অনেকগুলো ভাইবোনের সাথে গা ঘেষাঘেষি করে সারাক্ষণ থাকা। ঘুমানো লম্বালম্বি ভাবে ছোট একটা বিছানায় । গায়ের সাথে গা লাগানো। দেয়ালের সাথে যে শোয় তার মনে হয় ঢুকে পরছে পাশের জনের চাপে দেয়ালের ভিতর।পায়ের দিকেও শুয়ে থাকে একজন যার জন্য পা লম্বা করায়ও অসুবিধা। বিছানার খোলা দিকে যে শোয় মাঝে মধ্যে পরেও গেছে ঘুমের মাঝে নিচে। পাশের ঘরে মা বাবা থাকত। দুখানা ঘরের ভিতর গুটিশুটি জীবন।
খাওয়ার সময় মায়ের হাড়ি থেকে যা বের হয়, এক হাতা বা আধ হাতা স্যুপ বা পরিজ, জাউ ভাত খানিকটা সবজি সিদ্ধ। ঘুরে ঘুরে সবার পাতে দেয়ার পর মায়ের জন্য কিছুই থাকে না তেমন। চামুচে একটুখানী মুখে তুলে তুলে অনেকবার খায় মাত্র তিন চার চামুচ খাবার। খাওয়া শেষ করে ফেলতে হয় চামুচ আর থালা চেটে চেটে অনেকক্ষণ ধরে। তারপর পানি খেয়েই পেট ভরে ফেলা। খিদের কুমির হা করে নাচতে থাকে পেটের ভিতর। মাঝে মাঝে ঘরঘর শব্দ তুলে, মনে হয় গাড়ি চলছে।
অভাবের সংসারে তবু কিভাবে যেন বেড়ে উঠে তারা ছয়টি সন্তান । মানুষের মতনই দেখতে লিকলিকে হাত পা শরীর, নিয়ে। টলমল করে চলে। ছোট বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে বসে থাকতে হয় মা বাবা যখন কাজে যায়। একটা দুটো বিস্কুট ফল মুখে দেয় কান্না করতে থাকলে। এক সময় কান্না করতে করতে ঘুমিয়ে পরে।
এভাবে ছয় সাত বছর হলেই একজন একজন করে কাজে লেগে যায় মা বাবার সাথে। বাজারে দোকানে মা কাজ করে সেখানে বসে বাসন ধোয়। কখনো জিনিস এগিয়ে দেয়। এভাবেই মেয়েটাও একদিন কাজে লেগে যায়। সে ছিল তিন নাম্বারে বড় দুই বোনের পরে ও তিন নাম্বারে তারপর ভাই দুজন । সবার ছোট আরো একটা বোন।
বাবা নানা রকম কাজ করে যখন যেটা পায়। কখনো দূরে চলে যায় বাড়ি থেকে। কয়েকদিন পরে আসে। এভাবেই দিনগুলো পার হচ্ছিল।
বড় বোন দুটো একসময় বেশ ভালো কামাই করতে শুরু করে। প্রায় সময় দু হাত ভরে খাবার নিয়ে আসে। ছোট শিশু গুলো খাবারের উপর ঝাঁপিয়ে পরে। মা বাবার চেয়ে বোনগুলোকে বেশি ভালোবাসে শুধু পেট ভরে খেতে পারার জন্য।
ওর বয়স পনের এখন বুঝতে পারে বড় বোনগুলোর কাজ গুলো আসলে অন্য রকম। এই কাজ করে তারা বেশি আয় করতে পারে। মাঝে মাঝে রাতের বেলায় বাড়ির বাইরে কাটায়।
ওদের মতন পরিবারের সবার গল্পগুলোই একরকম। নিজের শরীর বিক্রি করা কিশোরী বয়স থেকেই স্বীকৃত তাদের সমাজে। যতদিন পারে মেয়েরা শরীর বিক্রি করে পরিবারে সাহায্য করে। তারপর এক সময় বিয়ে করে নিজেদের ঘর সংসার করে। স্বামী চাইলে তখনও তারা শরীর বিক্রি করতে পারে।
তাদের দেশে বহু বিদেশি লোক আসে শুধু মেয়েদের সাথে সময় কাটাতে। এরা অনেক টাকা দেয়। আসলে টাকাটা অনেক না। কিন্তু ডলারের হিসাবের টাকা ওদের দেশের হিসাবে অনেক বেশি মনে হয় তাদের কাছে। অন্যদিকে তাদের ক্রেতাদের কাছে এই ডলার খুব কম। নিজের দেশের একটা মেয়ের সাথে সময় কাটাতে তাদের অনেক বেশি খরচ করতে হয়।
দেশের বড় একটা আয়ের সোর্স মেয়েদের শরীর বিক্রির এই ইনকাম। সাথে পর্যটনের দেশ হিসাবে পরিচিত বিশ্বের কাছে তাদের দেশ।
মেয়েটার স্কুল শেষ হয়েছে বড় বোনরা প্রায় বলে তুই আমাদের সাথে চল, কাজে লাগিয়ে দেই। কিন্তু নিজের শরীর বিক্রির ঐসব কাজ করতে ভালোলাগে না। স্কুলে আয়ার কাজ করে। ছোট বাচ্চাদের দেখাশোনার কাজ করে। রান্না করা, ঘর পরিস্কারের কাজ করে। বোনদের মতন বিশাল অংকের আয় হয় না তবে কিছুটা আয় করতে পারে।
এই সময় ওর চেনা হয় একজন মহিলার সাথে সে জানায় সে বিদেশে ঘরের কাজ করার জন্য মেয়েদের পাঠায়। তবে তাদের ট্রেনিং নিতে হয় এবং ভালো কাজ পারতে হয় বাড়ি ঘর ঝকঝকে তকতকে রাখা শিখতে হয় বিদেশের সিস্টেমে। মনপ্রাণ দিয়ে ঘরের কাজ শেখার কাজে নিজেকে নিবেদিত করে।
দু বছর পরে যখন ওর বয়স আঠারো সে সময় ওর সুযোগ হয় বিদেশে আসার। ইহুদি এক দম্পতি তাদের বাচ্চা দেখা শোনার কাজের জন্য ওকে ক্যানাডায় নিজেদের কাছে নিয়ে আসতে পছন্দ করে।
ওরাই কাগজপত্র পাসপোর্ট বানানোর সমস্ত কাজ করে এবং খরচ পত্র দেয়। মাসের বেতন হিসাবে বিরাট অংকের টাকা পয়সাও ওকে দেয়। বাবা মা খুশি বোনরাও খুশি। ও নিজেও অনেক খুশি অন্তত্ শরীর বিক্রির কাজ করতে হবে না। যদিও এই কাজ করার জন্য ওদের সমাজে কেউ আঙ্গুল তুলে চিহ্নিত করে না। খারাপ কথা বলে না। তবু ওর নিজের কাছে কখনো ভালোলাগেনি।
মেয়েটির সাথে আমার যখন পরিচয় হয়েছিল। তখন তার বয়স পঁয়ত্রিশ বছর। সে একটা কোম্পনিতে সিপিং রিসিভিং ডেলিভারি দেখাশোনার কাজ করে।
শ্যাভিভান নিজের মুখে যখন বলছিল তার জীবনের গল্প অবাক হয়ে গিয়েছিলাম কত রকম পরিবেশ থেকে মানুষ আসে কত রকমের, জীবনযাপন এই সংসারে মানুষের।
ইহুদি পরিবারে দশ বছর ছিল সে। ওদের পরিবারে থাকাকালীন সময়েও নিজের মতন স্বাধীন ভাবে ঘোরাফেরা করতে পারত ও। প্রতিদিনের কাজের পর বাইরে যেতে পারত। দেশে ঘুরতে যেত প্রতি বছর। সব খরচ ঐ পরিবার থেকে দেওয়া হতো। ওদের আটটি বাচ্চার ছয়টিকে সে বড় করেছে আদর যত্ন করে। ছোট বাচ্চার যখন বারো বছর বয়স তখন ঐ পরিবারের লোকজন, ওকে কোম্পানির কাজ দিয়ে মুক্ত করে দিয়েছে স্বাধীন জীবনে।
এর কয়েক বছর আগে থেকে একটা ছেলের সাথে ওর পরিচয় হয়েছিল। ছেলেটি ক্যাথলিক পরিবারের। ইউরোপিয়ান ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে এসেছে তার পরিবার। দুই ভাইবোনের ছোট ছেলে। ছেলেটির বাবা একটি অফিসে একাউনটেন্ট মা হাই স্কুল শিক্ষক । ছেলেটি ইঞ্জিনিয়ার।
তিনচার বছর প্রেম করে বিয়ে করেছে তারা । দুটো বাচ্চা নিয়ে মহা সুখি জীবন তাদের। বছরে দুবার ঘুরতে যায় অন্য দেশে। একবার ছেলে মেয়েসহ যায় একবার শুধু স্বামী স্ত্রী মিলে যায় হানিমুন করতে।
থাইল্যাণ্ডের মেয়ে শ্যাভিভান এবং ক্যানাডার ছেলে ম্যাথুর সংসারে গিয়ে আমার খুব ভালোলেগেছে। শ্যাভিভানকে এখন কোন কাজ করতে হয় না। ওর স্বামী শ্যাভিভানকে ওদের পরিবার সম্রাজ্যের কুইন করে রেখেছে।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই আগস্ট, ২০২৩ ভোর ৫:৩১

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


