প্রিয়তীর থমথমে মুখের ভাঁজে থেকে থেকে যেন বিদ্যুৎ চমকায়! উৎকণ্ঠা ,উদ্বেগ,দুশ্চিন্তা সব যাপটে ধরে বিবেকের দুয়ারে এসে জড়ো করে প্রশ্নের স্তূপ!এভাবে মেয়েটির থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া উচিত হবে কি? কিন্তু সে কি বা করতে পারে? পুঁজিবাদী সমাজের বস্তুবাদী কঠিন নিয়মের কাছে মানুষ বড্ড অসহায়!
বামে মুখ ঘুরিয়ে সোফা বসা স্বামীর দিকে তাকায়। সাজ্জাদ গভীর মনোযোগ দিয়ে পেপারের মধ্যে ডুবে আছে। প্রিয়তীর তার সামনে এসে বসে।
-''সাজ্জাদ শোনো! চলো না এক বার গিয়ে মেয়েটিকে দেখে আসি!''
-''কোন মেয়েটির কথা বলছো? তোমার কলেজের ছাত্রী আলোর কথা?''
-''হুম! নিজেকে বড় অপরাধী মনে হচ্ছে জানো! আমারই চোখের সামনে দিয়ে ওরা আলোকে তুলে নিয়ে গেলো। আমি কিছু করতে পারলাম না! তারপর এক সপ্তাহ পর মুমূর্ষু অবস্থায় ফেরত! কিছুই কি করার নেই আমাদের?''
-'' এখানে ক্রিমিনাল প্রভাবশালী লোকের ছেলে! কত দূরই বা আমরা ওকে সাহায্য করতে পারবো! বরং নিজেরাই হয়ত কোন ঝামেলায় ফেঁসে যাবো।''
প্রিয়তী সাজ্জাদের হাটুর কাছে এসে বসে তার হাত থেকে পেপার নিয়ে সাজ্জাদের চোখের দিকে তাকায়। ''আচ্ছা ধরে নাও আলোর জায়গায় যদি আমাদের আপন কেউ এমন বিপদে পড়তো! তখনো কি আমরা এভাবে মুখ ফিরিয়ে থাকতাম?''
-''প্রিয়তী তুমি ঘটনাটা নিয়ে বড্ড বেশি ভাবছো! আলো তোমার ফেভারিট ছাত্রীদের একজন। তাই হয়ত তার এমন পরিস্থিতি তুমি মেনে নিতে পারছো না! কিন্তু তোমার অফিসের কলিগদের দেখো! ঠিকই সব জেনেও না জানার ভান করে আছে। এমন পরিস্থিতিতে এটাই বুদ্ধিমানের কাজ।''
- তুমি আমাকে এমন কপট বুদ্ধিমান হতে বলো না সাজ্জাদ! আমি পারব না! তিলে তিলে বিবেকের কাছে আত্মার পরাজয় ঘটিয়ে আমি কিছুতেই শান্তিতে থাকতে পারবো না। আমি দমবন্ধ হয়ে মারা যাবো!
-আচ্ছা! তাহলে কি করতে চাও?
- চলো না অন্তত একবার হাসপাতালে গিয়ে আলোকে দেখে আসি! প্লিজ!
সাজ্জাদ প্রিয়তীর মুখের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। বুঝতে পারে সে যখন সিদ্ধান্ত নিয়েই নিয়েছে যে কোন মূল্যেই হোক যাবে!
ঘন্টা দুয়েক পর তারা হাসপাতালের ইন্টেনসিভ কেয়ার ইউনিটের সামনে এসে পৌছায়। সেখানে ছোট বেঞ্চটিতে বসা আলোর মা আর বড় বোন। আলোর মা প্রিয়তীকে দেখে কাঁপা কাঁপা হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে অস্ফুট আওয়াজে ফোঁপানো কান্নায় বলে,'' আমার আলোকে বাঁচাও মা! আলোকে বাঁচাও!''
প্রিয়তীর আলোর মায়ের কাঁধে সান্ত্বনার হাত রেখে তাকে আবার বেঞ্চটিতে বসিয়ে দিয়ে কেবিনে ঢুকে দাঁড়ায় আলোর সামনে।
আলোকে দেখে সে চমকে ওঠে! কষ্ট, আতঙ্ক ,ভয় ,মমতার অতলস্পর্শী দহনে পুড়তে থাকে প্রিয়তীর আত্মা! এ কেমন অদৃষ্টের পরিহাস! এই মেয়েটিই কি তার কলেজের প্রথম বর্ষের সব থেকে সুন্দরী, চঞ্চলা কিশোরী আলো!
আলোর নাকে নল দিয়ে অক্সিজেন দেয়া হচ্ছে! গলা থেকে কেমন যেন ঘর ঘর শব্দ বেরোচ্ছে! চোখ বোজা, নিথর দেহ ছোট্ট কেবিনের বেডের উপর সোজা হয়ে শুয়ে আছে। দুই হাতের ক্যানুলা দিয়ে সমানে ফ্লুইড শিরা ছেদ করে ফোটায় ফোটায় বডিতে প্রবেশ করছে! পাশে দাঁড়ানো ডাক্তার জানান আলোর শরীরের বিভিন্ন জায়গায় গরম আয়রন দিয়ে ছেকা দেয়া হয়েছে, সেখানে ইনফেকশন ডেভেলপ করেছে। এত বেশি পুড়ে যাওয়া রোগীদের সুস্থ করে তোলা কঠিন! কিছু দূরে দাঁড়ানো সাজ্জাদ দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠে, ''আই উইস আই কুড কিল ডেট বাস্টার্ড!'' প্রিয়তীর মুখে কোন কথা আসে না। সে নিয়তির নিষ্ঠুরতা দেখে নির্বাক, নিশ্চুপ,হতবাক! কি করে কেউ তার ভালোবাসার মানুষকে এত নির্মমভাবে মৃত্যুর দুয়ারে ঠেলে দিতে পারে! এমন ভালোবাসার প্রয়োজন আদৌ কি পৃথিবীতে আছে!
হিরু পাড়ার বোখাটে ছেলে। আলো কলেজের প্রথম বর্ষের অসম্ভব রুপবতী এবং মেধাবী ছাত্রী। বিধবা মায়ের চোখের মনি আলো আর হিরু ধনীর দুলাল।
হিরুর প্রেমের প্রস্তাবে সাড়া না দেয়া সে বন্ধু বান্ধব নিয়ে আলোকে কিডন্যাপ করে পার্বত্য চট্টগ্রাম চলে যায়। তারপর টানা সাত দিন তার উপর চালায় পৈশাচিক নির্যাতন। তার সারা শরীরে গরম আয়রন দিয়ে ছেকা দিয়েই ক্ষান্ত হয় নি তার মনের বিষ, সে আলোর দগ্ধ শরীরের উপর লবন মরিচ ছিটিয়ে দিয়ে তার ব্যাথায় কাতর মুমূর্ষু চিৎকারের প্রতিধ্বনিত শব্দে নিয়েছে উৎপিপাসু রক্তচোষা পিশাচের রক্তসেবনের স্বাদ! প্রতিশোধের মোহে হিংস্র কুকুরের চেয়েও অধম হিসেবে সে নিজেকে প্রমাণ করেছে!
প্রিয়তী বাড়ি ফিরেও বিমর্ষ হয়ে থাকে। কিছুতেই সে আলোর কথা ভুলতে পারে না! আলোর মুখ, হাত পায়ের গোল গোল নীলচে রঙের, লালচে রঙের ট্রোমার চিহ্ন তার চোখে ক্ষণে ক্ষণে ভেসে উঠতে থাকে! সাজ্জাদও আজ বেশ নিরব! প্রয়োজন ছাড়া কথা বলছে না। মানুষের পৈশাচিকতার এমন নগ্ন দৃষ্টান্ত দেখে দু জনেই হতবাক!
পরদিন সকালে মুষড়ে পড়া প্রিয়তীকে সান্ত্বনা দেয় সাজ্জাদ, '' সকালবেলা মন খারাপ করে থেকো না প্রিয়তী! থানায় ডায়েরী করা হয়েছে! কালপ্রিট নিশ্চয়ই ধরা পড়বে!''সাজ্জাদ নিজের কথায় নিজেই ভরসা রাখতে পারে না! সে জানে রেপ কেইসের বিচার এত সোজা কথা নয়! ভিক্টিম আদালতে বিচার চাইতে গেলে তাকে দ্বিতীয়বারের মত মানুষের উগ্র দুর্বিনীত কথার দ্বারা রেপড হতে হয়! তৃতীয়বার ডাক্তারদের কাছে শরীরের প্রাইভেট পার্টগুলো পরীক্ষার মাধ্যমে শ্লীলতাহানী হয়! এমনতেই মেন্টাল ট্রোমা! তার উপর বার বারে সমাজের রক্ত চক্ষুর শাসানী! এত ঝড় ঝাপ্টা সহ্য করার মত ধৈর্য, মানসিক শক্তি আমাদের সমাজের বেশির ভাগ মেয়েদেরই থাকে না! আর আলোর অবস্থা তো আরো শোচনীয়!
-''কত মেয়ে তো পর পুরুষকে ফাঁসাতে মিথ্যা রেপেরও অভিনয় করে! তাই না সাজ্জাদ?''
-''হুম তাদের জন্য রেপ কেইসগুলো আরো জটিল হয়! আসল ভিক্টিমরা হয় ভুক্ত ভোগী!''
নাস্তা শেষে প্রিয়তীকে তার কলেজের সামনে নামিয়ে দিয়ে সাজ্জাদ চলে যায় তার অফিসে। প্রিয়তী কলেজে এসে বুঝতে পারে সব জায়গাতেই আলোকে নিয়ে নিরবে কানা ঘোষা চলছে! আলোচনার মত মুখরোচক টপিক্স পেয়েছে সবাই! এর মাঝে কেউ আবার আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে আলোকে নষ্টা সাজিয়ে চালিয়ে যাচ্ছে নিজেকে সতীপুণ্যময়ী প্রমাণের চেষ্টা!
আলোর সহপাঠী আফরোজা বলে ওঠে ,''কই আমাকে তো কখনো কোন ছেলে এভাবে বিরক্ত করে না। আলোকে করে কেন? আলোরও দোষ আছে!''
পাশ থেকে টিপ্পনী কেটে আরেকজন বলে ওঠে,''তোকে বিরক্ত করবে কেন রে? তুই তো পেত্নী, আলো সুন্দরী,ও পড়াশুনায় ভালো। তোর এত গুণ কই?''
আফরোজা তেলেবেগুণে জ্বলে ওঠে,''আলোকে নিয়ে বললে তোর এত লাগে কেন? তুইও তো আলোর মত ছেলেদের পিছনে ছোক ছোক করিস!''
প্রিয়তীকে সামনে দেখে ছাত্রীরা চুপ করে যায়। প্রিয়তী নিরবে টিচার'স রুমে গিয়ে বসে। টিচার'স রুমেও টিচারদের মাঝে আলোকে নিয়ে নানা রকম কথা হচ্ছে। প্রিয়তীকে দেখে একজন প্রবীন মেডাম বলে ওঠেন ,''আমাদের মেয়েটার পাশে দাঁড়ানো উচিত। হাজার হোক আমাদেরই তো মেয়ে। আমাদের হাতে বড় হওয়া!''
-আমিও তাই ভাবছি! রাব্বি ভাই কি বলেন?
রাব্বি সাহেব নিশ্চুপ। কিছু দূরে তার স্ত্রী আসমা বসা। তারা স্বামী স্ত্রী একই কলেজে চাকরী করেন। আসমা তার স্বামীকে নিয়ে আলোকে সন্দেহ করে। যদিও তার সন্দেহের বিশেষ কোন কারণ নেই। নিছক নারী মনের অতিরিক্ত সন্দেহ প্রবনতা। তার ধারণা তার স্বামী মনে মনে আলোকে পছন্দ করে!
তার এই সন্দেহের সাথে ঈর্ষা যোগ হয়ে প্রতিহিংসায় রুপ নিয়েছে। সে চোখ পাকিয়ে বলে ওঠে,''ওটা রেপ ছিল, নাকি মিউচুয়াল সেক্স করতে গিয়ে মেয়ে বিপদে পড়েছে তাও খতিয়ে দেখা দরকার!''
রাব্বি সাহেব এবার ইন্টারনেট ঘেটে স্ত্রীকে রেপের সংজ্ঞা পড়ে শুনান ,''According to sec.375.BPC-A man is said to commit rape who has sexual intercourse with a woman under circumstance falling in any of six following descriptions-1.Against her will,2.Without her consent,3.With her consent,when her consent has been obtained by putting her or any person in whom she is interested,in fear of death or of hurt,4.with her consent,when the man knows that he is not husband, and her consent is given because she believes that he is another man to whom she is or believes herself to be lawfully married,5.With her consent,when,at the time of giving such consent,by reasonof unsoundness of mind or intoxication or the administration by him personally or through another,of any stupefying or unwholesome substance, she is unable to understand the nature and the consequences of that to which she gives consent,6.With or without her consent,when she is under 16 years of age.'' এই সংজ্ঞার ছয় নাম্বার পয়েন্ট অনুযায়ী এটা নিঃসন্দেহে রেপ, আলোর বয়স যেহেতু ১৬ বছরের নিচে।
আসমার চেহারা দেখে মনে হল সে এখনই কেঁদে দেবে! সে দ্রুত রুম থেকে বের হয়ে যায়! প্রিয়তী দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে! আমাদের সমাজের মেয়েরা পুরুষদের নেগেটিভ দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা যতটা না নির্যাতিত তারচেয়ে বেশি পরোক্ষভাবে নির্যাতিত হয় আসমা, আফরোজাদের মত হীনমন্যতায় ভোগা নারীদের নেগেটিভ দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারা! প্রতিহিংসায় ভুগতে ভুগতে এরা এক সময় নারীত্বের কোমনীয়তা ভুলে রুক্ষ পাষণ্ড জীবে পরিণত হয়! ধীরে ধীরে এতই নীচত্বে নেমে যায় যে কতখানি নিচে নেমে গেছে সে হিসেব হয়ত তাদের নিজেদের কাছেও থাকে না!
কিছুক্ষণ পরে সাংবাদিক আসে। সবার কাছ থেকে আলাদা আলাদাভাবে আলোর বর্ণনা শোনে। প্রিয়তী যতদূর সম্ভব সব সত্য ঘটনা জানায়। কি করে দিনের পর দিন হিরু তাকে বিরক্ত করে গেছে! আর মেয়েটা মুখ বুজে সহ্য করেছে! অবশেষে একদিন রাস্তায় তার হাত চেয়ে ধরার প্রতিবাদে আলো তার গালে কষে এক চড় মেরেছে। তারপর সে প্রতিশোধ স্বরুপ আলোকে তুলে নিয়ে তার উপর সাত দিন ধরে চালিয়েছে নির্মম পাশবিক নির্যাতন!''
পর দিন বিভিন্ন পত্রিকায় আলোকে নিয়ে রিপোর্ট হয়। একটি পত্রিকার রিপোর্টের মাঝে এ কথাও বলা হয় ''আলোর চলাচল ছিল কিছুটা বেপোরোয়া! সে মাঝে মাঝে স্কারটও পড়তো'' এ নিউজ পড়ে প্রিয়তী রাগে জ্বলে ওঠে।
'' আমরা এমন কেন বলতো সাজ্জাদ! আমরা কেন এত নিচ! টাকা,ক্ষমতা, প্রতিপত্তিই কি আমাদের কাছে সব? নিষ্পাপ আলোরা কি এভাবেই নিভে যাবে? আলো কি মরে যাবে সাজ্জাদ!'' তার প্রশ্নের উত্তর দিতেই যেন আলোর বড় বোনের ফোন! ''আলো আজ খুব সকালে মারা গেছে, তার লাশ বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছে!''
প্রিয়তী, সাজ্জাদ দু জনেই বাকরুদ্ধ! হঠাৎ কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে প্রিয়তী । সাজ্জাদ মুখ নিচু করে বলে,''আমাকে ক্ষমা করে দিও প্রিয়তী! আমারই মত একজন পুরুষের জন্য আজ আলোর এত নিশংস পরিণতি! স্বাভাবিকভাবে বাঁচার অধিকারটুকু আমরা আলোদের দেই নি! আলোদের হেসে খেলে চলার স্বপ্ন দেখিয়ে পায়ে শেকল পরিয়েছি, গান গাইতে বলে গলাটিপে ধরেছি, আর প্রতিবাদ করতে বলে কন্ঠে পাড়া দিয়ে দাড়িয়েছি!নিজেকে আজ পুরুষ ভাবতে বড় লজ্জা হচ্ছে প্রিয়তী!''
-''তোমার কোন দোষ নেই সাজ্জাদ। বরং তোমার মত পুরুষেরা নারীদের রক্ষা বর্মণ! এক দলা থুতু সভ্যতার পক্ষ থেকে হিরুদের মত আদিম অসভ্যদের মুখে যারা আলোদের জীবন দুর্বিষহ করে রাখে! সেই সাথে থুতু ঐ আফরোজা, আসমাদের মত নারীদের মুখে যারা শুধু মাত্র প্রতিহিংসার কারণে তারই মত একটি মেয়ের চরিত্রের কলঙ্কের কালিমা লেপন করে!''
সাজ্জাদ,প্রিয়তী আলোদের বাড়ি যায় আলোকে শেষ বিদায় জানাতে!
আলোর মা কাঁদতে কাঁদতে বার বার মূর্ছা যাচ্ছেন। অনেক লোক জড়ো হয়েছে আলোকে বিদায় জানাতে। কিন্তু আলোর কোন ভাবনা নেই! সে নিশ্চিন্তে শব রাখার খাটের উপর ঘুমোচ্ছে! এখন আরো বেশী সজীব লাগছে তাকে! মনে হচ্ছে 'আলো' বলে ডাকলেই সে উঠে বসবে! তারপর তার নেতৃত্বে এগিয়ে চলবে আলোর মিছিল!
বি দ্রঃ পনি আপুর নারী বিষয়ক কিছু লেখা এই গল্পের অনুপ্রেরণা।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৩ বিকাল ৩:৩৫