পহেলা বৈশাখ এগিয়ে আসছে আর আমার মাঝে অপেক্ষা তীব্রতর হচ্ছে, কখন পার্লিয়াকে নিয়ে রমনার ভোরে গাইবো, কখন মঙ্গলশোভাযাত্রায় হাত ধরে হাঁটবো। দু’বার রমনার অশ্বথমূলে থাকলেও, এখনও পর্যন্ত মঙ্গলশোভাযাত্রায় আমরা একসঙ্গে হাঁটিনি। তবে, আমার মনে হয়, আজ হতে বহু বছর আগে, এই শোভাযাত্রাতেই তার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। কিন্তু অনেক বছর পর সেই স্মৃতি থেকে পরষ্পরকে চেনা ছিল আমাদের জন্যে প্রায় অসম্ভব।
কারণ, প্রথমত অত্যন্ত স্বল্পসময়ের জন্যে হয়তো আমরা মুখোমুখি হয়েছিলাম।
দ্বিতীয়ত আমি তখন চশমা পরতাম না, গোঁফও ছিল না, আর পার্লিয়া ছিল হালকা পাতলা গড়নের ছিপছিপে এক মেয়ে।
আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম কী দ্বিতীয় বর্ষে মনে নেই; গিয়েছিলাম মঙ্গলশোভাযাত্রায়, একাকী। ছিলাম ফুটপাথের দিকে, মধ্যরাস্তায় পা রাখার মতো জায়গা ছিল না, এতোটাই ভিড়। সেইসঙ্গে মানুষের উত্তেজিত স্বর, সপ্তমে চড়ে থাকা বাঁশি, ঘামের ভরযুক্ত বাতাস আর ক্রমশ চড়তে থাকা রোদ- সব মিলিয়ে উল্লসিত হলেও কিছুটা বিপর্যস্ত।
মূলযাত্রা একমুখী হলেও ভেতরে ভেতরে জনতার চোরাস্রোত বিভিন্ন দিকে ছুটে যাচ্ছিল। এর গতিপথ ব্যাখ্যা করার মতো নয়। হঠাৎ এমনই এক স্রোতজাত ঢেউ আমাকে ফুটপাথলগ্ন রাস্তা থেকে, ঠেলে ফুটপাথের ওপর তুলে দিলো। পরবর্তী ঢেউ এসে পুরোপুরি ঠেসে ধরলো দেয়ালের সঙ্গে।
পেছন থেকে এক নারী আমার পাশে চলে এসেছিল প্রথম ঢেউয়ের পর। দ্বিতীয়বারে সে কোনক্রমে তাল রেখে আমার ছোঁয়াচ বাঁচালো ঠিকই, কিন্তু তার স্যান্ডেলের হিল আমার প্রায় নগ্ন পায়ের পাতায় একরকম বসে গেল। এমন ঘটনা আমি প্রেমের উপন্যাসে পেয়েছি।
আমি কোন যন্ত্রণার শব্দ করলাম না, পুরো ব্যথাটাই গিলে ফেললাম। সে নারী হস্তিনী ছিল না, বরং ছিল যথার্থ পদ্মিনী। অনুভূতিহীনভাবে ভিড়ে মিশে না গিয়ে, ফিরে আমাকে ছোট্ট করে বললো, স্যরি।
দেখলাম, খুব ফর্সা, কিন্তু রোদের কারণে কিছুটা রক্তবর্ণ হয়ে থাকা এক মেয়ে। ছিপছিপে, চোখে চশমা। আরও দেখলাম, আমার দিকে ফেরানো তার ডান চিবুকে স্পষ্ট কালো তিল।
কোনরকম পূর্বসংকেত ছাড়াই তার পাশের ভিড় হঠাৎ হালকা হয়ে গেল, আরও একটি মুখ হঠাৎ কোথা থেকে এসে তার হাত ধরে ভিড়ের ভেতর টেনে নিয়ে গেল।
অনেক রঙের মাঝে তারা মিশে গেলো । রোদ পড়ে চুল লাল হয়ে থাকা মাথাটাকে কিছুক্ষণ চোখে চোখে রেখেছিলাম। হঠাৎ হারিয়ে ফেললাম। টিএসসির দিকে যেতে যেতে ভাবলাম, পেয়ে যাবো। কিন্তু আর পেলাম না।
সে ঘটনার পর প্রায় চার বছর গড়ালো। আমার পরিচয় হলো পার্লিয়ার সঙ্গে। গত পরশুদিন, তার সঙ্গে মঙ্গল শোভাযাত্রা একবারও যাওয়া হয়নি- এমনটা ভাবতেই হঠাৎ সেই ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল। ততদিনে আমাদের ভালোবাসার না ভোলা দিনগুলোর লৌকিক হিসেব পৌনে তিন বছর পেরিয়ে গেছে; আমরা শুভ পরিণয়ের খুব কাছে চলে এসেছি।
তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কি কখনও মঙ্গলশোভাযাত্রায় ছিলে?
সে বললো, ছিলাম তো।
আমি বললাম, কবেকার কথা হতে পারে সেটা?
দুহাজার সাতের দিকে হবে হয়তো।
সঙ্গে কে ছিল, মনে আছে?
হুম, নাহার ছিল সঙ্গে।
আচ্ছা, ভিড়ের চাপে রাস্তা থেকে ফুটপাথে উঠে গেছো, এমন কিছু মনে আছে?
ফুটপাথেই ছিলাম, তারপর ভিড় সইতে না পেরে চারুকলায় ঢুকে গেছি।
কোন ছেলের পা কি মাড়িয়ে দিয়েছিলে?
পার্লিয়া চুপ করে রইলো। মনে করার চেষ্টা করছে।
হঠাৎ উৎফুল্ল কণ্ঠে কলকল করে উঠলো। ওর কণ্ঠই বলে দিলো, মনে পড়েনি, বরং ভেবেছে আমি বরাবরের মত সেই খেলাটা খেলছি : যেন দূর শৈশব থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময়, বহু বহুবার আমাদের দেখা হয়েছিল। বললো, আরে হ্যাঁ! তুমিই তো!
পার্লিয়া আমার কথাকে ‘খেলা’ ভাবলেও, এ রাত গভীরে আমার ভাবতে ভালো লাগছে : সেদিনের ঐ মেয়েটা পার্লিয়াই ছিল।
পহেলা বৈশাখের অপেক্ষায়-

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




