৮ টা ৪৫ মিনিটে অফিসের পিসি অন করছি। অন করেই সামুতে। আউটলুক চেক করলাম। হাতে গোনা কয়েকটি মেইল। বায়ারের তরফ থেকে বিশেষ কোন মেইল নেই। দুবাই থেকে হোটেল বুকিংয়ের একটা মেইল দেখলাম। ৩১৯৫ ডলার জন প্রতি। ভেবে দেখলাম এতো টাকা আমার কাছে নেই।
মেইল দাতা ভুল জায়গাতে নক করেছে। কি আর করা , জাঙ্কে রেখে দিলাম।
ডলার আজ ১০৫ টাকা করে যাচ্ছে। তিনলাখ পঁয়ত্রিশ হাজার চারশো পঁচাত্তর টাকা কমাতে আমার কত বছর লাগবে হিসেবে করতে ইচ্ছা করছে না। যেদিন টাকা হবে সেদিন দুবাইয়ে রুম ভাড়া করবো সেটাও ভাবছি না।
আজ অফিস অনেক ফাঁকা। অনেকেই ছুটিতে। আমার অনেক প্রেশার নেই। কেমন একটা ঝিঁমুনি চলে এসেছে। চা খেলাম কাজ হলো না। আমাদের অফিসে চা দেয় চিনি ছাড়া। অফিসে চিনি নিষিদ্ধ। আমি আলাদা বয়ামে চিনি রাখি। চা দিতে দিতে রাজ্জাক বললো , স্যার বিপিএলের টিকিট দিবেন না ?
মাঝে মাঝে আমার কাছে টিকেট আসে। এর আগে দুইবার দিয়েছি তাই আমার কাছে পাবে আশা করে।
আমি বললাম , খেলা কবে ?
বলল , ৬ তারিখে শুরু।
আমি বললাম , আচ্ছা। হাতে পেলে জানাবো।
রাজ্জাক বললো , স্যার চায়ে চিনি দিসি।
চায়ে চুমুক দিয়ে দেখলাম চিনি ঠিক আছে। চিনি না দিলেও টিকেট দিতাম। রাজ্জাক সেটা জানে।
চা খেয়েও ঝিমুনি যাচ্ছে না। রাজীব নূরের 'নীলা গাঁজা খায়' এফেক্ট কিনা কে জানে। রাজীব নূরের কি হয়েছে বুঝলাম না। সেদিন ব্যান্ডি আজ গাঁজা ! তবে ব্যান্ডি থেকে সরাসরি গাঁজাতে নামা ঠিক হয়নি। রাজীব নূর কে বলা দরকার ছিল , বলিনি।
দুপুরে মাছ দিয়ে ভাত খেলাম। ভাত খেতে খেতে একদিন দৌড় দিয়েছিলাম। সাইরেন বেজে উঠেছিল। বিপদ ঘন্টা। নয়তলা থেকে নিচে নামতে হবে। লিফ্ট বন্ধ, সবাই আতঙ্কিত হয়ে নিচে নামছে। হুড়াহুড়ি করছে। আমি ধীরে নামতে বলেও নিজেই আতঙ্কিত। চোখের সামনে সাদা ভাত ভেসে উঠলো। গরম ভাত। ধোঁয়া উড়ছে। ছোটবেলায় ঘি দিয়ে খেতাম। মনে হলো সেই ভাত আর খাওয়া হবে না। আমরা সম্ভবত মারা পড়ছি। আমার মত অনেকেই খাবার খেতে খেতে উঠে এসেছে। মোটা চালের ভাত , আলু ভর্তা , বেগুনের ঝোল , শুকনা মরিচ ভর্তা। আর কি খেতে পারবে জীবনে ?
নিচে নেমে দেখলাম অনেকেই কাঁদছে। বেঁচে থাকতে পেরেছে বলে কাঁদছে , মারা যায়নি বলে কাঁদছে। বেঁচে থাকায় অনেক আনন্দ।
গার্মেন্টস শ্রমিকদের জীবনে আনন্দ খুব একটা আসেনা। আনন্দ দেখা যায় দুই ঈদে। ঈদের ছুটিতে বাড়ি ফেরার আনন্দ।
ছুটির দিন সকালে ভাড়া করা বাস দাঁড়িয়ে থাকে নিচে। আর ওপরে সাঁজ সাঁজ রব। সবাই সেজে কাজে আসে। ছেলেরা পাঞ্জাবি , একই রকম শার্ট। মেয়েরা শাড়ি পরে , খোঁপায় ফুল গোঁজে , মেশিনে ফুল লাগিয়ে রাখে। খালারা দামি(!) শাড়ি পরে সেজে ঘুরে বেড়ায়। সেদিন লাইনচিফ, পিএমদের গলার স্বর নরম থাকে।
এরমধ্যে অনেকে আবার প্রেমিক প্রেমিকা। তাদের মধ্যে বিচ্ছেদের বিষাদ। অনেকদিন দেখা হবে না। ঈদের দিন দেখা হবে না। মনের ভেতর আনচান করে। তাই ঈদের ড্রেস পরে আসে অনেকে।
আমি এগুলো দেখি । দেখতে ভালো লাগে। চোখ ঝাপসাও হয়।
কিউসি সুপারভাইজার একদিন বলেছিলো , "স্যার এতো নরম হলে গার্মেন্টসে টেকা মুশকিল। আপনি বেশি নরম।"
আমি কিছু বলি না। মনে মনে হাসি। হাসতে ভালো লাগে। বেঁচে থাকতে ভালো লাগে। বেঁচে থাকায় ভীষণ আনন্দ।
আমার আব্বা একদিন বলেছিলেন, আনন্দ করো। কিন্তু সেই আনন্দ যেন কারো দীর্ঘশ্বাসের কারণ না হয়। মানুষের দীর্ঘশ্বাস ভয়াবহ।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে ডিসেম্বর, ২০২২ বিকাল ৫:৫৯