আট তারিখ রাত বারোটার পর, প্রায় আড়াইটায় ঘুমাতে যাওয়ার আগে আকাশে তাকিয়ে তারাদের সাথে দেখা করে গেলাম। তারারা বেশ ঝকমক করছিল আকাশে। গত কয়েক দিনের তুমুল মেঘ, বৃষ্টি, বরফের পর দুদিন ধরে উজ্জ্বল রোদের আলো হচ্ছে তাই দেখে মনটা ভালো ছিল। সূর্য গ্রহণ ভালোভাবে দেখা যাবে।
গভীর রাতে ঘুমাতে গেলেও সকালের দিকে ঘুম ভেঙে গেল। জানালার বাইরে তাকিয়ে মনে হল বাইরে আলো কম আকাশটা বেশ অন্ধকার। সূর্যগ্রহণ কি লেগে গেছে , আমি দুপুর পর্যন্ত ঘুমাচ্ছি!
সময় দেখে বুঝলাম এখন কেবল সকাল। অনেক দেরি আছে আরো ছয়, সাত ঘন্টা পরে হবে গ্রহণ। তাহলে বাইরে এত অন্ধকার কেন?
মুখ গোমড়া আকাশ বাইরে, ঘন অন্ধকারে ছেয়ে আছে পৃথিবী। কিসের জন্য এত মন খারাপ হয়ে গেল এই ভোরবেলা প্রকৃতির? কখন এত মেঘের আনাগোনা হলো। কখন এরা এসে জোড় হলো আমার মাথার উপরে সূর্য ঢেকে দেওয়ার জন্য বুঝলাম না।
আমারও মন খারাপ হয়ে গেল আকাশ দেখে। তাহলে কি সূর্য গ্রহণ দেখার সুযোগ মিলবে না । এটা কেমন অবস্থা হলো।
আমার অবস্থান থেকে এক ঘন্টা দূরের জায়গায় কেমন থাকবে আকাশ, আবহাওয়া বার্তার ঘন্টা হিসাব চেক করে দেখলাম। দুই ঘন্টা দূরের জায়গায় আকাশ কেমন তাও দেখলাম। ঘন মেঘে ঢেকে আছে সব, কোথাও নীল আকাশ ঝকঝক করছে না সূর্যের আলোয় । সব জায়গাতেই মেঘ, সরে যাবে বেলা তিনটার পরে যখন পূর্ণগ্রহণ শেষ হবে। কি একটা অদ্ভুত ব্যাপার ছোটাছুটি করে দূরে গিয়ে জায়গা পরিবর্তন করে কি লাভ হবে ।
তার চেয়ে বাসায় থাকি অন্ধকার কতটা অন্ধকার হয় সেটুকু উপভোগ করি। চাঁদের ছায়ায় সূর্য ঢেকে যাওয়ার পাশাপাশি আরো অনেক কিছু পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ হবে শুধু এইখানে। অন্য জায়গায় গেলে মানুষের সাথে গেদারিং, চিৎকার হইচই চাঁদের ছায়ায় ঢাকা সূর্যটাকেই দেখা যাবে। কিন্তু এখানে উপভোগ করার সুযোগ আছে প্রকৃতি, প্রাণীকুলের অবস্থানও। তাই বাড়িতে থাকাই আমার পছন্দ।
বেলা বারোটার দিকে মেঘের ফাঁকে ফাঁকে খানিক নীল আকাশ উঁকি দিচ্ছিল। সূর্যের আলোটা বড় বেশি প্রখর দেখাচ্ছিল। আরো দুই ঘন্টার মধ্যে আকাশ পুরো পরিস্কার হয়ে যাবে এমনটাই আশা করছিলাম।
তখনো বেরিয়ে গেলে দক্ষিণের দিকে বা পূবের দিকে অন্য কোথাও যেতে পারতাম। কিন্তু কেন যেন এই ছুটাছুটি করতে ভালো লাগলো না। বরঞ্চ বাইরে গিয়ে প্রকৃতির সাথে প্রকৃতির চেহারা ক্ষণে ক্ষণে কি ভাবে বদলে যায় তাই দেখার অপেক্ষায় রইলাম। উষ্ণ সুন্দর একটা দিন।
প্রাণীদের অবস্থান দেখতে লাগলাম। এখন পর্যন্ত সবকিছু ঠিকই আছে স্বাভাবিক। আকাশের মেঘটা সরে যাচ্ছে না বরং আরো যেন ঘন হয়ে উঠছে। এমন সময় দেখলাম, আস্তে আস্তে আঁধার শুরু হয়েছে।
দূরে জঙ্গলের ভিতরে কায়োটি ডেকে উঠলো হঠাৎ করে। একপাল টারকি ছুটে গেলো মাঠের ভিতর দিয়ে। যারা কুড়িয়ে খাচ্ছিল পরে থাকা ফসল মাঠে।
খরগোশ আর কাঠবেড়ালি ছুটছে এদিক সেদিক। হয়তো ওরা ভাবছিল আজ ডিনার করা হলো না এখন কেন ঘুমাতে যেতে হবে। দিনটা আজ এত ছোট কেন?
বেরিয়ে এলো রেকুন পরিবার। আকাশের দিকে মুখ তুলে দেখছে। ওদের ঘরের ভিতর মনে হয় ঘুটঘুটে অন্ধকার নেমেছে তাই রাত হয়েছে মনে করে ওরা বেড়িয়ে এসেছে এখন ঘরের বাইরে। তাহলে কিছু খাবার খোঁজা যাক। পাখিরা কাকলি শুরু করে দিল সন্ধ্যায় নীড়ে ফেরার সময় যেমন ডাকে তেমন করে। ওদের অস্থিরতাটা একটু বেশি মনে হচ্ছে।
সূর্য তখন অর্ধেকটা ঢাকা চাঁদের আড়ালে। মেঘের ফাঁকফোকর দিয়ে কিছুটা দেখতে পাচ্ছি পুরোটা নয়। বরং আলো খুব বেশি জ্বলছিল যেন মেঘের মাঝে।
আমি শুধু ঘুরে বেড়াচ্ছি অনেকটা জায়গা জুড়ে। দেখছি চারপাশের পরিবর্তন গাছ, প্রাণী এবং পরিবেশের। যে ফুলগুলোকে গতকাল বিকেল পাঁচটায় পরিপূর্ণ চোখ মেলে হাসতে দেখেছি। গ্রহণ লাগা সময়ে দুপুরবেলা তারা চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে যেতে শুরু করল । চারপাশের প্রকৃতির পরিবর্তনগুলো আমি বেশ বুঝতে পারছি। আমি উপভোগ করছি একটু একটু করে প্রভাব পড়ছে চারপাশে।
মিলন হবে চাঁদ আর সূর্যের লক্ষ কোটি মানুষ তাকিয়ে থাকবে আকাশে, তাদের এই মিলন দেখতে। মেঘের কাঁথায় তাই পুরোটা জায়গা ঢেকে দিয়েছে, মনে হল আমার কাছে। এই মিলন তারা আড়াল করে রাখতে চায়। চার ঘন্টা সময় একটু একটু করে তারা কাছে আসবে। একটু একটু করে তারা একে অপরের সমস্তটা জড়িয়ে ধরবে। তিন মিনিট সময় গভীর আলিঙ্গনে থাকবে চাঁদ সূর্য তারপর আবার সরে যেতে থাকবে অন্য দিকে। যতটা সময় ধরে কাছে আসা ততটা সময় লাগবে দূরে যেতে।
শুরুর সময়টা মেঘের আড়াল ছিল ঘন। পরে টেলিভিষনের খবরে দেখলাম অনেক মানুষ ছুটছিল, এদিক থেকে ওদিকে মেঘহীন আকাশ পেতে। বিষয়টা সহজ ছিল না। দক্ষিণে ম্যাক্সিকো থেকে ডালাস মেঘমুক্ত ছিল। উত্তরে কর্নওয়েল শহর থেকে নোভাস্কসিয়া প্রভিণ্স ছিল মেঘ মুক্ত। এছাড়া মধ্যবর্তি বিশাল বিস্তীর্ণ এলাকা মেঘের কাথার নিচে লুকিয়ে ছিল চাঁদ সূর্যের মিলন। ছেঁড়াফাটা মেঘের ফাঁকফোকর দিয়ে কিছুটা চোখের সামনে এসেছে।
প্রথম কাছে যাওয়ার অনেকটাই আমি সূর্যের দেখা পেলাম না। কিন্তু আঁধার হয়ে আসার সাথে প্রাণীদের ব্যাস্ততা অনুভব করতে থাকলাম।
তবে পুরো ঢাকা সময়টার কিছু সময় মেঘ সরে দেখার সুযোগ করে দিল আমাকেও। চোখে পড়ল এবং সে সময় চারপাশে প্রাণীকুলের অস্থিরতাটা আমাকে আরো বেশি করে জানান দিল প্রকৃতির উপর কি প্রভাব পড়ছে। পাখিদের হইচই, কায়োটির ডাক যেন সন্ধ্যার প্রহর তাদের কাছে। অন্ধকার ঘনিভূত হওয়ায় তাদের ব্যস্ততা ও মুখরিত পাখির কলকাকলি শোনতে পেলাম।
উইন্ড টারবাইনের মাথায় লাল লাল আলোগুলো ঝলমল করতে লাগলো। সেন্সর বসানো এই মেশিনগুলো অন্ধকারে আপনা অপানি জ্বালায় বাতি। আবার দিনের আলো ফুটলে নিভে যায়।
এক ঝাঁক হাঁস ডাকতে ডাকতে ছুটতে ছুটতে এসে পানিতে নামল। ওরা এখানেই থাকবে আজ রাত নাকি অন্য কোথাও যাবে ঠিক করতে পারছিল না। পানিতে কয়েকটা চক্কর দিয়ে উড়ে গেলো অন্য কোথাও। আরো একদল এসে নামল তারপর। কয়েকটা হাঁসের দলের ভয় পাওয়া বা অস্থির হওয়ার সাক্ষী হয়ে রইলাম আমি।
মানুষরাও দেখার আগ্রহে মেঘ পেরিয়ে নীল আকাশে উড়ে গিয়েছিল। প্রাইভেট জেট নিয়ে অনেকেই উড়ছিল আমার মাথার উপর। ওদের যান্ত্রিক শব্দটা খুব বিরক্ত করছিল আমাকে।
দিগন্তরেখায় একটা গোলাপি আভা ছড়িয়ে পড়ল অদ্ভুত সুন্দর রঙ। উত্তাপ সারাদিনই খুব সুন্দর ছিল। সূর্য আড়ালে চলে যাওয়ার পর, উত্তাপ ঝুপ করে নেমে গেল কয়েক ডিগ্রি নিচে। একটু শীত শীত লাগছিল তখন।
হাঁসগুলো আর পাখিগুলোর অস্থিরতা আমি অবাক হয়ে দেখলাম। একটু আগেই হাসতে থাকা ফুলগুলো কেমন চোখ বন্ধ করে ফেলেছে রাতের ঘুমের জন্য।
দুপুরবেলা ফুলগুলো পাপড়ি বন্ধ করে ফেলেছিল।
আগের দিন বিকাল পাঁচটায় তোলা ফুলের হাসি।
অনেক ফুল রাতে বন্ধ হয়ে যায় সকালে চোখ মেলে তাকায়। নাইটকুইনে কলি থাকলে হয়তো দেখতাম ফুটে গেছে।
প্রকৃতির উপর বিশাল পরিবর্তন আনল ঢেকে যাওয়া সূর্য।
ঢেকে যাওয়া সূর্যের চারপাশে যে আলো গোলাকার বৃত্ত হয়ে ছড়িয়ে ছিল তার উজ্জ্বলতাও কম নয়, অনেকটা আলোকিত করেছিল ঠিক যেন সন্ধ্যা হওয়ার আগের সময়।
সূর্যটা পূর্ণ ঢেকে যাওয়ার পরে আবার বেরিয়ে আসতে থাকলো এবং তখন তার তীর্যক আলো, অনেক বেশি ছড়াচ্ছিল। সূর্যের শক্তি যে কত তাই প্রমাণ করে।
প্রথমা চাঁদের মতন থেকে পূর্ণিমার রূপ নিল ধীরে ধীরে সূর্য ছায়ার ভিতর থেকে বেরুতে বেরুতে। ফিরে এলো সন্ধ্যা থেকে আবার একটা পূর্ণ দিন।
পাখিগুলো ঘরে ফেরার জন্য যে কিচিরমিচির করছিল। তারা যেন আবার সকালবেলার জেগে ওঠার গান গাইতে শুরু করলো কি অদ্ভুত অনুভূতি।
আমি অসম্ভব ভাবে ধারণ করলাম আমার মধ্যে এই পরিবর্তন গুলো। প্রাণীদের এই বিষয়টা আগে কখনো উপলব্ধি করিনি। প্রাণীদের মধ্যে যে পরিবর্তনটা আসে, তারাও যে অন্ধকার দেখে, আলো দেখে। এমন কি ফুলের মাঝে যে ভীষণ একটা ব্যতিক্রম দেখলাম, চোখের সামনে নিমিষে তারা খোলা থেকে বন্ধ হয়ে গেল। এই পর্যবেক্ষণটা আমার নিজের কাছে খুব ভালো লাগলো। নতুন করে জানলাম সরাসরি দেখে, যা অন্য কোথাও আমি পেতাম না আমার এই চেনা জায়গা ছাড়া । গ্রহণ তো প্রতিবছর হয় বিভিন্ন জায়গায়। সতের সালেও আমার বাড়ির কাছে চলে এসেছিল পুরো নয় আংশিক। আবার পূর্ণগ্রহণ দেখতে হলে ছাব্বিশ সালের অপেক্ষা করতে হবে যেতে হবে অন্য কোথাও।
প্রকৃতির ভিন্নতার সাথে সময় কাটানো মন্দ না। আসলে চাঁদ সূর্যেরও লজ্জা আছে তাই ওরা ঢেকে নিয়েছিল মিলনের সময় নিজেদেরকে ।আড়াল করেছিল মেঘের আড়ালে অথবা মেঘ নিজেই এসে তাদের আড়াল করে দিয়েছিল। অদ্ভুতভাবে ঠিক সূর্য গ্রহণ শেষ হওয়ার সাথে সাথে সরে গেলো সব মেঘ, ঝকঝকে আকাশ মেঘবিহীন বিষয়টা ভাবাচ্ছে আমাকে।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৫৯