somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ অদৃশ্য মানব

১৪ ই নভেম্বর, ২০২১ রাত ১০:২৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

(১)
নিজ রুমে বসে দুপুরের খাবার খাচ্ছেন আজাদ আনসারী সাহেব। স্থানীয় এক ক্যাটারিং সার্ভিস থেকে খাবার অর্ডার করেন তিনি। আজ তরকারী রুই মাছের সাথে সীমের বিচি। তার অত্যন্ত প্রিয় খাবার। ক্যাটারিং এর মালকিন মেয়েটা নিজেই খাবার দিতে আসে আনসারি সাহেবকে। মেয়েটার নাম শারিন, আইন বিভাগে পড়াশোনা করছে। পাশাপাশি ক্যাটারিং চালায়। আনসারি সাহেবকে বিশেষ শ্রদ্ধা করেন। তার সামনেই আনসারি সাহেব একদিন বলে ফেলেছিলেন রুই মাছ দিয়ে সীমের বিচি রান্নার কথা। শারিন সময় সুযোগ বুঝে সেটা রান্না করে দিয়েছে।

কিন্তু তারপরও খাবারে মন দিতে পারছেন না তিনি। ঘরে একজন অপ্রত্যাশিত আগন্তুক এসে বসে আছে। অন্য কারও সামনে খেতে লজ্জা বোধ করেন আনসারি সাহেব। এই হয়েছে উনার এক যন্ত্রনা। ঢাকার সেই রহস্যজনক একের পর এক বাচ্চার অন্তর্ধানের বিষয়টি সমাধানে পুলিশকে সাহায্য করেছিলেন তিনি। সেই থেকে তার খ্যাতি ছড়িয়ে গেছে অনেকটা “সব সমস্যার সমাধানকারী” হিসেবে। “আজব…”, মনে মনে ভাবলেন আনসারি সাহেব। “আমাকেই কেন সব সমস্যা বলতে হবে? আমি কি শার্লক হোমস?” পরক্ষনেই নিজের চিন্তা বদল করলেন আনসারি সাহেব। “যে এসেছে, বসে থাকুক। আমার বাড়ি, আমি লজ্জা পাবো কেন?”
ধীরে সুস্থে খাওয়া শেষ করে আগন্তুকের দিকে তাকালেন। মুটামুটি গোলমাটল আকারের একজন লোক। একটা মুটামুটি ঢিলা শার্ট গায়ে আর গ্যাবার্ডিনের প্যান্ট পরনে। শার্টের স্লীভস কনুই পর্যন্ত ভাজ করে রাখা। চোখে মোটা ভারী ফ্রেমের একটা চশমা। দেখলে মনে হয় যেন আপাদমস্তক বইপড়ুয়া। পায়ে স্নিকার্স। লোকটির বয়স তিরিশের উপরে হবে ধারনা করলেন আনসারি সাহেব।
“আপনার কাছে কি মোবাইল আছে?”, আগন্তুকের উদ্দেশ্যে বললেন আনসারি সাহেব।

- জ্বি স্যার।
- কটা বাজে?
- পনে চারটার মতো,
- দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চললো, এইটা কি কোনও সময় কারও সাথে দেখা করতে আসার?

কিছুক্ষন মৌন থাকার পর জবাব দেয় আগন্তুক, “আসলে ইন্সপেক্টর লিখন সাহেব বলছিলেন আপনি এই সময়েই একটু ফ্রী থাকেন। আমার সমস্যাটা আপনাকে জানানোর জন্য এইটাই একটা ভালো সময়।“

- আপনার নাম্টা,
- জ্বি, মাহিম ইশরাক।
- জনাব মাহিম ইশরাক সাহেব, আমাকে আপনার শার্লক হোমস বলে মনে হলো কেন?
- না না স্যার, আসলে আমার প্রতিবেশী ঘোষ বাবু ইস্পেক্টর লিখন সাহেবের পরিচিত। উনাকে আমার সমস্যার কথা বলাতে

ঘোষবাবু বলেছিলেন লিখন সাহবের সাথে যোগাযোগ করতে। লিখন সাহেবের সাথে যোগাযোগ করার পর লিখন সাহেব আপনার সাথে কথা বলতে বলেন। উনি বললেন আপনি যেকোনো সমস্যার সমাধান করতে তো পারেন ই, উপরুন্ত কাউকে খালি হাতে ফিরিয়ে দেন না।

- এখন তাহলে আপনাকে বলি শুনুন, আপনার লিখন সাহেব আপনাকে সম্পুর্ন বিভ্রান্তিকর একটা তথ্য দিয়েছেন।
- স্যার, আমি আসলে ঢাকা থেকে চিটাগাং এসেছি অনেক আশা নিয়ে।
- আশা নিয়ে চিটাগাং এসেছেন, নিরাশা নিয়ে ঢাকা ফিরে যান।
- স্যার, লিখন সাহেব বলছিলেন আপনি নাকি প্রচন্ড যুক্তিবাদী একজন মানুষ, নিজের যুক্তির উপর নাকি আপনি মারাত্বক রকমের আত্মবিশ্বাসী।

কথায় বোধহয় চিড়ে ভিজলো। আনসারি সাহেব একটু নরম হলেন যেন। মাহিম ইশরাক সাহেব এই ফাঁকে পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে আনসারি সাহেবের হাতে দিলেন। আনসারি সাহেব কাগজটা খুলে দেখলেন, তাতে লেখা ছিলো;

আনসারি সাহেব,
মাহিম সাহেবের সমস্যাটা আসলেই গুরুতর। আর কেউ না জানলেও আমি জানি যে উনার এই সমস্যাটার যৌক্তিক ব্যাখ্যা এবং সুষ্ঠ সমাধান আপনি ছাড়া আর কেউ দিতে পারবেন না। উনার প্রতিবেশী ঘোষবাবু পুলিশকে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ উভয়ভাবেই সাহায্য করেছে। উনি খুব করে বললেন বলেই আপনাকে অনুরোধ করছি। বাকিটা আপনার ইচ্ছা। তবে আমার একান্ত অনুরোধ উনার সমস্যাটা শুনুন একবার।
ইন্সপেক্টর লিখন



চিরকুটটা পড়ার পর কিছুক্ষণ মৌন হয়ে থাকেন আনসারি সাহেব। তারপর মাহিম সাহবের উদ্দেশ্যে বললেন, “দুধ চা খান তো?” উত্তরে সম্মতি জানায় মাহিম ইশরাক। আনসারি সাহেব জানালা দিয়ে প্রায় চিৎকার করে বললেন, “এই কিসমত, দুইটা চা দিয়ে যাস তো চারতলায়।“ “হ্যাঁ, তাহলে বলুন ইশরাক সাহেব, যা বলতে ঢাকা থেকে চিটাগাং চলে এসেছেন।“

"স্যার, আসলে কিভাবে শুরু করবো বুঝতে পারছি না, মানে আমি যেভাবে বিষয়টিকে দেখছি, আপনি সেভাবে দেখবেন কি না .....

- সমস্যা নেই, আপনি আপনার মতো করেই বলুন।
- আসলে স্যার, আমার স্ত্রীকে....... পিশাচে ধরেছে।

আনসারি সাহেবের মনে হচ্ছিল চিৎকার করে একটা ধমক দিয়ে বলেন, "ব্যাটা এই অসময়ে পেট বানানো গল্প শুনাতে এসেছিস।" নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করলেন তিনি।

- আপনার এরকম মনে হওয়ার কারণ,
- রাত বারোটার পরপরই ওর উপর কিছু একটা ভর করে। উচ্চস্বরে চিৎকার আর গালিগালাজ করে। ওর আওয়াজ শুনলে রক্ত হিম হয়ে আসে। আর যখন ওর উপর এই...... মানে ভর করে, তখন উৎকট একটা দুর্গন্ধে চারপাশ ছেয়ে যায়।
- হুম, তো এইসব সমস্যা তো হুজুর ডেকে সমাধান করানো উচিত, আমার কাছে এসেছেন কেন?
- হুজুর, আলেম সবাইকেই ডেকেছিলাম, সবাই ব্যার্থ হয়েছে। অনেকে নিজেদের বিভিন্ন তত্ত্ব দিচ্ছে, বলছে.......ওকে ডিভোর্স দিতে, দোষ আছে।
- ওহ, সব টোটকা বিফলে যাওয়ার পর এসেছিন। তা বেশ! আপনার স্ত্রীর সম্পর্কে বিস্তারিত বলুন।
- আমার স্ত্রীর নাম রুদাবা মাশিয়াত প্রাচী, আমাদের বিয়ের তিন বছর হলো। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে মাস্টার্স পাস করার পর একটা অর্গানাইজেশনের তত্ত্বাবধানে রিসার্চ করার সুযোগ পাই। সেই কাজেরই এক সূত্রে ওর সাথে দেখা। গরীব ঘরের মেয়ে এস এস সি পাস এর বেশি পড়েনি। এরপর ওকে আমার এক বন্ধুর বুটিক কারখানায় কাজ পাইয়ে দেই। সেই কৃতজ্ঞতাবোধ থেকেই প্রেমের শুরু, এরপর.......
- জনাব ইশরাক সাহেব, আপনি অনেক কিছুই গোপন করে গেছেন আমার কাছ থেকে। সেটা করতেই পারেন। আপনার ব্যাপার। কিন্তু এভাবে তথ্য গোপন করলে আমি কোনও সমাধানেই আসতে পারবো না। আপনার স্ত্রীর সাথে আপনার সম্পর্কটা কৃতজ্ঞতাবোধ থেকে শুরু সেটা সত্য, তবে সেই কৃতজ্ঞতাবোধের কারণ আরও গভীরে। আমার ধারণা আপনার স্ত্রীর জীবনের একটা অন্ধকার অংশ রয়েছে, সেটা থেকেই যে উনার সমস্যার সূত্রপাত, এতটুকু আমি বুঝতে পারছি। সেই অন্ধকার অংশকে অস্বীকার করে বাস্তবতাকে উপেক্ষা করতে পারবেন না।

ইশরাক সাহেব কিছুক্ষণ মৌন হয়ে রইলেন। তারপর বললেন, "প্রাচীর সাথে আমার দেখা হয় পতিতালয়ে। আমার রিসার্চের বিষয়বস্তু ছিলো পতিতালয়ের নারী এবং শিশুদের নিয়েই। প্রাচী ওর আসল নাম না। ওর আসল নাম মৌসুমি। এই নামটা আমিই ওকে দেই। প্রাচী সাজিদ নামের এক ছেলেকে ভালোবাসতো। সেই ছেলে প্রাচীকে পতিতালয়ে বিক্রি করে দেয়। প্রাচী যখন বুঝতে পারে, তখন বড্ড দেরী হয়ে যায়। প্রাচী আমাকে তার জীবনের গল্প বলে, তারপর কাঁদতে কাঁদতে বলে সে এই জীবন থেকে মুক্তি চায়। তখন আমি ওকে একটা বুটিক কারখানায় কাজ পাইয়ে দেই। ও খুব আন্তরিক। অল্প কদিনেই কাজে অগ্রগতি করে। এরপরের ঘটনা বুঝতেই পারছেন। সব কিছু ভালোই চলছিলো। হঠাৎ এক মাস আগে রাত বারোটার পর ওর ওইরকম সমস্যা শুরু হয়। প্রতিদিন এইরকম উপদ্রব বড় একটা সমস্যা হয়ে দাড়ায়। পরে একটা সিদ্ধান্তে আসি বাড়ির সব পাড়া প্রতিবেশি মিলে। রাতের বেলা আমার ফ্ল্যাটের মেইন দরজা তালা দিয়ে আমি ঘোষবাবুর ফ্ল্যাটে ঘুমাই। আর রাত জুড়ে আমার ফ্ল্যাট থেকে ওর গালিগালাজ, চিৎকার শোনা যায়। সকাল হলেই শান্ত। তারপর আবার রাতে তান্ডব শুরু।"

আনসারি সাহেব মৌন হয়ে রইলেন কিছুক্ষণের জন্য। কি যেন ভাবছেন। তারপর বললেন, "আপনি মনে হয় প্রচুর বই পড়েন, গল্পের বই।"

- হ্যাঁ, কলেজ ভার্সিটিতে পড়তাম প্রচুর। এখন তো সময়ই হয় না। কিন্তু আপনি কিভাবে জানলেন স্যার?
- আপনি আমার বুকসেল্ফের বইয়ের দিকে বারবার তাকাচ্ছিলেন, কিন্তু সেখানে গল্পের বইয়ের বদলে বেরসিক অংকের বই দেখে আপনার চোখে অভিভূত হওয়ার পরিবর্তে এক প্রকার হতাশা দেখেছি।

মৃদু হাসলেন ইশরাক সাহেব।

"দেখুন ইশরাক সাহেব, পিশাচ টিশাচ নিয়ে রিসার্চ করা আমার কর্ম না। আমি গনিত শিক্ষক। গনিত নিয়েই থাকি। আমার ধারণা, গল্পের বইয়ের জন্য আপনি আপনার স্ত্রীকে সময় দিতে পারেন না। আমি বলবো, আপনি আপনার স্ত্রীকে কোনও মানসিক চিকিৎসা কেন্দ্রে নিয়ে যান। আর উনি সুস্থ হলে উনাকে বেশি বেশি সময় দিন। এখানে আর আসার প্রয়োজন নেই। আপনি এবার আসতে পারেন।", একনাগাড়ে বলে গেলেন আনসারি সাহেব।

ইশরাক সাহেব একটুও প্রতিবাদ করলেন না, আনসারি সাহেবের ঘর থেকে বেরিয়ে আসলেন।
সেই রাতে আনসারি সাহেবের ঘুম হলো না। ইশরাক সাহেবকে চলে যেতে বললেও উনার বর্নিত ঘটনাটা ওনার মনের ভিতর ঝড় তুলছিলো। বারবার মনে হচ্ছিলো কিছু একটা আছে এর মধ্যে, যেটা খালি চোখে দেখা যাচ্ছে না।
রাত বাড়লে আনসারি সাহেব আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে পড়েন।

(২)

ছয় থেকে আট বছরের একটা বাচ্চা জানলা দিয়ে তাকিয়ে আছে। আপনমনে বাগানের গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে সে। হঠাৎ রিনরিনে গলার নারীকন্ঠ শোনা গেলো,

“আমার গাছ সোনাটা কোথায় গো?”

বাচ্চাটা গাছ দেখা বাদ দিয়ে মায়ের কাছে দৌড়ে চলে যায়। একেবারে মায়ের কোলে উঠে যায়। শক্ত করে মায়ের গলা জড়িয়ে থাকে। মা ছেলেটিকে কিছুক্ষণ আদর করে। তারপর ছেলেটির কানে কানে ফিসফিস করে বলে,

“ইশরাক সাহবের স্ত্রী থেকে যত দূরে থাকবে, ততই তোমার মঙ্গল।“

ধড়ফড় করে বিছানা ছেড়ে উঠলেন আজাদ আনসারি সাহেব। প্রায়ই এইধরনের আজগুবি স্বপ্ন দেখেন তিনি। তিনি নিজেও জানেন না এই ধরনের স্বপ্নগুলোর উৎস কি। একটু আগে স্বপ্নে যে ছেলেটিকে দেখলেন তিনি, সেটা তারই ছেলেবেলা কি না এটাও জানেন না।

মোবাইলটা নিয়ে সময় দেখলেন আনসারি সাহেব। ভোর পাঁচটা বাজে।
বিছানার পাশ থেকে নোটবুকটা বের করে লিখন সাহেবের নাম্বারে কল দিলেন তিনি।

(৩)

টিং টং, টিং টং,

দরজায় বেল পরলো, ইশরাক সাহেবের কোনও কিছুই ভালোলাগছে না। স্ত্রীর অসুস্থতা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। সুস্থ হওয়ার নাম নিচ্ছে না। আর এদিকে ভর সন্ধ্যায় ঘরে অনাহুত অতিথির আগমন। যথেষ্ট বিরক্তির সাথেই তিনি দরজা খুললেন।
“একি স্যার, আপনি!”

- ভিতরে আসতে পারি?
- অবশ্যই স্যার, কিন্তু আমার ঠিকানা জানলেন কি করে,
- লিখন সাহেবের কাছ থেকে জেনেছি।
- আমাকে বলতেন, আমিই আপনার থাকা খাওয়ার ব্যাবস্থা করতাম।
- না, তার আর দরকার হবে না। আজ রাত দশটার বাসেই চিটাগাং চলে যাবো। আপনি আপনার স্ত্রীকে ডাকুন।

ইশরাক সাহেব তার স্ত্রীকে ডাকতে চলে গেলেন, ড্রইং রুমে সোফায় আরাম করে বসলেন আনসারি সাহেব এবং লিখন। আজ সাদা পোশাকে আনসারি সাহেবের সাথে এসেছেন তিনি।

বাড়িতে ঢুকেই কেমন যেন অশুভ অশুভ একটা অনুভুতি হলো আনসারি সাহেবের।

ইশরাক সাহেব তার স্ত্রীকে নিয়ে ড্রইংরুমে প্রবেশ করলেন। ইতিমধ্যে সেখানে যোগ দিয়েছেন ঘোষবাবু। ইশরাখ সাহেব তার স্ত্রীকে সোফার এক সাইডে বসিয়ে দিয়ে তিনি আরেক সাইডে বসলেন।

ইশরাক সাহেবের স্ত্রীর চেহারা দেখলেই যে কেউ বলে দিতে পারবে যে সে অসুস্থ। চোখের নীচে কালি, মুখটা কেমন ক্লান্ত অবসন্ন। ড্রইং রুমে সবার সামনে ঘোমটা দিয়ে মাথা নিচু করে বসলেন।

আনসারি সাহেব কোনও রূপ ভনিতা ছাড়াই প্রশ্ন করলেন, “আপনার নাম কি রুদাবা মাশিয়াত প্রাচী?”

- জ্বী,
- ভারী সুন্দর নাম। আপনাকে কিছু প্রশ্ন করতে চাই, করবো?
- জ্বি অবশ্যই।
- দুই এর সাথে এক যোগ করলে কত হয়?
- তিন।
- দুই এর সাথে দুই যোগ করলে?
- চার।
- তিন?
- পাচ।
- চার?
- ছয়।
- পাঁচ?
- সাত।
- ছয়?
- আট।
- সাত?
- নয়।

ইন্সপেক্টর লিখন এবং ঘোষবাবু প্রায় বলতে যাচ্ছিলেন যে আনসারি সাহেব কি ধরনের পাগলামি শুরু করেছেন? কিন্তু হঠাৎই তারা একটা বিষয় প্রত্যক্ষ করলেন। ইশরাক সাহেবের স্ত্রী যেন ক্রমশই উত্তেজিত হয়ে পরছেন। তার হাত অনবরত কাপছে। সেই কম্পন ধীরে ধিরে বেড়েই চলেছে।

আনসারি সাহেব আর দেরি করলেন না। “লিখন সাহেব, ইশরাক সাহেবকে তাড়াতাড়ি বাইরে নিয়ে যান, আর ঘোষ বাবু আপনি এই ফ্ল্যাট বাইরে থেকে তালা দিয়ে দিন। এখন কোনও প্রশ্ন করবেন না দয়া করে। সব কিছু পরেও ব্যাখ্যা করা যাবে।“, লিখন সাহেব আর ঘোষবাবুর উদ্দেশ্যে প্রায় ফিসফিসিয়েই কথাগুলো বললেন আনসারি সাহেব।

ইশরাক সাহেবকে নিয়ে বের হয়ে গেলেন ঘোষ বাবু আর লিখন সাহেব।
“মিসেস ইশরাক, আপনি আপনার রুমে যান এবার।“, আনসারি সাহেব বললেন। মিসেস ইশরাক ঠায় সোফায় বসে রইলেন। “মিসেস ইশরাক আপনাকে রুমে যেতে বলেছি”, আগের চেয়ে কিছুটা চড়া গলায় আগের কথার পুনরাবৃত্তি করলেন আনসারি সাহেব। মিসেস ইশরাক সোফা থেকে উঠে দাড়ালেন।

আনসারি সাহেব তার পিছু পিছু গেলেন। মিসেস ইশরাক রুমে ঢোকার সাথে সাথেই রুমের দরজা বাইরে থেকে আটকিয়ে দিলেন তিনি।
“এই, এই, এই, এই কুত্তা, কুত্তার বাচ্চা, তোরে……”

আনসারি সাহেব ভয়াবহ কিছুর মুখোমুখি হওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলেন। কিন্তু সেটা এতোটা ভয়াবহ সেটা আগে ভাবতে পারেন নি তিনি। গল্পে পাঠকরা যতটা সহজে পড়ে ফেলছেন, সেই কথাগুলো হজম করা বাস্তবে এতোটা সহজ নয়। এরকম মোটা কন্ঠস্বর শুনে যেকোনো যুক্তিবাদী মানুষেরই রক্ত হিম হয়ে আসবে।

আনসারি সাহেবের ক্ষেত্রেও এর ব্যাতিক্রম হয় নি। শুরুতে তিনিও কিছুটা ঘাবড়ে গেলেও পরে ঠিকই নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ আনতে সক্ষম হন তিনি। নিজেকে নিজে বলতে থাকলেন, “আওয়াজ শুনে ঘাবড়ানোর কিছু নেই, দ্যাটস জাস্ট নাথিং, বাট এ সিম্প্যাথেটিক রিএকশন।“

কিন্তু সেই দানবীয় কন্ঠস্বর যেন আনসারি সাহেবের মনস্তত্ত্বের সাথে খেলা করছে। ক্রমাগত গালিগালাজ করে চলেছে রক্ত হিম করা কন্ঠে। সেই সাথে উৎকট দুর্গন্ধ।

“হ্যালুসিনেশন, ইটস হ্যালুসিনেশন। এগুলা শুধুমাত্রই তোমার মস্তিস্কের সৃষ্টি। বাস্তবে এর কোনও অস্তিত্ত্ব নেই,।“, পুনরায় নিজেকে প্রবোধ দিলেন আনসারি সাহেব।

“এই বিজন্মা, ওই বেডি তোরে স্বপ্নে কয়া দেয় নাই? আমার লগে লাগতে না আইতে!”

আনসারি সাহেব চমকে উঠলেন। উনি স্পষ্ট অনুভব করতে পারছেন যে তিনি দুর্বল হয়ে পরছেন ধীরে ধীরে। শীঘ্রই তাকে কিছু একটা করতে হবে। যুক্তি দিয়ে আক্রমনে যেতে হবে। চোখের সামনে তিনি যে ভ্রম দেখছেন, সেটাকে যুক্তি দিয়ে জয় করতে হবে। যুক্তির উপরে কোনও কিছুই নেই। আজ উনার অগ্নিপরীক্ষা। মনস্তাত্ত্বিক খেলায় তাকে জয় ছিনিয়ে আনতে হবে।

“আপনার মুখের ভাষা যে এতোটা সুন্দর, সেটা তো আগে জানা ছিলো না সাজিদ সাহেব।“, খুবই ধীরে কন্ঠে বলার চেষ্টা করলেন, কিন্তু তিনি স্পষ্ট অনুভব করতে পারছেন, তার কন্ঠটা কেঁপে কেঁপে উঠছে।

দানবীয় কন্ঠের চিৎকার আগের চেয়ে বেড়ে গেলো। গালিগালাজ করে ক্রমাগত আনসারি সাহেবকে বিদ্ধ করছে। একটু পর পর রুমের বন্ধ দরজায় ধাক্কা মারছে। যেন এক্ষুনি আনসারি সাহেবকে কামড়ে ছিড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলবে।
আনসারি সাহেব তার আত্মবিশ্বাস ফিরে পেতে শুরু করেছেন। এবার আর তার কন্ঠে কাপুনি নেই। ধীরস্থির কন্ঠে তিনি বললেন, “সাজিদ সাহেব, আপনাকে একটা কথা বলে রাখি। দুনিয়ার সবচেয়ে বড় ভয়ানক কাজ হচ্ছে কেউটে সাপ নিয়ে খেলা করা। তার চেয়েও ভয়ানক হলো আনসারির মনস্তত্ত্ব নিয়ে খেলা করা।“

ঘরের মধ্যে যেন ঝড় বয়ে যাচ্ছে।

গালিগালাজ আর উৎকট দুর্গন্ধ, দুটোর প্রকোপই বেড়ে চলেছে। কিন্তু আনসারি সাহেব ঠিকই বুঝলেন, পরিস্থিতি তার নিয়ন্ত্রনে চলে আসছে।

আনসারি সাহেব এবার তার মোক্ষম চালটা দিলেন, “আপনার রুমের দরজাটা আমি খুলে দিচ্ছি। আপনাকে সুযোগ দিচ্ছি আমার কাছাকাছি আসার। সামনে পেলে আমাকে কি করবেন?”

কাঁচা খায়ালামু শুয়োরের বাচ্চা, একবার খুইলা দেকই না”, জবাব এলো।

আনসারি সাহেব রুমের দরজা খুলে দিলেন। পিশাচরূপী মিসেস ইশরাক এগিয়ে এলো, যেন মুহূর্তের মধ্যেই আনসারি সাহেবকে শেষ করে দিবে। কিন্তু মাঝপথেই থেমে গেলো। তার গলার কাছে কি যেন একটা আটকে গেছে। প্রানপণ শক্তিতে গলা চেপে ধরেছে। যেন এইমাত্র প্রানঘাতী কিছু একটা খেয়ে ফেলেছে।

এই সময়ে আনসারি সাহবের অদ্ভুত এক অনুভুতি হলো। যেন তিনি শূন্যে ভাসছেন। রুমের মধ্যে একটু আগে যে উৎকট দুর্গন্ধ ছিলো, সেখানে ভুসভুস করে মিষ্টি একটা ফুলের গন্ধ বের হচ্ছে।
জ্ঞান হারানোর আগে ইন্সপেক্টর লিখন এবং ঘোষবাবুর মুখটা স্পষ্ট দেখতে পেলেন।

(৪)

পাঁচদিন পর হাসপাতালে জ্ঞান ফেরে আনসারি সাহেবের।
সেদিনের সেই মনস্তাত্ত্বিক খেলার পর অজ্ঞান হয়েছিলেন আনসারি সাহেব। মারাত্মক জ্বর আসে উনার। এই পাঁচদিনে লিখন সাহেব, ঘোষবাবু এবং ইশরাক সাহেব শঙ্কায় ছিলেন এই বুঝি না উনার প্রাণয়ায়ু বেরিয়ে যায়। কিন্তু অবশেষে জ্ঞান ফেরে আনসারি সাহেবের।
এদিকে সেদিন মিসেস ইশরাকও অজ্ঞান হয়ে পরে ছিলেন। তবে তার গুরুতর কিছু হয় নি। আর ঐ সমস্যাটা একদম চলে যায়।
সেদিন বাইরে থেকে লিখন, ঘোষবাবু আর ইশরাক সাহেব গালাগালি শুনছিলেন। এক সময় তারা চিন্তিত হয়ে পরেন। তখন ঘোষবাবু সিদ্ধান্ত নেন দরজার তালা খুলে অবস্থা দেখবেন। এরপর তালা খুলে আনসারি সাহেব আর মিসেস ইশরাকের জ্ঞানহীন দেহ মাটিতে পরে থাকতে দেখেন।

আজ হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন আনসারি সাহেব। দুপুরে খাওয়াদাওয়ার আয়োজন হয়েছে ইশরাক সাহেবের বাড়িতে। রান্না করেছেন মিসেস ইশরাক। সেখান থেকে আনসারি সাহেব বিকাল পাচটার গাড়িতে উঠে চিটাগাং চলে যাবেন।
খাওয়া শেষে ঘোষবাবু প্রসঙ্গটা তুললেন, “সত্যি আনসারি সাহেব, আপনি যেই সাহসটা দেখালেন, সেটা আসলেই প্রশংসার দাবিদার। কিন্তু আমরা ঘটনার নেপথ্যে জানতে চাই। মূল সমস্যাটা কোথায় ছিলো, দয়া করে আমাদের খুলে বলুন।‘
“আমার বলতে সমস্যা নেই। কিন্তু এতে ইশরাক সাহেবের ব্যাক্তিগত জীবন নিয়ে টানাহ্যাঁচড়া করা হবে। উনি এবং উনার স্ত্রী না চাইলে তো আর বলতে পারি না।“, জবাব দিলেন আনসারি সাহেব।
ইশরাক সাহেব এবং তার স্ত্রী সম্মতি দিলেন।

আনসারি সাহেব আয়েশ করে একটা সিগারেট ধরালেন। তারপর বলতে লাগলেন, “প্রথম দেখায় ইশরাক সাহেব আমাকে যা যা বলেছেন, সেখানে অনেক ফাঁক ছিলো, তার মধ্যে প্রধান যে বিষয়টা আমার চোখে পরে, সেটা হলো, মিসেস ইশরাককে এক লোক ভালোবেসে প্রতারণা করে তাকে তাকে পতিতালয়ে বিক্রি করে দেয়।

খটকাটা এখানেই বাঁধে। কোনও লোক প্রেমে বিশ্বাসঘাতকতার স্বীকার হলে সে এতো সহজে কাওকে বিশ্বাস করতে পারে না। সেখানে ইশরাক সাহেবকে বিশ্বাস করে একেবারে তার জীবন কাহিনী বলে ফেলে মিসেস ইশরাক। হজম হচ্ছিলো না।“
পিনপতন নীরবতা।

আনসারি সাহেব আবার বললেন, “আমার ধারনা, ইশরাক সাহেব আমাকে বা অন্য সবাইকে যা শুনিয়েছেন, সেসব সত্য নয়। মানে মিসেস ইশরাক, ইশরাক সাহেবকে মিথ্যা ঘটনা বলেছেন তার সিম্প্যাথি আদায় করে উপরে উঠার জন্য। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি ইশরাক সাহেবের প্রতি দুর্বল হয়ে যান। ঘটনা সত্যি মিসেস ইশরাক?”
মিসেস ইশরাক মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে আছেন।

“এবার মুল কথায় আসি। সাজিদ নামের কোনও ছেলে উনাকে কখনোও ধোঁকা দেন নি। বরঞ্চ উনিই সাজিদ নামের এক ছেলেকে ধোঁকা দিয়ছেন, সেই ছেলে মিসেস ইশরাককে অনেক ভালোবাসতো। আমার ধারনা মিসেস ইশরাক ধোঁকা দেওয়ার কারনে ছেলেটি আত্মহত্যা করে। কথা সত্যি মিসেস ইশরাক?”, আনসারি সাহেব আবারো বললেন।“
মিসেস ইশরাক ফুপিয়ে ফিপিয়ে কাঁদছেন।

বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আনসারি সাহেব বললেন, “ইশরাক সাহেব আপনাকে অনেক ভালোবাসেন। আপনি সেই ভালবাসার সাথে সাজিদের ভালোবাসার একটা মিল খুঁজে পান এবং অনুশোচনায় ভুগতে শুরু করেন। এক সময় নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। আপনার বারবার মনে হতে থাকে সাজিদের অতৃপ্ত আত্মা আপনাকে বারবার অভিশাপ দিচ্ছে। একসময় সাজিদের সেই দুঃখ অনুভব করতে করতে আপনিও সাজিদের একটি প্রতিরুপ হয়ে যান। বিজ্ঞানের ভাষায় একে স্পিরিট পারসোনালিটি বা দ্বৈত স্বত্ত্বাও বলে।“
“আর সেই আওয়াজটা?”, ইন্সপেক্টর লিখন প্রশ্ন করলেন।

আনসারি সাহেব জবাব দিলেন, “সিম্প্যাথেটিক রিএকশন, যেমন ধরুন একটা জায়গায় যদি তিন থেকে চারটি বোমা থাকে, একটা বোমা ফাটলে বাকি সব বোমাগুলাও কিন্তু ফেটে যাবে। আপনারা সবাই ইশরাক সাহেবের ওয়াইফের এইরকম অবস্থায় চিন্তিত। সে চিন্তা থেকেই আপনারা ওরকম রক্ত হিম করা আওয়াজ শুনেছেন। আপনি যদি আশেপাশের বাসাবাড়িতে খোঁজ নিয়ে দেখেন, তাহলে দেখবেন তারা কেউই এই আওয়াজ শোনেননি। অথচ আমি যেই আওয়াজটা শুনেছি, তাতে গোটা পুরানা ঢাকার এলাকার মানুষের শুনতে পাওয়ার কথা।“

একমত হলেন ইন্সপেক্টর লিখন।
“আর ওই দুর্গন্ধ?”, ঘোষবাবু প্রশ্ন করলেন।
“আমরা ছোটবেলায় পিশাচ তাড়ানো দেখে অভ্যস্ত। যারা পিশাচ তাড়ায়, তারা পরিবেশ ভীতিকর করে তোলার জন্য টেকনিক্যালি এরকম মরাপচা বোটকা গন্ধ ছড়িয়ে দেয়। সেখান থেকে আমাদের মনে সেট হয়ে গেছে, যে পিশাচ আসলেই দুর্গন্ধ হবে। এখান থেকেই আমাদের সবার মনে হ্যালুসিনেশন তৈরী হয়েছে।“, জবাব দিলেন আনসারি সাহেব।
“আর ওই কিসব নামতা জিজ্ঞাসা করছিলেন ওকে?”, ইশরাক সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন।

আনসারি সাহেব জবাব দিলেন, “আমরা সাধারণ মানুষরা যতটা অনায়াসেই নিজেদের মস্তিষ্কের উপর নিয়ন্ত্রন আনতে পারি, সবার পক্ষে সেটা সম্ভব নয় ইশরাক সাহেব। অন্তত কারও জীবনের যদি কোনও অন্ধকার দিক থাকে তাদের পক্ষে বিষয়টা অনেক সংগ্রাম করার মতোই। নিজের মস্তিষ্কের উপর নিয়ন্ত্রন হারিয়েছেন বলেই আপনার ওয়াইফের দ্বৈত স্ব্ত্ত্বা তৈরি হয়েছে। যখন আমরা কোনও প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য ভাবি, তখন আমাদের মস্তিষ্ক আমাদের নিয়ন্ত্রনে আসতে শুরু করে। মিসেস ইশরাক উনার মস্তিষ্কের উপর কতক্ষন নিয়ন্ত্রন রাখতে পারেন, সেটা দেখার জন্যই ওইভাবে ক্রমাগত নিউমেরিকাল প্রশ্ন করে যাচ্ছিলাম। আমি এই ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলাম যে, মিসেস ইশরাক উনার মস্তিষ্কের উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারালেই সেই দ্বৈত স্বত্ত্বা ফিরে আসবে।“

আনসারি সাহেবের বাসের সময় হয়ে আসে। যাওয়ার সময় মিসেস ইশরাকের উদ্দ্যেশ্যে বলে গেলেন, “মিসেস ইশরাক, জীবন সবসময় মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে আসার সুযোগ দেয় না। যাদের দেয়, তারা ভাগ্যবান। আপনি নিঃসন্দেহে ভাগ্যবতী। সুযোগটিকে কাজে লাগান। পুরোনো সব কথা ভুলে যান। নতুনভাবে জিবন শুরু করুন। আপনার এবং ইশরাক সাহেবের জন্য শুভকামনা রইলো।
বাস স্টেশনে আনসারি সাহেবকে এগিয়ে দিতে এসেছিলেন ইন্সপেক্টর লিখন, ঘোষবাবু এবং ইশরাক সাহেব।

(৫)

তিন মাস পর একটা চিঠি পেলেন আনসারি সাহেব। তাতে লেখা ছিলো;

আনসারি সাহেব,
আপনি ফেরেশতা। ফেরেশতার মতোই আমার জীবনে এসে সব সমস্যার সমাধান করেছেন। আপনার কারনে আমি আজ একটি সুখের সংসার করতে পারছি। আমাদের সংসারে আর কোনও উপদ্রব নেই। আমি তিন মাসের প্রেগন্যান্ট। সব জড়তা কাটিয়ে ইশরাককে ভালোবাসতে পেরেছি আপনি অনুপ্রেরনা দিয়েছিলেন বলেই। আমার আসল বাবা কে আমি জানি না, যেই পরিবেশে বড় হয়েছি তাতে এটা হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আপনাকে পিতৃতুল্য শ্রদ্ধা করতে ইচ্ছে করছে। ঢাকা আসলে আপনার এই মেয়ের বাসায় কিন্তু অবশ্যই বেড়াতে আসবেন।
রুদাবা মাশিয়াত প্রাচী


মেয়েটার প্রতি অন্যরকম এক মায়ায় মনটা ছেয়ে গেলো আনসারি সাহেবের। সেদিনের সেই মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধে আনসারি সাহেব জিতেছিলেন বটে কিন্তু একটা বিষয় তার কাছে অমীমাংসিত রয়ে গেছে। সেদিন মিসেস ইশরাকের রুমের দরজা খুলে দেওয়ার পিছনে উনার যুক্তি ছিলো, দ্বৈত স্বত্ত্বা কারও প্রত্যাক্ষ ক্ষতি করতে পারে না। কিন্তু পিশাচরূপী মিসেস আশরাফ উনার দিকে যেভাবে তেড়ে আসছিলেন, তাতে উনি কিছুক্ষনের জন্য ধরে নিয়েছিলেন যে উনার যুক্তি হেরে গেছে। কিন্তু যেভাবে মিসেস ইশরাক সেদিন গলা খামচে পরে গিয়েছিলেন, তার উপর ফুলের গন্ধ, সব মিলিয়ে তার মন এইসব ব্যাপারকে দ্বৈত স্বত্ত্বার প্যারাডক্সের অধীনে ফেলতে পারছে না। অবশ্য আনসারি সাহেব অতিপ্রাকৃত কিছুও ভাবছেন না। আনসারি সাহেব কোনও বিষয়কেই অতিপ্রাকৃত ভাবতে রাজি নন। তার মতে যুক্তি দিয়ে সব রহস্যেরই সমাধান করা যায়। অমীমাংসীত বলে কিছু নেই। হয়তো সেদিনের ঘটনার পিছনে দ্বৈত স্বত্ত্বার যুক্তিটা ছাড়াও অন্য কোনও যুক্তি আছে। সেটা এখন হয়তো বের করতে পারছেন না। কিন্ত একদিন ঠিকই বের করবেন।

সন্ধ্যার দিকে অন্যরকম বিষন্নতায় মন ছেয়ে গেলো আনসারি সাহেবের। কত মানুষের সমস্যা উনি যুক্তি দিয়ে বিচার করেন, অথচ উনার পূর্বের জীবনে কি ঘটেছিলো, সেটা যুক্তি দিয়ে বিচার করতে পারেন না। তিন বছর হতে চললো ঢাকা-চিটাগাং হাইওয়ের পাশে মারাত্মক আহত অবস্থায় উদ্ধার করে পুলিশ। জ্ঞান ফিরার পর থেকে আজ অবধি উনি উনার পুর্বের জীবনের কিছুই মনে করতে পারছেন না। উনার শুধুমাত্র পিতামাতার নামই মনে আছে। তাও সম্ভব হতো না যদি না উনার সার্টিফিকেট এর ফাইলটা উনার ব্যাগে পাওয়া যেতো। উখান থেকেই শুধুমাত্র মাতা পিতার নামটা মনে রাখতে পেরেছেন। মাতা পিতার চেহারা দেখতে কেমন ছিলো সেটা মনে করতে পারছেন না। তার কি কোনও স্ত্রী সন্তান আছে কি না আদও সেটাও মনে করতে পারছেন না। অবশ্য উনাকে যে অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে তাতে উনাকেও দোষ দেওয়া যায় না। সারা মাথা রক্তে মাখামাখি হয়েছিল। যেন কেউ কেউ তার মাথায় ভারী কোনও বস্তু দিয়ে ক্রমাগত আঘাত করে গিয়েছিল। সেই থেকে আগের জীবনের কিছুই মনে নেই। উনার ব্যাগে উনার জন্মসনদ, এন আই ডি, স্কুল কলেজের সার্টিফিকেটগুলো ছিলো বলেই তিনি চিটাগাং পলিটেকনিকে গনিত পড়িয়ে একা একা কোনোমতে দিন চালাচ্ছেন।

কিন্তু এভাবে কতদিন? তার কি কোনও পরিবারই কি নেই? তারা কি খোঁজ করছে না তার? না কি উনি শুরু থেকেই এমন ছন্নছাড়া পরিবারহীন? তিন বছর ধরে কত জায়গায় খোঁজ লাগিয়েছেন, কিন্তু কোথাও কোনও সূত্র খুঁজে পান নি যেটা তার আগের জীবনের কোনও সন্ধান দিতে পারে। আর প্রতিনিয়ত যে অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেন, তার পেছনেই বা যুক্তি কি?
ভাবতে ভাবতে এক সময় দিশেহারা হয়ে পরেন আজাদ আনসারি সাহেব।


[মিসির আলী আমার অন্যতম প্রিয় একটি চরিত্র, আজাদ আনসারি চরিত্রটির অনুপ্রেরণা মিসির আলী সেটা নিরদ্বুধায় বলতে পারি, তবে দুটি একই ধাচের চরিত্র নয়, ভিন্নতা অবশ্যই আছে। আনসারিকে নিয়ে লেখা বাকি গল্পগুলোও ধীরে ধীরে ব্লগে প্রকাশ করলে কিছুটা ক্লিয়ার হওয়া যাবে।]

সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই নভেম্বর, ২০২১ রাত ১০:৩২
৬টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×