মাশরুম আমাদের পরিচিত ছিল না। খাদ্য তো নয়ই। প্রথম দেখলাম এবং খেতে শিখলাম চাইনিজ খেতে গিয়ে। বিদেশে এসে দেখলাম শুধু গোলগোল ব্যাঙের ছাতা নয়, নানা রকমের মাশরুম। এসব আমি কখনোই দেশে দেখি নাই।
বিভিন্ন স্যুপে জাপানীজ, কোরিয়ান, থাই, চাইনিজরা অনেক রকম মাশরুম ব্যবহার করে। নানা রকমের রান্নাও অনেক সুস্বাদু। ইউরোপ আমেরিকার মানুষও মাশরুম খায়, নানা রকম পদ্ধতিতে রান্না করে। ক্রীম মাশরুম স্যুপ আমার খুব পছন্দ।
বিদেশি গল্পে পড়তাম বাচ্চারা মাশরুম কুড়াতে বেড়িয়ে পরত ঝুড়ি হাতে। বনের ভিতর থেকে মাশরুম চিনে তুলে আনা সহজ তাদের কাছে। বনের ভিতর থেকে শুধু মাশরুম না, নানা রকম ব্যারি,তোলার জন্যও তারা যায়। এখন বিদেশে থেকে দেখি, এখানেও, সামারে দল বেঁধে উইকএন্ডে বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে বনের ভিতর বেড়াতে যায় পরিবার। এছাড়া স্কুল গুলো থেকে বাচ্চাদের নিয়ে যাওয়া হয় ফার্মে। ফার্ম মানে খামার বাড়ি প্রতিষ্ঠান না। হাতে কলমে চেনানো হয় বাচ্চাদের নানান রকম ফল সবজি থেকে হাঁস, মোরগ, ভেড়া ছাগল, গরু, ঘোড়া, তিতির, গাধা, ইমু এবং আরো অনেক প্রাণী তাদের আচার আচরণ।
শুধু চিরিয়াখানায় নিয়ে যাওয়া না। বাস্তব অভিজ্ঞতায় কি ভাবে কৃষি কাজ হয়। প্রাণী পালন হয়। মধু সংগ্রহ হয়। সব কিছুই প্রাইমারি পর্যায়ে বাচ্চাদের চিনানো হয়। এছাড়া মাঝে মধ্যে ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে প্রকৃতির সাথে বসবাসের সুযোগও দেয়া হয়। গাছে চড়া,রকে চড়া থেকে দোল খেয়ে এক গাছ থেকে অন্য গাছে যাওয়া। দড়ির ব্রীজ ধরে নদী পাড় হওয়া সাথে বনে জঙ্গলে নানান রকম গাছ চেনা। ফুল ফল চেনা। কোনটা ভালো আর কোনটা বিষাক্ত সবই শিখানো হয় স্কুলের সাইড ট্যুরগুলোতে নিয়ে বাস্তবতার নিরিখে। সারভা্ইভালের মতন বাঁচতে পারার মন্ত্রটা তাদের ভিতর ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। যে কোন অবস্থায় জীবন যাপন করার সহজ বিদ্যাটা তারা স্কুলের শিক্ষায় যেমন পায়, তেমন অভিভাবকরা যখন তাদের নিয়ে মাটির উপর আকাশের নিচে ট্যান্ট খাটিয়ে ঘুমিয়ে, কাঠ পুড়িয়ে খাবার বানিয়ে খাওয়া আর জলে ঝাঁপাঝাপি দৌড়া দৌড়ি করে, ধূলা মাটির সাথে কদিন কাটান। তখন অনেক বাচ্চাদের মনে সারভাইবাল হওয়ার বা প্রকৃতিকে শিখার জানার আগ্রহ বাড়ে। গাছ প্রকৃতি এবং প্রাণীর প্রতি মমতা বাড়ে শিশু মনে। বনফায়ার করার আগ্রহ খুব বেশি থাকে এখানকার কিশোর বয়সীদের মাঝে। যা আমাদের দেশে কেবল স্কাউট যারা হয় তারাই করে কদাচিৎ। বিদেশি মানুষদের আমরা দেখি অনেক এডভেঞ্চার করতে। পাহাড় ডিঙ্গায়, মরুভূমি পারি দেয়, সাগড়ে ভেসে যায় ডিঙ্গি নিয়ে, বন জঙ্গলে দুঃসাহসিক ঘোরাফেরা করে ছবি তুলে আনে। শুধু পুরুষ নয় নারীরাও সমান পরদর্শি সব এডভেঞ্চারে। মূল মন্ত্রটা গেঁথে যায় ছোটবেলায় স্কুলে পড়ার সময় বা অভিভাবকের আগ্রহে।
হোয়াইটফিশ উপসাগর থেকে সুপিরিয়র লেক ২৯ কিলোমিটার সাঁতার কেটে পার হন মেরিলিন করজেকওয়া নামের এক মহিলা। এই বিশাল হ্রদ সাপিরিয়র সাঁতার দিয়ে পাড় হওয়াটা তিনি এমনি শখে করেন সাথে মেন্টাল অসুস্থ যারা সারফিং করতে পছন্দ করে তাদের জন্য ফান্ডরেইজিং করেন। একটি হ্রদ পাড়ি দিয়েই তিনি বসে নাই ক্রমাগত একটার পর একটা হ্রদ, উপসাগর, নদী সাঁতার দিয়েই চলেছেন। মেন্টাল অসুস্থরা সারফিং করে শুনতে কেমন লাগে না আমাদের। আমাদের অনেক মেন্টাল অসুস্থ বা শারীরিক ভাবে ব্যাতিক্রম দেখতে হলে, তাকে তো আমরা ঘরের বাইরে আনতে লজ্জা পাই। অথচ বিদেশে তাদের জন্য সব সব রকমের সুযোগ সুবিধা আছে। পড়ালেখা থেকে খেলাধূলা। ঘুরে বেড়ানো আমোদ প্রমোদের।
মাত্র দশ বছরের মেয়েটি ইচ্ছা করল পাহাডের চূড়ায় উঠবে। অভিভাবক তাকে নয় মাস ধরে ট্রেনিং দিয়ে উপযুক্ত করে নিয়ে গেলেন পাহাড়ে উঠার জন্য। মেয়েটি তিন হাজার ফিট পাড়ি দিয়ে ইয়োসেমেটের এল ক্যাপ্টেন চূড়ায় উঠে সর্বকনিষ্ট ব্যক্তির পাহাড়ে উঠার রেকর্ড সৃষ্টি করল গত বছর।
২০১১ সনের সুনামির সময় ইংলেণ্ড থেকে বেড়াতে যাওয়া একটি দশ বছরের মেয়ে থাইল্যান্ডে সমুদ্রে বুদবুদ উঠতে দেখে পরিবার এবং অনেককে সরিয়ে নিয়ে যায় সৈকত থেকে। সুনামি আসার আগাম সংকেত দিয়ে। গত বছর অ্যালগনকুইন পার্কে ক্যাম্পিংয়ে গিয়ে সতের বছরের একটি মেয়ে হারিয়ে গিয়েছিল গভীর জঙ্গলের ভিতর । চার দিন পর উদ্ধার কর্মি মেয়েটিকে খুঁজে পায়। এ কয়দিন মেয়েটি একা নিজেকে বাঁচিয়ে রাখে। এই কয়টি উদাহরণ কিন্তু এমন বহু ঘটনা সব সময় শোনা যায়। বাচ্চাদের স্কুলের শিক্ষা থেকে শেখা প্রযুক্তি তারা সময় মতন কাজে লাগিয়ে থাকে। হাতে কলমে শিক্ষা এবং প্রকৃতির সাথে বেড়ে উঠা প্রকৃতির উপাদান থেকে সাহায্য নেয়ার শিক্ষাটা খুব জরুরী সবার জন্য।
আমি প্রায় সময় বাচ্চাদের ক্লাসের সাথে স্কুলের বিভিন্ন ট্যুরগুলোতে যেতাম ভলান্টিয়ার হিসাবে।
বাচ্চারা যা ছোট সময়ে শিখেছে, তাদের সাথে গিয়ে এদেশের কালচারটা কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে আমার বড় বয়সে। আমার স্কুল জীবনে ক্লাস থেকে এমন ট্যুরে যাওয়ার সৌভাগ্য কখনো হয়নি।
একদিন মেয়ে এসে বলল, আজ আমি অনেকগুলো প্রাণী দেখেছি এবং সাপ ধরেছি। কি প্রাণী? খরগোস, চিপমাঙ্ক, হ্যামস্টার, চেমেলিয়ন,টারটোল,ফ্রগ, পাইথ্ন। আই ওয়াজ হোল্ডিং দ্যা পাইথন। আই ওয়াজ হ্যঙ্গিং দ্যাট ওন মাই সোল্ডার।
হ্যামস্টার ইঁদুরের মতন দেখতে প্রাণীটা অনেক বাচ্চা শখ করে পালে। সাপও এদের পোষা প্রাণী। আমি তো কত সাপ খেলা দেখেছি কিন্তু সাপ ধরার কথা কখনো ভাবিনি। অথচ মেয়ে সাপ ধরে গলায় ঝুলিয়ে দেখে এসেছে কেমন লাগে ধরতে। কিছুদিন আগে একটা খবর দেখেছিলাম, মরুভুমিতে বেড়াতে গিয়ে এক মহিলা আহত একটি অজগর দেখে সেটা সাথে নিয়ে এসে পশু চিকিৎসা কেন্দ্রে দেন। তেমনি গত শীতে এক বৃদ্ধ লোক রাস্তায় একটি কুকুর পড়ে থাকতে দেখে তাকে গাড়িতে উঠিয়ে চিকিৎসা কেন্দ্রে নিয়ে আসেন। পরে জানা যায় কুকুরটি আসলে কুকুর ছিল না, কায়োটি ছিল। এই সব মানুষের বেশির ভাগ এমন মানবিকতার খবর শুনি। পশুদের সাথে ভালো ব্যবহার করলে পশুরা খুব ভালো বুঝে। তিনদিন ধরে দেখছিলাম একটা বাচ্চা পাখি ঝোপঝাড়ে লুকিয়ে থাকার চেষ্টা করছে আর মা পাখিটা চিৎকার করে সবাইকে তাড়িয়ে বাচ্চাটাকে লুকিয়ে থাকতে সাহায্য করছে। কাটবেড়ালি গাছে উঠে বাচ্চাটাকে ফেলে দিয়েছে । বাচ্চাটা ঠিক মতন উড়তে পারছে না। আমি বাচ্চাটার সাথে কথা বলছিলাম। ঘরে চল তোকে ভালো করে রাখি। খাবার দিব। বাচ্চা পাখিটা শুনছিল আমার কথা চুপচাপ বসে।
আমাদের শুধুই সাবধান বাণী। খাইও না, ধইরো না, যাইও না। এটা ভালো না। খারাপ হবে।
এত সাবধান বাণী শুনতে শুনতে কোন কিছু করার জন্য এক পা আর আগানো হয় না আমাদের। বেশির ভাগ মানসিকতা এক জায়গায় থেমে থাকে। প্রকৃতির মাঝে আমাদের শিশুদের বেড়ে উঠা নাই। গ্রামের শিশুরাও তেমন কিছু লতা পাতা ঘাস ফুল বনজ উদ্ভিদ চিনে না এখন আর।
আমাদের বাড়িতে সাধারন ঘরে থাকা হলুদ, আদা রশুন, দারুচিনি, লবঙ্গ এলাচ, কালিজিড়া, বসক পাতা, তুলসি পাতা, নিম এসব দিয়ে মা চিকিৎসা করতেন তাই এসব আমার চেনা। খেলতে গিয়ে চামড়া ছিলে গেলে। ঘাসের রস, গাঁদা ফুলের পাতার রস লাগিয়ে দিতাম। যদিও দরকার ছিল না তবু এই সব রস লাগিয়ে ভালোই উপকার পেতাম।
বিদেশেও দেখলাম বন্য লতাপাতার সহজ ঘরোয়া ব্যবহার। খুঁজে খুঁজে পড়ে আমিও কিছু শিখলাম। মুলানের রস কফের জন্য। প্রিমরোজ পেট ব্যথায়, ল্যাভেন্ডার চা, পেপার মিন্ট বাগান থেকে তুলে ব্যবহার এবং সংরক্ষন করে রাখাটা সহজ হয়ে গেছে আমার কাছে।
চাইনিজরা সবচেয়ে বেশি বনজ উদ্ভিদ ব্যবহার করে। কত কিছুর শুধু চা যে ওরা খায়। এবং এসবই উপকারি শরীরের জন্য। মিডিলইস্টার্ণ আর আফ্রিকানরাও অনেক রকম লতাগুল্মের ভেষজ ব্যবহার করে ঘরোয়া ভাবে। আমার ইটালিয়ান এবং নোওরোজিয়ান বন্ধুরা প্রায় সময় আমাকে বিভিন্ন এ দেশিও লতাপাতার রেসিপি দেয় যা অত্যন্ত উপকারী। এখন পর্যন্ত সব জাতীর মানুষ নিজস্ব চেনা জানা এই বিষয়গুলোর চর্চা ধরে রেখেছে নিজেদের মধ্যে এবং পরবর্তি প্রজন্মের কাছেও ছড়িয়ে দিচ্ছে।
বাংলাদেশের মানুষের মধ্যেই আদি এই বিষয়গুলোর চর্চা উঠে যাচ্ছে, আধুনিকতার ছোঁয়ায়। কোন একদল মানুষ করবে এবং বয়স্ক মানুষরা করবে যেহেতু তারা জানে। তারপর হারিয়ে যাবে। আমি এখনো অনেক কিছু চিনার চেষ্টা করি যা শেখা হয়নি আমার ছোটবেলায়। এবং ভালোলাগে নতুনকে জানতে।
মাশরুম নিয়ে কথা বলতে গিয়ে এতবড় লেখা হয়ে গেল। বাড়ির আসেপাশে গজানো কিছু মাশরুম উঠিয়ে চিকেনের সাথে রান্না করে খেয়ে ফেলেছি বেশ ভালো ছিল এবং ঠিক আছি। কারন চেষ্টা করে চিনতে পেরেছি কোনগুলো বিষাক্ত নয়।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জুন, ২০২০ সকাল ১১:১৪