গল্প:
গলির মাথায় দাঁড়ানো সেই লোকটা
সাইয়িদ রফিকুল হক
লোকটাকে দেখলাম—বড় রাস্তাটার মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকতে। তাকে দেখে হঠাৎ মনে কেমন যেন একটা খটকা লাগলো! এত রাতে একটা মাঝবয়সী লোক রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে কী করছেন!
একটু দূর থেকে তাকে দেখছিলাম। কিছুটা দূর থেকেই তাকে কেমন যেন উস্কোখুস্কো মনে হচ্ছিল। তার হাবভাব সবটা বুঝতে পারছিলাম না। কী তার মতিগতি জানতে মনে না চাইলেও হঠাৎ তার জন্য মনটা কেমন যেন করে উঠলো। কিছু-একটা ভেবে তার কাছে এগিয়ে গেলাম।
কিছুটা কাছে যেতেই বুঝলাম—লোকটা কী যেন খুঁজছে!
আর-একটু কাছে এগিয়ে আন্তরিকভাবে তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “কিছু খুঁজছেন?”
লোকটা যেন এতোক্ষণ আমাকে দেখেনি। হঠাৎ এবার আমি তার নজরে পড়ে গেলাম। তবুও তিনি আমার প্রতি কোনো ভ্রুক্ষেপ না করে খুব ব্যতিব্যস্ত হয়ে তার জামাকাপড় হাতড়ে বারবার কী যেন খুঁজতে লাগলেন। আর তার পরনের শার্ট-প্যান্টের প্রতিটি পকেট তন্ন-তন্ন করে কী যেন খুঁজতে লাগলেন—সেই আগের মতো।
আমি একটা ভ্যাবাচাকা খেয়ে তার কাণ্ডকারখানা দেখতে লাগলাম। আর ভাবছিলাম, লোকটা আসলে কী খুঁজছেন? আর কেনইবা খুঁজছেন? এত রাতে হঠাৎ তার কী প্রয়োজন হলো?
শেষমেশ তিনি আমার দিকে তাকিয়ে খুব নীরস গলায় বললেন, “আপনার কাছে একটা দেশলাই হবে? মাত্র একটা কাঠি খরচ করবো। দেশলাইটা আমি বাড়ি থেকে সঙ্গে করে এনেছিলাম। কিন্তু তাড়াহুড়ার কারণে কোথায় যেন পড়ে গেছে! কিছুতেই আর খুঁজে পাচ্ছি না!”
আমি তার কথা শুনে একেবারে হতভম্ব! এত রাতে কেউ কারও কাছে দিয়াশলাই চায়! হতে পারে লোকটা কোনো চেইন স্মোকার! কিন্তু তাকে দেখে তো সেরকম মনে হচ্ছে না! তবুও কেন তিনি দিয়াশলাই চাচ্ছেন!
সিনেমা হলের শেষ নাইট-শো দেখে বাড়ি ফিরছিলাম। মদ্যপান করিনি। তবুও এই রাত বারোটায় নিজেরই একটা টালমাটাল অবস্থা। তারউপরে এই লোকটার হাবভাব আমাকে ভয়ংকরভাবে বিস্মিত করেছে। এমনিতে আমি নিয়মিত সিগারেট খাই। আমার পকেটে সবসময় একটা-না-একটা দিয়াশলাই থাকে। আজও আমার পকেটে কাঠিভর্তি একটা দিয়াশলাই আছে।
আমি তার কাছে আরও কিছুটা এগিয়ে দিয়াশলাইটা দিতে যাবো—এমন সময় বুঝলাম—লোকটার গায়ে কেরোসিনের গন্ধ! সারা গায়ে তার কোরোসিন মাখা! হঠাৎ তার তীব্র গন্ধ এলো নাকে! আর মনে হলো—এর সঙ্গে পেট্রোলও থাকতে পারে কিছুটা!
চমকে উঠলাম। আর ভাবলাম—এখন রাত বারোটার বেশি। নির্জন পথের মোড়ে লোকটা দাঁড়িয়ে রয়েছে সারা গায়ে পেট্রোল কিংবা কেরোসিন মেখে! হঠাৎ মাথাটা কেমন যেন ঝিম ঝিম করে উঠলো।
আর অমনি একলাফে দিয়াশলাইটা মুঠো করে দিলাম এক দৌড়!
দৌড়াতে-দৌড়াতে ভাবলাম—ভাগ্যিস তার কাছে গিয়ে একটা সিগারেট ধরাইনি কিংবা অন্যমনস্কভাবে লোকটার হাতে তুলে দিইনি দিয়াশলাইটা! তাইলে মানুষের কাছে না হোক, বিবেকের কাঠগড়ায় চিরদিন আমাকে হন্তারক হিসাবে অনুশোচনা করতে হতো।
লোকটা আমার দিকে কিছুটা এগিয়ে আসতে-আসতে তবুও বলছিলেন, “আপনার দেশলাইটা আমাকে একটু দিন। মাত্র একটা কাঠি খরচ করবো। মাত্র একটা কাঠি…!”
পুনশ্চ:
বাড়ি ফিরে মনে মনে ভাবলাম—লোকটা যেন আত্মহত্যা না করে! আহা! জানি না কী দুঃখ-কষ্ট তার মনে! আর মনে মনে প্রার্থনা করলাম কিছুক্ষণ—কেউ যেন তাকে একটা দিয়াশলাই কিংবা তার একটা কাঠিও না দেয়। আর ভোরের আলো ফুটে ওঠার আগেই লোকজন যেন তাকে বুঝিয়েশুনিয়ে বাড়ি নিয়ে যায়। আবার এও মনে হলো—যে একবার আত্মহত্যার খাতায় নাম লিখিয়েছে—তাকে কে বাঁচাবে?
সাইয়িদ রফিকুল হক
মিরপুর, ঢাকা।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা আগস্ট, ২০২০ বিকাল ৫:৫১