ছোটবেলায়, মুরুব্বীদের মুখে একটা কথা শুনতাম, ‘বেটি-মাটি’, অর্থাৎ মেয়ে মানুষকে হতে হবে, মাটির মতো নমনীয়, যার ত্যাজ থাকবেনা, প্রতিবাদী মনোভাব থাকবেনা, অনায়াসে সোয়ে যাবে অনেক কিছু (অন্যায়কেও) এবং বক্তব্য থাকবে কম। সহজ ভাষায় বলা যেতে পারে, মাটির মতো নমনীয়, ঠাণ্ডা এবং নিম্ন মুখী। অতটুকু বয়সে যুক্তি বুদ্ধি দিয়ে বিবেচনা করার মতো জ্ঞান আমর ছিলোনা, কিন্তু কথাটা মেনেও নিতে পারতাম না। সে যাই হোক, এই ‘বেটি-মাটি’ হওয়ার দরুন, সামাজিক রঙ্গ মঞ্চের গ্রিন রুমে ঘটে যায় অনেক গল্প। সেই গল্প গুলো দিয়েই নাহয় শুরু করি.........
শামীমার বিয়ে হলো এইতো সেই দিন, কীভাবে যেন পার হয়ে গেলো ১০ টি বছর। ইতিমধ্যে দুই সন্তানের মা হয়েছেন, একেবারে ভরা সংসার, স্বামীর সাথে ব্যস্ততার মাঝেও হেসে খেলে পার হয়ে যাচ্ছে দিন। সব ভালোর মাঝেও, গত দশ বছরে সেই মনের খচ খচ-টা আজও শামীমার মন থেকে যায়নি। স্বামীকে অনেক বার বলবো বলবো করেও বলতে পারেনি, শৈশবের সেই বিস্মৃতিময় ঘটনাটা……… শোনার পর তার স্বামী কি তাকে আর গ্রহন করবে???
নোভা বেশ ভাল একটা চাকরি করছিলো, বেতন, বোনাস, ফ্যাসিলিটি, কোন দিক থেকে কম নয়। কিন্তু হঠাৎ করে চাকরিটা ছেরে দিলো। বন্ধু-বান্ধব আর পরিবার থেকে আসা প্রশ্ন বাণে নোভা জর্জরিত, ‘এতো ভাল চাকরিটা কেন ছাড়লি?’ নোভা সঠিক কোন উত্তর দিতে পারে না। নোভা বুঝে পায়না, এতো প্রভাবশালী এই লোকটার কথা ও কীভাবে সকলকে বলবে? সেই দিনও পত্রিকার অর্থনীতির পাতায় লোকটার হাস্যজ্জল চেহারা দেখে ঘিন্নায় থুতু ছিটাতে ইচ্ছা করছিলো। লোকটা যেদিন নোভা কে কক্ষে ডেকে নিলো, সেই দিনের অশ্রীল ছোঁয়া গুলো, নোভাকে আজও গুমরে গুমরে কাঁদায়।
মফঃস্বল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসেছিলো মিতু, প্রথম সেমিস্টারেই প্রেমে জড়িয়ে পড়লো, সিনিয়র ব্যাচের এক ছেলের সাথে। এর পর হর হামেশাই, দেখা, কথা। একদিন বন্ধুদের ফাঁকা একটি ম্যাসে গিয়ে, দুজন দুজনের প্রতি আর আবেগ ধরে রাখতে পারেনি। মিতু প্রথমে চায়নি, এমনকি মিতু জানতোনা ম্যাসটা ফাঁকা, কিন্তু মিতুর প্রেমিক এমন কিছু আশ্বাস দিলো……… সরল বিশ্বাসে শেষ পর্যন্ত মিতু কাজটা করেই ফেলল। এই ঘটনার আজ দুই বছর, মিতু চোয়াল শক্ত করে চোখের পানি ফেলে, আজকেও তাকে যেতে হবে সেই ছেলেটার ঠিক করে রাখা কোন খদ্দেরের কাছে, আর না হলে ভিডিও লিক………
স্বামী, সন্তান সহ, উত্তরবঙ্গ থেকে ঢাকায় এসেছিলো সালমা। নুন আনতে পান্তা ফুরানো সংসারের ইতি টানতে, ঢাকায় এসেই অস্থায়ী গৃহকর্মী হিসাবে বেশ কয়েকটা বাসায় কাজ নিলো সালমা। সালমার স্বামীকে ‘কওই কাম কি নাহি’ বললে ভুল হবে না, তাই সংসার খরচ পুরোটাই পড়েছে সালমার ঘাড়ে। ম্যাডাম কিছু দিনের জন্য ঢাকার বাইরে যাচ্ছেন, তাই আগের দিনই সালমাকে পই পই করে বলে রেখেছেন, স্যরের নাস্তা-পানি, দুপুরের খাবার যেন ঠিকঠাক মতো রেডি করে দিয়ে যায়। এক মনে কাজ করছিলো সালমা, পিছন থেকে কিছু উক্তি কাটতেই, সে ঘুরে তাকাল। অমনি ম্যডামের স্বামী তার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়লো, সেই সাথে তার কাছে জানতে চাইলো, ‘কত টাকা চাই’। আটপৌরে শাড়ীটার আঁচল দিয়ে চোখ মুচতে মুচতে সালমা সেদিন ঘর থেকে বের হয়ে গিয়েছিলো, কাউকে কিছু বলতে পারেনি, সমাজ কি তাকে বিশ্বাস করবে?
এমনই অসখ্য শামীমা, নোভা, মিতু, সালমাদের গল্প খুঁজে পাওয়া যাবে আমাদের এই সমাজে। এই সমস্ত অন্যায়ের বিচার তো দুরের কথা, কজনই বা পারছেন এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে? যদিও বা কেউ মুখ খুলেছেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাকে পরতে হয়েছে সামাজিক নিয়মের রোষানলে, কারণ ‘তুমি মেয়ে মানুষ......’ ‘চুপ করে থাকো, কাউকে বলোনা’, ‘বললে বিয়ে-শাদি হবেনা’। আর অন্যায়কারী যদি হয়ে থাকেন প্রভাবশালী, তাহলে তো কথাই নাই, ‘একদম মুখ খুলবি না, জানে মেরে ফেলব’, ‘ক্যেইস উঠা নাইলে, তোর বাব, ভাই, মা, বইন কেউ আস্তা থাকবনা’। অতএব ‘বেটি-মাটি’-র কনসেপ্টে বেটির কথা গুলো মাটিতেই মিশে যায়।
ছাড়া ছাড়া এই গল্প গুলোর স্বীকৃতির অভাব কিন্তু শুধু আমাদের সমাজেই নয়, অতি আধুনিক পাশ্চাত্য সমাজেও আছে এই স্বীকৃতির অভাব, তাই প্রয়োজন পরেছিলো একটি প্লাটফর্মের, যার নাম ‘#me_too’. সুদূর অ্যাটলান্টিক মহাসাগরের ওপাড় থেকে, এই প্ল্যাটফর্মটি বিরাজ করেছে আমাদের এই উপমহাদেশেও। কীভাবে এলো? কেন হলো? এই বৃত্তান্ততে আর যাচ্ছিনা, এই ব্যপারে মোটামটি আমরা সকলেই জানি।
আপাত দৃষ্টিতে #me_too, একটি বিচার পাওয়ার প্ল্যাটফর্ম না হলেও, স্বীকারোক্তি, স্বীকৃতি এবং অন্যায়কারীকে চিহ্নিতকরণের জন্য, আমি মনে করি এই প্ল্যাটফর্মটি সময়ের দাবী। অনেকেই প্রশ্ন করেন, ‘যখন হইসে, তখন বলনাই, এতদিন পরে কেন?’ যারা এই প্রশ্ন গুলো করেন, আমি জানিনা তারা এমন কোন বিরূপ আচরণের শিকার হয়েছেন কি না। নিজেকে একটি বার ঘটনার ভিকটিম হিসাবে ভেবে দেখেছেন কি? একটি মানুষ এমন পরিস্থিতিতে কি পরিমাণ ট্রমাটাইসড হতে পারে? এই ট্রমা কাটিয়ে, নিজের সাথে অন্যায় আচরণের কথাগুলো শক্ত হাতে লিখতে পারার মতো সাহস আমাদের কয়জনেরই বা আছে, একটু ভেবে দেখবেন।
চলবে………
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে নভেম্বর, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:৫২