somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একজন হুমায়ূন আহমেদ

২০ শে জুলাই, ২০২০ সকাল ১০:৪৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর ছয় মাস পর বা তার কাছাকাছি সময়ে এক বন্ধু আমার কাছে অবাক হয়ে জানতে চাইলো, “কিরে তোর ফেসবুক কাভার ম্যালাদিন ধরেই কাল দেখি,ব্যাপার কি?” । আমি একটু থতমত খেয়ে গেলাম প্রশ্ন শুনে। কারণ হল এর ভাল কোন উত্তর আমার কাছে ছিলনা। আমি জানতাম যে ফেইসবুকের ভার্চুয়াল দুনিয়ার কাভার কাল করে রাখায় আসলেই কিছু আসে যায়না। এসব দেখলে হুমায়ূন নিজেই হয়তো হাসতেন। কোনদিন যার সঙ্গে সামনাসামনি দেখা হয়নি, কথা হয়নি, এমন একজনের চলে যাওয়ার কারণে মাথার মধ্যে দিনরাত যে ভোঁতা অনুভূতি জমে ছিল বা আছে, তারই কি কোন অর্থ হয় ?

মনে আছে হুমায়ূন আহমেদ তখনো বেঁচে, বিভিন্ন জায়গায় মিডিয়াতে উনার মজার সাক্ষাৎকার দেখেও আমরা ভাইবোনেরা কেন যেন পুরোপুরি খুশির হাসি হাসতে পারিনা। চিন্তিত হয়ে ভাবি, লোকটা বুড়ো হয়ে যাচ্ছে, উনি মারা গেলে কিভাবে থাকবো?

অতঃপর সত্যিসত্যি একদিন হুমায়ুন ছাড়া একটা সকাল হলো। মনে আছে, তাঁর মৃত্যুর পরদিনই প্রথম আলোর প্রথম পাতায় আনিসুল হকের বিশাল লেখা দেখে আমি একই সংগে অবাক আর হিংসান্বিত হয়েছিলাম ।উনি কি সুন্দর দ্রুত চিন্তা ভাবনা প্রসেস করে বিশাল এক শোকগাঁথা লিখেছিলেন।আমি তখনো ঘোর ডিনাইয়ালে আছি, আমরা সবাই তখনো ঘোর ডিনাইয়ালে আছি।

লোকজন এসব পড়ে ভাবতে পারে, আপনজন ছাড়া, পরিবার বা বন্ধুবান্ধব ছাড়া অন্য কারো জন্য আজাইরা শোকের দোকান খুলে বসা কেন? ভাল প্রশ্ন। হুমায়ূন আসলে কি ছিলেন আমাদের জন্য? অন্য জেনারেশনদের কথা জানি না, আমরা আশির দশকে জন্ম নেয়া বাচ্চাকাচ্চারা যখন বড় হচ্ছিলাম, আমাদের জন্য হুমায়ূন ঠিক আত্মীয়ও ছিলেননা, বন্ধুও ছিলেননা, হুমায়ুন ছিলেন হুমায়ূন।ব্যক্তিগত দু:খ কষ্টের সময় তিনি এসে সবসময় পাশে দাঁড়িয়েছেন, কাঁধে হাত রেখেছেন। দৈনন্দিন দু:খ কষ্টের নিরানন্দের জগতের পাশাপাশি আমাদের জন্য ছিল একটা রহস্যময় হুমায়ূনীয় জগত।

আমাদের বড়বোনের এসএসসিতে অনেক ভাল করার কথা। রেজাল্ট দেয়ার পর দেখা গেল অত ভাল হয়নি। সে মন খারাপ করে শুয়ে আছে, আম্মু গিয়ে পিঠে হাত রেখে বললো, “চল, বাইরে থেকে ঘুরে আসি”। বাইরে থেকে এসে সে কী খুশি, হাতে কয়েকটা নতুন কেনা হুমায়ূন আহমেদের বই। অত কষ্টের একটা রাতেও বই পড়তে পড়তে মাঝে মাঝে সে খিলখিল করে হাসে, আমি আর আমার ছোট বোন অবাক হইনা। কারণ আমরা জানি যে, সে এখন ঘুরতে গেছে হুমায়নীয় জগতে। ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করি কখন তার বই পড়া শেষ হবে, তারপর আমরাও ঘুরতে যাব সেখানে।

এরপর কতদিন চলে গেছে। কত বইমেলা এসেছে আর গিয়েছে। বহুদিন হুমায়ূন আহমেদের লেখা নতুন কোন বই পড়া হয়না। মনে হয় যেন প্রিয় কোন বন্ধুর সংগে দেখা হয়না যুগের পর যুগ। এখনো হয়তো চাঁদি ফাটা ঠাঠা রোদের দুপুরে খালি পায়ে হলুদ পান্জাবী পড়ে হিমু রাস্তায় নামে, শেষ বিকেলে মিসির আলীর দড়জার কড়ায় হাত রাখে কোন রহস্যময় চরিত্র, জোৎস্না রাতে নীল শাড়ী পড়ে বারান্দায় দাঁড়ায় বিষন্ন সুন্দরী রূপা। অলৌকিক সুন্দর সেই সব জগতের কোন গল্পই আর আমাদের কাছে এসে পৌঁছায়না, সেই জগতের সংগে আমাদের যোগসূত্র হুমায়ূন একা একা কাণ্ডজ্ঞানহীনের মত কোন অচেনা অজানা জায়গায় গিয়ে বসে আছেন।আমাদের রাগ, অভিমান কষ্ট কিছুই আর সেখানে তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনা।

বছর ঘুরে হুমায়ুন আহমেদের জন্মদিন আসলে আমার প্রতিবারই মনে হয় তাঁকে নিয়ে বিশাল বড় করে কিছু লিখি। কোনবারই লেখা হয়না। মনে হয় উনাকে নিয়ে বেশি কিছু লিখলে স্বীকার করে নেয়া হবে যে হুমায়ূন আহমেদ আর নেই, মস্তিষ্ক মেনে নেবে যে, সেই রহস্যময় হুমায়নীয় জগতের নতুন কোন জায়গায় আর কেউ কখনো ঘুরতে যেতে পারবেনা। উনার বিষয়ে অনুভব করা গভীর আবেগের জোয়ার ভাটা তাই মনের মধ্যে চুপচাপ রয়ে যায়, বের করে নেড়েচেড়ে দেখার জন্য যে সাহস প্রয়োজন, তা আমার বছরের পর বছরেও সঞ্চয় করে ওঠা হয়না।

তবে স্বান্ত্বনা এটাই যে, হুমায়ূন আহমেদের মত লেখকেরা সচরাচর মারা যেতে পারেননা, লেখা নামক সাংকেতিক আঁকিবুকির জটিল প্যাঁচের মধ্যে তাদের চিন্তা ভাবনা থেকে যায়, তারা থেকে যান। হুমায়ূন আহমেদের থেকে অনেক গ্রেট লেখক অতীতে জন্ম নিয়েছেন, ভবিষ্যতেও জন্ম নেবেন। তাতে আসলে কিছু যায় আসে না।আমরা হুমায়ূনকে গ্রেটনেসের স্কেলে চুলচেরাভাবে মেপে তারপর তাকে তার জায়গায় নিয়ে বসাইনি। হুমায়ূনের জন্য আমাদের আছে শুধুমাত্র হুমায়নীয় স্কেল।কাজেই উনার সাথে অন্য কারো তুলনা হবেনা।

হুমায়ূন আহমেদ বেঁচে থাকতে দেশে বিশ্বমানের একটা ক্যান্সার হাসপাতাল করতে চেয়েছিলেন। তাঁর নামে সাহিত্য পুরষ্কার দেয়া হচ্ছে , স্মরণ সভা হচ্ছে, কিন্তু তার শেষ এই ইচ্ছা নিয়ে কেউ কথা বলেনা। আমার মনে হয় হুমায়নীয় জগতে ঘুরে ফিরে বড় হওয়া কেউ একজন খুশি মনে একদিন এই দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেবে। তখন সেই গর্বিত কেজো মানুষদের মিছিলের এক কোণায় যেন থাকতে পারি, সেটাই প্রত্যাশা।

পরিশেষে, হয়তো দু:খ কষ্টকে ঝড়ো বাতাসে উড়িয়ে দিয়ে প্রাণখোলা হাসি হাসানোর জন্য, কিমবা মাঝে মধ্যে অন্তর পরিষ্কার করা কান্না কাঁদানোর জন্য বাঙালীর একজন হুমায়ূন আহমেদ আর নাই।কিন্তু তাতে কী। আমার মনে হয়, দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন সময়ে আমাদের সবার জীবনেই হুমায়নীয় মুহূর্তরা আনাগোনা করে।আর তার গল্পের হাজারো চরিত্র বইএর পাতা থেকে বের হয়ে মিশে গেছে চারপাশের বাস্তবতায়। তাদের সঙ্গে দেখা হলে একটু কষ্ট করে চিনে নিতে হবে,এই যা।

অত:পর, অনেক ভালবাসা হুমায়ূন আহমেদের জন্য।

সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জুলাই, ২০২০ ভোর ৫:২০
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমাদের হাদিকে গুলি করা, আর আওয়ামী শুয়োরদের উল্লাস। আমাদের ভুল কোথায়?

লিখেছেন তানভির জুমার, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৫৩



৩০ জনের একটা হিটলিস্ট দেখলাম। সেখানে আমার ও আমার স্নেহের-পরিচিত অনেকের নাম আছে। খুব বিশ্বাস করেছি তা না, আবার খুব অবিশ্বাস করারও সুযোগ নাই। এটাই আমার প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

এ যুগের বুদ্ধিজীবীরা !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৪০


ডিসেম্বর মাসের চৌদ্দ তারিখ বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করা হয়। পাকিস্তান মিলিটারী ও তাদের সহযোগীরা মিলে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করেন লেখক, ডাক্তার, চিকিৎসক সহ নানান পেশার বাংলাদেশপন্থী বুদ্ধিজীবীদের!... ...বাকিটুকু পড়ুন

মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫….(৭)

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৭

ষষ্ঠ পর্বের লিঙ্কঃ মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫-….(৬)

০৬ জুন ২০২৫ তারিখে সূর্যোদয়ের পরে পরেই আমাদেরকে বাসে করে আরাফাতের ময়দানে নিয়ে আসা হলো। এই দিনটি বছরের পবিত্রতম দিন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আধা রাজাকারি পোষ্ট ......

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:৫৬


আমি স্বাধীন বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছি। আমার কাছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, বা পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে আজকের বাংলাদেশের তুলনা—এসব নিয়ে কোনো আবেগ বা নস্টালজিয়া নেই। আমি জন্মগতভাবেই স্বাধীন দেশের নাগরিক, কিন্তু... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্দিরা কেন ভারতীয় বাহিনীকে বাংলাদেশে দীর্ঘদিন রাখেনি?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:২০



কারণ, কোল্ডওয়ারের সেই যুগে (১৯৭১সাল ), আমেরিকা ও চীন পাকিস্তানের পক্ষে ছিলো; ইন্দিরা বাংলাদেশে সৈন্য রেখে বিশ্বের বড় শক্তিগুলোর সাথে বিতন্ডায় জড়াতে চাহেনি।

ব্লগে নতুন পাগলের উদ্ভব ঘটেছে;... ...বাকিটুকু পড়ুন

×