somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কুরআন-হাদীছের আলোকে শবে বরাত - শেষ পর্ব

০৩ রা জুলাই, ২০১২ বিকাল ৩:০৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

بسم الله الرحمن الرحيم

মুফতী মীযানুর রহমান সাঈদ

উপসংহারঃ

শবে বরাতের আলোচনা কুরআন শরিফের সূরায়ে দুখানে ليلة مباركة দ্বারা করা হয়েছে। যা বাতিল বা ভুল বলা সঠিক নয়। তবে মুফাসসিরীনের নির্ভরযোগ্য মতানুসারে এ তাফসীর অনগ্রাধিকার বলে সাব্যস্ত। তাই শবে বরাতের প্রমাণ মূলত হাদীছভান্ডারেই বিদ্যমান।

সকল আহলে সুন্নাত ওয়াল-জামাআতকে একথা দৃঢ়ভাবে বুঝে নিতে হবে যে, কুরআন বা সুন্নাহ দ্বারা যে বিষয়টি প্রমাণিত নয় এবং সাহাবায়ে কেরাম ও বুজুরগানে দ্বীনের আমল দ্বারাও প্রমাণিত নয়, সেটাকে দ্বীনের অংশ মনে করা বিদআত। বাস্তবে যদি শবেবরাতের ফজীলতের বিষয়টি উপরোক্ত নীতিমালার আওতায় পড়ে তাহলে নিঃসন্দেহে এই রাতটিকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়াও বিদআত হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবতা এটা নয়। কেননা শবেবরাতের ফজীলত হাদিছ দ্বারা প্রমাণিত নয় একথা বলার কোন সুযোগ নেই। বরং অন্তত দশজন সাহাবা (রঃ) শবেবরাত সম্পর্কে রসূল (সঃ) থেকে হাদীছ বর্ণনা করেছেন। তন্মধ্য থেকে দুএকটি হাদীছ সনদের বিবেচনায় দুর্বল হলেও অন্যান্য হাদীছগুলো সহীহ এবং আমলের মানদন্ডে উপনীত হয়েছে। যার বিস্তারিত বিবরণ ইতিপূর্বে তুলে ধরা হয়েছে। সুতরাং শবেবরাতের সমর্থনে যখন দশজন সাহাবার ১২টির মত হাদীছ রয়েছে তাহলে এটাকে ভিত্তিহীন বলা রসূল (সঃ) - এর হাদীছ (সুন্নাহ) ও সকল সাহাবগণের প্রতি অনাস্তা প্রকাশ করার নামান্তর।

ইসলামের শ্রেষ্ঠ ও সোনালী যুগ তথা সাহাবায়েকেরাম, তাবেঈন এবং তবে তাবেঈনের যুগেও শবেবরাতকে ফজীলতপূর্ণ রাত হিসেবে পালন করা ও বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হতো। সুতরাং এটাকে ভিত্তিহীন বা বিদআত আখ্যা দেয়ার কোন অবকাশ নেই। বরং এ রাতে ইবাদতের জন্য জাগ্রত থাকা অবশ্যই ছাওয়াবের কাজ এবং এ রাতের বিশেষ গুরুত্বও অনস্বীকার্য।

এ রাতে ইবাদতের বিশেষ কোন তরীকা নির্দিষ্ট ও নির্ধারিত নেই। এটা বাস্তব সম্মত কথা। অনেকে মনে করেন এ রাতে বিশেষ পদ্ধতিতে এর রাকাআত নামায পড়তে হয়। প্রথম রাকাআতে অমুক সূরা এতবার, দ্বিতীয় রাকাআতে অমুক সূরা অতবার পড়তে হয়। না হলে শবেবরাতই পালিত হয় না। মূলতঃ এগুলোর কোনই প্রমাণ নেই। বরং এগুলো সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও মনগড়া কথা। এ রাতে যত বেশি সম্ভব হয় নফল নামায পড়বে, কুরআন তিলাওয়াত করবে, বেশি-বেশি যিকির করবে, তাসবীহ পড়বে, অধিক দোয়া ও তাওবা-ইস্তিগফার করবে ইত্যাদি। সুতরাং এ জাতীয় সকল ইবাদত এ রাতে করা নিঃসন্দেহে ছওয়াবের কাজ।

শবেবরাতে কবর যিয়ারত একটি প্রমাণিত আমলঃ

হাদীছ শরীফে এসেছে যে, রসূল (সঃ) এরাতেই কবরস্থানে গমণ করেছেন। তাই মুসলমানগণও এরাতে কবরস্থানে গমন করে থাকেন। কিন্তু রসূল (সঃ) জীবনে এক শবেবরাতেই জান্নাতুল বাকীতে গমণ করে ছিলেন। তাই যে কোন মুসলমানের জীবনে একবার যাওয়া অতি উত্তম। যদি প্রতি শবেবরাতে অতি গুরুত্ব ও দলবদ্ধতার সাথে, নারী-পুরুষ সমানভাবে কবরস্থানে গমণ করে এবং এটাকে জরুরীও মনে করে তাহলে এটা হবে নিশ্চিত সীমালংঘণ। তবে এসব রীতি-নীতি পরিহার করে প্রতি শবেবরাতে কবরস্থানে গমণ করা শরীয়ত সম্মত।

এ রাতে জামাআতের সাথে নফল নামাযঃ

অনেকে এরাতে জামাতের সাথে নফল নামায পড়ে থাকেন। বিশেষ করে সালাতুততাসবীহ। জেনে রাখুন যে, ফরজ নামায এবং যেসব নামায রসূল (সঃ) জামাআতের সাথে আদায় করেছেনঃ যেমন তারাবীহ, বিতির এবং ইস্তিসকার ইত্যাদি নামায ছাড়া অবশিষ্ট সব ধরণের নামায একাকি পড়া উত্তম। এ কারণে হানাফী মাযহাব মতে নফল নামায জামাআতের সাথে পড়া মাকরূহে তাহরিমী, তথা নাজায়েয। সুতরাং শবে বরাতে ও শবে ক্বদরে নফল নামায জামাতের সাথে পড়লে ছাওয়াবতো দূরের কথা বরং গুনাহ হবে। হযরত ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলতেন, " নফল ইবাদতের সঠিক মূল্য দাও, আর তা হলো তুমি থাকবে আর তোমার আল্লাহ থাকবে, তৃতীয় কেউ থাকবে না। " এটাই নফল ইবাদতের বিধান।

হাদীছে উল্লেখিত আল্লাহর আহবানের প্রতি লক্ষ করুন।

الاهل من مستغفر فاغفر له

অর্থাৎ আছো কি মাগফিরাতের কোন প্রত্যাশী যে, তাকে আমি মাফ করতে পারি।

দেখুন এখানে, مستغفر শব্দটি একবচন। অর্থাৎ একক ক্ষমাপ্রার্থী। এর অর্থ হলো আল্লাহ আমাকে নির্জনে ডাকছেন। তাহলে এসব পবিত্র রজনীতে জামাআতের সাথে আলোকসজ্জা করে সদলবলে ইবাদত করা কি সমীচীন হবে ? কখনো না। বরং এটা আল্লাহর পুরস্কারের কঠিন অবমূল্যায়ন বৈ কিছু নয়।

শবেবরাতের মত ফজীলতময় রাতটি শূরগুল করার জন্য নয়, কিংবা সিরনী-মিঠাই বিলি করার জন্য নয়, এমনকি সম্মেলন করার জন্যও নয়। বরং এ বরকতময় রাত আল্লাহর সঙ্গে একান্তে সম্পর্ক গড়ে তোলা ও গুনাহ মাফ করানোর রাত, জান্নাত কামাই করার রাত। এর মাঝে কোন অন্তরায় থাকা মোটেই সমীচীন নয়। উল্লেখ্যঃ অনেকেই অনুযোগের সুরে বলেন, একাকি এবাদত করতে গেলে ঘুম ধরে। মসজিদ যেহেতু লোকজনে সরগরম থাকে, আলো-বাতি থাকে তাই সেখানে আর ঘুম কাবু করতে পারে না। এর জবাবে মাওলানা মুফতী মুহাম্মদ তক্বী ওছমানী (দাঃবাঃ) বলেন, বিশ্বাস কর নির্জনে ইবাদতে যে কয়েকটি মুহূর্ত কাটাবে, যে স্বল্পসময় আল্লাহর সাথে তোমার প্রেম বিনিময় হবে তা সারারাতের ইবাদতের চেয়ে অনেক উত্তম। কেননা এটা তখন সুন্নাত মুতাবেক হবে, সেখানে ইখলাস বিদ্ধমান থাকবে। ইখলাস বা সুন্নাত মোতাবেক ইবাদত করলে অল্প আমলই ইনশাআল্লাহ নাজাতের জন্য যথেষ্ট হয়ে যাবে।

মহিলাদার জামাআতঃ

এ ব্যাপারে শরীয়তের মাসআলা হলো মহিলাদের জন্য ফরজ নামাযের জামাআতে অঙ্গশগ্রহণ মাকরূহ বা অপছন্দনীয়। সুতরাং তাদের জন্য যেখানে ফরজের জামাআতে অংশগ্রহণ অনুচিত, সেখানে সুন্নাত বা নফল নামাযের জামাআত করার প্রশ্নই উঠে না। শুনে নিনঃ দ্বীনের মূল নীতি হলো শরীয়তের যথাযথ অনুসরণ ও অনুকরণ। তাই রসূল (সঃ) এর প্রেম ইশকের নামে শরীয়ত বিরোধী মনের যে কোন কামনা বাসনা অবশ্যই বর্জনীয়।

শবেবরাতে হালোয়া-সিরনীতে ব্যস্ত রাখা শয়তানের চক্রান্তঃ

শবেবরাতে সুন্নাত মুতাবেক ইখলাসের সাথে ইবাদত যতটুকু সম্ভব ততটুকু করা জরুরী। এ ছাড়া অবশিষ্ট অহেতুক কাজ যেমন হালোয়া-রুটি, সিরনী পাকানো ইত্যাদি অবশ্যই বর্জনীয়। এমনিতে যে কোন দিন হালোয়া রুটি পাকানো না জায়েয নয়। কিন্তু শবেবরাতে যে হালোয়া-সিরনী পাকানোর প্রথা চলে আসছে এবং জরুরী মনে করা হচ্ছে তা শয়তানেরই আবিস্কার। দেখুন শবেবরাতে আল্লাহ তাআলা বনুকালব গোত্রের বকরীর পশম পরিমাণ গোনাহ মাফ করার ঘোষণা দিয়েছেন। শয়তান তা কি করে সহ্য করতে পারে ? সে কারণে সে নিজেই শবে বরাতে ভাগ বসাল তথা মানুষকে অহেতুক কাজে ব্যস্ত করে গোনাহ মার্জনা হতে বঞ্চিত রাখল। অতএব শয়তানের চক্রান্তে পড়া কোন নবী প্রেমিক উম্মতের জন্য সমীচীন হতে পারে না।

শাবানের পনের তারিখ রোযা রাখাঃ

পূর্ব আলোচনা করা হয়েছে যে, শাবানের পনের তারিখে রোযার ব্যাপারে শুধু একটি হাদীছই পাওয়া যায়। তবে বর্ণনাসুত্রে তা দুর্বল। এ কারণে এ হাদীছের ভিত্তিতে পনের তারিখের রোযাকে সুন্নাত ও মুস্তাহাব বলা অনেকের মতে অনুচিত। কিন্তু ২৯, ৩০ তারিখ ছাড়া পুরা শাবান মাসের রোযার ফজীলত বহু হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত। উপরন্ত পনের তারিখ আইয়ামে বীজেরও অন্তর্ভুক্ত ( আরবী মাসের ১৩, ১৪, ১৫ তারিখকে আইয়ামে বীজ বলা হয়।) রসূল (সঃ) প্রায় মাসে আইয়ামে বীজের রোযা রাখতেন। সুতরাং কোন ব্যক্তি যদি এসব বিষয়ের প্রতি লক্ষ করে শাবানের পনের তারিখের রোযা রাখে তাহলে অবশ্যই সে ছোয়াবের অধিকারী হবে।

মোট কথা, শবেবরাত নিয়ে তর্কবিতর্কে জড়িয়ে পড়ার কোন অবকাশ নেই। এ রাতের ফজীলতকে ভিত্তিহীন বলা চরম অজ্ঞতা। বরং রমজানের মাত্র দুসপ্তাহ পূর্বে এ বরকতপূর্ণ রাত আল্লাহ তাআলা প্রদান করে স্বীয় বান্দাদের জন্য রমজান মাসকে ইস্তিকবাল করার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। রমজানের প্রস্তুতি গ্রহণের আহবান করছেন। যাতে রমজান মাসের রহমত, বরকত ও মাগফিরাত পাওয়ার জন্য পূর্বেই গোনাহ হতে পরিত্রান অর্জন করতে পারে।

আল্লাহ তাআলা পবিত্র শবেবরাতকে যথাযথা মূল্যায়ন করে ইবাদত করার আমাদের সকলকে তৌফিক দান করুন।

وصلى الله تعالى على خير خلقه محمد واله وأصحابه أجمعين

( ইনশাল্লাহ আমার পরবর্তী পোস্ট হবে - তারাবীর নামায ২০ রাকাআত কেন )
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আইনের ফাঁকফোকর-০৩

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৪২

যেকোনো চাকরির নিয়োগের পরীক্ষা চলছে। সেটা পাবলিক সার্ভিস কমিশন, বিভিন্ন সংস্থা, বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক বা উপজেলা পর্যায়ের কোনো কার্যালয়ে হতে পারে। এই নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস হতে পারে। একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

গল্পঃ অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথি

লিখেছেন ইসিয়াক, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১২

(১)
মাছ বাজারে ঢোকার মুখে "মায়া" মাছগুলোর উপর আমার  চোখ আটকে গেল।বেশ তাজা মাছ। মনে পড়লো আব্বা "মায়া" মাছ চচ্চড়ি দারুণ পছন্দ করেন। মাসের শেষ যদিও হাতটানাটানি চলছে তবুও একশো কুড়ি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগে বিরোধী মতের কাউকে নীতি মালায় নিলে কি সত্যি আনন্দ পাওয়া যায়।

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৮

ব্লগ এমন এক স্থান, যেখানে মতের অমিলের কারণে, চকলেটের কারণে, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে অনেক তর্কাতর্কি বিতর্ক কাটা কাটি মারামারি মন্তব্যে প্রতিমন্তব্যে আঘাত এগুলো যেনো নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। ব্লগটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

সিকান্দার রাজার চেয়ে একজন পতিতাও ভালো।

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ৮:০৭

সিকান্দার রাজা কোকের বোতল সামনে থেকে সরিয়ে রাতারাতি হিরো বনে গেছেন! কিন্তু তাকে যারা হিরো বানিয়েছেন, তারা কেউ দেখছেন না তিনি কত বড় নেমকহারামি করেছেন। তারা নিজেদেরকে ধার্মিক বলে দাবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগার'স ইন্টারভিউঃ আজকের অতিথি ব্লগার শায়মা

লিখেছেন অপু তানভীর, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১১:০৫



সামুতে ব্লগারদের ইন্টারভিউ নেওয়াটা নতুন না । অনেক ব্লগারই সিরিজ আকারে এই ধরণের পোস্ট করেছেন । যদিও সেগুলো বেশ আগের ঘটনা । ইন্টারভিউ মূলক পোস্ট অনেক দিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×