নিজের নামের প্রতি অসম্ভব ভালোবাসা মানুষের। এই নাম দিয়েই তার পরিচয়। কেউ নামটা খুব ভালোবাসে কেউ আবার অপছন্দ করে নিজের নাম। অনেকে অভিভাবকের দেয়া নাম বদলে ফেলে নিজের পছন্দে নাম রাখে অথবা কেটে ছেটে ঠিক করে ।
নিজের নাম লেখা শুরু হয় স্কুলের খাতায়। তারপর মানুষ কত জায়গায় কতভাবে লিখে নিজের নাম সারা জীবন ধরে। সমুদ্রের বেলাভূমিতে গেলে নিজের নাম লেখা খুব পছন্দের একটা বিষয়।
বালুর উপর লিখে রাখা এই নাম জোয়ারের ঢেউ এসে ভাসিয়ে নিবে জানার পরও বারে বারে মানুষ নিজের নাম সাথে প্রিয়জনের নামও লিখে রাখে।

কাগজের বাইরে প্রথম নাম লেখা দেখি দেয়ালে। চক,খড়ি, ইট, কয়লা পেন্সিল কলম কত কিছু দিয়ে কত নাম লেখা। সাথে প্লাস দিয়ে পাশে প্রিয়জনের নাম। নিজে লেখার চেয়ে বন্ধুরাই এই নাম লিখার কাজটা করত বেশি।
তারপর দেখলাম গাছের গায়ে খোদাই করে লেখা নাম। পুরো নাম না হলেও খোদাই করে লেখা প্রথম দুটি অক্ষর মাঝে একটা যোগ চিহ্ন।
এছাড়া পার্কের বেঞ্চে, বাসের সিটে, ট্রেনের জানালায়। বাথরুমের দেয়ালেও প্রচুর নাম লেখা থাকে।
কখনো দেখি ভীষণ রকম কঠিন জায়গায় মানুষ নাম লিখে রাখে। কত আগে কে সে নাম লিখেছে জানা হয় না। তবে তার স্মৃতি চিহ্ন ভাবায়। কত কষ্ট করে সে্ জায়গায় নাম লিখেছে কতটা আবেগে নিয়ে, কতটা সময় দিয়ে। উঁচু ব্রিজের বাইরের দিকে যেখান দিয়ে গাড়ি চলা ফেরা করে সেরকম জায়গায় দাঁড়েয়ে নিজের জীবনের রিস্ক নিয়েও মানুষ কত না ভালোবেসে এই নাম লেখার কাজটি করে।
একবার এক পাহাড়ে গায়ে, অনেক উঁচুতে লিখা দেখেছিলাম দুটে নাম। হয়তো ভীষন ভালোবেসে অথবা ভালোবাসা ভেঙ্গে যাওয়ার পর সে নাম লেখা হয়েছে অনেক আবেগে। পাহাড়ের উপর থেকে নিচু হয়ে ঝুলেই সে নাম লিখা হয়েছিল বোঝা যায়। এবং লিখতে হয়েছে উল্টো দিক থেকে তারপরও লিখে রেখেছে পাহাড়ের গায়ে খুদাই করে নিজের নাম। কিছু কাজ করার জন্য মানুষ অনেক বেশি আবেগ প্রবন হয়ে যায়। যার কোন ব্যাখ্যা করা যায় না।
কিছু দেশে কিছু জায়গায় মানুষের নাম লেখার জন্য জায়গা করে রাখা হয়। কোথাও সে নাম থাকে অনেক দিন, বছর পর্যন্ত কোথাও সে নাম লিখা থাকে এক বছর সময়। তারপর দেয়ালটাকে নতুন করে পরিচ্ছন্ন করে দেয়া হয় নতুন করে নাম লেখার জন্য। আবার অনেক জায়গায় বড়বড় কাগজের বোর্ড রাখা হয় নাম লেখার জন্য। এই অনুষ্ঠানে যারা এসেছিল বা কোন একটা কেম্পেইনকে সার্পোট করে নাম লেখা যায়। এমন অনেক জায়গায় আমিও নাম লিখে দেই।
নব্বইয়ের ডিসেম্বরে স্বৈরাচারী শাসক এরশাদের পতনের আন্দোলন যখন প্রবল আকার ধারন করে সাতাশে নভেম্বর ডাক্তার শামসুল আলম মিলন হত্যার পর। সেই সময়ে ঢাকার রাজপথে সাধারন মানুষ, শিল্পী, কবি, সংস্কৃতিক কর্মি, গন মানুষ নানা জায়গায় বসে পরেছিলেন প্রতিবাদে। নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থান বাধ্য করে স্বৈর শাসককে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে। গান, কবিতা, নাটক কমেডি চলছিল সকাল সন্ধ্যা রাত পর্যন্ত।
চার ডিসেম্বর এরশাদ ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়। সে বছর ষোল ডিসেম্বর পর্যন্ত মানুষ যেন মুক্তির নতুন স্বাদ গ্রহণ করেছিল।
শিল্পীরা ঘরে ফিরেছিলেন ষোল ডিসেম্বরের আনন্দ অনুষ্ঠান শেষ করে। মনে আছে, টি এসসি, শহীদমিনার, রামপুরা টেলিভিশন ভবনের সামনে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রতিদিন কাটত সে সময় আমার। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক সন্ধ্যায় হুমায়ুন ফরিদী নিজের সাদা টিসার্টে সবার নাম লিখার জায়গা দিয়েছিলেন। ঝকঝকে সাদা টিসার্টটি কিছুক্ষণের মধ্যে নাম লেখা একটি ডিজাইন অঙ্কিত টিসার্ট হয়ে গেল। কত মানুষের কত ভাবে লেখা হাতের লেখায়। একটি ঐতিহাসিক সংগ্রহও তাতক্ষনিক ভাবনায়।
কিউবার হাভানায় দুহাজার ষোল সালে আমি আমার নাম লিখে রেখে এসেছিলাম একটি দেয়ালে। সে নাম অঙ্কিত ছিল সেখানে পুরো এক বছর পর্যন্ত। পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত থাকে সে দেয়াল নাম লিখে রেখে আসার জন্য। আবার নাম লিখেছিলাম মন্ট্রিয়ালে সতের সালে একটি দেয়ালে। এটা কতদিন ছিল বা থাকবে জানতে পারিনি। তবে অসংখ্য ইংলিশ লেখার মাঝে বাংলায় নিজের নামটি লিখে দিতে ভালো লেগেছে।
পৃথিবীর কত সাগরের পাড়ে বালুকাবেলায় নিজের নাম লিখেছি যা মুছে দিয়েছে সাগরের ঢেউ । তারপরও ভালোলাগে লিখতে নিজের নাম। শীতকালে প্রচুর বরফের মাঝে খুদাই করে লিখি নাম। কখনো বেশ কিছুদিন থাকে কখনো জমে ক্রিষ্টাল হয়ে যায় আবার কখনো জলেরধারায় গলে যায়। কখনো বাতাস মুছে ফেলে বরফের উপর লেখা নাম। তবে কখনও দেয়াল, সিট পার্কের বেঞ্চ নষ্ট করে লিখিনি। লিখিনি গাছের গায়ে গাছকে কষ্ট দিয়ে। না কোন জীবনের রিস্ক নিয়েও কোথাও লিখতে যাইনি নিজের নাম। আর সবচেয়ে বড় লিখা হয়ে যায় কোন কাগজ কলম কালি ছাড়া কখনো হৃদয়ে। কেউ কেউ মনে রাখে ভালোবাসে আমার নাম। সেইটাও অনেক আনন্দের।

সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২২ দুপুর ১:৩১

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



