ভেবেছিলাম সুন্দর একটা পোষ্ট দিব বছর শুরুর । কিন্ত সময়টা চারপাশে কেমন কঠিন বাস্তবতার। মৃত্যু তার মধ্যে একটা চির সত্য। যা থেকে নিজেকে আলাদা করা যায় না।
বর্তমান সময়ে আমাদের চেনা পরিচয়ের গণ্ডি ছড়িয়ে যাচ্ছে র্ভচুয়াল জগতে অনেক বেশি। এই ব্লগ, লিঙ্কডিন, টিকটক, ইউটিউব, ইস্টগ্রাম, ফেসবুক সব কিছুতে অনেক র্ভাচুয়াল মানুষের সাথে প্রতিদিন পরিচয়। কারো সাথে মন্তব্য বিনিময়ে সংযোগও হয়। সাক্ষাতে দেখা শোনার চেয়েও একটা মানুষের লেখা, কার্যক্রম দেখে তার সম্পর্কে বেশ একটা ধারনা নিয়ে থাকি আমরা। এই যে আমি এখানে ব্লগে লিখি। এই লেখার মাধ্যমেই আমার সাথেও আপনাদের একটা জানা শোনা। আমার মনের ভাবনা প্রকাশ থেকে আপনারা চিনেন আমাকে।
তেমনি আপনাদের একটা লেখা পড়ে আমিও আপনাদের জানি ধারনা করি একজন মানুষ সম্পর্কে। এই পরিচয়ও অনেক বড়। আমার কাছে এবং মনে করি আপনাদের সবার কাছেও। তাই আমরা ছুটে আসি ব্লগে। ফেসবুকে। অচেনা মানুষকে দেখাই নিজের ছবি, বলি নিজের কথা অথবা ভাবনার সমাহার গুলো পোষ্ট করি ব্লগে। মন্তব্যের মাঝে বিনিময় করি মতামত।
অচেনার মাঝেও একধরনের জানাশোনা ভালোলাগা। কেউ পছন্দের মানুষ হয়ে যান। কেউ অনুসরণ করেন। কেউ অপছন্দও করেন। সবটাই হয়ে উঠে অপন মনের সীমানা থেকে। ধারনা করা একজন মানুষ সম্পর্কে।
বেশির ভাগ মানুষকেই আমরা চিনি না, সরাসরি, জানিনা তার জীবন যাপন সম্পর্কে। অনেকে ব্লগে নেন ছদ্মনাম। তা থেকে অনেক সময় সে ব্যাক্তি সম্পর্কে কোন ধারনাই পাওয়া যায় না কিন্তু বোঝা যায় তার লেখা পড়ে ভাবনার মাঝে তিনি মানুষটি কেমন।
বন্ধুত্ব হয়ে যায় ঐ ছদ্মনামের মানুষটির সাথেই।
প্রতি দিন সকালে উঠে একবার ফেসবুকে চোখ বুলানো অনেক দিনের অভ্যাস হয়ে গেছে। সবটাই ছিল আনন্দ এক সময়। চেনা পরিচিতদের খুঁজে পাওয়া। ভাব বিনিময় কুশল জানা। ছবি দেখা, সাহিত্য চর্চা । কখনও প্রতিবাদও, সত্য সুন্দরের জন্য।
চেনা শোনার বাইরে অচেনা জনের সাথেও হলো বন্ধুত্ব। সাথে যদিও যোগ হলো কিছু অবাঞ্ছিতও। তারপরও আনন্দ ছিল ফেসবুকে আসায়।
অথচ গত দু বছর যাবত ফেসবুক হয়ে গেছে অসুস্থ আর মৃত্যুর খবর জানার মাধ্যম যেন।
মহামারীর কারণে কত যে মৃত্যুর খবর দিল ফেসবুক। সেটা মেনে নিলেও গত বছরের শেষের দিক থেকে এই বছর শুরু না হতেই কত গুলো আত্মঘাতি মৃত্যুর খবর জানলাম। যা মন খারাপ করে দিল খুব। এই আত্মঘাতি মানুষগুলোর বয়স খুব কম, জীবন তারা শুরুই করেনি তখনই তাদের এসে গেছে জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা। জানি না কি তাদের ভাবনা এত বড় বিধ্বংসী কঠিন মনোভাব ধরে রাখার শক্তি যোগায়। আত্মহত্যা করা সহজ কাজ না কিন্তু তারা করে ফেলে।
কিন্তু গত কয়েকদিন এই অপমৃত্যুর খবর এছাড়াও কিছু মৃত্যুর খবর শুনলাম যা খুব মন খারাপ করে দিল। যখন বাড়ি গিয়েছিলাম এই এক মাস আগে আমার ভাইয়ের মেয়ে, বোনের মেয়েকে দেখলাম মহা উৎসাহে তাদের বন্ধুর ভাইয়ের বিয়ের জন্য ব্যাস্ত। যেন তাদেরই ভাইয়ের বিয়ে লেগেছে। কোন অনুষ্ঠানে কি পরবে, কি করবে, সাজ পোশাক নিয়ে সাজ সাজ ব্যস্ততা তাদের। পরীক্ষার মাঝে ছুটে যাচ্ছে বাড়ি বিয়েতে থাকবে বলে। সারা রাতভর গল্প হাসি তামাসায় তাদের সাথে সামিল ছিলাম।
সেই বর ছেলেটি বিয়ের মাত্র একমাসের মধ্যে সেদিন মারা গেলো আগুনে পুড়ে।
বাড়ির গ্যাস হয় তো লিক করছিল ঘরে ম্যাচের কাঠি লাগাতে্ই আগুন জ্বলে উঠল। হাসপাতালে নিয়ে গিয়েও বাঁচানো গেল না তাকে। মাত্র বিয়ে হওয়া বউটার কথা ভেবে কি যে খারাপ লাগছে আমার।
চারদিন আগে ফেসবুক খুলেই তেমনি আতঙ্কিত হলাম খবর দেখে। শান্তিনিকেতনে থাকত মেয়েটি। হল জীবনে পরিচিত। খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। মাঝে মাঝে কথা হতো আমাদের নিজস্ব একটি গ্রুপে।
ডা. সুনীপা কি কারণে প্রান্তিক স্টেশনে গিয়ে ট্রেনের ধাক্কা খেয়ে ইহলোক ত্যাগ করে চলে গেল। বিষয়টা কিছুতেই পরিস্কার হচ্ছে না। সেখানে ওর কোন আত্মিয় স্বজন নেই। যে মানুষটিকে বাবা বলত, তিনি ফেসবুক স্ট্যটাস দিয়ে জানিয়েছেন এমন একটি খবর।
"সুনীপা শান্তিনিকেতনে আমার প্রতিবেশী। আমাকে বাবা বলে ডাকত। এখন আমি কলকাতায়।
আজ ভারতীয় সময় দুপুর ২/৩০- ৩টা নাগাদ প্রান্তিক স্টেশনের কাছে ট্রেনের ধাক্কায় মারা যায়। আমার কেয়ারটেকার জানাল। ওর বাংলাদেশের আত্মীয় স্বজন বা পরিচিত কারোর সম্বন্ধে কিছু জানি না। যদি তার আত্মীয়স্বজনদের আপনার জানা থাকে তবে অনুগ্রহ করে খবর দেবেন।"
এত ব্রিলিয়ান্ট একজন মানুষ তার এত ভাবনা চিন্তার সব অবসান হয়ে যাবে এমন ভাবে, ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে।
কোভিডের প্রকোপ কমলে দেশে আসবে, আনন্দবাড়ির আঙ্গিনায় সবাই মিলে জমায়েত হবো। কত স্বপ্ন, সব গল্প রেখে এই মাঝ পথে এভাবে চলে যেতে হলো নীপা তোমাকে, কেন? অনেক যুদ্ধ করেছো জীবনে না হয় আর কিছুদিন যুদ্ধ করতে। অনেকটা সামলে উঠে সব কিছু স্বাভাবিক ছিল এখন। অথচ কি কঠিন ভাবে ত্যাগ করলে এই ধরা।
টরন্টো এলাকার রাইজিং বাঙালি রিয়েলটর নাঈমা নাজারা রহমান । যেদিন তার সাথে পরিচয় হলো খুব প্রত্যয়ের সাথে বলেছিল আমি সেরা হতে চাই সবার উপরে উঠতে চাই। করছিলও বেশ ভালো। অথচ ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে অচমকা শুনলাম তার মৃত্যু খবর। মাত্র চার পাঁচ বছর কাজ করার সুযোগ হয়েছিল তার। তার মধ্যেই বেশ নাম করেছিল। উপরেই উঠছিল তরতর করে। কত আর বয়স হয়েছিল ছত্রিশ কি আটত্রিশ তার বেশি নয়। অথচ জমাল পরপারে পারি। হঠাৎ করেই এমনি বুঝি মানুষ থেমে যায়। থামিয়ে দেয় পথ চলা।
গতকাল সকালে জানলাম মাস তিন আগে চলে গেছে ব্লগ লেখক আমার এক ছোট বন্ধু/ ভাই। আদর করে আপু বলত আমাকে। নতুন কাজে যোগ দিয়ে খুব ব্যাস্ত ছিল তাই অনেক দিন কথা হতো না। গান লিখত, কবিতা লিখত। মাঝে মাঝ নিজের গানের পোষ্ট দিত সে গুলোও চোখে পরছিল না অনেক দিন। সরাসরি পরিচয় না থাকলেও ভার্চুয়াল জগতের মানুষরাও কত অপন হয়ে যায় নয়নের চলে যাওয়ার খবর শুনে সেটা উপলব্ধি করছি।
আমিও অনেক ব্যাস্ততায় ছিলাম বেশ কিছুদিন। খোঁজ নিতে পারিনি। আর খোঁজ নেওয়ার সুযোগ রাখল না। অথচ আজ শুনলাম তরতাজা তরুণ নাঈম জাহাঙ্গীর নয়ন চলে গেছে অন্যলোকে।
নয়ন খুব বিরহর লেখা লিখত গান করত। ওকে অনেক বলতাম জীবনের সুখগুলো উপভোগ করতে। কেন যেন সে দুঃখ বোধ থেকে বেরিয়ে আসতে পারত না লেখার সময় কে জানে। জানি না তার ব্যাক্তিগত সময় কেমন কাটত। তবে মনে হতো খুব সহজ সাধারন একটি ছেলে। ভালো থাকুক সবাই পরপারে।
আসলে মানুষ এভাবে কেন হারিয়ে যায়? সব সাজানো দুনিয়া রেখে একদিন ওপারে সবাই চলে যাব। তারপরও কত ভালোবাসা এই জীবনের প্রতি।
বুদ্ধ এই জরা ব্যাধী, মৃত্যু, শোকের কথা ভেবে কত বছর ধ্যানে কাটালেন। সিদ্ধার্থ থেকে বুদ্ধ হয়ে উঠলেন। মানুষকে শান্তির বাণী শুনালেন কিন্তু মানুষের সেই দুঃখগুলো তেমনই রয়ে গেলো। বয়সের আগেই কেন মানুষকে চলে যেতে হয়। এ বড় কষ্ট।
ভেবেছিলাম কােন দুঃখ কথা লিখব না। কিন্তু জীবনটাই এমন দুঃখগুলো পাশেই থাকে যখন তখন জড়িয়ে নিবে বলে। ফেসবুকে পাওয়া কষ্ট খবরগুলো তাই শেয়ার করে দিলাম।নিজের মাঝে জমিয়ে রেখে শুধুই কষ্ট বাড়ছে।
জীবনের অতি পরিচিত এই নিয়মটা মানতে খুব কষ্ট হয়। আসলে এমন খবর শোনার পর আর কিছু বলার থাকে না। কথা হারিয়েই যায়। আর গত দুবছর ধরে এমন খবরগুলো শুনে জেনে মন অনেক কঠিন হয়ে গেছে যেন। তারপরও পাথরের ভিতর জল জমে থাকে ঝরনা ধারায় বইয়ে দিয়ে শান্তনা পাওয়ার চেষ্টা।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই জানুয়ারি, ২০২২ রাত ৩:১৬