বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসের নায়িকা বনবালিকা কপালকুণ্ডলা পথহারা নবকুমারকে জিজ্ঞেস করেছিল ‘পথিক, তুমি কি পথ হারাইয়াছ?’ বাস্তবিকই পথ হারিয়েছিল নবকুমার। পথিক পথ হারাইতে পারে। কিন্তু অনেক সময় পথও তার পথ হারিয়ে ফেলে।
পথও অনেক সময় পথ হারিয়ে ফেলে! বিস্ময়ের কিছু নাই। মাত্র ৬০ বছর আগেও, যখন এশিয়ার বেশির ভাগ মানুষ যাতায়াত করত টি হর্স রোড় (চা ও ঘোড়া সড়ক) দিয়ে। মানুষ এই পথে যাতায়াত করতো হেঁটে বা কোন প্রাণীর পিঠে চড়ে। এটা ছিল চীন ও তিব্বতের মধ্যে যোগাযোগের প্রধান অবলম্বন। অথচ আজ? মাত্র ৬০ বছরের ব্যবধানে পথটি হারিয়ে গেছে।
একদা এই পথটি সিচুয়ান প্রদেশে চা উৎপাদনকারী অঞ্চল ইয়ান থেকে ক্যাথের বুকের উপর দিয়ে প্রায় ১৪০০ মাইল পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছাত তিব্বতের রাজধানী লাসায়, যে নগরী আবার সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১২ হাজার ফুট উঁচুতে অবস্থিত। এশিয়ার অন্যতম সর্বোচ্চ ও দূর্গম এই পথটির যাত্রা শুরু চীনের শ্যামল উপত্যকা থেকে। তারপর এটি পেরিয়ে গেছে কত না ঝড়ো হাওয়া, তুষারাচ্ছন্ন তিব্বতি মালভূমি। পার হয়েছে বরফ হয়ে যাওয়া ইয়াংশি, মেকু ও সালাউয়িন নদী। রহস্যময় নিয়াইনকুয়েনটাংলা পর্বতমালা পাড়ি দিয়েছে এ পথ। অতিক্রম করেছে ১৭ হাজার ফুট ভয়ঙ্কর গিরিপথ। তবেই না পৌঁছেছে পবিত্র নগরী লাসায়।
এ পথের পশ্চিমাংশ বুজে যেত তুষারঝড়ে। আর পূর্বাংশ অচল করে দিত লাগামছাড়া বৃষ্টি। আর পথে পথে ডাকাত দল তো ছিলই। তবুও এ পথ চলেছে। কেননা চীনের ছিল চা, যা দরকার তিব্বতের। আর তিব্বতের ঘোড়ার ভীষণ প্রয়োজন ছিল চীনের। সুতরাং ‘চায়ের বদলে ঘোড়া’- বিনিময় বাণিজ্য চলবেই, পথ যত দূর্গম হোক না কেন। চীন দেশের শ্রমিকরা পিঠের সাথে রশি বেঁধে চা পাতার বস্তা ঝুলিয়ে বহন করতো। হাতে থাকতো ইংরেজী ‘টি’ আকৃতির ক্র্যাচ। এই সকল বস্তার ওজন ১৩৫ পাউন্ড বা তারও বেশি। এটা ছিল এক ভয়ঙ্কর কাজ। শীতকালে পথটি তিন ফুট বরফের নিচে চাপা পড়ে যায়। আর উপরে পাথর খন্ডের সাথে ঝুলতে থাকে সুঁচের মতো তীক্ষè অগ্রভাগবিশিষ্ট বরফ খন্ড, যা কোনভাবে মাথায় পড়লে নিশ্চিত মৃত্যু। মাথা নিচু করে ক্র্যাচে ভর দিয়ে পথ চলতো। চোখ থাকত পায়ের দিকে।
সাত কদম গিয়েই একটু বিশ্রম। এটাই নিয়ম। একটা গানও ছিল এ নিয়ে। যার অর্থ এ রকম- ওপরের দিকে সাত কদম গিয়ে একটু বিশ্রাম নাও। নিচের দিকে আট কদম নেমে একটু বিশ্রাম নাও। সমতলে এগার কদম হেঁটে একটু বিশ্রাম নাও। যদি বিশ্রাম না নাও তবে তুমি একটা নির্বোধ।চা বহনকারীদের মধ্যে নারী-পুরুষ সবাই থাকত। সবচেয়ে শক্তিমান মানুষটি ৩০০ পাউন্ড পর্যন্ত চা পাতা বহন করত। করবে না কেন? যত বড় বোঝা, তত অর্থ। যত পাউন্ড চা পাতা নেবে, বাড়ি ফিরে তত পাউন্ড চাল।
এসব শ্রমিকের পরনে থাকত ছেঁড়া কাপড়। পায়ে ঘাসের স্যান্ডেল। তাদের একমাত্র খাদ্য ছিল ভুট্টার রুটি। কদাচিৎ এক বাটি শিমের দধি। তুষারঝড়ে পড়ে, বোঝা বইতে না পেরে হাঠাৎ পড়ে গিয়ে কতজন যে মারা গেছে তার ইয়াত্তা নেই।
কিন্তু এ পথ হারালো কিভাবে? ১৯৪৯ সালে মাও সেতুংয়ের নেতৃত্বে কমিউনিস্ট বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার পরপরই এই চা পরিবহন বন্ধ করে দেয়া হয়। নির্মাণ করা হয় একটি মহাসড়ক। ধনীদের সম্পদ গরিবদের মধ্যে পুনবন্টন করা হয়। চা পরিবহনকারীদের দাসবৃত্তি থেকে মুক্তি দেন মাও সেতুং। এটা ছিল এই দাসদের জীবনে সবচেয়ে আনন্দের দিন।
সূত্র- অন্যদিগন্ত

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




