ছবিটিতে আমি দেখতে পাই, একজন খুব সাধারণ চেহারার মানুষ বাঁশি বাজাচ্ছে, এক রাস্তার ধারে ফুটপাথে। কিছু কচি গাছের চারার পাশে, শ্যাওলাধরা এক দেয়ালের কোণে দাঁড়িয়ে সে একমনে বাজিয়ে চলেছে। তার দাড়িগোঁফের মাঝে ঋষিভাব প্রবল, ভুরুযুগলে আশ্চর্য ব্যাথার ছাপ। তার ঠোঁটজোড়া গোঁফের আড়ালে অদৃশ্য, কিন্তু যত্নলালিত হৃদয়কাঁপানো সুর বলছে, তারা আছে। তার কৃশ আঙুলগুলো আশ্চর্য মসৃণতায় খেলে বেড়াচ্ছে বাঁশির বৃত্তাকার অধিবৃত্তাকার ছিদ্রমুখসমূহে। সে চোখ বুজে আছে, তবু যেন দেখে ফেলছে সব কিছু! সবকিছু, যা আছে রুমির অলৌকিক বাগানে! মর্ত্যলোকের কারও তাচ্ছিল্য বা মুগ্ধতা সে দেখছে না। কারও প্রতিক্রিয়ায় শ্লাঘা বা বিচলন বোধেরও বহু ওপরে চলে গেছে সে। সামনে একটি রুমাল পাতা। সে রুমালে কি পড়ল না পড়ল তাতে তার কিছুই যায় আসে না যেনততক্ষণ, যতক্ষণ বাঁশিটা তার হাতে রবে, যতক্ষণ তার লহরীরাজ্যের সে রাজা। তার মলিন রুমালটি দারিদ্র সমভিব্যাহারে এক আশ্চর্য মাহাত্ম্য প্রকাশ করে চলেছে। আকাশ-নীল চমৎকার একটি রুমাল, হয়ত আরজন্মের প্রেয়সীর উপহার। যখন বাঁশির সুর থামবে, তখনই মনে পড়ে যাবে কি দারুণ অর্থকষ্ট আর ক্ষুধার মচ্ছবে তার বাস। চারিদিকে শুধু বৃত্তাকার রুটি, শুভ্রসফেদ অন্ন দানা, তামাক আর এক পাটকিলে রঙা বামুন মানুষের সমান বাঁশির স্বপন! সে যে ভাবের জগতের লোক! ভবের চিন্তার মাঝেও তার ভাবের অলঙ্কার লতিয়ে ঢুকে পড়ে। নতুবা রুটি-ভাতের সঙ্গে বাঁশি কেন? কিছু মানুষ আছে এমন, এদের মনে উঁকি দিয়ে প্রবল অভাবের মাঝেও দেখা মেলে, ‘অর্থ নয়, বিত্ত নয়, সচ্ছলতা নয়, আরও এক বিপন্ন বিস্ময়ে’র তৃষ্ণা। অন্যদের যা ‘ক্লান্ত করে, ক্লান্ত করে, ক্লান্ত করে’, এদের তা উজ্জীবিত করে। সে বিপন্ন বিস্ময় নিয়ে এরা বাঁচে বলেই বাজানো শেষে শূন্য আকাশ-নীল রুমালটিকে অবিচলিত চিত্তে তুলে নিয়ে ভাঁজ করে বুকপকেটে পুরে চলে যাবে। আমি আবার ছবিটির দিকে তাকাই। দেখতে পাই, একটি ছোট্ট ছেলে বাবার হাত ধরে যেতে যেতে প্রায় ক্যানভাসের বাহিরে চলে গেছে, তবু সে চোখ ফেরাচ্ছে না মানুষটির ওপর থেকে। তার চোখে যে আশ্চর্য কৌতূহল, তাতে এক ভবিষ্যৎবংশীবাদকের অস্তিত্ব প্রোথিত যেন! ‘বাহ!’ আমি আহ্লাদিত হয়ে উঠি। এ ছবিটি যদি সত্যিই এঁকে ফেলা যায়?
হঠাৎ আমার মাথার পেছনটা টনটন করে ওঠে ব্যাথায়। নিকোটিন চাই! নিকোটিন! নিকোটিন আমার প্রতিভা প্রাসাদের দ্বাররক্ষী। আমার সৃজন ঘরে ঢুকবার তরে সে কখনও পথ করে দেয়, কখনও পথরোধ করে দাঁড়ায়। তাকে পেতে হলে সৃজন করা চাই, অথবা সৃজনকে পেতে তাকে চাই। আহ, সম্পর্কটা তবে সিদ্ধই হয়েছে বলতে হবে! ওয়রস্টেড যখন বিদ্যুৎ প্রবাহ দিয়ে চৌম্বকক্ষেত্র সৃষ্টি করলেন, ফ্যারাডে তখন চৌম্বকক্ষেত্র থেকে বিদ্যুৎ এনে দিলেন। সিদ্ধির প্রথম শর্ত তবে উভমুখিতা! এই উভমুখিতার ললিতপ্রসূনটি হাতে নিতে গিয়ে আমার আস্ত একটি রাত পেরিয়ে যায়। ভোরের আলো এসে পাশের দালানের কালচেধূসর দেয়ালটিকে হালকাধূসরে পরিণত করেদেয়। এক গ্লাস পানি খেতে গিয়ে আমার পদযুগল টলতে থাকে। রঙ গোলা জল বেসিনে ঢেলে আমি মুগ্ধচোখে তাকিয়ে থাকি। একসময় ‘চোঁ-অক’ শব্দে বেসিনে এক ক্ষুদ্র সৌরজগৎ সৃষ্টি হয়। আর আমি ঠিক সেই মুহূর্তে সৃষ্টির রহস্য ধরে ফেলি! কাউকে বলতে যাই না শুধু এ ভয়ে যে, সবাই ব্যাপারটাকে স্রেফ হেসে উড়িয়ে দেবে!
আমার খিদে পায়। পেটের ভেতর ছুঁচো নখ চালাতে থাকে। আমি আকুতিমাখা কণ্ঠে তাকে বোঝাতে চেষ্টা করি আমার পাকস্থলিগাত্রের পেলবতা। সেই নির্মম তা বুঝতেই চায় না! আমি ঘর থেকে বের হয়ে যাই। বাহিরে ঠাণ্ডা হাওয়া ভীষণ! ঘরে আমি ঘেমে গিয়েছিলাম, বাহিরের এ শীতল বাতাসে আসবার আগে যা বুঝতে পারিনি। আহ! ভোরবেলাতে নাকি বেহেশতের জানালা খুলে দেন ঈশ্বর। শুধু ভোরের কদরে বেহেশতকে এমন আগেভাগেই ব্যস্ত করে রাখার জন্যে, বোধকরি ভারি নাখোশ হয় সে ঈশ্বরের ওপর। ঈশ্বরও বিব্রত!বৃত্তাকার এ পৃথিবীতে কেন যে ভোরের শেষ নেই! রাস্তার একপাশ ধরে হাঁটতে হাঁটতে আমি হঠাৎ একজন শ্মশ্রুমণ্ডিত বয়োজ্যেষ্ঠের সামনে পড়ে যাই। সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে পড়ি সসম্ভ্রমে। আশ্চর্য, সক্রেটিস!এঁকে আমি চত্বরের মুখচেনা ভিক্ষুকদের দলে কত দেখেছি, অথচ আজ এ প্রভাতকরের পূর্বে তাঁকে তাঁর আপন পরিচয়ে চিনতেই পারিনি। বইয়ে পড়েছি প্রতি শতকে একবার পৃথিবীর একেক প্রান্তে তাঁর দেখা মেলে। আমি তাঁকে বিনতকণ্ঠে বলি, ‘সুপ্রভাত। অমৃতপথের মূর্তিমান আতঙ্ক আপনি। আপনার জন্যে অমৃত পানেও আমার ভারি ভয়। যদি ক্ষুন্নিবৃত্তির প্রবণতাটিকে ভয় পাইয়ে দিতে পারতাম, তবে অমৃতটুকুও হয়ত অনভ্যাসে পায়ে ঠেলতাম! তাই বুঝি আমার ক্ষুধার আর নিবৃত্তি হল না। একটি ছবি বিক্রি করা ভারি প্রয়োজন আমার। যদিও এখনও তা আঁকা হয়নি। তথাপি, কুছ পরোয়া নেহি। আপনি তা কিনে নিন। বিপরীতে আমায় কিছু কটুকাটব্য দিন। মাঝে খিস্তির ভারি ন্যাওটা হয়েছিলাম। সে এক আশ্চর্য সাহিত্য বলতে পারেন!’ সক্রেটিস বলে ওঠেন, ‘ভিক্ষে করতে বেরিয়েছিলাম, দুর্ভাগ্যক্রমে আপনার সঙ্গে দেখা। আজ আর ভিক্ষেই মিলবে না। ধ্যাৎ!’
না, আমি আসলে ঘর ছেড়েই বেরোইনি আর। কখন যেন বসে পড়েছিলাম আমার লেখালিখির রিভলভিং চেয়ারে, সেখানেই খানিকটা তন্দ্রামতন এসেছিল। আমি হাতলে হাতের কনুই অবধি চেপে ধরে রেখে সোজা হয়ে বসি। ভাবতে থাকি, প্রকৃতপক্ষে কি চাইছি আমি।প্রেম? আছে। প্রতিষ্ঠা? নেই। নিন্দুকেরা বলে প্রতিষ্ঠা না থাকলে নাকি প্রেম টেকে না। বাজে কথা। দিব্যি টিকে আছে। প্রেমের সঙ্গে প্রতিষ্ঠার কোন সংস্রব নেই। যদি থাকত, তাহলে প্রেম থেকে প্রতিষ্ঠা আসত আর প্রতিষ্ঠা থেকে প্রেম। দেখা যায়, একটির সঙ্গে অপরটি আসে কদাচ। সুতরাং অনিয়মিত উভমুখিতা তাদের সম্পর্ক সিদ্ধির পথে প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে নিশ্চয়ই! আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াই। মা বলেন, ‘রাত তো পোহাল! এবার অন্তত পিঠটা ছোঁয়া বিছানায়! নাকি তাও ছোঁয়াবি না!’ বাবা বলেন, ‘ফজরের নামাজ পড়েছিস? গতরাতের ঈশা? তাও নয়! নচ্ছাড় ছোকরা! নামাজ না পড়ে কোন ঘুম নেই!’ এমন সময় দরজায় কোমল ঠকঠক শোনা যায়। বাবা এগিয়ে যান দরজার দিকে। অস্ফুটে বলেন, ‘এত ভোরে কে এল!’ দরজার ছোট ফুটোয় চোখ রেখে বলেন, ‘বোধয় মনারকাছেই এসেছে’। শুনে এগিয়ে গিয়ে ফুটোয় চোখ রাখি আমি। আরে! এ যে আমার ভীষণ আপনজন! বংশীবাদক! আমার কল্পিতঅনঙ্কিত তেলরঙ থেকে উঠে এসেছে! আমি সোল্লাসে দরজার কবাট মেলে ধরি। সে বলে, ‘সুপ্রভাত শিল্পী! চলুন, নিচে যাওয়া যাক। এক ঢিলে দুটি পাখি মারা হবে। আপনার ছবি তো আঁকা হবেই, সেই সাথে আমার দু’ পয়সা আয়’। আমি বলি, ‘বেশ!’
ভোরের আকাশের মতন নীল রুমালটায় ঠুংঠাং আধুলি পড়তে থাকে, বাঁশিতে মন্দ্রিত ভৈরবী। চলতিপথে কেউ হঠাৎ দাঁড়িয়ে যায়। কারও চোখে ভৎসনা, কারও চোখে প্রশ্রয়! বাবার হাত ধরে যেতে যেতে এক বালক হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে। তাঁর চোখের কৌতূহলে বৈরাগ্যের ভৈরবী। আমি তার বাবাকে বলি, ‘এ তো বন্য ছেলে, অবাধ্য ছেলে। যশোধরার রূপও একে আটকাতে পারবে না। পারেনি কোনদিন’। লোকটি আমার কথা বুঝতে পারে না। পারবেনা জানতাম। এ পৃথিবীতে অশোকের পিতারা বিন্দুসার হয়েছেন কদাচ। কিংবা বিন্দুসারের ছেলেরা অশোক। পিতা পুত্রের সম্পর্কের সিদ্ধতা অধরা থেকেছে শতকের পর শতক। হাওয়া বইতে থাকে,লহরীর ওঠানামা চলে। বেলা বাড়ে, ফুটপাথে লোকজন বাড়ে, একসময় ভিড় জমে যায়। আমি আমার অবশপ্রায় হাত ক্যানভাস থেকে নামাই। কেউ একজন বলে, ‘বাহ, চমৎকার ছবি। এটা নিতে চাই আমি। কিসের মূল্যে দেবে বলে তুমি মনে কর?’ কণ্ঠস্বরটিকে আমি চিনতে পারি। অর্থের বিনিময়ে ছবি কেনার সামর্থ্য বা ইচ্ছে এঁর নেই। কিন্তু কিছু নেবার বিনিময়ে, ইনি তাকে অমূল্য করে দিয়ে যান। আমার অন্ন চাইনে! চাই অমূল্য এক ছবি, যা লক্ষজনের হৃদয়ের অন্ন যোগাবে! আমি গর্বিত ভঙ্গিতে পেছন ফিরে চাই। দেখি প্রদোষ ব্রাত্যজন- ভোরের সেই সক্রেটিস হাসিমুখে দাঁড়িয়ে। পরম তৃপ্তিতে তেলরঙটা তুলে দিই তাঁর হাতে। ছবিটা বুকে নিয়ে চলে যেতে উদ্যত হন তিনি। হঠাৎ পেছন ফিরে বলে ওঠেন, ‘এ শতকে আজই ছিল আমার শেষ দিন। প্রতিবারের মত এবারও শেষ মুহূর্তটি অবধি দেখে গেলাম, প্রজ্ঞাবানেরা আজও জীবনের দাম ফেরি করে বড্ড খেলো গণ্ডিতে বাঁচে। আর শতকের ব্যবধান নয়, এবার সহস্রাব্দের ব্যবধানে আসব। বিদায়’।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে সেপ্টেম্বর, ২০১২ রাত ৯:৩৩