সেদিন মানে এইতো একদিন আগে হঠাৎ করে শান্তুনু কে গ্রামের বাড়ি যেতে হলো। এর আগে গিয়েছে তবে সে কারণ ভিন্ন।
প্রথমে যাওয়ার কোন ইচ্ছে ছিল না পরে অবশ্য মায়ের জোরাজোরিতে যেতে হলো কারণ তেমন কিছুই না ওর এক কাজিনের মেয়েকে দেখতে আসবে আজ ফাইনাল কথা হবে।সব ঠিক হলে খুব দ্রুত বিয়ে দেয়া হবে।শান্তনু অবশ্য ওর মাকে বলেছিল, যাব আর আসব থাকতে বলো না। করোনার টাইম ! যদিও ভেকসিন নেয়া আছে ওদের।
মায়ের এক কথায় নড়ে গেল ওর ভেতর "ওখানে তোর বাবা শুয়ে আছেন! " তাঁকে দেখতে যাবি না। সেই যে মানুষটাকে রেখে আসলাম আর তো তেমন যাওয়া হলো না। শান্তনুর চোখ ছলছল করে উঠল।
যেদিন ওর বাবা মারা যায় সেসময় ও দেশের বাইরে ছিল হঠাৎ করে ফোন আসল ওর বাবাকে হাসপাতালে নেয়া হয়েছে স্ট্রোক করেছে তবে ডাক্তার বলল, ঘাবড়ানোর কিছু নেই। ঠিক হয়ে যাবে। আপনারা যথা সময়ে নিয়ে এসেছেন। আমরা চেষ্টা করছি পুরোটা আল্লাহর হাতে।
শান্তুনু ঘন্টা খানেক বাবার সাথে ভিডিও কলে কথা বলল জ্ঞ্যান ফেরার পর। তিনি হেসে হেসে কথা বলার চেষ্টা করছেন আর বারবার বলতে ছিলেন " আমার কিচ্ছু হয়নি ! " এইতো কয়দিন থাকব! তারপর বাড়ি ফিরছি। তুই তোর কাজ শেষ করে আয়। " টেনশন করিছ না।
শান্তনু, মায়ের সাথে কথা বলল, ওর মা শুধু বলল, ডাক্তার বলেছে, চিন্তা না করতে ঠিক হয়ে যাবে তোর বাবার প্রেসার নীচে নেমে গেছে। এইটা একটা মাইল্ড স্ট্রোক ! রেস্ট নিলে দাওয়াই খেলে ঠিক হয়ে যাবে ইন শা আল্লাহ।
শান্তুনু পরে ডাক্তার সাহেব এর সাথে কথা বলল, তিনি ও আশ্বাস দিলেন চিন্তা করতে না করলেন। বললেন দোয়া করুন। আমরা চেষ্টা করছি।ইন শা আল্লাহ উনি ঠিক হয়ে যাবেন। তখন শান্তুনুর ওখানে বিকাল বাংলাদেশে এগারো টা রাত।
শান্তুনুর ভেতর খচখচ করতে লাগলো। মা একা ওখানে আর গ্রামের সেই কাজিন ছিল সর্বক্ষণ ছায়ার মতন ।
আবার একদিকে লকডাউন, করোনা! কি হচ্ছে চিন্তায় ঘুম আসল না মেলা রাত অব্দি জেগে ছিল।ওর বাবার সাথে যত স্মৃতি রয়েছে সব যেন ওর সামনে ভেসে উঠছে এক এক করে।একবার ফোন দিয়েও দিল না। সারাদিন ওরা ছুটাছুটি করছে এখন একটু বিশ্রাম দরকার। এই ভাবতে ভাবতে ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পড়ল।
সকাল শান্তুনুর সময় দশটার দিকে ফোন আসল শান্তুনু ফোন ধরে যা শুনলো তা কেউ শুনতে চায় না। দিনের শুরুতে ঘুম ভাংগার পর এমন খবর তাও কি না নিজের জন্মদাতা না ফেরার দেশে! উনি আর ফিরবেন না আর কথা হবে না। আর কোনদিন কথা হবে না। নিজে চলে যাচ্ছে তবুও বলছে "টেনশন করিছ না ! " এই বুঝি বাবা! যিনি হাজারো টেনশন মাথায় রেখে ঘুমায় হাসে।মৃত্যুর আগেও সন্তানদের একবারও টেনশন নিতে বারণ করেন।
শান্তুনু আসতে পারেনি করোনা আরও নানান ঝামেলা সরকারি নিয়ম কানুন সবচেয়ে বড় কথা ও সময় ফ্লাইট ই ছিল না। সারাদিন হোটেলে ছিল একা।কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলিয়ে ফেলছে। আর বাবা বাবা বলে চিৎকার করছে। বিদেশ বুঝি এই! কোম্পানির সবাই শান্তনা দিল আর ফ্লাইট চালু হলে জলদি যেন ফিরে আসে। আপাতত কাজে যাবার দরকার নাই। অন্যরা ম্যানেজ করে নিবে। এসবের ভেতর কেটে গেল সময়।
ভিডিও কলে বাবার জানাজায় শরিক হলো। শেষবার বাবার হাসি মাখা মুখটি দেখল। কি সুন্দর হাসি মুখে ধরে রেখেছে। তারপর থেকে শান্তুনু সকালে ফোন আসলে আঁতকে উঠে। কিছুক্ষণের জন্য ওর সারা শরীর অবশ হয়ে যায়।দম বন্ধ বন্ধ লাগে। দেশে ফিরেই সোজা এয়ারপোর্ট থেকে গ্রামের বাড়ি । বাবার কবরের কাছে যেয়ে হাউমাউ করে কান্না ! সবাই শান্ত হতে বলল। সেই কাজিন তখন ওর পাশে পাশে ছিল। এমন করে কয়েকবার গ্রামে গিয়েছিল তারপর সেই কাজের ব্যস্ততায় আর তেমন যাওয়া হয়নি।
প্রতিটি সেকেন্ড ও বাবাকে মিস করে তবুও লোক দেখানো একটা হাসি ঠোঁটে রেখে অভিনয় করে যাচ্ছে রোজ।যা কেবল শান্তনু জানে।আজ ওর মায়ের কথায় আবার দুটি চোখ নোনা জলে ডোবা এক বর্ষার দিন !
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০২১ দুপুর ২:২১