somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নিঃশব্দ দূরত্বে (১)

১৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ রাত ১২:৪৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


নিঃশব্দ দূরত্বে

(এক)
বৃষ্টি কমছেই না।আজ আখড়ায় কোন সাধু নেই।থাকলেও লাভ হতোনা।উনাদের খাওয়া-ঘুমানোর কোন স্টেশন নাই।মাধবকে শুধু থাকার শর্তে আশ্রয় দিয়েছে সাধুরা।মাধব অপেক্ষা করছে বৃষ্টি কখন থামবে।বৃষ্টি থামলে সে খেতে যাবে।আজ সকালে খাওয়া হয়নি তার।পেটে সুঁচোর নর্তন-কুর্দন শুরু হয়েছে।থাকতে না পেরে বটি হাতে আখড়ার পিছনে চলে যায়।মানের পাতা কেটে আনে। পাতা মাথায় দিয়ে কাপুড়িয়াপট্টির দিকে রওনা দেয়।

কখন থেকে শিকল ঝাঁকাচ্ছে মাধব,দরজা খোলার কোন নাম নেই।মাধব ভাবে আজ বুঝি খাওয়া কপালে নেই।আবার শিকল ঝাঁকায়।এবার দরজা খুলে যায়।
-ও তুই।এত দেরী?সবাই খাওয়া শেষে দুপুরের ঘুম দিচ্ছে।শব্দ করিসনা।বারান্দায় গিয়ে বোস।খাবার দিচ্ছি।
গেন্দা পিসী দরজা আটকিয়ে রান্না ঘরের দিকে চলে যায়।
মাধব উঠোন দিয়ে সাবধানে হেঁটে রান্না ঘরের বারান্দায় গিয়ে বসে।
-মানের পাতা কলপারে রেখে আয়।
রান্নাঘর হতে গেন্দা পিসী বলে।মান পাতা কলপারে রেখে আসে মাধব।
খুব পুরানো আমলের চুন-সুরকির বাড়ি।শ্যাঁওলা ধরা চারপাশে।এই বাড়ির বর্তমান মালিক নীলু বসাক।কাপড় ব্যবসায়ী।খুব ধর্ম ভীরু।এক সাধুর অনুরোধে মাধবের দুপর আর রাতের খাবার সে জোগায়।
-শেষ কবে মায়ের সাথে দেখা হয়েছে?
খাবার দিতে দিতে গেন্দা প্রশ্ন করে।
-তিন মাস হলো।
মাধব জবাব দেয়।
কুরিকচুর তরকারি পেয়ে মাধব খুব খুশি হয়।খিদার জ্বালায় খাবারের থালা আক্রমণ করে বসে।গেন্দা বসে বসে মাধবের খাওয়া দেখে।ছেলেটার জন্যে খুব মায়া হয় ওর।কত বড় ঘরের ছেলে,আর এখন খাওয়ার জন্যে দারে দারে ঘুরে বেড়ায়।তবে ছেলেটার একটা গুন ওদের সবাইকে খুব মুগ্ধ করেছে।এই ছেলের একটিই পণ-মরে যাবে তবু ধর্ম ত্যাগ করবেনা।সেই ক্লাস ফোরে থাকতে বাড়ি হতে পালিয়েছে।তারপর লড়াই করে যাচ্ছে ছেলেটি-বেঁচে থাকার লড়াই।গেন্দার বিয়ে-থা হয়নি।এখন পৌড়ত্বের দারপ্রান্তে।মাধবের জন্য ওর মাতৃস্নেহ প্রবল।
-বাড়ি যাসনা কেন?
গেন্দার প্রশ্ন শুনে ভেজা উঠোনের দিকে মাধব ভাবলেশহীনভাবে তাকিয়ে থাকে।
-মা যেতে নিষেধ করেছে যে।
মাধব উত্তর করে।
-তোরা তো সবাই ওপারে চলে যেতে পারিস।
-গিয়েছিলাম তো একবার বাড়ির সবাই মিলে।দমদমে ছিলাম ছয়মাস।ঠিক মত খাওয়া জুটতোনা।তাই মা আমাদের নিয়ে আবার পাকিস্থানে ফিরে এলো।
-তোর বড়দা?
-ওর কথা আর বলোনা। কোন কাজেরনা।
-ভারতে টাকা নিয়ে যাসনি তোরা?
-কোথায় পাবো?
-কেন তোদের এত সম্পত্তি বিক্রি করে দিতিস।
-যতদূর মনে পড়ে মা চেষ্টা করেছিল।কিন্তু কেউ কেনেনি।তাই আমাদের খালি হাতেই ভারতে যেতে হয়েছিল।
গেন্দা আর কোন প্রশ্ন করেনা।মাধব খাওয়া শেষ করে।মান পাতা মাথায় দিয়ে মাধব চলে যায়।গেন্দা মাধবের চলে যাওয়া দেখে।

তীব্র গন্ধে মাধবের অস্বস্তি হতে থাকে।কুপির আলোয় মাধব পড়ছে।আগামীকাল ফাইনাল পরীক্ষা।মহারাজা স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র সে।সন্ধ্যা হতেই সাধুরা গাঁজায় দম দেওয়া শুরু করেছে।
-এই ছোঁকড়া কুপি নিভিয়ে দে।ঘুমাবো এখন।
এক সাধু বলে
-ওর আগামীকাল ফাইনাল পরীক্ষা।ও পড়ুক।
আখড়ার প্রধান সাধু বলে।
-দেখুন বাবা,আখড়ায় ছেলে-ছোকড়া রাখা ঠিকনা।ওর জন্যে ক্ষতিকর হতে পারে।
-চেষ্টাতো চালাচ্ছি ছেলেটার একটি গতি করার জন্যে।দেখি সামনে কি হয়।

মাধব তৃতীয় স্থান অধিকার করে সপ্তম শ্রেণীতে উঠে।প্রথম স্থান অধিকার করে শুভ মুখার্জি।শুভর বাবা ধীরেন্দ্র মুখার্জি নাটোর মহারাজা জে.এন. হাইস্কুলের সংস্কৃত শিক্ষক।মাধবকে খুব পছন্দ করে ধীরেন্দ্র।ছেলেটার জীবনের জটিলতা ওকে খুব ভাবায়।

এক বিকেলে নীলু বসাকের দোকানে আসে ধীরেন্দ্র।সাধু মহারাজকে দেখে নমস্কার করে।নীলু ধীরেন্দ্রর বাল্য বন্ধু।
-ধীরেন্দ্র তোকে আজ বিশেষ প্রয়োজনে ডেকেছি।
নীলু বসাক বলে।
-কি প্রয়োজন বল।
ধীরেন্দ্র বলে
-সাধু বাবা একটা অনুরোধ নিয়ে এসেছেন।উনার আশ্রমে এক ছেলে থাকে,তোর স্কুলেরই ছাত্র।ছেলেটা লেখা-পড়ায় ভালো।ওর পরিবারে এক দুর্ঘটনায় ছেলেটি আশ্রয়হীন।সাধুবাবা চাচ্ছেন আমরা ওর একটা ব্যবস্থা করে দিই।
নীলুর কথা শেষ হলে সাধুবাবা কথা বলেন।
-বাবারা,ছেলেটি অত্যন্ত সৎচরিত্র।মেধাও আছে।ওর একটা আশ্রয় দরকার।আপনারা সৎজন।যদি দয়া করেন।ঈশ্বর আপনাদের মঙ্গল করবেন।
সবার কথা চুপ করে শুনে ধীরেন্দ্র।
-কার কথা বলছেন?মাধব নয়তো?
ধীরেন্দ্র বলে।
-হ্যাঁ ছেলেটার নাম মাধব।লালপুরের কোন গ্রামে যেন বাড়ি।
নীলু বলে।
-কি ব্যবস্থা করবো বলতো নীলু?
ধীরেন্দ্র নিলুকে প্রশ্ন করে।
-আপনাদের দুই জনের কারও একজনের বাড়িতে আশ্রয়দিন।
সাধুবাবা করজোড়ে আবেদন করে দুইজনের কাছে।
নীলু আর ধীরেন্দ্র কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে।তারপর নীলুই কথা বলে উঠে।
-ধীরেন্দ্র তোর কাছে নিয়েনে ছেলেটাকে।আমি কাপড়ের ব্যবসায়ী।আমার বাড়িতে নিয়ে রাখলে পড়াশুনা হবেনা।তুই মাষ্টার।তোর বাড়িতে থাকাই ভালো।
সাধুবাবা আর নীলুর পিড়াপিড়িতে রাজি হয়ে যায় ধীরেন্দ্র।

স্কুল ছুটির আগে দপ্তরি এসে মাধবকে বলে,ছুটির পর সে যেন পণ্ডিত স্যারের সাথে দেখা করে।সবার শেষে সমাজ ক্লাস।ক্লাস শেষ করে মাধব ধীরেন স্যারের কাছে যায়।
-আজকে তোর এখন আখড়ায় যাওয়ার প্রয়োজন নেই।তুই আমার সাথে আমার বাড়িতে যাবি।
ধীরেন স্যারের কথার কোন অর্থ খুঁজে পায়না মাধব।সে শুভ আর ধীরেন স্যারের সাথে ওদের বাড়ির দিকে রওনা দেয়।ধীরেন স্যারের বাড়িটি লালদীঘির পারে।চারটি মাটির ঘর।ধীরেন্দ্র গরীব ব্রাক্ষ্মণ।তার ছয় ছেলে আর চার মেয়ে।
-কুন্তলা এদিকে এসো।
ধীরেন্দ্র বউকে ডাক দিয়ে পাঞ্জাবী খুলে গলায় রুদ্রাক্ষের মালা পড়ে নেন।
স্বামীর ডাক শুনে কুন্তলা দীঘির ঘাট হতে দ্রুত চলে আসে।
-কি করছিলে?
-বাসন ধুতে নিয়ে গিয়েছি।
-কাকে নিয়ে এসেছি দেখো।ও হলো মাধব।শুভর সাথে পড়ে।এই ছেলে আজ হতে আমাদের সাথে থাকবে।ও আজ হতে আমাদের আর একটি সন্তান।
স্বামীর কথা শুনে আশ্চর্য হয়ে যায় কুন্তলা।
-থাকতে না হয় দিলে কিন্তু খাওয়াবে কি?যে অভাব অনটনের সংসার।
কুন্তলা বলে।
-শোন বউ আমরা আধপেট খেলে এও আধপেট খাবে।ঈশ্বর আছেননা।শুভ যা মাধবকে তোদের ঘরে নিয়ে যা।

দরজায় রোদ পোহাচ্ছিল ধীরেন্দ্র।গনেশ এগিয়ে আসে।গনেশ মৌসুমী ফল বিক্রেতা।ধীরেন্দ্রদের পাড়ায় থাকে।
-ঠাকুর নাকি আর একটি ছেলেকে দত্তক নিয়েছো শুনলাম।তা ছেলেটা ব্রাক্ষ্মণতো?
গনেশের কথায় বিরক্ত হয় ধীরেন্দ্র।
-না ব্রাক্ষ্মণ নয়।
বিরক্তিমাখা কন্ঠে জানায়।
-কি জাত?
-জাত দিয়ে আপনি কি করবেন?
-না এমনই জানতে চাচ্ছিলাম।
-বৈষ্ণব।
-বরেগী?
-যাই স্নানের সময় হলো।
গনেশকে রেখে ধীরেন্দ্র বাড়ির ভেতর চলে যায়।কুন্তলা কাপড় মেলার জন্যে বাহিরে আসে।কুন্তলাকে দেখে গনেশ এগিয়ে যায়।
-কি ঠাকুরন বাড়িতে এতগুলি মেয়ে আর এর মধ্যে এক অজাত এনে তুললো।কিছু বললেননা?
কুন্তলা কাপড় মেলা শেষ করে।
-দাদা,উনি এখন স্কুলে যাবে।খেতে দেবো।যাই।আর একদিন গল্প করবো।
কুন্তলা বাড়ির ভেতর ঢুকে যায়।গনেশ কিছুক্ষণ রোদ পোহায়।তারপর সেও বাড়ির পথ ধরে।

চলবে....
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০২০ রাত ১০:৪৬
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

×