আর জি কর কাণ্ডের কারণে জনগণের সামনে দিনে দিনে ধীরে ধীরে বেশ কয়েকটি বিষয় প্রায় জলের মতোই পরিস্কার হয়ে যাচ্ছে। সরকারি অর্থের নয়ছয়। মেয়াদ উত্তীর্ণ কিংবা জাল ওষুধের কারবার। ব্যবহৃত সরঞ্জামের কালোবাজারি। বেওয়ারিশ লাশ পাচার। লাখ লাখ টাকার বিনিময়ে ডাক্তারি না শেখা ছাত্রকেও ডাক্তার বলে পাশ করিয়ে দেওয়া। পরীক্ষার আগেই প্রশ্নপত্র ফাঁসের কারবার। তৈরী উত্তরপত্র বিক্রীর রমরমে ব্যাবসা। রাজনৈতিক ক্ষমতার বাধ্যবাধকতায় যখন তখন শিক্ষার্থীর প্রাপ্ত নম্বর প্রায় দ্বিগুন অব্দি বৃদ্ধি করে দেওয়া। পরীক্ষার হলে গণটোকাটুকির খোলামেলা সংস্কৃতি। গবেষণা পত্র সাবমিট করতেও বাধ্যতামূলক ঘুষের লক্ষাধিক টাকার রেট ঠিক করে দেওয়া। শিক্ষার্থীদের প্রাপ্ত নম্বর ইচ্ছাকৃত ভাবে গরমিল করে মোটা অর্থের বিনিময়ে সঠিক নম্বর দেওয়ার মেকানিজম তৈরী। মোটা অর্থের নিয়মিত তোলাবাজি। পদাধিকারীদের দিয়ে যেকোন অনৈতিক নীতি বহির্ভুত কাজ স্রেফ হুমকি দিয়ে করিয়ে নেওয়া। প্রয়োজনে চিকিৎসকদের রেজিস্ট্রেশন বাতিলের হুমকি। কিংবা পাশ করা ডাক্তারদের রেজিস্ট্রেশন না দেওয়ার হুমকি। এবং হাসপাতাল ও কলেজ জুড়ে সর্বাত্মক একটা সন্ত্রাসের রাজত্ব। না, এগুলি কেবলমাত্র আর জি কর মেডিকেল হসপিট্যালের ঘটনা নয়। রাজ্যের প্রতিটি সরকারি হাসপাতাল, বিশেষ করে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলিরই এটাই ঘটনা। এই যে একটা বিশেষ বন্দোবস্ত। সম্পূর্ণ এই ব্যবস্থা পরিচালিত হয়ে চলেছে বিশেষ এক থ্রেট সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে। যাদের উপরে সরাসরি স্বাস্থ্যভবনের আশীর্বাদ রয়েছে। আর যে বা যাঁরাই এই থ্রেট সিণ্ডিকেটের বিরোধীতা করবেন। তাঁদের সরে যেতে হবে। নিজের পদ থেকে। নয়তো পৃথিবী থেকেই।
আর জি কর কাণ্ডের বিরোধীতায় আন্দোলনরত জুনিয়র চিকিৎসকরাই এই থ্রেট সিণ্ডিকেটের বিরুদ্ধে প্রায় মরণপণ লড়াই করছেন। অন্তত এখন অব্দি। আমাদের জানা নাই, তাঁরা আর কতদিন তাঁদের এই লড়াই চালিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন। কিংবা আদৌ তাঁদের এই লড়াই কাম্য সাফল্য লাভ করতে সক্ষম হবে কিনা। একটু ভালো করে ভেবে দেখলে, এই যে একটা থ্রেট সিণ্ডিকেট রাজ্যের সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নিয়ে নিয়েছে, তাতে সবচেয়ে বেশি বিপদের সম্মুখীন কিন্তু সেই সাধারণ মানুষই। যাঁরা এই সরকারি হাসপাতালগুলির উপরেই মূলত নির্ভরশীল। প্রভুত অর্থ আছে যাঁদের। যাঁরা আদৌ সরকারি হাসপাতালের চৌকাঠে পা রাখেন না। বড়ো বড়ো ঝাঁ চকচকে বেসরকারি হাসপাতালগুলিতে মোটা টাকার স্বাস্থ্যবীমায় যাঁরা চিকিৎসা করান, তাঁদের তত মাথাব্যথার কারণ নেই। যতটা মাথাব্যাথার কারণ সাধারণ জনগণের। এমনকি তার বাইরেও যাঁরা প্রাইভেট চেম্বারে ডাক্তার দেখিয়ে থাকেন। তাঁরাও একইরকম ভাবে বিপদের সম্মুখীন। যে চিকিৎসক অর্থের বিনিময়ে কিংবা ক্ষমতাসীন শাসকদলের আশীর্বাদে চিকিৎসাবিদ্যায় পারদর্শী না হয়েই প্রাইভেট চেম্বার খুলে বসে গিয়েছে, তার কাছে যে বা যাঁরাই রোগ নিরাময়ের জন্য গিয়ে দাঁড়াবেন, জীবন মৃত্যুর মাঝখানে তাঁদের ভাগ্য ঝুলতে থাকবে বিপদসঙ্কুল ভাবেই।
যে থ্রেট সিণ্ডিকেটের অধীনে এইরকম একটা ভয়ানক বন্দোবস্ত চলে আসছে। বছরের পর বছর ধরে। শত শত কোটি কালোটাকার কারবার যে সিণ্ডিকেটের ভিতর দিয়ে প্রতি মাসেই এই হাত ঐ হাত হয়ে চলেছে। সেই থ্রেট সিণ্ডিকেট যে সহজেই নিজেদের তৈরী করা জমি ছেড়ে দিয়ে গায়ে নীতিমালার নামাবলী ঝুলিয়ে সুর সুর করে আইনের হাতে নিজেদের আত্মসমর্পণ করবে এমনটাও কেউ ভাবছেন না। আবার একটু তলিয়ে দেখলে, এমটাও মনে করার কিংবা ভরসা করার খুব একটা উপায়ও থাকে না যে, দেশের আইনব্যবস্থা এই সিণ্ডিকেট রাজত্বকে একেবারে গোড়া থেকে আগাগোড়া নির্মূল করে উপড়িয়ে ফেলে দিতে পারবে। তার একটা বড় কারণ আইনের নিজের চোখ বাঁধা। আর আইনকে আইনের পথে চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার যে রাজপথ। সেই পথও রাজনীতির খানাখন্দে বোঝাই। ফলে মূল বিষয়টা নিতান্তই আইনের আওতায়ও নেই। বিষয়টা রাজনীতির বাইরে গিয়ে মীমাংসা করাও কষ্টসাধ্য। এমনটাও নয়, ক্ষমতাসীন যে সরকারের বদান্যতায় আইন ও প্রশাসনের নাকের ডগায় বসে এমন একটা ভয়ানক সিণ্ডিকেট রাজত্ব চলছে, সেই সরকারকে যেভাবেই হোক ক্ষমতাচ্যুত করতে পারলেই এই সিণ্ডিকেট রাজত্ব একেবারে খতম হয়ে যাবে। অন্তত ভারতবর্ষের প্রেক্ষিতে তেমন কোন ঘটনা ঘটার কোনরকম সম্ভাবনাও নেই। বড়োজোর এই থ্রেট সিণ্ডিকেটের পাণ্ডাদের নাম ও পদবী বদলিয়ে যেতে পারে। একান্তই যদি তারা ক্ষমতাসীন নতুন শাসকদলের সাথে কোনরকম ভাবেই গাটছড়া বাঁধতে নাই পারেন। সেক্ষেত্রে পরবর্তী শাসকদলের আশীর্বাদধন্য নতুন নতুন মুখকেই থ্রেট সিণ্ডিকেটের মাথা থেকে ফুট সোলজার অব্দি দেখা যাবে হয়তো। এই ভাবেই শাসক আসে শাসক যায়। সিস্টেম রয়ে যায়।
কিন্তু সেই সিস্টেমকেই যদি সমূলে উৎপাটন করতে হয়? তবে সংঘাত বড়ো তীব্র আকার নিতে বাধ্য। কারণ লড়াইটা তখন আর শুধু ক্ষমতাসীন শাসকদলের বিরুদ্ধেই নয়। ঘোলাজলে মাছ ধরতে নেমে পড়া ক্ষমতালোভী অন্যান্য রাজনৈতিক পক্ষগুলির বিরুদ্ধেও সমান ভাবেই লড়ে যেতে হবে। লড়ে যেতে হবে সেই আইনের হাত ধরেই। যাতে আর কোনভাবেই এই থ্রেট সিণ্ডিকেট কাজ করে যেতে না পারে। তার জন্যেই থ্রেট সিণ্ডিকেটের মাথাগুলিকে এবং অন্যান্য ছোট বড়ো মেজো সেজো পাণ্ডাদের সরাসরি আইনের দরজায় নিয়ে গিয়ে দাঁড় করাতে হবে। এবং এমনভাবেই করাতে হবে যাতে একজনও রেহাই না পায়। দেশের আইনে তাদের প্রাপ্য সর্বোচ্চ সাজায় সঠিক শাস্তিবিধান যেন সুনিশ্চিত হয়। একমাত্র তখনই কিছুটা হলেও ভরসা করা যেতে পারে, চট করেই নতুন নতুন রথী এবং মহারথীদের হাতে আবার কোন থ্রেট সিণ্ডিকেট গড়ে ওঠা খুব একটা সহজ হবে না। কিন্তু শুধুমাত্র সেই ভরসায় কোন কাজ হওয়ারও কথা নয়। ঘরে যেমন সময়মতো জায়গা মতো খিল দিতে হয়। নাহলে চোর বাটপারদের হাতে ঘরের দখল চলে যেতে পারে। ঠিক তেমনই রাজ্যের গোটা স্বাস্থ্য ব্যবস্থার খোল এবং নোলচের ভিতরে এমনভাবেই নিঃশ্ছিদ্র প্রহরা বসাতে হবে, যাতে করে আর যেন কোনভাবেই এইরকম একটা ভয়ানক থ্রেট সিণ্ডিকেট দ্বিতীয়বার গড়ে উঠতে না পারে।
ফলে এটুকু অন্তত বোঝা যাচ্ছে। এই থ্রেট সিণ্ডিকেটের বিরুদ্ধে ওয়েস্টবেঙ্গল জুনিয়র ডক্টরস ফোরামের ব্যানারে সমবেত হওয়া রাজ্যের জুনিয়র চিকিৎসকরা যে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। সেই যুদ্ধটা শুধু যে কঠিনতম কঠিনই, তাই নয়। প্রায় অসম্ভব। তার কারণ ভারতবর্ষের রাজনীতির ণত্ব এবং ষত্ব। যে দেশের লোকসভা এবং বিধানসভাগুলি আলো করে নানাবিধ ফৌজদারী অপরাধে অভিযুক্ত শতশত নির্বাচিত জন প্রতিনিধি বসে থাকেন নানাবিধ আইন তৈরীর কাজে, সেই দেশে জুনিয়র চিকিৎসকদের পক্ষে এই অসম যুদ্ধ জয় করা আদৌ এতটা সহজ নয়। যে দেশের সমাজ এবং রাজনীতির পরতে পরতে দুর্নীতি, সেই দেশের একটি রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ভিতরে বাসা বাঁধা এই সিণ্ডিকেট রাজত্ব নির্মূল করা এতই সহজ কি? আমাদের ধারণা আন্দোলনরত জুনিয়র চিকিৎসকরাও সেটা বিলক্ষণ জানেন। ফলে তাঁদের কাছে এই যুদ্ধে জয়ী হওয়ার থেকেও অনেক বড়ো একটা দায় রয়েছে। সেটা হলো সাধারণ জনগণকে জাগিয়ে দিয়ে সজাগ করে দেওয়া। সুখের কথা আন্দোলনের চল্লিশ দিন অতিক্রান্ত করে অন্তত কিছুটা হলেও তাঁরা তাঁদের সেই দায়িত্বে অনেকটাই সফল। মানুষ টের পেয়ে গিয়েছে। কত ধানে কত চাল। মানুষ টের পেয়ে গিয়েছে কি ধরেণের সব রথী থেকে মহারথীরা এই থ্রেট সিণ্ডিকেট চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। মানুষ টের পেয়ে গিয়েছে তাদের সন্তানসন্ততির ভবিষ্যৎ কতটা ভয়ানক! মানুষ টের পেয়ে গিয়েছে এই রাজ্যে শারীরীক ভাবে সুস্থ্য থাকাটাই সামনের দিনে কতটা ঝুঁকিপূর্ণ। মানুষ টের পেয়ে গিয়েছে বছর বছর সরকারিভাবেই গণ্ডায় গণ্ডায় হাতুরে ডাক্তার সমাজের ভিতরে ঢুকে পড়ছে। যাদের মুখ দেখে চেনার উপায় থাকবে না। আর কাজ দেখে যখন টের পাওয়া যাবে তাদের বিদ্যের দৌড়। ততক্ষণে হয়তো পরপারের টিকিটই না কনফার্ম হয়ে যায় রুগীর। এই থ্রেট সিণ্ডিকেটের বিরুদ্ধে জুনিয়র চিকিৎসকদের চল্লিশ দিনের চলমান আন্দোলনের এটাই একটা বড়ো সাফল্য।
আর থ্রেট সিণ্ডিকেটের টিকি যাদের হাতে ধরা। তারা যে মানুষের এই জেগে ওঠাকেই ভয় পেয়ে যাবে। তাতে আর সন্দেহ কি। সেই কারণেই তারা প্রায় সর্বশক্তি দিয়ে সামনে এবং পিছনে সর্বত্র, এই আন্দোলনকে ধামাচাপা দিয়ে ব্যর্থ করে দিতে উঠে পড়ে লেগে গিয়েছে। তারাও বিলক্ষণ জানে মানুষ একবার খেপে গেলে আম ও বস্তা দুইই যাবে। তাদের কাছে একটাই সান্ত্বনার জায়গায়। জনতার স্মৃতি বড়ো দুর্বল। আর সেই সূত্রটিকেই খড়কুটোর মতো আঁকড়িয়ে ধরতে তারা ব্যস্ত হয়ে প্রহর গুণছেন উৎসবের আগমনী পদধ্বনি শোনার জন্য। আশা, জনতা একবার উৎসব মোডে ঢুকে পড়লেই তারা ডেমেজ কন্ট্রোলে নেমে পড়তে পারবেন সফল ভাবে।
১৯শে সেপ্টেম্বর ২০২৪