হাসিমুখের গল্প । কিংবা চেপে রাখা ভীষণ আক্ষেপের গল্প । হাসির মুখের আড়ালে লুকানো অনেক কিছু । যা কখনোই আমারা দেখতে পাইনি। অনেক বছর কেটে গেছে ।
আব্বা সুস্থ থাকলে হয়তো প্রতিদিনের মত আজকেও আম্মার ঘুম ভাঙতো আব্বার বানানো চায়ে। গরম ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপেও গল্প থাকে। গল্প থাকে খটমটা টোস্ট বিস্কুটে।
সেই সব গল্প পরে হবে। গুছিয়ে বলবো একদিন।
আমরা ভাইবোনেরা সবাই বড় হয়ে যাচ্ছি বলে তাঁরাও বুড়ো হচ্ছেন । আমরা বড় না হলে তাঁরাও হয়তো বুড়ো হতেন না।
৫.
খুব সকালে অফিসের উদ্দেশ্যে বের হয়। রাশান রাজপুত্র সচরাচর ঘুমিয়ে থাকে। আজ দেখি জেগে গেল। আমি তখন রেডি হচ্ছি ।দেখে বলে, ' বাআআপ' । আমি বলি, 'অফিস যাচ্ছি বাবা। ' আমাকে ইশারায় ডাকে আদর করার জন্য। আমি বলি, 'তোমার জন্য কি আনতে হবে?' রাজপুত্র উত্তর দেয়, 'ডিম!' আমি অবাক হয়ে হাসি । ওর মা হাসে।
বাসা থেকে নামতে নামতে ইচ্ছে হলো পৃথিবীর সমস্ত ডিম কিনে ফেলি কিংবা একটা মুরগীর খামার দেই। বাবারা কি এভাবেই ভাবেন? প্রতিদিন যেন একেকটা গল্প তৈরী হয়। বাবাদেরও তো গল্প থাকে কারণ বাবারাও তো একদিন ছোট ছিল!
৬.
রেল লাইন পাড় হয়ে বাবার হাত ধরে বাড়ির পথে যাচ্ছে ছেলেটি। ছোট্ট ছেলের মুখে অনেক প্রশ্ন। একের পর এক বাবাকে প্রশ্ন করে। বাবাও আগ্রহ নিয়ে প্রশ্নের উত্তর দেয়।ইচ্ছে করলেই তারা রিকশা নিতে পারে , কিন্তু ছেলেটা নেবে না। হেঁটে গেলে হাঁটতে হাঁটতে কথা বলা যাবে , সময় পাওয়া যাবে। ছেলেটি বাবাকে জিজ্ঞেস করে , ''আচ্ছা বাবা সবাই ভালো হয় না কেন ?'' বাবা চুপ করে থেকে ছেলে উল্টা প্রশ্ন করেন , ''আচ্ছা তুমিই বলো - সবাই খারাপ হয় না কেন ?''
প্রশ্ন শুনে ছেলেটি বাবার মুখের দিকে তাকায়। বাবা মিটিমিটি হাসেন। ছেলেটি ভাবে , থাক। আরেকটু বড় হলে ঠিক জেনে যাবে। তখন এই উত্তর বাবাকে দেবে।
আঁধার নেমে আসছে ,অন্ধকার হচ্ছে চারপাশ। রাস্তার শেষ প্রান্তের বাড়িতে আলো জ্বলে উঠলো , আলোকিত হয়ে উঠলো । এটা ওদের বাড়ি। অন্ধকারেই আলো চেনা যায়।
ছেলেটা বাবার মুখের দিকে চেয়ে মিটিমিটি হাসে। উত্তরটা সম্ভবত সে পেয়ে গেছে।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে ডিসেম্বর, ২০২১ সন্ধ্যা ৭:২৭