তোমরা যারা ১৯৯৯ সালে ভেড়ামারা এস.এস.সি পরীক্ষাকেন্দ্র থেকে এস.এস.সি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছিলে তারা সকলে মিলে আগামী ঈদ-উল ফিতরের পরের দিন অথবা একদিন পর পূর্ণমিলনী অনুষ্ঠান করবে বলে জানিয়েছো , তা জানতে পেরে খুশি হলাম। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি তোমাদের আশা সফল হোক।
তোমাদের সহপাঠী বন্ধু সৌরভ প্রায়ই আমাকে বলছে তোমাদের উদ্দেশ্যে কিছু একটা লেখার জন্য। আজ প্রায় ২০ বছর পার হয়ে গেল। অর্থাৎ ১৯৯৯ সালে নভেম্বর মাসে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের পদ থেকে অবসর নিয়েছি।
আমাকে কিছু লেখার জন্য বারবার অনুরোধ করছো কিন্তু কি লিখবো ? তোমরা যখন ১৯৯৯ সালে এস.এস.সি পরীক্ষা দিলে তখন আমি ভেড়ামারা পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এবং পরীক্ষা কেন্দ্র সচিব ছিলাম।
এ প্রসঙ্গে তোমাদের স্মরণ করে দিতে চাই যে, ১৯৭০ সালে ভেড়ামারাতে প্রথম এস.এস.সি পরীক্ষাকেন্দ্র স্থাপিত হয়। ইতিপূর্বে থানা পর্যায়ে কোন পরীক্ষাকেন্দ্র ছিলো না (এস.এস.সি )। এই প্রথম ভেড়ামারা , মিরপুর এবং দৌলতপুর এই তিন থানা মিলে এস.এস.সি পরীক্ষাকেন্দ্র স্থাপিত হয় এবং এই সময় থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ৩০ বৎসর আমি কেন্দ্র সচিবের দায়িত্ব পালন করেছি।
আমার কেন্দ্রসচিব থাকা অবস্থায় তোমাদের বন্ধু সৌরভের দুই বোন ১৯৮৬ সালে এস.এস.সি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছিল। বর্তমানে রেলওয়ে মন্ত্রণালয়ের উপসচিব আমার ভাতিজা সাইদুর রশিদ তপন ১৯৯১ সালে এবং আমার আরো দুই ভাতিজা ১৯৯৫ এবং ১৯৯৬ সালে এস.এস.সি পরীক্ষা দিয়েছিল। ১৯৯৯ সালে তোমাদের সহপাঠী ও বন্ধু সৌরভও আমার কেন্দ্রসচিব থাকা অবস্থায় এস.এস.সি পরীক্ষা দিয়েছে।
১৯৫২ সালে আমরা যখন দশম শ্রেণীর ছাত্র তখন একসময় স্কুলে কোন প্রধান শিক্ষক ছিলেন না। ঐ সময় আমাদের মিঞা ভাই মোহাঃ আবুল কাশেম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (এস.এম হলে) ইসলামের ইতিহাসের এম.এ শেষ বর্ষের ছাত্র ছিলেন। কমিটি তাকে অনুরোধ করে আমাদের স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়ে আসেন। তিনি মাত্র ২/৩ মাসের জন্য প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন এবং পুনরায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যান। বর্তমান প্রধান শিক্ষকের অফিস কক্ষে প্রাক্তন প্রধান শিক্ষকদের নামের যে তালিকা আছে তাতে উনার নাম ৯ নাম্বারে (মোহাঃ আবুল কাসেম) লিখা আছে।
মিঞা ভাই ওই সালে অর্থাৎ ১৯৫২ সালে ইসলামের ইতিহাসে এম.এ ডিগ্রী লাভ করেন এবং অধ্যাপক হিসেবে বাগেরহাট প্রফুল চন্দ্র কলেজ (পিসি কলেজ) যোগদান করেন। তিনি কেবল এই স্কুলের প্রধানশিক্ষক ছিলেন না , তিনি এই বিদ্যালয়ের প্ৰাক্তন ছাত্র ছিলেন। তিনি ইসলামের ইতিহাসের ছাত্রছাত্রীদের জন্য (কলেজ পর্যায়ে ) তিনখানা পাঠ্য পুস্তক রচনা করেন। প্রথম পুস্তকের নাম হল '' ISLAM AND THE MODERN WORLD'' । দ্বিতীয় বই খানার নাম '' MUSLIM RULE IN INDIA'' এবং তৃতীয় বইখানার নাম '' ESSENTIALS OF ISLAMIC HISTROY'' । তোমাদের বলে রাখি , আমি এ তিনখানা বই-ই বাগেরহাট কলেজে অধ্যয়নকালে ইন্টারমিডিয়েট এবং ডিগ্রী ক্লাসে পড়েছিলাম। তাঁর রচিত চতুর্থ বইখানার নাম '' MUSLIM RELRGIOUS INSTITUATION'' যা একসময় করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ে পঠিত হয়। এছাড়াও নবম ও দশম শ্রেণীর জন্য ইতিহাসের একখানা বই রচনা করেন। তার নাম ছিল ''প্রশ্নোত্তরে স্বদেশ সমাচার। ''
পরবর্তীতে ১৯৬০ সালে তিনি করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ প্রাপ্ত হন। দুর্ভাগ্য , তিনি যোগদান করতে পারেননি। ওই বছরে মানে ১৯৬০ সালে তিনি মারা যান। আজ তোমারদের এক মনীষীর সাথে পরিচয় করিয়ে দিলাম। যিনি এই ভেড়ামারা পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। আশাকরি তোমরা তাকে স্মরণ রাখবে।
তোমরা আমাকে তোমাদের উদ্দেশ্যে কিছু লেখার জন্য বলেছো , কিন্তু কি লিখবো ভাবছি। তোমাদের একটা গল্প বলি শোন , আমার যখন বাগেরহাট পিসি কলেজের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র তখন আমাদের ইংরেজি পড়াতেন তাঁর নাম ছিল , প্রফেসর পরেশ চন্দ্র ব্যানার্জী। তাঁকে কলেজের শেষ ক্লাসে ছাত্র ছাত্রী প্রশ্ন করলো ,
''স্যার আজ ৪ বৎসর আপনার কাছে পড়লাম কিন্তু কোনদিন কোন উপদেশ দিলেন না। ''
স্যার হাসতে হাসতে উত্তর দিলেন ,
' আরে । আমি তোদের কি উপদেশ দিবো ? তোরাই তো আর কিছুদিন পর গ্রাজুয়েট হয়ে দেশের প্রথম শ্রেণীর নাগরিক হবি , তোরাই তো উপদেশ দিবি। আমি তোদের কি উপদেশ দিবো। এই বলে স্যার হাসতে হাসতে '' LAUGH AND BE MERRY'' কবিতা আবৃত্তি করলেন।
আর বললেন ,
'' জীবনে যত রকম আনন্দ করতে ইচ্ছা করে তা করিস কিন্তু যেন এই আনন্দে রাস্তার একটা সাধারণ ভিক্ষুকও দীর্ঘশ্বাস না ফেলে।''
আর একটা কথা আমাদের বললেন , '' দেখ ময়না পাখিকে যা শেখানো হয় তাই বলে কিন্তু হঠাৎ বিড়াল এসে ধরলে ময়না সব কথাই ভুলে যায় এবং চ্যাও চ্যাও করে চিৎকার করে। কিন্তু বলতে পারে না আমাকে বিড়াল ধরেছে। পরীক্ষা তোদের কাছে বিড়াল। এতদিন যা শিখেছিস বা মুখস্ত করেছিস তা তোদের ময়নার বুলি শেখার মত। পরীক্ষার হলে যেন কোন ভুল না হয়। আর এটা জীবনে কাজে লাগাবি।''
ডিগ্রী টেস্ট পরীক্ষায় ইংরেজিতে আমরা কেউই পাশ করলাম না ! যে সব থেকে বেশি নাম্বার পেলো তা হল ২০! আমার কয়েকজন ছাত্র স্যারের বাসায় গিয়ে প্রশ্ন করলাম। স্যার বলেলেন , '' দেখ , আমি ২০ দিলাম আর তোরা ফাইনাল পরীক্ষায় ৫০ পেলি। আর আমি ৫০ দিলাম আর তোরা ফেল করলি। কোনটা ভালো ?'' স্যারের এই কথা শুনে আমরা চলে আসলাম।
এখন আমি তোমাদের একটা প্রশ্ন করি , বলতো তোমাদের মা কয়জন ? শোনো , মা চারজন। (১) জন্মদাত্রী মা (২) জন্মভূমি মাতা (৩) বিদ্যালয় / স্কুল - স্কুল থেকে যে টুকু অর্জন করেছো , তাতে তুমি আজ এতদূর উঠতে পেরেছো (৪) তোমার কর্মস্থল অর্থাৎ তুমি যেখানে কাজ করে উপার্জন করছো , তা দিয়ে সংসার চালাচ্ছ , সন্তানদের লেখাপড়া শেখাচ্ছ। আজ বড় বড় পজিশনের মালিক হচ্ছ। আবার কেউ শিল্পপতি হচ্ছ। সুতরাং এ প্রতিষ্ঠান তোমার মা।
এই চার মায়ের কাছে তোমরা চিরঋণী। এদের প্রতি তোমাদের দায়িত্ব আছে।
তোমার যে বিদ্যালয় থেকেই ১৯৯৯ সালে ভেড়ামারা এস.এস.সি পরীক্ষা কেন্দ্রে পরীক্ষা দিয়েছিলে তারা প্রত্যেকেই যেন তাদের বিদ্যালয় কে 'মা ' মনে করে এবং বিদ্যালয়ের উন্নয়ন কাজে সাহায্য করে।
গত বছর একদিন স্কুলে গিয়েছিলাম। তখন বর্ষাকাল। দেখি , প্রধান শিক্ষকের অফিস কক্ষে এবং কেরানি সাহেবের অফিসের ভিতরে বৃষ্টির পানি ঢুকেছে। ঐ সময় একজন ছাত্র বর্তমানে ঐ স্কুলের শিক্ষক , আমার প্রাক্তন ছাত্র আমাকে বললো , '' স্যার, এই বিল্ডিংয়ের ভিত্তি যদি আর দুই ফুট উঁচু করতেন তাহলে আজ এই অবস্থা হতো না।'' আমি আজ ঐ শিক্ষকের উদ্দেশ্যে বলতে চাচ্ছি , ''তখন আমি ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলাম না। ''
এখানে তোমাদের কিছু তথ্য দিয়ে রাখতে চাই যে , ১৯৬০-১৯৬১ সালে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান সাহেব আমাদের স্কুলকে Bilateral স্কুলের অন্তর্ভুক্ত করেন। ওই সময় থেকে '' ভেড়ামারা হাইস্কুল'' কে বলা হত ''Bilateral High School With Advanced Science and General Courses.'' এবং ঐ সময় গৃহ নির্মাণের জন্য তিনি যে অর্থ বরাদ্দ করেন তা দিয়ে আমাদের বিদ্যালয়ের বর্তমান দক্ষিণ দুয়ারী তিনতলা ভবনের পশ্চিম দিকে প্রধানশিক্ষকের অফিস , কেরানি সাহেবের অফিস এবং একটা ক্লাসরুম নির্মাণ করা হয়।
১৯৬০-৬১ অর্থ বছরে ভেড়ামারা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন জনাব আজিজুর রহমান আক্কাস এবং সহকারী প্রধান শিক্ষক ছিলেন হাফেজ আব্দুর রশিদ সাহেব। ঐ ভবনের ভিত নিচু হবার জন্য আমাকে অপরাধী করা ঠিক না আর বর্ষণের সময় হেডস্যারের অফিসসহ অন্যান্য রুমে বৃষ্টির পানি ঢুকে জিনিসপত্র নষ্ট হয়ে যায় , এর জন্য আমি দায়ী না। কারণ ঐ সময় তৎকালীন প্রধান শিক্ষক যদি ঐ ভবনের ভিত ১/২ ফুট করতেন তবে আজ এই অবস্থা হতো না।
তোমাদের আরও কিছু তথ্য দিয়ে রাখি। তা হচ্ছে , ১৯৮০ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান প্রতিটি থানায় দুই টি করে মাধ্যমিক স্কুলকে 'পাইলট' স্কুলে রূপান্তরিত করেন (বালক ১ টি এবং বালিকা ১ টি ) । ঐ সময় থেকে ভেড়ামারা স্কুলকে - ভেড়ামারা পাইলট হাইস্কুলে নামান্তরিত করা হয়। আরো জানিয়ে রাখি , ১৯৮৪ সালে স্কুলকে কমিউনিটি প্রজেক্ট এ অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং ১৯৯৬ সালে এস.এস.সি ভোকেশনাল কোর্স চালু করা হয় কিন্তু বিশেষ কিছু কারণে ১৯৯৭ সালে ছাত্র ভর্তি শুরু করা হয়। এখানে তিনটি বিষয়ে পাঠদান করা হয়। (১) গৃহ নির্মাণ (২) মেকানিক্যাল (৩) ইলেক্ট্রিক্যাল।
পরিশেষে তোমাদের বলতে চাই , বাংলাদেশের বর্তমান জনসংখ্যা ১৬ কোটির অধিক কিন্তু মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত কম। রক্তের বিনিময়ে ১৯৭১ সালে যারা এদেশ কে স্বাধীন করেছিল তোমরা তাদের কথা চিন্তা করে সকল দুর্নীতির ঊর্ধ্বে থেকে দেশকে সত্যিকারের স্বাধীন দেশ হিসেবে গড়ে তুলবে। এটাই আমার প্রত্যাশা। তোমরা দেশটাকে পৃথিবীর শ্রেষ্ট দেশের অন্তর্ভুক্ত করবে।
তোমরা হয়তো অনেকেই জানো না । ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ , পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্র দিবস। ঐদিনে শোষকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে কুষ্টিয়া জেলায় সর্ব প্রথম বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেছিলাম। শুধু এই দেশের জন্য , তোমাদের জন্য। এটা আমার অহংকার বলতে পারো। জানতাম এটা আমার জীবনের হুমকি ছিল। কিন্তু ভয় পাইনি। ভয় পেলে দায়িত্ব পালন করা যায় না। তখন ওটাকে দায়িত্বই মনে হয়েছিল। দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা। তাই আমি সবাইকেই এই উপদেশ দিই - তোমার এই দেশটাকে খুব ভালোবাসবে।
অনেক কিছু লেখার ইচ্ছা ছিল কিন্তু অসুস্থতার কারণে তা পারলাম না। যদি বেঁচে থাকি , আল্লাহ চাইলে তোমাদের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবো আমি। আরো অনেক কথা বলবো। যে কথা লিখবো বলে ঠিক করেছিলাম, যা আজও হলোনা লেখা।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত সোনার তরী কবিতার দুটি লাইন দিয়েই আজকের মত তোমাদের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছি।
'' ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই-- ছোটো সে তরী
আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি।''
মোঃ রুহুল ইসলাম
এম.এ.বি.এড
প্রাক্তন ছাত্র ও অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক
ভেড়ামারা পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়।
চ্যানেল ওয়ানের একটা অনুষ্ঠানে তাঁর কয়েকটি কথা।
**** আব্বার লেখা এর আগেও পোস্ট করেছিলাম। এই লেখাটিও শুনে শুনে লিখেছিলাম আমরা।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে আগস্ট, ২০২২ সকাল ১১:০৪