১.
বহুদিন পর শিপনের সাথে দেখা। আমার থেকে দুই তিন বছরের বড়। আমি শিপন কাকা বলতাম। বিকেল বেলা আমাদের সাথে খেলতো। শিপন কাকার মা গরু পালতো। সেই গরুর দুধ এ বাড়ি ও বাড়ি দিয়ে আসতো। মাস শেষে টাকা।
শিপন কাকার ছেলেদের খেলার চেয়ে মেয়েলি খেলার প্রতি আগ্রহ ছিল বেশি। মেয়েদের সাথে গল্প করতে পছন্দ করতো। সবাই ভেঙ্গাতো । বয়স বাড়ার সাথে সাথে পাড়ার ছেলেরাও ওকে খুব বিরক্ত করতো। ধীরে ধীরে ঘরবন্দী হলো। দুধ দিতে আসতো না। খেলতেও দেখা যেত না।
তখন বুঝিনি আমি। এভাবে কেটে গেল কয়েক বছর। একদিন খবর পেলাম শিপন কাকা কে ইন্ডিয়াতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তারপর আর দেখা নেই।
একদিন দেখলাম পৌরসভার ঢালে রিকশাতে। শাড়ি পড়ে বসে আছে। মাথা নিচু। আসে পাশে জটলা।
আরেকদিন দেখা রাস্তায়। এগিয়ে গেলাম। মাথা নিচু। আমি বললাম , কেমন আছিস শিপন কাকা ? ও চুপ করে থাকে। মাথা নিচু , বলল - '' আমাকে কেউ আর কাকা বলে না। বলে , শিপন ফুফু।'' ওর কন্ঠ টা কেঁপে উঠলো।
আমার কেঁপে উঠলো বুক। জানলাম টঙ্গীতে থাকে।
এরপর মাঝে মাঝে দেখতাম এর ওর মোটর সাইকেলের পিছে বসা। কথা বলার সুযোগ হয়নি। এড়িয়ে চলতো। কথা বলতে চেতনা। নিদারুন করুণ চোখের ভাষা আমি বুঝতে পারতাম।
বহুদিন পর শিপনের সাথে দেখা। সনো গলির সামনে। আমার কোলে আমার ছেলে। শাড়ি পরে সেঁজে গুঁজে পার্লার থেকে বের হচ্ছে। সাথে আরেকজন। তার সাজসজ্জা একই রকম। আমি ডাকলাম , শিপন কাকা ? সালাম দিয়ে বললো , ভালো আছেন ? আমি বললাম , তুই আমাকে আপনি বলতি না।
অনেক কিছুই বদলায় , এইযে আমি কাকা থেকে ফুফু হয়েছি।
আমি কিছু বললাম না। কি বলবো ?
এটা তোর ছেলে?
হুমম , আমার ছেলে ।
একটু কোলে নিবো ?
ছেলেকে কোলে নিয়ে ফুঁপিয়ে উঠলো। সদ্য মেকাপ করা চোখ ভিজে উঠতে দেখলাম। পাশের জনার চোখেও জল।
২.
জুঁই আপা ইন্টারে ভালো রেজাল্ট করেছিল। ভর্তি পরীক্ষার পূর্ব প্রস্তুতির জন্য ঢাকায় যেতে হবে। ঢাকায় জুঁই আপার তেমন পরিচিত কেউ নেই যে তার বাসায় গিয়ে উঠবে। সেই সময় যোগাযোগ ব্যবস্থা খুব ভালো ছিল না। জুঁই আপারা খোঁজ পেলো তাদের পরিচিত এক মেয়ে এক বাসায় ভাড়া থাকে। বেশ কয়েকজন মেয়েও ওখানে থাকে। জুঁই আপার বাবা মেয়েকে ওই বাসাতে রেখে বিকালে রওনা হলো।
সকালে খবর পাওয়া গেলো ওই বাসাতে পুলিশ রেড দিয়েছে। পেপার পত্রিকায় ছবি এলো। যৌন কর্মী গ্রেফতার। কাস্টমারের ছবির চেয়ে মেয়েদের ছবির দিকে মানুষের আগ্রহ বেশি দেখা গেল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে চাওয়া জুঁই আপা এর পর আর বাড়ি ফেরেননি।
৩.
কুটি আপা মারা গেছে। শশুর বাড়ি পাশের বাঁশ ঝাড় থেকে লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। কুটি আপা আমাকে সময় দিতো ছোটবেলায়। আব্বা আম্মা কর্মক্ষেত্রে গেলে আমি প্রায় একা হয়ে যেতাম। সেই সময় সে সময় কুটি আপা এসে খেলতো। আম গাছতলায় আম কুড়াতো। পাকন পিঠা ভেজে দিতো। কুটি আপার নাম 'রেহানা'। ছোটোখাটো গড়নের ছিল বলে 'কুটি ' বলে ডাকতো।
কুটি আপার লাশ আমি দেখতে যায়নি। শুনেছি গলায় আর গালে অনেক গুলো ব্লেডের পোঁচ! না মরা পর্যন্ত হয় তো পোঁচ দিয়েই গেছে। কিংবা শ্বাসরোধ করে মেরে ফেলার পর ব্লেডের পোঁচ দেয়া হয়েছে।
কুটি আপার স্বামী পলাতক। শ্বাশুড়ি আর ননদ পুলিশ হেফাজতে। কুটি আপার নামে কোন এনজিও কিংবা সমিতি থেকে লোন নিয়েছিল শশুরবাড়ির লোক। ঋণ গ্রহীতা অপঘাতে মারা গেলে নাকি ঋণ মওকুফ হয়ে যায়।
৪.
২৫ ডিসেম্বর ১৯৯১ মস্কোর ক্রেমলিন শহর। শেষবারের মতো উড্ডীয়মান সোভিয়েত পতাকা। ঠিক সন্ধ্যা ৭:০২ মিনিটে সোভিয়েত পতাকা নামিয়ে সেখানে রাশিয়ার পতাকা উত্তোলন করা করা হলো। সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বশেষ নেতা মিখাইল গর্বাচেভ পদত্যাগ করলেন। পদত্যাগ করার পর বললেন , "আমরা বাস করছি এক নতুন পৃথিবীতে!"
পরদিন সকালে আব্বা বললেন , "তোমার সোভিয়েত ভেঙে গেছে। "
সকালবেলা উঠে মনটা খারাপ হয়ে গেল। আমি কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললাম , আর আমার সোভিয়েত বই ? প্রগতি প্রকাশনী !
আব্বা বললেন , "ওগুলো আর কোনদিনই ছাপা হবে না !"
ছবিঃ সমান্তরাল চলচ্চিত্র
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই জুন, ২০২২ সন্ধ্যা ৬:৪১