somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ ফিরে আসিবো আবার

১৩ ই নভেম্বর, ২০২১ দুপুর ১২:৪১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

রাইসুল কবির বাপ্পী,

ছেলেটার মধ্যে কিছু একটা ছিলো। যার কারণে আমার মতো সবকিছুতেই বিরক্ত হওয়া মানুষ ওর প্রতি কেন আকৃষ্ট হতে যাবো। গণিতে সে একটুও ভালো না। তার প্রতি আমার আকর্ষ্ন তৈরি হওয়ার সেরকম কোনো বিশেষ কারণ নেই।

বাপ্পীকে কে আমি "আবার আসিব ফিরে" কবিতাটি নিয়ে ছবি আঁকতে দিয়েছিলাম। ও এঁকেছিল, বিশাল খোলা মাঠ, মাঝখানে ঝোপ ঝাড় আর দুইপাশে গ্রাম।

আমি বলেছিলাম, এ "আবার আসিব ফিরে " ছবি হলো?

ও বলেছিল, একদিন প্রমাণ পাবেন।

দশ ফেভ্রুয়ারি প্রমাণ পেয়েছিলাম। সেদিন আমিও বাপ্পীর ছবির মতোই দাঁড়িয়ে ছিলাম বিশাল একটি খোলা মাঠে। মাঝখানে জায়গাটা উঁচু। ঝোপঝাড়ে ভরা আর সিরিজ গাছের ছায়ায় ঢাকা। মাঠের দুই পাশে গ্রাম – গ্রামের নামটি নাম ফুলতলা।

নিজের চোখে দেখেছিলাম, বাপ্পি যেন ফিরে এসেছিলো। তার আকা ছবির জায়গায়। আমি প্রমাণ পেয়ে গেলাম। কোথায় আমার আকাশ আর কোথায় আমার ডানা। সব ভেঙে আমার বুকের মধ্যে পড়লো। তখন আমার হাতে তিনি মুঠো মাটি ছাড়া আর কিছুই নেই। চোখ ফেটে আমার জল আসতে লাগলো। কেন? এটা কি বাপ্পীর প্রতি আমার মমতা? আমি তো অন্তরে কারও প্রতি মমতা লালন করি না।
বাপ্পী মারা যাবার কিছুদিন আগে থেকে আমার কাছে নিয়মিত আসতো। নিজের চলে যাবার তারিখ নিজেই ঘোষণা করেছিল। মানুষ মাঝে মাঝে নিজের মৃত্যুর সঠিক সময় নির্ণয় করতে পারে। এর পিছনে অবশ্যই একটা বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যাখ্যা আছে। কিন্তু কেন যেন আমার মন এই বিষয়টার ব্যাখ্যা খুজতে চাচ্ছে না। যেই আনসারি যুক্তির বাইরে কোনো কিছু মেনে নিতে নারাজ, সেই আনসারি আজ বাপ্পীর এই বিষয়টাকে ব্যাখ্যাতীত রাখতে চাচ্ছে। কেন?

প্রায়ই মাগরিবের পরে আমার কাছে এসে সে আমাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়তো। তার শেষ অপারেশনটার আগে এতা যেন দৈনিন্দিন রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ক্যাম্পাসের মাঠে খালি পায়ে হেঁটে হেঁটে আমার সাথে গল্প করতো। ব্রেন টিউমারে আক্রান্ত হয়েছিলো সে। আগে দুই বার অপারেশন হয়েছে। এটা ছিলো তার তৃতীয় বারের অপারেশন। আমাকে নানা ধরনের গল্প শোনাত আর আমাকে বলত প্রশ্ন করতে। আমি যেন বাপ্পীকে নিয়ে পরাবাস্তবে হারিয়ে গিয়েছিলাম। আশ্চর্য্য! আমি কিন্তু পরাবাস্তব বলে কিছু মানি না। অথচ এখানে ঠিকই বাপ্পীর সাথের সেই মূহুর্তগুলোকে পরাবাস্তব বলে লিখছি। আমার অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয়েছিল ওকে নিয়ে। আজ পর্যন্ত কারোর সাথে সে সব কথা নিয়ে আলোচনা করিনি। সেই অদ্ভুত অভিজ্ঞতাগুলোর ব্যাখ্যা খোঁজার চেষ্টা করিনি। সেগুলো আমার এই খাতাতে লিখে রেখেছি। আমি মাঝে মাঝে এই খাতাটা খুলে দেখি, বাপ্পী এর স্বপ্ন, পছন্দ, শখ,অভিজ্ঞতা, মতামত আরও কতো কিছু যে আছে। এগুলো পড়তে থাকি আর চোখ দুটি চলে যায় সেই ফুলতলা গ্রামটিতে। বিশাল একটা খোলা মাঠ, দুই পাশে গ্রাম , মাঝখানে জায়গাটা উঁচু আর ঝোপঝাড়ে ভরা।

যদি সুযোগ করে পাই তাহলে ফুলতলায় বাপ্পী এর চিরনিদ্রা র পাশে আর একবার দাড়িয়ে আকাশ দেখবো, বিশাল খোলা মাঠ দেখবো, দুইপাশে দুরের গ্রাম দেখবো। কেন যেন মনে হচ্ছে, ক্যাম্পাসের মাঠে বাপ্পীর সাথে যেসব অভিজ্ঞতা হয়েছিলো, সেরকম কিছুর সাথে হয়তো আবারও সাক্ষাৎ ঘটবে

.
.
.
.
.

আনসারি সাহেব লেখা শেষ করলেন। ইদানিং কোনও কিছুতে তার মন বসছে না। বাপ্পি নামের ছেলেটির সাথে তার বেশ ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। হঠাত করেই বাপ্পি মারা যাওয়ায় আনসারি সাহেব একদম ভেঙ্গে পরেছেন। প্রায়ই খাতাটা খুলে বাপ্পির সাথে তার অভিজ্ঞতার লেখাগুলো পড়েন। সারাদিন একই রকম ভাবে পরে থাকেন বাসায়। ঠিকমতো ক্লাস নিতে পারেন না ছাত্রদের। তিন মনসংযোগটাই করতে পারছেন না কোনও কিছুতেই।

হঠাত দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ, আনসারি সাহেব ওঠে গিয়ে দরজা খুললেন। শারিন এসেছে। আনসারি সাহেব দরজাটা খোলা রেখেই তাঁর ঘরে চলে গেলেন, দরজাটা ভীড়াতেও ভুলে গেলেন। শারিন দরজাটা ভিড়িয়ে দিয়ে আনসারি সাহেবের রুমে ঢুকলো। রুমে ঢুকেই আনসারি শারিন প্লেট বাটি সাজাতে লাগলো। সন্ধ্যা সাতটা। আনসারি সাহেব এখনও খাননি। আনসারি সাহেব যে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত সেটা শারি জানেন। এজন্যই সময় বের করে চলে এসেছে। সে জানে, নিজে এসে তদারকি করে না খাওয়ালে আনসারি সাহেব আজ অভুক্তই থেকে যাবেন।

আনসারি সাহেবকে খাওয়াতে শারিনের বেশ বেগ পেতে হলো, কিন্তু সে সফল হলো। আনসারি সাহেবকে এতোটা ভেঙ্গে পরতে কখনো দেখে নি শারিন। বাপ্পি মারা যাবার দুই মাস পেরিয়ে গেলেও আনসারি সাহেব এখনও স্বাভাবিক হতে পারেনি। আজ একটা শেষ চেষ্টা করে দেখবে আনসারি সাহেবকে আবার আগের মতো করে তোলার। সেজন্যই শারিন নিজে এসেছে।

আনসারি তার স্টাডি টেবিলে বসা। শারিন একটা মোড়া নিয়ে এসে আনসারি সাহেবের পাশে বসে। এই মোড়াটা এবং স্টাডি টেবিলের চেয়ারটা বাদে ঘরে তৃতীয় কোনো বসার আসবাব নেই।

“আচ্ছা স্যার, আপনি যদি শোনেন, একটা পরি এসে একটা কামেল পীর বান্দাকে তুলে নিয়ে গেছে, তাহলে সেক্ষেত্রে আপনি কি বলবেন? মানে এই ব্যাপারে আপনার মতামত কি হবে?”

আনসারি সাহেবের যেন চমক ভাঙল, শারিনের দিকে তাকিয়ে বললেন, “হা?” অর্থাৎ শারিনের কথা তিনি শুনতে পান্ নি। অন্য চিন্তায় ছিলেন।

- না মানে বলছি আপনি কি পরিতে বিশ্বাস করেন?
- সেটা পারিপার্শ্বিকের উপর নির্ভর করে। বিজ্ঞানভিত্তিক যুক্তি দিয়ে যদি কেউ আমাকে পরীর অস্তিত্বের প্রমাণ দিতে পারে, তাহলে আমি অবশ্যই বিশ্বাস করে। তবে তোমার জ্ঞাতার্থে জানিয়ে রাখি, বায়োলিজিক্যাল সাইন্স এখন পর্যন্ত মানুষের মতো দেখতে ডানাওয়ালা কোনো সুন্দরী প্রাণীর প্রজাতির সন্ধ্যান পায় নি, যেমনটা পায় নি অর্ধেক নারী অর্ধেক মাছ সদৃশ কোনো প্রজাতির।

শারিন বুঝতে পেরেছে যে কাজ হয়েছে। আনসারি সাহেব স্বরূপে ফিরছেন। জবাবে সে বললো, “তা ঠিক আছে স্যার, কিন্তু আমার ম্যাডামের কাছে এরকম একটি ঘটনা শুনলাম। একটা মেয়েকে সবাই পরী বলে মেনে নিচ্ছে। সে নাকি মুখ দেখে বলে দিতে পারে মানুষের মনে কি আছে। এরকম আরও অনেক ঘটনা আছে।“

- এরকম অন্ধ বিশ্বাসের ১০১ টা খবর পত্রিকাতে পাবে। ওসব গুরুত্ব দেওয়ার মতো ব্যাপার নয়।
- স্যার, আপনি যেভাবে খুব সহজেই বিষয়টা নিচ্ছেন, বিষয়টা অতোটাও সহজ নয়। মেয়েটা খোদ গ্রামের চেয়ারম্যানের মেয়ে। তাছাড়া, তার অলৌকিক কাজকারবার এর প্রমাণ অনেক শিক্ষিত মানুষই দেখেছেন। আমার ম্যাডামও দেখেছেন।
- দেখো শারিন, অলৌকিক বলতে কোনও কিছু পৃথিবীতে নেই। যেসব বিষয়ের ব্যাখ্যা আমরা বের করতে পারি না, সেগুলোকে আলৌকিক বলে দাবি করি। তার মানে কিন্তু এই না যে বিষয়গুলোর ব্যাখ্যা নেই। ব্যাখ্যাতীত কোনও কিছু থাকা অসম্ভব।
- স্যার, একজন ল টিচার, যার কাজই হচ্ছে যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করা, সেই তিনিই যদি এরকম কিছু দেখে থাকেন, তাঁর মানে তো অবশ্যই এখানে কিছু আছে। আপনিই ভেবে দেখুন,
- তুমি কি চাইছো আমি এই ঘটনার ব্যাখ্যা বের করি?
- জ্বি স্যার।
- এই সব ব্যাখ্যা খোজা ধরনের কাজ গোয়েন্দা বিভাগের, আমার না।
- স্যার, আপনি সম্ভবত এই রহস্যের ব্যাখ্যা জানতে চাইছেন না। কারণ আপনি সম্ভবত বুঝে গেছেন যে আপনি এর ব্যাখ্যা কখনও বের করতে পারবেন না!
- চ্যালেঞ্জ করছো?
- এক হিসেবে বলতে পারেন।
- এক্সেপ্ট করলাম। কোথায় থাকে তোমার এই পরী ?
- স্যার…………
- দ্বিধা করো না, বলে ফেলো।
- ফুলতলা গ্রামে।

আনসারি সাহেব এক মুহুর্ত চুপ করে রইলেন, তারপর বললেন, “ঠিক আছে।“
পরের দিন আনসারি সাহেব শারিনকে নিয়ে উপস্থিত হলেন ফুলতলা গ্রামে। চিটাগাং টু খুলনা রূটের ভোরের বাসে উঠেছিলেন দুইজন। ফুলতলা গ্রামে তারা উঠেছিলো শারিনের সেই ম্যাডামের আত্মীয়ের বাসায়। সেই ম্যাডামের প্রিয় ছাত্র শারিন। তাই সব কিছু বুঝিয়ে কনভিন্সড করতে শারিনের খুব একটা সমস্যা হয়নি। শারিন সেদিন কথায় কথায় ভুলিয়ে আনসারি সাহেবকে ফুলতলা গ্রাম পর্যন্ত নিয়ে আসলেও এখানে এসে আরেক বিপত্তি বাধলো। আনসারি সাহেব সর্বক্ষণ বাপ্পির কবরের কাছে বসে থাকেন আর ঘরে এসে বাপ্পিকে নিয়ে লেখা খাতাটা নিয়ে পরে থাকেন। শারিন ভেবেছিলো এখানে এসে এই ঘটনাটা নিয়ে মাথা ঘামালে হয়তো বাপ্পির মৃত্যুর শোকটা কাটিয়ে উঠতে পারবেন। কিন্তু উলটো বিষয়টা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।

সেরকমই এক সন্ধ্যায় আজাদ আনসারি বাপ্পির কবরের কাছে বসে আছেন। শারিন চেষ্টা করছে আনসারি সাহেবকে ঘরে নিয়ে যাওয়ার। এমন সময় কোথা থেকে এক মেয়ে হাজির হলো। এদিকে আনসারি সাহেব তাঁর চশমা ফেলে এসেছেন ঘরে। চোখ কুঁচকে আধো দৃষ্টিতে মেয়েটির দিকে তাকেলন। তারপর অস্ফুট স্বরে বললেন, “কে গো তুমি মা?” “আমি এ জগতের কেউ নই। অন্য ভুবনের বাসিন্দা। এ ভুবনের উপর দিয়ে যাচ্ছিলাম। ব্জ্রপাতে আমার ডানা পুরে খসে গেলো। এরপর আমি মাটির পৃথিবীতে রয়ে গেলাম”, বলেই মেয়েটি হি হি করে হাসতে লাগলো।

- তাই বুঝি।
- হ্যা তাইতো। আচ্ছা তুমি বারবার এখানে আসো কেন বলতো? তোমার মন এখানে কেন পরে থাকে? যার জন্য আসো, সে তো আগে থেকেই তাঁর নিয়তির ঘোষণা তোমার সামনে দিয়েছিলো। উফফফ তোমরা মাটির পৃথিবীর মানুষরা না বড্ড অবিশ্বাসী।

আনসারি সাহেবের চমক ভাঙল। মেয়েটি এতো কিছু কিভাবে জানছে?

“আমি তোমার মনের কথা বুঝতে পারছি বলে অবাক হচ্ছো? আমি কিন্তু চিন্তা চুরি করতে পারি। এটা কিন্তু সত্যি। যেমন আমি জানি এই মুহুর্তে তুমি ভাবছো আমার, ঐ তোমাদের ইংরেজিতে কি যেন বলে? ‘থটরিডিং’ আমার এই থটরিডিং এর পিছনের যুক্তি কি? ওওহ তুমি তো আবার বিজ্ঞানভিত্তিক যুক্তি ছাড়া মানো না। আমি এও জানি তুমি ভাবছো তুমি এর আগেও থটরিডিং করতে পারে এমন মানুষের মুখোমুখি হয়েছ, কিন্তু তারা কেউ আমার মতো করে চিঠি পড়ার মতো মনের কথা হুড়হুড় করে বলে দিতে পারে না।“

- “হুম অবাক তো হয়েছিই, তবে আমি একটা ব্যাপারে নিঃসংশয় যে…………
- যে আমার এই থটরিডিংয়ের পিছনেও সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা আছে। ওই যে আপুটি দাঁড়িয়ে আছে, তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছেন, সেও কিন্তু তোমাকে এখানে নিয়ে এসেছেন আমার বিষয়টার ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য, অবশ্য উনার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে তোমাকে ঠিক করে তোলা, তোমার আঘাতটা কাটিয়ে উঠার জন্যই হাজারো ব্যাখ্যাতীত ঘটনার ভীড়ে আপনাকে এই ফুলতলা গ্রামে নিয়ে এসেছে।

আনসারি সাহেবের এর আগেও এমন অভিজ্ঞতা হয়েছে। কেউ তাঁর চিন্তা হুবুহু পড়তে পারছে, কিন্তু শারিনের জন্য অভিজ্ঞতাটা নতুন ছিলো। সে যে কতটা অবাক হয়েছে, সেটা তাঁর চেহারার ভাব দেখলেই বোঝা যায়।

পরদিন আনসারি সাহেব আর শারিন নাস্তার টেবিলে রাতের অভিজ্ঞতা নিয়ে আলোচনা করছে। "স্যার, নিজের চোখেই তো দেখলেন।", শারিন বললো।

- হুম,
- এখন কি বলবেন?
- আপাতত বলবো এই ঘটনার কোনও ব্যাখ্যা এই মুহুর্তে আমার কাছে নেই।
- আমি তো স্যার এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না, কিভাবে সম্ভব! মানে এভাবে হরহর করে একজন মানুষের মনের কথা....
- আচ্ছা তোমার ম্যাডামের ব্যাপারে বলছিলে, উনি কিরকম অভিজ্ঞতার সম্মুখিন হয়েছিলেন।
- ম্যাম একটা কিছু দেখে মারাত্মক ভয় পেয়েছিলেন। মেয়েটা তাকে বলে ভয় না পেতে, ম্যাম যাকে দেখেছেন সে কোনও ক্ষতি করবে না।
- এইটুকুই?
- স্যার, বলাটা যত সহজ বিষয়টা মোটেও অত সহজ না। ম্যামও শুরুতে বিষয়টা হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু মেয়েটা........... আপনি নিজেও গতকাল দেখলেন। মেয়েটা ম্যামের জীবনের অনেক একান্ত গোপন কথা ম্যামের সামনে অনায়াসে বলে গেছে।
- কিন্ত এ তো জীবনবৃত্তান্ত বলা হলো! থটরিডিং না!
- মানে!
- মানে তুমি এখন আমার সাথে কথা বলছো, এখন কি তুমি তোমার জীবনের কোনও গোপন কথার ব্যাপারে ভাবছো? বা তুমি যে আইন নিয়ে পড়ছো এবং পাশাপাশি ক্যাটারিং এর বিজনেস করছো, সেটা কি তুমি এই মুহূর্তে চিন্তা করছো?
- না তো!
- সেটা যদি চিন্তা না করো, তাহলে সেই তথাকথিত থটরিডার কিভা‌বে এতোকিছু জানলো? সে তো গতকাল দাবি করলো সে চিন্তা চুরি করতে জানে, তুমি কিংবা আমি কেউই তো সেসময় আমাদের নিজেদের ব্যাপারে সেসব চিন্তা করি নি যেটা সেই মেয়েটা হুড়হুড় করে বলেছিলো রাতে।
- এক মুহুর্তের জন্য শারিন কিছুটা অবাক হয়। এদিক ওদিক তাকিয়ে কিছু একটা ভাবতে থাকে। এরপর বলে, "ঠিকই তো, এভাবে ভেবে দেখি নি তো!"
- স্বাভাবিক, অনেক কিছুই আমরা ধরতে পারি না, আমাদের মন বিক্ষিপ্ত থাকে।
- কিছুক্ষণ মৌনতা।

"আচ্ছা, মেয়েটিকে নিয়ে ঠিক কি কি ধরনের কথা প্রচলিত, মানে বলতে চাচ্ছি ঠিক কি কি কারণে মানুষজন বিশ্বাস করতে শুরু করেছে যে ও মেয়েটি পরী!", আনসারি সাহেব বললেন। "এ ব্যাপারে হায়দার চাচা বলতে পারবেন। উনি এই বাড়ির দেখাশোনা করেন। ম্যামের নানু বাড়ি এটা। গতবছর ম্যামের মা মারা যাওয়ার পর এখন আর কেউ থাকে না। ম্যামই মাঝে মাঝে এসে এখানে এক্টু সময় কাটিয়ে যান। হায়দার চাচা অনেক পুরোনো মানুষ। উনি এখানের অনেক কিছুই বলতে পারবেন। দাড়ান ডেকে দেই। হায়দার চাচা, হায়দার চাচা!", জবাবে শারিন বললো।

হায়দার চাচার প্রবেশ।

শারিন বললো, "আচ্ছা হায়দার চাচা, রহমান চেয়ারম্যানের মেয়েটাকে নিয়ে কি ঘটনা খুলে বলবেন? মানে এই ধরনের কথাবার্তার সূচনা কিভাবে?

- রহমান চেয়ারম্যান এর আদি নিবাস কিন্তু এই গ্রামে না। কইত্তে জানি আইসা এই গ্রামে ঘাটি গাড়ে, এরপর আস্তে আস্তে পলিটিকসে ঢুকিয়া এইরকম প্রভাবশালী হইছে। হের প্রথম পক্ষের স্ত্রী তো ছিলো মেলা সম্পত্তির মালিক, তয় বিধবা। হেরে বিয়া কইরাই এতো ট্যাকা পাইছে।
- তার মানে মেয়েটা আগের পক্ষের!
- হ, তয় আমার মনে হয় ওই চেয়ারম্যানই হের বউরে মারছে সম্পত্তি পাওনের লাইগা। এইসব কথা তো হগলের সামনে বলা তো যায় না! বোঝেনই তো!
- সব বুঝলাম কিন্তু এসবের শুরু কিভাবে?
- আমি সঠিকভাবে জানি না, তবে লোকমুখে শুনছি। আসলে এই ব্যাপারটা নিয়া সহজে কেউ কথা বলতে চায় না। চেয়ারম্যান এর মেয়ে বলে কথা। তো যেটা বলতেছিলাম, রহমান তখনও চেয়ারম্যান হয় নাই, মাইয়াটা খুব ছোট। এক লোক নাকি ওর সাথে............. উল্টাপাল্টা কিছু করার চেষ্টা করে, আর সেই লোক নাকি এমন কিছু দেখে যেইটা নাকি ভয়ংকর। সেইদিনই লোকটার প্রচন্ড জ্বর আসে আর লোকটা মরে যায়। এরপর থেকেই এরকম কিছু না কিছু ঘটতে থাকে। একদিন কি হইছে মাইয়াটার পেটে অনেক ব্যাথা, শুরুতে এক মহিলা বুড়ি, সে নাকি ঝাড়তে জানে ভালো, সে আইসা মেয়ের পিঠে কি জানি দেখতে চাইলো। সবাই মিলা মেয়েরে তুইলা পিঠের কাপড়টা উঠাইয়া দিলে দেখা গেলো পিঠে ইয়া বড় এক খত।
- "এখান থেকে তাহলে ডানার কথা উঠেছে! আর ডানা থাকার কথা মানে পরী, তাই তো!", আনসারি সাহেব বললেন।
- জ্বি, তবে বুড়ি মহিলার পর বড় ডাক্তারও দেখে গেছিলেন, উনিও অবাক হইছিলেন।

আনসারি সাহেব কিছুক্ষণ চুপ করে বসে ভাবতে লাগলেন। কিছুক্ষণ ভাবার পর বললেন, "এখনো বিষয়টা বুঝতে পারছি না। আরও কিছুদিন থাকলে হয়তো বোঝা যাবে। শারিন, আমরা আরও কিছুদিন এখানে থাকলে কি সমস্যা হবে?" "না স্যার", শারিন জবাব দিলো।

আনসারি সাহেব চুপচাপ বসে আছেন। খোলা মাঠে ছেলেরা ফুটবল খেলছে, আশেপাশে কয়েকজন সারিবদ্ধভাবে বসে খেলা উপভোগ করছে। গ্রামের লোকেরা বার্সেলনা রিয়াল মাদ্রিদ, স্প্যানিশ লীগ, ইংলিশ লীগ এসব বোঝে না বা বুঝলেও হাতে গোনা কয়েকজন। খোলা মাঠে স্থানীয় ছেলদের মধ্যকার এই খেলাই তাদের কাছে বিনোদনের একমাত্র উৎস।
আনসারি সাহেবের সেই খেলার দিকে কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই। তিনি তাকিয়ে আছেন মাঠের অন্য প্রান্তে। বিশাল খোলা মাঠটি সেদিকেও বিস্তৃত। মাঝখানে জায়গাটা উঁচু। ঝোপঝাড়ে ভরা আর সিরিজ গাছের ছায়ায় ঢাকা। মাঠের দুই পাশে গ্রাম – এই হলো ফুলতলা। বাপ্পীর আঁকা ছবিতে যেমনটা দেখা গিয়েছিলো।

“টুকি!”

আনসারি সাহেব চমকে উঠলেন। দেখলেন, গতকালের সেই মেয়েটি। “কেমন আছো গো মামনি?”, আনসারি সাহেব মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে বললেন।

- ভালো। গতকাল আপনাকে তুমি করে বললাম, কিছু মনে করলেন না তো?
- না আমি তেমন কিছু মনে করি নি।
- ওওহ, আপনি যে টিচার জানতে পারি নি।
- কেন, এই ক্ষেত্রে কি আমার চিন্তা চুরি করতে ব্যার্থ হলে নাকি?
- ঠিক তা না। মাঝে মাঝে ওই একটু ভুল হয়ে যায় আর কি। মানুষ যেমন ভুলের উর্ধ্বে নয়, সেরকম পরিরাও।
- আচ্ছা, তোমার নামটা তো জানা হলো না মা!
- সে কি! আমার নাম না জেনে রহস্য সমাধান করতে চলে এসেছেন?
- সেভাবে মাথায় আসে নি। তোমার ‘বিশেষ’ বিষয়গুলো নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছিলাম।
- আমার নাম অধরা।
- ভারী সুন্দর নাম।
- আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করতে পারি?
- করো,
- আপনি কি জানেন আমি আসলে কে?
- জানি মা।
- বলুন তো তাহলে,
- উহু, ওটা আমার আবিষ্কার। বলা যাবে না।
- না না না , আমি শুনবোই। শুনবোই, নাহলে কিন্ত কেঁদে দিবো।
- আহা! জিদ করে না লক্ষ্মী মেয়েটি।

এইভাবে খুনশুটি করতে করতে কখন যে সন্ধ্যা হয়ে গেলো, আনসারি সাহেব টের পেলেন না।

অধরা মেয়েটির সাথে আনসারির প্রায়ই দেখা হয়। খুনশুটি করতে করতে সময় কেটে যায়। ঠিক যেমনটা কেটে যেতো বাপ্পির সাথে।
মাঝে মাঝে খুনসুটি এবং দুষ্টুমি করতে করতে অধরা ঘাসের মধ্যেই ঘুমিয়ে পরে। তখন আনসারি পরম মমতা ভরে তাকিয়ে থাকেন। মেয়েটির মধ্যে অস্বাভাবিক বলতে কিছু দেখতে পান না তিনি। বরঞ্চ মেয়েটি খুবই সাধারন, খুবই সরল। এই সরলতাই মেয়েটিকে অসাধারণ করে তুলেছে। তাঁর টানা তানা চোখ এবং মুখে লেগে থাকা আবছা আবছা হাসি, যেন সৃষ্টিকর্তা পরম যত্নে বানিয়েছেন। হঠাত করেই আনসারির মনে হয়, অধরার মতো তার একটা মেয়ে থাকলে কত ভালোই না হতো!

একদিন আনসারি সাহেব দেখলেন, অধোরা একটা বিড়ালের পিছনে দৌড়াচ্ছে। এই প্রথম আনসারি সাহেব লক্ষ্য করলেন অধোরা মেয়েটি কৈশোরকাল পার করে ফেলেছে। শারিরীক গঠন পরিপক্বতার স্বাক্ষ্য দিলেও ভিতরে ভিতরে বাচ্চাই রয়ে গেছে অধোরা। “তোমার কি বিড়াল পছন্দ?”, আনসারি সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন।

- খুউব। আপনার পছন্দ না?
- হ্যাঁ। আপনার পছন্দ না?
- হ্যাঁ। আমিও পছন্দ করি।
- আপনার আর আমার পছন্দের কি মিল না?
- হ্যাঁ, অনেকাংশে।
- আপনি আমার মেলায় হারানো বাবা, হি হি।
- মানে?
- মেলায় হারানো ভাই হয় না? সেরকম মেলায় হারানো বাবা।
- ওওহ।
- দাঁড়ান, আপনাকে আজ থেকে বাবা ডাকবো।
- ধুর, সে কিভাবে হয়? আমি তোমার বাবা না তো।
- উহু। ওই বাবা না, আপনি আমার বিলাইতুতো বাবা। কেমন?
- হা হা হা, আচ্ছা। তাই হবে।
- এইতো আমার বিলাইতুতো বাবাটা।
- মাগো, তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করি?
- হ্যাঁ, অবশ্যই।
- তুমি কি যেকোনো কিছুর জন্য প্রস্তুত।

অধোরার শিশুসুলভ হাসিমাখা মুখটি গম্ভীর হয়ে যায়। অধোরা একটি কথাও বলে না।

“মাগো, তোমার কথার উপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। নীরবতা সম্মতির লক্ষণ হলেও আমি এক্ষেত্রে তোমার নীরবতাকে সম্মত না হওয়া হিসেবে ধরবো।“, আনসারি সাহেব বললেন।

- আপনি যেটা ভালো মনে করেন।
- এভাবে হবেনা মা। ঝেড়ে কাশো।
- আমি প্রস্তুত।

আনসারি সাহেব খালি অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করলেন,“হুম।“

রাত নটা।

রাত দুইটা বাসে ফিরতি বাসে খুলনা থেকে চিটাগাংইয়ের পথ ধরবেন আনসারি সাহেব এবং শারিন। যাবার আগে চেয়ারম্যান সাহেব দেখা করার জন্য আমন্ত্রণ পাঠিয়েছেন আনসারি সাহেবকে।

“চেয়ারম্যান সাহেব” শব্দটা শোনার পর আমাদের মনে যেরকম একটা অবয়ব ভেসে ওঠে, রহমান সাহেব, অবিকল সেরকম। বিশাল এক সিংহাসন জুড়ে বিরাজমান এবং হাতে লাঠি ধরা এক লোক, গায়ে পাঞ্জাবী, মুখে বিশাল পুরো গোঁফ। “এইখানে আপনেরা কি মতলবে আইছেন কন তো?”, চেয়ারম্যান সাহেব বললেন। “আমার এক স্টুডেন্টের কবর আছে এখানে, ওর নানুবাড়ি এই গ্রাম। ছেলেটা আমার খুব প্রিয় ছাত্র ছিলো। এজন্যই এখানে আসা। আজই রাতের বাসে চলে যাবো।“, আনসারি সাহেব বললেন।

- ওহ, তা নাম কি আপনের ছাত্রের?
- বাপ্পি।
- বাপ্পি! এই নামে কাওরে চিনিনা। অন্য কোনও নাম থাকলে কন।
- রাইসুল কবির বাপ্পী।
- ওওহ, চিনছি। পূব পাড়ার বাসিন্দা। ওর নানু মানুষ হিসেবে বেশ বজ্জাত। তা নাতি মরছে, এমনে তো খারাপ কথা বলা যায় না। যাই হোক, তারপরও দোয়া করি আল্লাহ বেহশত নসীব করুক।
- জ্বি, তা তো বটেই।
- মূল কথায় আসি, এইখানে কেন আইসেন সত্যি কইরা কন। সত্য কইলে ছাইড়া দিতে পারি।
শারিন চেয়ারম্যানের কথায় কিছুটা চমকে উঠলো। “ছেড়ে দেবেন মানে? আপনি কি করবেন আমাদের নিয়ে?”, শারিন বললো।
- ওই বেডী, বকোয়াজ বন্ধ। আগুন লইয়া বহুত খেলছোত, এখন আবার সাধু সাজো! কিচ্ছু বোঝো না? এতোকিছু ঘাটানোর পরও আশা রাখো তুমগোরে ছাইড়া দিমু? পাগলে কামড়াইছে আমারে?
- কি বলছেন এসব? কি এমন করেছি আমরা?

“আহা! শারিন, তুমি বুঝবে না এসব। এবং চেয়ারম্যান সাহেবও সবটা ক্লিয়ার না করলে বুঝবেন না কিছু। আমরা শুরু থেকেই ছিলাম দাবার গুটি। না! না! রহমান সাহেব, দুঃখিত কুন্ডূ মশাই, ভুলেও না। পুলিশ এক্ষুণি এসে পরবে। হাতের অস্ত্রটা ফেলে দিন। পালাতে আপনি এমনিতেও পারবেন না। আমদের মেরে পালিয়ে গেলেও রাস্তায় পুলিশের হাতে ধরা আপনি পড়বেনই। তাছাড়া যেহেতু আপনি কার্যত চেয়ারম্যান, আপনাকে আইনের আওতায় আনতে পুলিশকে প্রয়োজনীয় অর্ডার দেওয়ার জন্য সম্মানিত ম্যাজেস্ট্রেট সাহেবও আসছেন। আপনার এতো কষ্টে গড়া প্রতিপত্তি সব এক মুহুর্তেই শেষ হয়ে গেলো। অবশ্য একে রক্ষার জন্য চালটা আপনি ভালোই চেলেছেন। এতো বছর ধরে একটা মিথ্যাকে ডেভেলপ করেছেন। একটা মা মরা মেয়ের কাছ থেকে তার স্বাভাবিক জীবন কেড়ে নিয়েছেন। খালি আপনার দুর্ভাগ্য এইবার আনসারির সাথে আপনার টক্কর লেগেছে।

রহমান সাহেব হঠাত ত্রুদ্ধসৃষ্টিতে ডান দিকে তাকালেন। অধোরা সেখানে দাঁড়িয়ে আছে।

“হারামজাদী, মরার আগে তোর ভন্ডামীর একটা সুরাহা কইরা দিয়া যাই, দাড়া।“, বলেই কোমর থেকে ছুরি বের করে একছুট দিলেন অধোরার দিকে।

আনসারি সাহেব সোফায় বসা ছিলেন। ততোধিক বেগে দৌড় দিলেন। দৌড়ে রহমান সাহবের আগে গিয়ে নিচু হইয়ে আনসারি সাহেব তাকে ল্যাং দেওয়ার চেষ্টা করলেন এবং সফলও হলেন। হুমড়ি খেয়ে পরায় রহমান সাহেবের হাতের ছুড়িটা তার নিজেরই বুকে গেঁথে যায়।

ঘটনার আকস্মিকতায় অধোরা খুবই ভয় পায়, ভয়ে আনসারি সাহেবকে জড়িয়ে ধরে। আনসারি সাহেব অধোরার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকেন। ঠিক যেন বাবা তার মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।

সেই রাতে আনসারি সাহেব এবং শারিনের আর চিটাগাং যাওয়া হলো না। কন্ডু আত্মহত্যা করেছে বলে ধরে নেওয়া হয়।

পুলিশি ঝামেলা মিটলে ম্যাজেস্ট্রেট মাহবুব কবির আনসারি সাহেব এবং শারিনকে নিয়ে বসলেন। মাহবুব কবির আনসারি সাহেবের পূর্ব পরিচিত। সেই কারনেই আনসারি সাহেব রহমান সাহেবকে ধরার জন্য সবকিছু ম্যানেজ করতে পেরেছিলেন।
এদিকে অধোরা আনসারির কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে।

ঘরে চা দেওয়া হয়েছে। তবে সে চা বাইরে থেকে আনানো। ঘরের কর্তা মারা যাবার পর সেই ঘরের চুলা জ্বলবে না স্বাভাবিক। আনসারি সাহেব একটা সিগারেট ধরাতে চাইলেও অধোরার কথা ভেবে ধরালেন না।

“তাহলে শুরু থেকে বলুন আনসারি সাহেব, ঘটনাটার আদ্যপান্ত আমরাও শুনি।“, আনসারির উদ্দ্যেশ্যে বললেন মাহবুব সাহেব।

- আমাদের এখানে আসার পর অধোরার সাথে আমাদের যেসব ঘটনা ঘটেছে বা কথোপকথন হয়েছে সেসব আপনি জানেন আশা করছি।
- হ্যাঁ, সেটা আগেই বলেছেন।
- ঘটনার দুটো অংশ। প্রথ অংশ দৃশ্যত, বাকিটা অন্তর্নির্হিত। দৃশ্যত অংশটা হলো অধোরা। অন্তর্নির্হিত অংশটি হচ্ছে রহমান সাহেব বা কুন্ডু মশাই। প্রথমে শুরু করি কুন্ডু মশাইয়ের ঘটনা দিয়ে। এই লোকটা একটা নোংরা মন মানসিকতার লোক। সে মুন্সিগঞ্জের এক বনেদী হিন্দু পরিবারের চাকর ছিলো। তার একটা বাজে নেশা ছিলো। মৃত মহিলাদের দেহভোগ। মুন্সিগঞ্জে কোথাও কোনও মেয়ে মারা গেলে সে কোন না কোনও উপায়ে সেটা উপভোগ করতো। একদিন বাড়ির মেজ বৌমা কুন্ডুকে খারাপ কাজ করতে দেখে ফেলে। কুন্ডু উত্তেজনার বশে খুন করে ফেলে মেজ বৌকে। ওর কামনা তখনও শেষ হয়নি। সে মেজ বৌমার সাথে………
- মাই গড……
- বাড়ির লোকজন দেখে ফেলে। বাড়ির শক্তপোক্ত পালোয়ান ধরনের ছেলেমেয়ের অভাব ছিলো না। তাকে ইচ্ছেমত মেরে মৃত ভেবে জংগলে ফেলে দেয়। কিন্তু কুন্ডু বেচে রাতের আঁধারে সেই বাড়িতে আগুন দিয়ে ওখান থেকে পালিয়ে চলে আসে। এই গেলো এক অংশ। পরবর্তীতে সে এখানে এসে অধোরার মায়ের সাথে ভাব জমায়। অধোরার মা স্বামীর কাছ থেকে বেশ সম্পত্তি করেছিলেন। এসব সম্পত্তি দেখে লোভে পরে সে অধোরার মাকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে। তারপর নেশায় উন্মত্ত হইয়ে তাকেও মেরে ফেলে। বলা বাহুল্য সেই মারার পর ……………
- ছি! নোংড়া লোক একটা।
- আমার ধারনা যেকোনো ভাবেই হোক, অধোরা গোটা বিষয়টা দেখে ফেলে। সেই ছোট মনে নিজের মার সাথে এসব হতে দেখার পর যে কারও স্বভাবিক থাকা কঠিন। কুন্ডু হয়তো অধোরাকেও মেরে ফেলতো কিন্তু পরবর্তীতে সে জানতে পারে অধোরার ১৮ বছর পুর্ন হওয়ার আগে সম্পতি সব ট্রাস্টি বোর্ডের অধীনে থাকবে।
- আর অধোরার পরী টাইপ গুজব ?
- অধোরার সাথে……… বুঝতেই পারছেন। সেই লোকের জ্বরে মারা যাওয়াটা কাকতলীয়। কিন্তু এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে কুন্ডু অধোরার নামে আরও বেশি গুজব ছড়ায়। ওর উদ্দেশ্য ছিলো অধোরা যেন স্বাভাবিকভাবে কারও সাথে না মিশতে পারে। এতে অধোরা তার কৃতকর্ম ফাস করে দিতে পারে। তাছাড়া, অধোরাকে কোনও এক অজানা কারণে ভয় পেতে থাকে কুন্ডূ। সেই ভয়ের চোটেই একদিন অধোরার সামনে সব কিছু স্বীকার করে নেয়। এরপর অধোরা টেকনিক্যালি সুযোগ খুঁজতে থাকে। কোনও না কোনও ভাবে সে আমার ব্যাপারে জানে। আমাকে এখানে দেখে সে বিশ্বাস করতে শুরু করে আমিই ওকে এখান থেকে উদ্ধার করতে পারি। কুন্ডুর মুখোশ খুলে দিতে পারি আমি।
- কুন্ডু ওকে ভয় পেতে যাবে কেন?
- মেয়েটার দিকে কখনও তাকিয়েছেন? মেয়েটার মধ্যে অদ্ভুত কিছু একটা আছে। মেয়েটাকে দেখলেই কেমন যেন একটা মায়া জন্মে যায়, মনে হয় মেয়েটা যেন এই ভুবনের না, অন্য ভুবনের কেউ। অথচ ভিতরে মেয়েটা খুবই সাধারণ। এই সাধারণ বৈশিষ্ট্যই মেয়েটাকে অসাধারণ করে তুলেছে। ওর ওই চেহারা দেখেই ভয়ে লোকজন ওকে নিজেদের সব কথা নিজেদের মনের অজান্তেই বলে দেয়, এর উপর আছে কুন্ডুর গুজব। এভাবেই মেয়েটা সব কথা জেনে ফেলে যেটাকে সবাই ভাবে ও মনের কথা পড়ে নিতে জানে। একটা সময় ও নিজেও বিষয়টা উপভোগ করতে শুরু করে। সবাইকে বলে বেড়ায় সে চিন্তা চুরি করতে জানে। কুন্ডুর ভয়ের কারণ ওর অপরাধবোধ। ওর সামনেই ওর মাকে খুন করেছে অথচ ওকে বাচিয়ে রাখতে হচ্ছে। অপরাধবোধ একটা সময় ভয়ে রুপান্তরিত হয়।
- আর ওর পিঠের ক্ষত?
- আমার ধারণা ও স্কলিওসিসের প্রব্লেম আছে। মেরুদন্ডের হার বাকা, ছোট থাকতেই ওর অপারেশন হয়। এতো ধনী ঘরের মেয়ে চিকিৎসায় কমতি হবে না স্বাভাবিক। সেই ক্ষতটাকেই সবাই ডানা কাটা ক্ষত হিসেবে প্রচার করছে।
- ওওহ, এই কথা তো কারও মাথাতেই আসে নি। কিন্তু ওকে তো কোয়ালিফাইড ডাক্তার এসেও পরীক্ষা করে গিয়েছিলো। সে কেন ধরতে পারলো না।
- কে বললো সে ধরতে পারে নি? সে পুরোটাই ধরতে পেরেছে। কিন্তু মুখ খুলেনি, কুন্ডু বাবু টাকা কিংবা ভয় দেখিয়েছিলেন।
- হুম ,
- ওর কার্যত অভিভাবক তো মারা গেলো, এখন ওর দায়িত্বের কি হবে?
- ওর ১৮ বছর হতে এখনও অনেক বাকি আছে। ট্রাস্টি বোর্ড বিষয়টা দেখবে। মানে যেই ট্রাস্টি বোর্ডের অধীনে ওর মা উইল করে দিয়েছেন।
- আমার মতে ওর হোস্টেলে যাওয়াই উচিত, এভাবে একটা বাচ্চা মেয়ের একা থাকা ঠিক না। কত জায়গা থেকে লোকে আত্মীয়তা পাততে চলে আসে ঠিক নেই।
- ঠিক বলেছেন। আমিও তাই মনে করি। কিন্তু ও কি রাজি হবে?

এই সময়ে অধোরার ঘুম ভেঙ্গে গেলো। আধো ঘুম আধো জাগরণের চেহারায় এবার তাকে সত্যিকারের পরীর মতো লাগছে।
“মা গো, আমার যে এবার যেতে হবে?”, আনসারি সাহেব অধোরার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন।

- বিলাই বাবাই, তুমি চলে যাবে?
- হ্যাঁ মা।
- তুমি পসা।
- মা গো, সবাইকেই তো যেতে হয়।
- তুমি আবার আসবে তো?
- একটা শর্তে।
- বলো, আমি রাজি।
- তুমি পড়ালেখা আবার শুরু করো, সবকিছু ছেড়ে স্বাভাবিক হবে। তাহলেই আসবো।
- তোমার কথা আমি মানবো বাবাই, কিন্তু আমি জানি তুমি আসবে না। তুমি সবকিছু থেকে পালাতে ভালোবাসো। তোমার ঠিকানা আমাকে দাও। আমিই সময় করে তোমার সাথে দেখা করবো।

আনসারি সাহেব ঠিকানা লিখে দিলেন চিরকুটে।

যাওয়ার সময় অনুরোধ করলেন ম্যাজেস্ট্রেট সাহেবকে যেন এই গ্রামের শৃঙ্খলা এবং চেইন অব কমান্ড যেন ভেঙ্গে না পরে। বাপ্পীর ছবির এই গ্রামটিকে আনসারি সাহেব ভালবেসে ফেলেছেন। এই গ্রামের ক্ষতি হোক তিনি চান না।

যাওয়ার পথে দেখলেন ময়লার স্তূপ পোরান হচ্ছে, আনসারি সাহেব বাপ্পীকে নিয়ে লেখা খাতাগুলো আগুনে ফেলে দিলেন। শারিন অবাক হলো।

আনসারি সাহেব মুচকি হেসে বললেন, “বাপ্পীর সাথে আমার কিছু অভিজ্ঞতা আছে যেগুলো ব্যাখ্যাতীত। জানি না কেন, আমার মন এইগুলির ব্যাখ্যা খুঁজতে সায় দিচ্ছে না। মন বলছে, ‘ব্যাখ্যা তো অনেক খুজলে, কয়েকটা জিনিসের ব্যাখ্যা না পেলে এমন কি ক্ষতি?”


[মিসির আলী আমার অন্যতম প্রিয় একটি চরিত্র, আজাদ আনসারি চরিত্রটির অনুপ্রেরণা মিসির আলী সেটা নিরদ্বুধায় বলতে পারি, তবে দুটি একই ধাচের চরিত্র নয়, ভিন্নতা অবশ্যই আছে। আনসারিকে নিয়ে লেখা বাকি গল্পগুলোও ধীরে ধীরে ব্লগে প্রকাশ করলে কিছুটা ক্লিয়ার হওয়া যাবে।]

সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই নভেম্বর, ২০২১ দুপুর ১:০৪
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার কিছু ভুল!

লিখেছেন মোঃ খালিদ সাইফুল্লাহ্‌, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:৪৮

১। ফ্লাস্কে চা থাকে। চা খেতে টেবিলে চলে গেলাম। কাপে দুধ-চিনি নিয়ে পাশে থাকা ফ্লাস্ক না নিয়ে জগ নিয়ে পানি ঢেলে দিলাম। ভাবছিলাম এখন কি করতে হবে? হুঁশ ফিরে এল।... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিঃ ব্যাঙের বিয়েতে নামবে বৃষ্টি ...

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:০০



অনেক দিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা ছিল অনেক এই রকম যে চারিদিকে প্রচন্ড গরম। বৃষ্টির নাম নিশানা নেই। ফসলের মাঠ পানি নেই খাল বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশি ভাবনা ও একটা সত্য ঘটনা

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৭


আমার জীবনের একাংশ জুড়ে আছে; আমি চলচ্চিত্রাভিনেতা। বাংলাদেশেই প্রায় ৩০০-র মত ছবিতে অভিনয় করেছি। আমি খুব বেছে বেছে ভাল গল্পের ভাল ছবিতে কাজ করার চেষ্টা করতাম। বাংলাদেশের প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না ********************

লিখেছেন মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৩৫

যখন প্রথম পড়তে শিখেছি তখন যেখানেই কোন লেখা পেতাম পড়ার চেষ্টা করতাম। সেই সময় দোকানে কোন কিছু কিনতে গেলে সেই দোকানের লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। সচরাচর দোকানে যে তিনটি বাক্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×