
বাংলাদেশের উদ্ভুত পরিস্থিতি কাঁটাতারের এপারের অনেক বাঙালিকেই বেদনাবিদ্ধ করেছে। ওপারের যতটুকু সংবাদ এই পারে এসে পৌঁছিয়েছে। শুধু বাঙালি বলেও নয়। সাধারণ মানুষ হিসাবেই দুঃখ আতঙ্ক এবং কিছুটা পরিমাণে হলেও ক্ষোভ এই পারের মানুষকে বিচলিত করে তুলেছে। বিচলিত হওয়ার আরও একটা বড়ো কারণ ঘটে গিয়েছে। প্রায় দিন চারেক বাংলাদেশের সাথে ইনটারনেটের কোন রকম সংযোগ না থাকায়। কেউই জানে না। সেই সময়ে ওপার বাংলার পরিস্থিতি ঠিক কতটা পরিমাণে ভয়াবহ হয়ে উঠেছিল। শুধু জানা গিয়েছিল সরকার সেনাবাহিনীর সাহায্য নিয়েই উদ্ভুত পরিস্থিতি মোকাবিলায় এগোতে বাধ্য হয়েছিল। সারাদেশে কারফিউ জারি করে সেনা নামিয়ে এবং ইনটারনেট সংযোগ বন্ধ করে দিয়ে বেসামাল পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছিল। আর তারপরেই ব্লাকআউট। প্রযুক্তি বিপ্লবের হাত ধরে ইনটারনেট পরিসেবার মাধ্যমে বস্তুত বিভিন্ন সোশ্যাল সাইটগুলির উপরে নির্ভর করে কাঁটাতারের দুই পারের বাঙালি পরস্পরে সাথে একটা যোগাযোগ সংযোগ বজায় রাখতে পারে। এটা একুশ শতকের দান। বিগত শতকে সেই সুযোগ ছিল না। এই যে যোগাযোগ সংযোগ, সেটি কিন্তু ব্যক্তিস্তরে পৌঁছিয়ে দিয়েছে এই প্রযুক্তি বিপ্লব। ফলে দুই পারের বাঙালির ভিতরে আজ আর কাঁটাতার কোন অমোঘ দূরত্বের সৃষ্টি করতে পারছে না। পরস্পর পরস্পরের সাথে নিমেষের ভিতরেই খোঁজ খবর করতে পারছে। হঠাৎ দ্যুম করে সেই সুযোগ এবং সুবিধের রাজপথটা ভ্যানিশ হয়ে গেলে সত্যিই যেন বুক কেঁপে ওঠে। না জানি কি শুরু হয়েছে সেখানে। ফলে এপারের বাঙালির অনেকেই এই কয়দিনে সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে তাঁদের আশঙ্কার কথা নানাভাবে ব্যক্ত করছিলেন। আর অনবরত খোঁজ নিচ্ছিলেন, বাংলাদেশের নেট চালু হলো কিনা।
স্বস্তির কথা। অবশেষে সেই নেট চালু হয়েছে। একদম সম্পূর্ণ ভাবে না হলেও অনেকটা পরিমাণে ফিরে এসেছে ইনটারনেট সংযোগ। শোনা গিয়েছে, প্রথমে ব্রডব্যান্ড নেট সংযোগ চালু করা হয়েছে সে দেশে। মোবাইলে নেট সংযোগ এখনো নাকি চালু করা হয়নি। পরিস্থিতির উপরে নির্ভর করে আগামী রবিবার নাগাদ সেই পরিসেবাও চালু হয়ে যেতে পারে। প্রায় চারটি দিন। একটা গোটা দেশ কার্যত বাকি বিশ্বের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু প্রশ্ন হলো, হঠাৎ কেন এইরকম ভয়াবহ একটা পরিস্থিতি ঘটে গেল? আমরা জানি, সরকারী চাকরির ক্ষেত্রে চালু থাকা ত্রিশ শতাংশ ‘মুক্তিযোদ্ধা কোটা’ সংস্কারের দাবি নিয়ে সে দেশের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা দেশব্যাপী ব্যাপক একটা আন্দোলন শুরু করে ছিলেন। আন্দোলনের অভিমুখ অবশ্যই সরকারের দিকে ছিল। সরকারের কাছেই তাঁদের দাবি। ত্রিশ শতাংশ ‘মুক্তিযোদ্ধ কোটা’ সংস্কার করতে হবে। কেননা সে দেশের স্বাধীনতা অর্ধ শতাব্দী পার করে দিয়েছে। এখনো কেন মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি নাতনিদের পারিবারিক ভাবে কোটার সংরক্ষণের ভিতরে রাখা হবে। যার ফলে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের একটা বড়ো অংশই মেধা থাকলেও প্রাপ্য চাকরি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। উল্টো দিকে, মেধার অভাব থাকুক না থাকুক সংরক্ষণের সুবিধেতে ‘মুল্তিযোদ্ধা কোটায়’ মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের সদস্যরা সরকারী চাকরীতে বহাল হয়ে চলেছে বছরের পর বছর। ফলে একটা ভারসাম্যহীন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বাংলাদেশের সরকারী কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে। এই ভারসাম্যের ফলে যে বৈষম্যমূলক পরিস্থিতির শিকার হচ্ছেন দেশের বৃহৎ অংশের শিক্ষার্থীরা সে বিষয়ে আশা করা যায় কোন বিতর্কের অবকাশই নেই। অন্তত থাকা উচিত নয়। ফলে একেবারে সাধারণ যুক্তিতেই সাম্প্রতিক ‘মুক্তিযোদ্ধা কোটা’ সংস্কার আন্দোলনের যৌক্তিকতার বিষয়টি বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। আর ঠিক এই কারণেই দেশে বিদেশে ছড়িয়ে থাকা ওপার বাংলা ও এপার বাংলার বাঙালিদের একটা বড় অংশেরই নৈতিক সমর্থন পেয়ে গিয়েছে বাংলাদেশের চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলন।
আন্দোলনের যৌক্তিকতা নিয়ে কোন প্রশ্ন না থাকলেও। আন্দোলনের ফলে দেশ জুড়ে ঘটে যাওয়া চরম হিংসাত্মক এবং ধ্বংসাত্মক পরিণতির বিষয়ে বিস্তর প্রশ্ন রয়ে গিয়েছে। প্রশ্ন হয়ে গিয়েছে শতাধিক প্রাণের নিহত হওয়া নিয়ে। প্রশ্ন রয়ে গিয়েছে শিক্ষার্থী সহ সহস্রাধিক মানুষের আহত হওয়া নিয়েও। কেন এমনটা হলো। এবং সবচেয়ে বড়ো প্রশ্ন ঠিক কারা কারা দায়ী? না, সব উত্তরের প্রশ্নের উত্তর এই মুহুর্তে জানা না থাকলেও ঘটনা প্রবাহের দিকে নজর দিলে বেশ কিছু বিষয়ে চিন্তা করার অবকাশ রয়েছে। শোনা যাচ্ছে, প্রাথমিক ভাবে কোটা সংস্কারের দাবিতে চলতে থাকা ছাত্র আন্দোলন মোকাবিলার প্রশ্নে শাসকদলের দুই তিনজন নেতানেত্রী প্রকাশ্যে অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন নাকি, আন্দোলন মেকাবিলায় শাসকদলের শাখা সংগঠন ছাত্রলীগের কর্মীরাই নাকি যথেষ্ঠ। এই অভিযোগ যদি সত্য হয়। তবে বোঝা দরকার। ক্ষমতায় থাকতে থাকতে শাসকদলের দম্ভ এবং আন্তম্ভরিতা কোন পর্যায় গিয়ে পৌঁছালে এইরকম বেআইনী এবং হটকারি অভিমত ব্যক্ত করা যায়। এও শোনা যাচ্ছে। শাসকদল মুখ থেকে কথা খসিয়েই নাকি বসে থাকেনি। সত্য সত্যই তাদের ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের মাঠে নামিয়ে দিয়েছিল পুলিশি প্রোটেকশনে। কোটা বিরোধী কোটা সংস্কারপন্থী চলমান ছাত্র আন্দোলন মোকাবিলায়।
এটা বুঝতে বিশেষ অসুবিধে হওয়ার কথাও নয়। প্রাথমিক ভাবে হিংসা শুরুর ঘটনা এর ফলেই ঘটে। শাসকদলের ছাত্র সংগঠন আর আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ভিতরে দিনে দিনে চরম সংঘাত বেঁধে যায়। এ কথাও শোনা যাচ্ছে যেখানে যাঁরা বেশি সংঘবদ্ধ ছিল। সেখানে বাকিদের উপরে নেমে আসে চরম আঘাত এবং হেনস্থা। অনেক স্থানেই ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের ঘরেও বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা তাণ্ডব চালিয়ে জিনিসপত্তর ছত্রভঙ্গ করে দেয়। সেসবের ছবিও দেখা গিয়েছে। এমনকি এও শোনা গিয়েছে। হস্টেলের ছাদ থেকে কোন কোন শিক্ষার্থীদের নাকি ঠেলে ফেলে দেওয়ার মত নৃশংস ঘটনাও ঘটে গিয়েছে। এরই সাথে পুলিশের গুলিতে নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের নিহত হওয়ার খবরও জানা গিয়েছে। দেখা গিয়েছে লাইভ ভিডিও। বিশেষ করে রংপুরে এক ছাত্রকে পুলিশের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে গুলি খেয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়াতে দেখার ছবিটি বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ায় আন্দোলনের গতিপথ আরও বেশি করে হিংসার দিকেই এগিয়ে যায়। শাসকদলের কিছু নেতানেত্রীর সম্পূর্ণ দায়িত্বহীন বক্তব্য এবং শাসকদলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগকে আন্দোলনরত ছাত্রদের উপরে লেলিয়ে দেওয়ার মতো পৈশাচিক ঘটনা না ঘটলে কে বলতে পারে, অবস্থা অনেক বেশি শান্তিপূর্ণ ভাবে সমাল দেওয়া যেত না। যেকোন বিষয়ে শাসকদলের সংযম এবং দায়িত্বপূর্ণ আচরণ অনেক সহজে পরিস্থিতি মোকাবিলায় কাজে আসে। অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক যে বাংলাদেশের শাসকদল সেই বিষয়ে চুড়ান্ত ব্যর্থ হয়েছে। এর সাথেই আগুনে ঘি ঢেলে দিয়েছিলেন দেশের প্রধানমনত্রী নিজেই। তিনি যদি না বলতেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি নাতনি কোটা পাবে না তো কি রাজাকারদের নাতি নাতনি কোটা পাবে’’। তাহলেও হয়তো শিক্ষার্থীরা এতটা আন্দোলিত হতো না। দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে সমগ্র ছাত্র সমাজকে মুক্তিযোদ্ধা আর রাজাকারদের বংশধর বলে ভাগ করে দেওয়া তাঁর পক্ষে চুড়ান্ত পর্যায়ের হটকারিতা হয়ে গিয়েছে। এবং এই হটকারিতার ঘটনাকে তিনি ও তাঁর দল কিভাবে সমাল দেয়। সেটাই দেখার। ঘটে যাওয়া সহিংসতা এবং ধ্বংসযজ্ঞের অন্যতম অনুঘটক হিসাবে প্রধানমন্ত্রীর এই বয়ান বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে একটা বিশেষ জয়াগা করে নেবে অচিরেই।
এতো গেল শাসকদলের হটকারিতার বিষয়। কিন্তু সেটাই কি সব? বাংলাদেশের রাজনীতিতে বর্তমান শাসকদলের বিরোধী শক্তি পক্ষগুলির কি কোনই ভুমিকা নেই এই ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞে? দেশব্যাপী এই হিংসাত্মক ঘটনাক্রমে? ঘটনাক্রমের পিছনে কারা কারা ছিল এবং এখনো আছে। সেটাও একটা বড় প্রশ্ন কিন্তু। একথা কোনভাবেই মেনে নেওয়া যায় না, কোটা সংস্কারের পক্ষে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরাই এই স্কেলে দেশজুড়ে হিংসা ছড়িয়েছে। রাজধানীর বিভিন্ন সরকারি সম্পত্তি ধ্বংস করে দিয়ে গিয়েছে। এই পরিমাণে বিপুল ধ্বংসযজ্ঞ কেবলমাত্র শিক্ষার্থীদের পক্ষে সংঘটিত করা সম্ভব নয়। সম্ভব নয়, কোটা সংস্কার আন্দোলনের মুখকে সরকার ফেলে দেওয়ার আন্দোলনে ঘুরিয়ে দেওয়াও। শিক্ষার্থীদের পক্ষে এই কাজ অসম্ভব। তাদের আন্দোলনকে হাতিয়ার করে নিয়েই শাসকপক্ষের বিরোধী শক্তিরা একক ভাবে বা কিছুটা সংঘবদ্ধ ভাবে এই পর্যায়ের ধ্বংসলীলা চালাতে পারে। এই প্রশ্নের সাথে আরও বড়ো একটা প্রশ্ন জড়িয়ে রয়েছে। বাংলাদেশের মতো ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলির পক্ষে বৈদেশিক মদত এবং উস্কানি ছাড়া সরকার বিরোধী আন্দোলন এই পর্যায় নিয়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব। এদিকে পড়শি দেশ ভারতবর্ষের সরকারপন্থী সংবাদ মাধ্যম এবং টিভি চ্যানলগুলি দেখে পরিস্কার বোঝা গিয়েছে, ভারতবর্ষ এই ঘটনায় বাংলাদেশের সরকারের সমর্থনে তাদের পাশে বটবৃক্ষের মতো দঁড়িয়ে গিয়েছে। তাহলে সেদেশের সরকার বিরোধী শক্তিগুলিকে এই সুযোগে সরকার ফেলে দেওয়ার চেষ্টায় বাইরে থেকে কারা মদত জুগিয়েছে? এই প্রশ্নের উত্তরও পাওয়া খুবই জরুরী। বিশেষ করে সাম্প্রতিক ইতিহাসে আন্তর্জাতিক স্তরে দেশে দেশে সরকার ফেলে দেওয়ার পিছনে সবচেয়ে বেশি করে যে শক্তির স্বার্থ, মদত এবং ষড়যন্ত্র জড়িয়ে থাকে। এবং সেই দেশটির নাম যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। হঠাৎ করে তাদের যে ‘বিড়াল বলে মাছ খাবো না’র মতো দশা হয়েছে। তাও কিন্তু নয়। আমাদের স্মরণে রাখতে হবে, মুক্তিযুদ্ধের সময়, এই মার্কিনশক্তিই বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে বানচাল করে দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিল। এবং সেই সঙ্কটের চুড়ান্ত পর্বে মার্কিনশক্তি তাদের সপ্তম নৌবহরকে ভারত মহাসাগর অভিমুখে রওনা করেও দিয়েছিল। লক্ষ্য ছিল বঙ্গোপসাগরে ঢুকে পড়ে সরাসরি পাক বাহিনীর মদতে কাঁধে কাঁধ লাগিয়ে নেমে পড়া। তাদের সেই অভিসন্ধি যদিও বানচাল হয়ে যায় তৎকালীন সোভিয়েত রাষ্ট্রের ভুমিকায়। মার্কিন সপ্তম নৌবহর সঠিক স্থানে পৌঁছানোর আগেই সেখানে অবস্থান নিয়ে নেয় সোভিয়েত সাবমেরিন। ফলে পিছু হটতে বাধ্য হয় মার্কিনশক্তি। এরপরেই ভারতীয় সেনাবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে দাঁড়াতে সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। আর মুক্ত হয় স্বাধীন বাংলাদেশ। ফলে সেই ইতিহাস ভুলে গেলেও ভুল হবে। এই সময়ে ওয়াশিংটন বাংলাদেশের জন্য ঠিক কোন স্ক্রিপ্ট লিখে রেখেছে। বা লিখছে। সেটা জানাও জরুরী। নাহলে চলমান পরিস্থিতির মূল গিয়ে পৌঁছানো সম্ভব হবে বলে মনে হয় না।
যেহেতু সাধারণের জন্য কাঁটাতার পেরিয়ে সব খবর এখনো এই পারে এসে পৌঁছাচ্ছে না। ফলে ঘটনার পুরো ছবি কিন্তু আমাদের চোখে এখনো অধরাই রয়ে যাচ্ছে। এর সাথে আরও একটি বিষয় জানা দরকার। অসমর্থিত সূত্রে জানা যাচ্ছে প্রায় পাঁচ শতাধিক ছাত্র জনতা শহীদ হয়েছেন। সংবাদ মাধ্যমগুলির দেওয়া তথ্যে যা প্রায় দেড়শতাধিক। সংখ্যা বেশি হোক কম হোক। এত বিপুল পরিমাণে নরবলি দিতে হলো কেন? হ্যাঁ পুলিশের দিকেও হতাহতের সংখ্যাও রয়েছে। একজনের তো মাথা থেঁতলে ঘিলু বার করেও দেওয়ার মতো নৃশংসতম ঘটনাও ঘটেছে। বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। এই ধরনের নৃশংসতা পড়ুয়াদের হাতেই সংঘটিত হয়েছে বলে। যদি হয়েও থাকে। তবে তার দায়িত্বও কিন্তু ক্ষমতাসীন সরকারকেই নিতে হবে। কেবলমাত্র কথায় কথায় বিএনপি জামাত শিবির এইসব গতেবাঁধা বাঁধাধরা মুখস্থ বুলি বলে গেলেই হবে না। সরকার তার পুলিশ প্রশাসন এবং সেনা নামিয়েও যদি এত মৃত্যু রোধ করতে না পারে। তবে সরকারের যোগ্যতার দিকেই কিন্তু আঙুল উঠবে। সেটাই স্বাভাবিক। একথাও শোনা যাচ্ছে, সরকারী বাহিনীই নির্বিচারে গুলিবৃষ্টি করায় এত মৃত্যু ঘটে গিয়েছে। শোনা যাচ্ছে, কারফিউ চলাকালীন নাকি তাদের কাছে দেখা মাত্র গুলি’র নির্দেশ দেওয়া ছিল। এখন প্রশ্ন হলো। যদি সরকারী বাহিনীর গুলিতেই এত মৃত্যু ঘটে গিয়ে থাকে। তবে প্রাথমিক ভাবে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির এমন ভয়াবহ পরিণতির দায় কি সরকার নেবে আদৌ? কিংবা যদি এত মৃত্যু সরকার ফেলে দেওয়ার প্রয়াসেই সংগঠিত ষড়যন্ত্রের কারণে ঘটে থাকে, তবুও কিন্তু সেই ষড়যন্ত্র রোধে সরকারের প্রাথমিক দায় থেকেই যায়। সেই ঘটনাই সত্য হলে সরকারের সার্বিক ব্যর্থতাই প্রমাণ হয়। আর বিরোধী পক্ষের হাতে সেটাই সরকার ফেলে দেওয়ার তুরুপের তাস হয়ে ওঠে। এই পর্য্যন্ত ঘটনা প্রবাহ দেখে একটা বিষয়ে ধারণা করা যায়। সরকার ফেলে দেওয়ার প্রয়াস আপাতত সমাল দেওয়া গিয়েছে। দেশের সেনাবাহিনী এবং শিল্পমহলের একটা বড়ো অংশ এখনো বর্তমান সরকারের পাশেই রয়েছে। সেটাই কিন্তু সরকারের মূল শক্তি। বিশেষ করে এক দশকের বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকার কারণে সরকারিস্তরে যে পরিমাণ দুর্নীতির ঘুঘু বাসা বেঁধে বসে গিয়েছে, তাতে সেদেশের জনসাধারণের একটা বড়ো আংশেরই ক্ষোভ রয়েছে বর্তমান সরকারের উপরে। ফলে এই অবস্থায় সেনাবাহিনী এবং দেশের শিল্পমহলই সরকারের শেষ ভরসা। ক্ষমতায় টিকে থাকতে গেলে। অনুমান করা যাচ্ছে। সেই কারণেই রণক্ষেত্র বাংলাদেশে, সেই দেশের বর্তমান সরকার কঠোর হাতে সরকার বিরোধী আন্দোলনকে আপাতত দমন করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু তার মূল্য দিতে শত শত প্রাণের বলিদান সংঘটিত করতে হলো। যে কোন ক্ষমতাসীন সরকারের পক্ষে সেটি আদৌ কোন উজ্জ্বল নিদর্শন নয়।
এই সহিংসতা এবং ধ্বংসযজ্ঞে বিরোধী রাজনৈতিক পক্ষগুলি যদি ছাত্র আন্দোলনের আড়ালে অংশগ্রহণ না করে থাকে। এবং তাদের পিছনেও যদি বৈদেশিক মদত না থাকে। তাহলে বুঝতে হবে বর্তমান সরকার ও প্রশাসন এবং শাসকদলের উপরে বাংলাদেশের জনগণের একটা বৃহৎ অংশের মানুষের পুঞ্জীভুত ক্ষোভ পাহাড়ের মতোন জমে উঠেছে। আপাতত সেনা নামিয়ে সেই ক্ষোভ সামাল দেওয়া গেলেও অচিরেই যে সেই ক্ষোভ ভিসুভিয়াসের মতো সারা দেশে লাভাস্রোতের মতোন আবার ছড়িয়ে পড়বে না, সে কথা নিশ্চিত করে বলা মুশকিল। উল্টোদিকে যদি সত্যিই বর্তমান পরিস্থিতি তৈরীর পিছনে বিরোধী শিবিরগুলির সক্রিয় অংশগ্রহণ থেকে থাকে। এবং তারা বৈদেশিক শক্তিগুলির মদতে এগিয়ে থাকে। তাহলেও বর্তমান সরকারের পক্ষে নিশ্চিন্তে বসে থাকার উপায় নেই। ঘটনা যাই হোক। একটানা দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকলে, স্বজনপোষন এবং দুর্নীতির রোগ বাসা বাঁধতে বাধ্য। বিশেষ করে আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের তথাকথিত আরোপিত গণতান্ত্রিক দেশগুলিতে। বাংলাদেশের বর্তমান সরকার সেই রোগ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। এমন কথা নিশ্চয়ই স্বপ্নেও কেউ ভাববে না। ফলে সরকারের আশু কর্তব্য আত্মসমীক্ষা করার। নিজেদের ত্রুটি বিচ্যুতিগুলি যত দ্রুত সম্ভব দুর করা। শাসকদলকে আত্মম্ভরিতার পদস্খলন থেকে রক্ষা করা। এবং সর্বপরি দেশকে একটি দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন উপহার দেওয়া। নাহলে শুধুমাত্র সেনাবাহিনী শিল্পমহল এবং কোন না কোন বৈদেশিক শক্তির বরাভয় নিয়েও যুগের পর যুগ শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকা সম্ভব হবে না। ইতিহাসেও কিন্তু সেরকম কোন নজির নেই।
©শ্রীশুভ্র ২৬শে জুলাই ২০২৪

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


