somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নামকরণ - দেশে বিদেশে

০৫ ই এপ্রিল, ২০১৫ সকাল ৯:১৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

নিজের ভালো নাম নিয়ে অনেকদিন ম্রিয়মাণ ছিলাম। কমতিটা কোথায় ছিল ঠিক বুঝতে পারতাম না। শুধু মনে হতো এই না হয়ে যদি সেই হতো! স্কুলজীবনের এক বন্ধু ছিলো কমল। খেলতে খেলতে ঝগড়া লাগলেই বলে উঠতো, খন্দকার, কেমন যেন অন্ধকার। হয়তোবা সেটার প্রভাবও ছিলো এই অস্বস্তিকর অনুভূতিতে।

স্বাধীনতার পর পর নাম লেখার এক নতুন ধারার প্রচলন শুরু হয় সারা দেশে। ভালো নাম আর ডাকনাম মিলিয়ে একধরণের আধুনিকীকরণ আর কি! একজনের নাম ছিলো মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম, ডাকনাম সবুজ। সে লিখতে শুরু করলো আমিনুল ইসলাম সবুজ। পদ্ধতিটা লুফে নিলাম সাদরে এবং হয়ে গেলাম আলমগীর হোসেন স্বপন। লেখালেখি শুরু করতেই প্লাস্টিক সার্জারি করে সেটাকে করলাম স্বপ্নুল আলমগীর। কান্ড দেখে ইত্তেফাকের কচিকাঁচার আসরের শ্রদ্ধেয় দাদাভাই (বর্তমানে জান্নাতবাসী) একদিন ধমকে দিলেন জোরেশোরেই। চশমার ফাঁক দিয়ে রাগত দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলেন আমার দিকে এবং নতুন ধারণ করা নামটা কেটে পিতৃপ্রদত্ত আসল নামটা লেখার পরই কেবল আমার গল্পের পাণ্ডুলিপিটা জমা নিলেন।

আরেকদিন আজাদ পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক অগ্রজপ্রতিম ইউসুফ শরীফ (বর্তমানে তিনি দৈনিক ইনকেলাবে উচ্চতর পদে কর্মরত) আমার পিতৃপ্রদত্ত নামটা যে অতিশয় একটা হেভিওয়েট নাম, ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বলে আমার সেলফ এস্টিম একেবারে আকাশে চড়িয়ে দিলেন।

ততদিনে সৌদিআরব চলে এসেছি এবং আরবি শেখার প্রাথমিক প্রক্রিয়ায় আমাদের দেশের মুসলমানি নামগুলোর অর্থ আবিষ্কার করার নেশায় মেতেছি। জানলাম কমরুদ্দিন আরবিতে কমর আল-দ্বীন, অর্থাত ধর্মের চাঁদ। আমার মা হাবিবুন্নাহার আরবিতে হাবিব আল-নাহার, যার অর্থ দাঁড়ায় ‘দিবসের বন্ধু’। আরো জানলাম, কাউকে রহমান সাহেব কিংবা করিম স্যার কিংবা উল্লাহ সাহেব বলে সম্বোধন করা মারাত্মক ভুল। যেহেতু ওগুলো আল্লাহর নাম। যিনি আব্দুর রহমান কিংবা 'ভৃত্য কিংবা উপাসক রহমানের', তাঁকে পুরো নামেই ডাকতে হবে, শুধু রহমান বলা গর্হিত ভুল।

আরবরা সুনির্দিষ্টভাবে শুধু আল্লাহর ভৃত্যতা স্বীকার করে এবং প্রায় প্রতিটি পরিবারেই অন্তত একজন আব্দুল্লাহর উপস্থিতি দেখা যায় নিশ্চিত, যিনি কিনা ‘ভৃত্য আল্লাহর’। আমি যে কোম্পানিতে কাজ করতাম তার মালিকানা ছিলো পাঁচ ভাইয়ের, আব্দুল্লাহ, আব্দুল হামিদ, আব্দুল রহমান, আব্দুল গফুর এবং আব্দুল করিম। অর্থাৎ প্রতিটি ভাইয়ের নামের অর্থই ছিলো ‘আল্লাহর ভৃত্য’ সূচক।

ফার্সিতে ‘গোলাম মোহাম্মদ’ বা ‘মোহাম্মদের সাঃ এর ভৃত্য’, ‘গোলাম রসুল’ কিংবা ‘রসুলের গোলাম’ বা ‘গোলাম আলি’ অর্থাৎ ‘আলি রাঃ এর গোলাম’ অথবা ‘কানিজ ফাতেমা’ যা কিনা ‘ফাতেমা রাঃ এর দাসী’ অহরহ দেখা গেলেও আরব দেশগুলোতে এধরণের নামকরণ দেখিনি একজনেরও।

আরবদেশে সবচেয়ে প্রিয় নাম হোল মোহাম্মদ, তারপর আহম্মদ। আমরা দেশে অজানা লোককে দূর থেকে পিছু ডাকি অঞ্চল বিশেষে 'এই মিয়া' কি 'এই বেটা' কিংবা 'এই বাহে' বলে। এরা অপরিচিত লোককে পেছন থেকে ডাকে 'ইয়া মোহাম্মদ' অথবা 'ইয়া আহম্মদ' সম্বোধনে। বলা চলে অজানা লোককে বেশী সন্মান দেবার চল এদের মাঝে।

সবচেয়ে মুগ্ধ হলাম এদের সন্তানদের নামকরণের পদ্ধতি দেখে। এটা মুসলমানি পদ্ধতি বলা যাবে না, বলতে হবে আরবীয় পদ্ধতি। নইলে আমাদের দেশে এর প্রচলন নেই কেন? আমরা সন্তানদের সবচেয়ে সর্বাধুনিক নামটি রাখতে পছন্দ করি, শুধু এইটুকু প্রমাণ করতে যে আমাদের পিতামাতার অতি যত্নভরে রাখা নিজের নামটা বড্ড সেকেলে। আমার জান্নাতবাসি চাচাজান আর চাচী তাঁদের দশ ছেলের নামের প্রথম অংশটি রেখেছেন 'ম' দিয়ে আর দ্বিতীয় অংশে 'আহম্মদ', 'রহমান', 'জামান', 'ইসলাম', 'নবী', 'দোহা', 'উল্লাহ', 'করিম', 'রায়হান' রেখে স্বাধীনতার সদ্ব্যবহারে কোন রকম কার্পণ্য রাখেননি। কিন্তু বাবার নাম জানার আগে পর্যন্ত এরা যে সবাই একই পিতার সন্তান, বুঝতে কষ্টকর হয় বৈকি। আমাদের সুধী সমাজেও বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি রয়েছেন, তাঁদের পিতার নাম অজানা থাকলে, ওনারা যে সহোদর, বোঝার একদম উপায় নেই।

বলছিলাম আরবদের সন্তানদের নামকরণের পদ্ধতি নিয়ে আমার মুগ্ধতার কথা। ওরা ছেলে হোক আর মেয়ে হোক, নবজাতকের শুধু একটি নামই রাখবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ফর্মেতে নামের প্রথম লাইনটিতে, যেখানে লেখা আছে 'এসম আল মউলুদ' অর্থাৎ নবজাতকের নাম, সেখানে ধরে নেই ছেলের নাম লিখলো 'আইমান' আর মেয়ে হলে 'জয়নাব'।

ওদের বাবা যদি হয় আব্দুল্লাহ, দ্বিতীয় লাইনে 'এছম আল আব' বা বাবার জায়গায় লিখবে আব্দুল্লাহ।

তৃতীয় লাইনে 'এছম আল জেদ' অর্থাৎ দাদার নাম লিখবে, ধরে নেই দাদার নাম আহম্মদ এবং তাই লেখা হোল ফর্মে।

চতুর্থ লাইনে 'এছম আল আইলা' লেখার জায়গা, যা কিনা পারিবারিক নাম। এখানে একটা প্রবণতা রয়েছে, যে শহরে এই পরিবারের গোড়াপত্তন হয়েছিলো সেই শহরের নাম থেকে পারিবারিক নাম গ্রহণ, যেমন মক্কা থেকে বংশের কি গোত্রের উৎপত্তি বলে 'মক্কি'।

উপরোল্লেখিত ফর্মুলা অনুযায়ী নবজাতক পুত্রটির পুরো নাম গিয়ে দাঁড়ালোঃ আইমান আব্দু ল্লাহ আহম্মদ মক্কি আর মেয়ে হলে নবজাতিকার নামঃ জয়নাব আব্দুল্লাহ আহম্মদ মক্কি। উল্লেখ্য, মেয়েটির প্রথম নামটি ছাড়া বাকি অংশগুলো তার বংশ পরিচয় বহন করে এবং বিয়ের পরেও নামের কোনও পরিবর্তন হয় না। নামকরণের এই পদ্ধতিতে বাবার এবং দাদার নামটি মূলত শিশুর নিজের নাম হয়ে যায়, পছন্দ করতে শুরু করে এবং ব্যাকডেটেড ভাবার সুযোগই থাকে না।

আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নামের চারটা অংশ ব্যবহার করা বাস্তব সন্মত নয় বলে, যেখানে শুধু ফার্স্ট নেইম, মিডল নেইম আর লাস্ট নেইম লেখার সুযোগ থাকে, ওরা সেসব ক্ষেত্রে শুধু নিজের নাম, বাবার নাম আর বংশের নাম লিখে। সেটাও বা কম কিসে।

আরবি নামকরণ পদ্ধতি অনুসরণ করে আমার দুই ছেলের নাম, তারেক আলমগীর খন্দকার এবং জারিফ আলমগীর খন্দকার। গ্রেজুয়েশনের দিন ইউনিভার্সিটিতে মাইকে যখন ওদের পুরো নামগুলো ডেকেছিল, আমার চোখে পানি এসে গিয়েছিল জান্নাতবাসি আব্বা ও আম্মার কথা স্মরণ করে। নিশ্চয় ওনারা খুব খুশী হতেন দেখে যে ওনারা অনেক আগ্রহ ও ভালোবাসার সাথে তাঁদের সন্তানের যেই নাম রেখেছিলেন, তাঁদের উত্তরসূরিরাও সেই নাম ওদের নামের সাথে ধারণ করছে।
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

যুক্তরাষ্ট্রে ইসরাইল বিরোধী প্রতিবাদ বিক্ষোভ

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ০৩ রা মে, ২০২৪ সকাল ৮:০২

গাজায় হামাস উচ্ছেদ অতি সন্নিকটে হওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিউইয়র্ক ও লসএঞ্জেলসে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পরেছিল। আস্তে আস্তে নিউ ইয়র্ক ও অন্যান্ন ইউনিভার্সিটিতে বিক্ষোভকারীরা রীতিমত তাঁবু টানিয়ে সেখানে অবস্থান নিয়েছিল।


... ...বাকিটুকু পড়ুন

৫০১–এর মুক্তিতে অনেকেই আলহামদুলিল্লাহ বলছে…

লিখেছেন বিচার মানি তালগাছ আমার, ০৩ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০০



১. মামুনুল হক কোন সময় ৫০১-এ ধরা পড়েছিলেন? যে সময় অনেক মাদ্রাসা ছাত্র রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিল। দেশ তখন উত্তাল। ঐ সময় তার মত পরিচিত একজন লোকের কীভাবে মাথায় আসলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেহেদীর পরিবার সংক্রান্ত আপডেট

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:৪৯


মার্চ মাস থেকেই বিষয়টি নিয়ে ভাবছিলাম। ক'দিন আগেও খুলনায় যাওয়ার ইচ্ছের কথা জানিয়েও আমার বিগত লিখায় কিছু তথ্য চেয়েছিলাম। অনেক ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও মেহেদীর পরিবারকে দেখতে আমার খুলনা যাওয়া হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

×