আমাদের বাড়িতে দুইটি পত্রিকা আসত সে সময় প্রতিদিন, একটি ইংরেজী মরনিং নিউজ, অন্যটি বাংলা দৈনিক আজাদ, আর সাপ্তাহিক চিত্রালী ও বেগম প্রকাশ হতো। প্রতি সপ্তাহে শুক্রবার মোটা তাজা প্রত্রিকা বিতরন করে যেত হকার।
বেগম পত্রিকার ঈদ সংখ্যাটি খুব মজা লাগত। সব লেখিকাদের ছবি থাকত। তাই দেখে সবাইকে চেনার চেষ্টা করতাম। বেগম পত্রিকার রিজিয়া রহমান আমার খুব প্রিয় একজন লেখক। বেগমে, বঙ থেকে বাংলা নামে একটা ধারাবাহিক উপন্যাস প্রকাশ হতো উনার লেখা। খুব কঠিন লাগত সে সময় তবু পড়তাম অনেক কিছু না বুঝেও। ইতিহাস ভিত্তিক লেখাটা আমার মায়ের বলা গল্পের সাথে অনেকটা মিল লাগত।
জীবন যাপনের গল্প বলা মকবুলা মঞ্জুরও আমার খুব প্রিয় ছিলেন। কাজী মদিনার নামটা পরিচিত ছিল যাকে পরে শিক্ষক হিসাবে পেয়েছিলাম। আমাদের পাড়ার ঝর্ণাদাশ পুরোকায়স্তর লেখা বেগমে দেখে তখন খুব পুলকিত হতাম। চেনা মানুষের নাম ছাপার অক্ষরে দেখার আনন্দটা ছিল অন্য রকম। কি সাধারন মানুষ ঝর্ণা’দি কত আদর করতেন দেখা হলে অথচ উনি লিখেন। অবাক হয়ে উনার বিশেষত্বটা বোঝার চেষ্টা করতাম। যুদ্ধের সময় পশ্চিম পাকিস্তানে বন্দী ছিলেন। ফিরে যখন আসলেন সবাই দল বেঁধে তাদের বন্দী থাকার সময় কেমন ছিলেন জানতে যেতেন। ঝর্ণাদি কি সুন্দর করে সে গল্পগুলো বলে ছিলেন। তাদের আতংকগ্রস্ত জীবন, কি ভাবে দেশে আসা যাবে তার জন্য সুযোগ খোঁজা। সেই বন্দী দশা অবস্থা, এক ক্যাম্প থেকে আরেক ক্যাম্পে নিয়ে রাখার গল্প গুলো আবার মন দিয়ে শুনতে ইচ্ছা করছে। আর এক সময় তাদের ছেড়ে দিলেও নানান জায়গায় যেতে হয়েছে, ভয়ংকর চড়াই উতড়াই পেরিয়ে। উনাকে আর বাচ্চাদের ঝুড়ির ভিতর বসিয়ে মাথায় করে পাড় করে দিয়েছিল পাহাড়ি এলাকা, কিছু পাহাড়ি মানুষ।
আগামী দিনের নাগরিক নামে একটা অংশ ছিল বেগমে। সেখানে ছাপা হতো শিশুদের ছবিও নাম। মনে আছে আমার ছোট বোন হলে তার নাম রাখার জন্য নাম পছন্দ করতে বসলাম আমি আর ভাই। যদিও কোন নাম সেখান থেকে রাখা হলো না।
চিত্রালীর নায়িকাদের ছবি কেটে জমানো ছিল আমার হবি। যুদ্ধ শেষে চিত্রালী বন্ধ হয়ে আসা শুরু হলো নতুন বেরুনো বিচিত্রা। আমরা তখন সদ্য কৈশোর জীবনের দূর্দান্ত নিজের হওয়া সময়ে। নতুন এই পত্রিকাটি হয়ে উঠল ভালোবাসার ক্ষেত্র।
বিচিত্রাটি একদম অন্য ধাচের পত্রিকা। পাঠকের পাতা দিয়ে শুরু যেখানে যে কেউ লিখতে পারে নিজের অনুভুতি। ফিচারগুলো ছিল বেশ মন কাড়া। প্রতি সপ্তাহের বিচিত্রার জন্য তখন অধির আগ্রহে অপেক্ষা করতাম।
আলমাজি নামের এক ফটোগ্রাফারের তোলা কি অসাধারন পোট্রেট দিয়ে কাভার পেইজ করা হত। সাদাকালো সেই ছবিগুলো তখনকার টিভি নায়িকার এখনও চোখে লেগে আছে। ছবিগুলো যেন কথা বলত। কোন চাকচিক্য নেই কিন্তু জীবন্ত ছবি। মনে মনে তখন থেকে ইচ্ছে পোষণ করতাম, আলমাজী যদি আমার ছবি তুলে দিতেন।
অনেক পরে কাছের একজনের বইয়ের কভারের জন্য দূর্দান্ত কিছু ছবি তুলে দিয়েছিলেন। শুনলাম তার নাকি আত্মিয় আলমাজী। সেই থেকে অনেকদিন ঘ্যানঘ্যন করেছি, বলে দাও না আলমাজীকে, আমার ছবি তুলে দিতে। তুমি কী বিখ্যাত ব্যক্তি হয়ে গেছো যে আলমাজী তোমার ছবি তুলে দিবে। এমন ভাবেই সে আমার ইচ্ছায় পানি ঢেলে দিত। কিছু মানুষ আছে পরিচিত লোকের জন্য সব সুযোগ আদায় করে নেয় আর কিছু লোক আছে পরিচিত লোকদের সবচেয়ে উপেক্ষার চোখে দেখে। বড় মানুষদের কাছে তাদের পরিচয় করাতেও লজ্জা পায়। তো আলমাজীর আত্ময়িটি ছিল এই দ্বিতীয় দলের। কোনদিনও আমার ছবি তোলার জন্য সে বলেনি উনাকে।
ভেবেছিলাম নিজেই বলব, কিন্তু এর মধ্যে তিনি চলে গেলেন আমেরিকা। অনেক বছর পর আমেরিকায় তার সাথে দেখা হলো জ্যাকসনহাইটের বাঙালি পাড়ায়। সাথে উনার আত্মিয়টি ছিল। তো প্রথম দেখাতেই উনাকে আমার ইচ্ছের কথা জানিয়েছিলাম। আর বলেছিলাম জানেন, আপনাকে নিয়ে এই লোকটির সাথে প্রায় ঝগড়া করেছি।
উনি অবাক হয়ে জানতে চাইলেন আমাকে নিয়ে ঝগড়া কেন?
আপনাকে দিয়ে ছবি তোলার খুব শখ আমার কিন্তু আমি আপনাকে চিনি না। তাই আপনার এই আত্মিয়টিকে কতবার বলেছি, একবার আপনাকে বলতে। আমাকে পাত্তাই দিল না কখনও। বরং সব সময় বলল, আপনি কখনই তুলে দিবেন না, আমার ছবি।
শুনে উনি সাথে সাথেই বললেন, ঠিক আছে আমি আপনার ছবি তুলে দিব। কাল পরশুই তুলে দিব। কিন্ত পরদিন আমার চলে যাওয়ার কথা। তাই আর হলো না ছবি উঠানো। কখনই হলো না আর শখ পুরুণ। উনিই চলে গেলেন অন্য লোকে।
বলছিলাম বিচিত্রার কথা, সেখান থেকে কোথায় গেলাম। তবে বিচিত্রার সাথে সম্পর্কটা এমনই বিচিত্র অনেক গল্প জড়িত। নতুন বিচিত্রা নিয়ে টানাটানি মান অভিমান ভাইবোনের মধ্যে কে আগে পরবে। সাবার মন জয় করা বিচিত্রা। পাঠকের পাতার লেখক থেকে সব লেখকের নাম চেনা। নাম দিয়ে এক একটা মানুষকে অনুভব করি। একদিন একটা গল্প ছাপা হলো গল্পের নাম,”না সজনী” ছোট গল্প বরাবর পাঠ করা গল্পের মতন নয়, অন্যরকম এক গল্প। নতুন এক লেখককে প্রিয় করে দিল। ইমদাদুল হক মিলনের গল্প পড়ার জন্য আগ্রহ ভরে অপেক্ষা শুরু হলো। একটা গল্প যে অনেকের মনে গেঁধে গিয়েছিল, মিলনের প্রথম লেখা গল্প বিচিত্রায় ছাপা হওয়ার পর। সেটা নানাজনের সাথে গল্পে জেনেছি অনেক সময়।
আমাদের কথা বলার এক কমন স্থান দখল করেছিল বিচিত্রা তখন। ওরিয়ানা ফ্যালাসির সেই বিখ্যাত গল্প বা মুহাম্মদ জাফর ইকবালের আকাশ বাড়িয়ে দাও মনস্তত্বের কঠিন বিষয়। সেই কিশোরবেলায় মনের ভিতর জমে থাকা হাহাকার হয়ে রয়েছে। এ্যা চাইল্ড নেভার বর্ন এর বাংলা অনুবাদ, মায়ের গর্ভের ভিতর শিশুর সাথে মায়ের কথোপকথন। বা বোহেমিয়ান আমিনের সব ছেড়ে বেড়িয়ে আকাশ ছূঁতে চাওয়া জীবনের সব আকাঙ্খার মৃত্যু, জীবনের সাথে কানা মাছি খেলার মতন গভীর অনুভূতি। কিছু কিছু উপন্যাস জীবনবোধকে হঠাৎ প্রবলভাবে নাড়া দিয়ে যায়। জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনার মতন গল্পগুলো এখনও বুকের মধ্যে এক সুনীল স্রোতের অনুভব জাগিয়ে তুলে।
রিজিয়া রহমানের দারুণ ভক্ত হয়ে গেলাম, বিচিত্রায় উনার উপন্যাস ঘর ভাঙা ঘর,রক্তের অক্ষর, অরণ্যের কাছে, শিলায় শিলায় আগুন পড়ে। এত শক্তিমান লেখক উনি অপেক্ষা থাকত প্রতি সংখ্যায় উনার একটা লেখা পড়ার। তবে বিশেষ সংখ্যা ছাড়া তেমন পাওয়া যেত না উনার লেখা।
হিরোশিমার উপর একটা লেখা পড়ে প্রথম বিস্তারিত ভাবে মাশরুম বোমের ভয়াবহতা অনুভব করেছিলাম। মনে আছে পরীক্ষার আগে লেখাটা পড়ে এমনই ভারাক্রান্ত হয়েছিলাম আমি, জ্বরে আক্রান্ত হয়ে গিয়েছিলাম মানসিক অশান্তি থেকে। খুব ইচ্ছে হয়ে ছিল হিরোশিমায় যাওয়ার। সেই যাওয়ার ইচ্ছাটা পূরন হলো শেষে, তিন বছর আগে ঘুরে এলাম হিরোশিমা। তার গল্প লিখতে হবে আরো বিস্তারিত।
জেনেছিলাম পাক আর্মির বরবরতা নির্যাতনের কথা রোকেয়া হলে। সুইপার কলোনীর মহিলাদের উপর অত্যাচারের বিস্তারিত বিবরণ। যুদ্ধের সময় নারী নির্যাতনের ঘটনাগুলো তখন সরাসরি এমন আলোচনায় আসত না। তবে বিচিত্রা পড়ে অনেক কিছ’ মনের মধ্যে ধারনা জন্মেছিল। আরো জানার আগ্রহ জেগেছিল। যুদ্ধের জন্য নির্যাতিত মানুষগুলো পাবেন বিশেষ সম্মান তাদের অসম্মানে দূরে সরিয়ে রাখছিল পরিবার, সমাজ। ভয়াবহ দুঃসহ যন্ত্রনার কোবন্ধ বয়ে বেড়াচ্ছেন কত নারী। যাদের পারিবারিক ভাবেও স্বীকৃতি দেয়া হয়নি আর। একজন মানুষ বলে ছিলেন, সব নির্যাতিতার পিতার নাম লিখে দিও আমার নাম, শেখ মুজিবর রহমান। ঠিকানা ৩২ নম্বর ধানমন্ডি।
খুব প্রিয় ছিল প্রবাসের চিঠি। প্রবাসে থাকা মানুষগুলোর সাথে পরিচয় সুত্রে বাঁধা পরে গিয়েছিলাম বিচিত্রায় লেখা তাদের চিঠির মাধ্যমে। ফুয়াদ ওসমান, সেলিম রেজা আরো অনেকের চিঠি পড়তে খুব ভালোলাগত। মস্কো থেকে নমিতা ইসলাম নামে একজন খুব সুন্দর চিঠি লিখতেন। তার চিঠি পড়ার জন্য অপেক্ষা ছিল। কেমন থাকে মানুষ নতুন দেশে, নতুন দেশের নতুন খবর, জীবন যাপনের চালচিত্র চিনতে পারতাম নতুন করে। ঠিক গোর্কির লেখার মতন নয় শংকর বা সৈয়দ মোস্তফার মতন নয় আরো আধুনিক বর্তমানকে চিনতে পারতাম।
একদিন পেলাম প্রবাসের পাতার একটা চিঠি, একাকী জীবন যাপনের ভয়াবহ গল্প। আর যদি সেই একাকীত্বে দেশের পরিবারের কোন খবর না পাওয়া যায় তা হলে কেমন লাগে। চিঠি পাওয়ার আকুলতায় নিজের নামে নিজেই চিঠি পোষ্ট করার অদ্ভুত খবর। তাকে একটা চিঠি দেয়ার তাগিদ অনুভব করলাম। অচেনা একটি মানুষের সাথে হয়ে উঠল পত্রমিতার সুন্দর সম্পর্ক। অনেকদিন তার সাথে চিঠি লেখা লেখি চলেছে। তারপর কেমন করে যেন হারিয়ে গেল সম্পর্কটা। কখনও কাউকে দেখিনি আমরা।
তবে অতি সাধারন মানুষরা এই পত্রমিতার খবর শুনেই তাকে প্রেমিক বানিয়ে বিয়ে করার জন্য সব আয়োজন করে বসল। অথচ বিষয়টা আমাদের বাড়ির সবাই অনেক সহজ এবং সুন্দর ভাবে নিয়ে ছিল। বন্ধুত্বে কখনও কোন বাঁধা আসেনি। আমরা অনেক চিঠি লিখতাম। অচেনা মানুষদের সাথে পত্র মিতালীর মেল বন্ধনটা সে সময়ে, সাহিত্য রচনার মতন ছিল আমাদের জীবনে।
বিচিত্রায় ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপন নামে একটি বিষয় যখন চালু হলো তখন দেখা গেলো অনেক সাধারন মানুষের অংশ গ্রহণ। এখানেই তসলিমা নাসরিনের নাম দেখেছিলাম। ব্যাক্তিগত বিজ্ঞাপন দিত, "আমার মরফিয়া তুমি নাও ঘুমাও মানিক সোনা ঘুমাও"। এমন ভয়াবহ বিজ্ঞাপন দেয়া থেকে বিরত করতে রুদ্রর ময়মনসিংহ গমন। আর সেখান থেকে নিজের জীবনের নিগর্মন। যে যেমন তাকে ফিরানো সহজ নয়।
এক সময় বাড়ি থেকে চলে এলাম ঢাকায়। বই খাতার সাথে বেশি মেলামেশার কারনে বিচিত্রার সংযোগ কমে গেল। বাড়ি ফিরলে এক সাথে জমানো সব পর্ব গুলো পড়তাম। গুছিয়ে রাখতাম তারিখ মিলিয়ে সব।
তারপর এক সময় সম্পর্কটা আলগা হয়ে গেল, বিজ্ঞাপনের ভাড়ে লেখার মান কমে গেল। এক সময় বন্ধও হয়ে গেল রমরমা সেই সাপ্তাহিক।মনের আর্কাইভে জমা হয়ে রইল সেই সময়ের পাঠকের মনে তার যৌবনের দূরন্ত সময়।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই মে, ২০১৯ দুপুর ২:১০