আমি এখনও বেঁচে আছি,
বুক ঝাঝরা করা একমুঠো যšণা নিয়ে,
ভোরের বাতাসে ঝরে পড়া কাঠাল পাতা
ক্লাšত সন্ধ্যায় খয়েরি ডানা মেলে শালিখের নীড়ে ফেরা
কোনকিছুই এখন আর আমাকে উদ্ধেলিত করে না।
এখনও গ্রীষ্মের অগ্নিফুলকি ঝরা লাল কৃষ্ণচড়া
বর্ষার আকুল করা গন্ধে মাতানো কদম্ব ফুল
আর স্কুলের সামনের রা¯ায় পা রাখতেই
মান্নী এসেছে স্বাগতম বলে কোরাস তোলা
শহীদ দিবসে দল বেঁধে চাঁদা তুলতে যাওয়া
কোন স্মৃতিই মন থেকে মুছে ফেলতে পারিনি।
আজও পল্লবের ¯ূপে, ভোরের দোয়েল পাখি-
নেচে চলে আপন তালে, কা-কা কর্কশ ধ্বনিতে
কাকেরা ঘোষণা করে আরেকটি সকাল।
ব্য¯ জীবনের ব্য¯তায়, নিজেকে হারিয়ে দিতে
ছুটে চলি সম্মুখপানে, নিজেকে ফাঁকি দেয়ার
এক অনš অপচেষ্টায়, তারপর ক্লাš বিকেলে
অবসন্ন পায়ে আবার সেই নীড়ে ফেরা,
রুটিন বাঁধা জীবন, নিরানন্দ প্রতিটি ক্ষণ,
জীবনের নিয়মে ছুটে চলা-------
কিন্তু! আমি যে আজ চলতে চলতে
বড্ড বেশি ক্লাš হয়ে পড়েছি।
খাঁ খাঁ অন্ধকার সীমাšে- মরু বালুকণায়
কোথাও একটু ছায়া চোখে পড়ছে না-
মাথা গুজাবার একটু ঠাই,
আজ বড় বেশি প্রয়োজন।
অথচ অন্ধকারে হাতড়াতে হাতড়াতে
তপ্ত বালুকণার রুদ্ধশ্বাস ছাড়া
আর কিছুই খুঁজে পাচিছ না।
ভূমিকা
ঈদের ছুটিতে বাড়ি গিয়েছি। রমজানের দিনগুলো অখন্ড অবসর। ব্রীজের ধারে বসে গল্প করছিলাম। সামনে মিলেনিয়াম। কি করবো? এই সময় আমার এক বন্ধু গল্প তুললো- আমাদের এক সহপাঠির বিয়ের আলাপ চলছে। আর সাথে সাথে এ উপন্যাসের প্লট আমার মাথায় ভর করলো। অবসরটা কাজে লাগালাম। আমি আর আহাদ মিলে এ উপন্যাসের অক্ষরবিন্যাস করেছি। ক্লাস মিস্ করে, রাত জেগে এর কাজটুকু খুব দ্রুত শেষ করার চেষ্টা করেছি। তাই অনিছাকৃতভাবে ভাষাগত বা ছাপার অনেক ভুল থেকে যেতে পারে। আশা করি সবাই ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।
এ উপন্যাসের সকল ঘটনা ও চরিত্র কালপনিক। উত্তম পুরুষে লেখেছি বলে অনেকে হয়তো আমার জীবনের সাথে মিলাতে চেষ্টা করবেন। এটা নিশ্চয় একটা অবাšর অপচেষ্টা হবে। আর কারও সাথে একাš কাকতালীয় ভাবে কোন ঘটনা বা চরিত্র মিলে গেলে ক্ষমা প্রার্থনা ছাড়া আমার আর কিছুই করার নেই। আমি কাউকে ব্যঙ্গ বা উপহাস করতে চাইনি। শুধু পাঠককে আনন্দ দেয়ার জন্য মাঝে মাঝে কিছু নিরেট হিউমার ঢুকিয়েছি। আশা করি সবাই ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। আমি আমার সাধ্যমত চেষ্টা করেছি একটা ভালো কিছু পাঠকের হাতে তুলে দিতে। বাকিটুকুৃ আপনাদের বিবেচ্য।
উপন্যাস পরিচ্ছেদ ১
খট্! খট্! খট্! বেলা ন’টা না বাজতেই দরজায় টোকা পড়লো। ইদানীং দশটা- সাড়ে দশটা না বাজলে ঘুম থেকেই উঠি না। বাড়ীতে এসে এই এক বিশ্রী অভ্যেস হয়েছে। সেহরী খেয়ে লম্বা ঘুম। ছাত্রাবাসে অবশ্য কোনদিনই দেরী করে উঠতাম না। সেখানে জীবনের তাড়া আছে।
আপা তার একটানা টোকা চালিয়ে গেলেন দরজায়। সঙ্গে আবার বেশ গলা ছেড়ে ডাকও দিলেন। এই মান্না! এই মান্না! উঠ! নিশ্চয়ই তেমন কোন সাংঘাতিক ব্যাপার ট্যাপার ঘটেনি। আপা শুধু শুধু সবাইকে জাগাতে চান। তার ধারণা তিনি যখন ঘুমাবেন, পৃথিবীর সবাই তখন ঘুমাবে। আবার তার সাথে সাথেই জেগে উঠবে। একদিন হলো কি শুনেন, আমি গভীর রাতে ঘুমুতে গিয়েছি, চোখে রাজ্যের ঘুম এসে ভর করেছে । এমন সময় তিনি ডেকে ডুকে একেবারে হলস্থূল কান্ড আরম্ভ করলেন। রাত তখন তিনটে। তিনি সবাইকে সেহরী খাওয়ার জন্য ডাকছেন। আমার দরজা খোলাই ছিল, তিনি টেনেটুনে আমাকে তুললেন। আমিতো রেগে আগুন! যা মুখ দিয়ে বেরল তা-ই বকা দিলাম। এর পর থেকে আমাকে আর সাড়ে চারটার আগে ডাকা হয়নি।
সেই আপা আজ আবার সাত সকালে কেন দরজায় খট খট করছেন কে জানে। আমি হাই তুলে জিজ্ঞেস করলাম- কি হয়েছে? তোর মাথা হয়েছে, উঠতো! গাভী টাকে বোধ হয় বাঁচানো গেল না। আপার অবিরল বক-বকানিতে বিছানা ছেড়ে উঠতে বাধ্য হলাম। গিয়ে দেখি গাভীর বারটা বেজে গেছে। কাল এনে খাওয়ানো ঔষুধ গুলোয় তাহলে কাজ হয়নি। আপা আজ অবশ্য এুি এুি ডেকে তুলেননি-হঠাৎ আমার এ কথাটা মনে হল। ইতিমধ্যে চাচা এসে উপস্থিত। বাবা-মা হজ্জে যাবার পর থেকে তিনিই এখন বাড়ির হর্তা কর্তা। নিজেকে তিনি ক্লিনটন ভাবেন। তার কথাবার্তায় মনে হয় সারা বিশ্ব তার পদতলে। যখন যাকে যা বলবেন তা হওয়া চাই-ই চাই-ই। এ বাড়িতে এখন
তার কর্তৃত্ব সব চেয়ে বেশি। সেই চাচা এখন ব্যা¯ ভঙ্গিতে এসে আমার সামনে এসে দাড়ালেন। গাভীটার বর্তমান অবস্থার উপর তিনি একটা নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা শেষ করে,একশ টেটরা পিটিয়ে হুকুম জারি করলেন ঢাকাদক্ষিণ থেকে গিয়ে ডাক্তার আনতে। এখান থেকে ঢাকাদক্ষিন অনেক দরে। গুদের উপর আবার বিষ ফুড়োর মত আজ হরতাল। সে যেই তেই হরতাল না। এক্কেবারে হালুয়া টাইট। বেটি বজ্জাত আর ইলেকশন করানোর সময় পেল না। বেছে বেছে আমার গাভীর অসুখের দিন ইলেকশন দিয়েছে। দিলই বা, তাই বলে আবার বিরোধী দলকে ক্ষ্যাপাবে কেন? গলা ফাটিয়ে হাসিনা বেগম নাকি প্রহসনের নির্বাচন বলে চিল্লাচিল্লি শুর করে দিয়েছেন। কি জানি! কে কাকে প্রহসন (পরিহাস) করছে?
অগত্যা উঠে আমাদের তথাকথিত পচাঁয়েষ্ট (পঁচা এর সুপারলেটিভ ডিগ্রী) বাইসাইকেল নিয়ে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করার উদ্দেশ্যে হাত, মুখ না ধুয়েই রওয়ানা হলাম। বাব্বা, কি কষ্টের পথরে বাবা! একশ প্যাডেল দিলে ও সাইকেল এক হাত এগুয় না। গত রাতে ঘুম হয়নি মোটেও। আজকাল আমাকে অনেকটা ইমসনিয়ায় পেয়ে বসেছে। সারা রাত না ঘুমিয়ে সকালে নাক ডাকিয়ে ঘুমাই। কাল রাতে শোবার আগে আজকের দিনটার কি সুন্দর পরিকল্পনা করেছিলাম! কিন্তু আজ ভোর না হতেই সব ভে¯ে গেল। সাইকেলে বসে বার বার আমার কালকের পরিকল্পনাটা মনে পড়তে লাগলো। সত্যিই! এমন হয় কেন? মানুষ ভাবে এক আর হয় আরেক। কোন দিনই পরিকল্পনা মতো পুরো দিনটা কাটাতে পারিনা। একটা না একটা বাধা এসে পড়বেই। তাকে কোন রকমে আটকানো যাবে না।
কি আর করি! অগত্যা উঠেছি যখন সাইকেলে যেতে হবে ডাক্তারের কাছে। নির্বাচনী কেন্দ্র গুলো কেমন যেন খাঁ খাঁ করছে। লোকের ভিড় নেই একেবারে। প্রতিবারের মত এবার আর ভোটাধিকার প্রয়োগের জন্য কেউ লাইনে দাড়ায়নি। মাঝে মাঝে দু’একজন বি. এন.পি দরদী এসে ভোট দিয়ে দায়িত্ব আদায় করছেন। যেতে যেতে শুনলাম, কাল রাতে নাকি পুলিশ ঢাকাদক্ষিন থেকে তিন জন কে বেধে নিয়ে গেছে। আওয়ামী লীগের একজনকে নাকি খুব মার-পিট ও করেছে। রা¯া একদম খালি। ইেছ করলে চোখ বোঁজেও সাইকেল চালাতে পারি। কিন্তু এটা সে রকম সাইকেল নয় যে সুখের জার্নি হবে। কোন মতে দেহ ফেলে প্রান নিয়ে ঢাকাদক্ষিন পৌছলেই যেন আলাউদ্দিনের আশ্চর্য প্রদীপ লাভে সমর্থ হবো। একবার ভাবলাম, গিয়ে যদি দেখি পশুর ডাক্তার সাহেব একপাল রগী নিয়ে বসে আছেন; অথবা ব্য¯তা দেখিয়ে আসতে না চান, তাহলে কি হবে? নানা বিকট চিšা আমাকে পেয়ে
বসতে শুর করল। ইস! গভীটার কি হবে, যদি মরে যায়, বাবার কি সাধের গাভী ছিল। প্রতিদিন ভোরে উঠে তিনি নিজ হাতে ঘাস তোলে তাকে খাওয়াতেন। রাতে হাতে ব্যাথা করলেও পরদিন সকালে উঠে দেখা যেত তিনি ঠিকই ঘাস তুলতে গেছেন। আমাদের বাড়িতে ১২/১৪ বছরের একটি ছেলে থাকে, সেই পারে ঘাস তুলতে। কিন্তু বাবা তার এত সাধের গাভীকে নিজ হাতে তোলে ঘাস খাওয়াবেন। আমি দেখেছি ঈদের দিনও বাবা ঘাস না তোলে গোসলে যান নি। এখন তার অনুপস্থিতিতে তার এত স্বাধের গাভীর যে কি হবে এক খোদাই জানেন। ব্যাটা ফাজিল ডাক্তার যদি না আসে তাহলে নাকে লাগাবো এক ঘুষি। কিছু তারণ্য না দেখালে যৌবনটাই বোধ হয় বৃথা। না! আর পারা যােছ না! কি উচু নীচু পথরে বাবা। প্যাডেল চাপতে চাপতে মুখ দিয়ে বোধ হয় ফেনা বেরোেছ। টিলার উপর দিয়ে পাকা রা¯া। এই যদি এক’শ ফুট উপরে উঠি তাহলে পুনরায় দু’শ ফুট নীচে নামছি। সাধে কি আর এর নাম দেয়া হয়েছে পাহাড়লাইন। কেউ যদি এরকম বেয়াড়া সাইকেল নিয়ে মাথার উপর চৈত্রের খাড়া রোদে যেত তাহলে বুঝতো কার বাবার সাধ্য আছে লাইনটার নাম পাহাড় লাইন বদলে ডি. এম. রোড রাখবে। শুধু সাইনবোর্ডে ইছা মাফিক একটা নেইম প্লেট ঝুলিয়ে দিলে তো আর হবে না। লোক মুখে এর প্রচলন যদি থাকতে হবে।
পানির তৃষ্ণায় প্রাণ বোধ হয় বেরিয়ে যাবে। এক তো রোজা তার উপর এই আরেক বিপত্তি। কি যে করি। খোদার কাছে রহম চাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই। কিছু লোক শুধু বিপদে পড়লে খোদাকে ডাকে। বোধ হয় আমিও সেই দলের। আবার কেউ কেউ বিশেষ দিনে বা মাসে খোদাকে ডাকে। অনেক সময় মনে হয় আমিও সেই দলের।
সাইকেল ধীর গতিতে এগিয়ে চলছে। আমিও বসে আছি সীটের উপর। প্যাডেল চাপতে অসহ্য লাগছে। রমজানের শেষ দিনগুলোতে এসে মনে নানা বিরক্তি ভিড় জমিয়েছে। কেন জানি বার বার মনে হেছ রমজানে বাড়িতে এসে মারাÍক ভূল করে ফেলেছি। মাত্র ক’দিনের ছাত্রাবাস জীবনের জন্য হটাৎ মায়া লাগছে।
উপন্যাস পরিচ্ছেদ ২
বেলা আনুমানিক দশটা-সাড়ে দশটা নাগাদ ঢাকাদক্ষিণ পৌছলাম। বাজারটা দিন দুপুরে কেমন নিঝুম হয়ে গেছে। প্রতিদিনকার মত প্রানচঞ্চলতা নেই আজ। থানার ব্য¯তম বৃহৎ বাজার আজ যেন পাষাণ¯ু‘পে রূপাšরিত হয়েছে। অনেক খুঁজে খুঁজে শেষ পর্যš ডাক্তারের ঘরটা বের করলাম। সবার মুখে কেমন যেন ভয় ভয় ভাব। মুখ দেখে মনে হয় সবার ধারনা, এই মাত্র একটি এটম বোমা বিস্ফোরিত হয়ে সমগ্র বাংলাদেশ উল্টে দিবে। কি জানি সামনে বসা লোকটার হার্টবিট এখন কত। সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম ঃ-
ঃ পশুর ডাক্তারের গেইটে তালা ঝুলছে কেন?
ঃ আজ ইলেকশন। তাই সেন্টারে আছেন।
ঃ সেন্টার কোথায়?
লোকটা এমন ভাবে মুখ খেচিয়ে উত্তর দিল “আমি কি করে বলবো” ঠিক যেন মনে হল লোকটাকে আমি এই মাত্র পশুর ডাক্তারের বৃহদাকার সিরিঞ্জ দিয়ে উপর্যপরি বিষাক্ত ইনজেকশন দিিছ। দ্বিতীয় বার কথা বলার উৎসাহ হারিয়ে ফেললাম। কি যে করি ঠিক বুঝতে পারলাম না। হঠাৎ যš চালিত রোবটের ন্যায় লোকটা উঠে দাড়ালো। ধপাস করে সামনের সাটারটা বন্ধ করলো। তার পর হš-দš হয়ে পর্ব দিকে রওয়ানা দিল।
ইতিমধ্যে আধাপাকা দাড়িওয়ালা একজন লোক রিক্সা যোগে এসে উপস্থিত। লোকটার পরনে সাদা পাঞ্জাবি। ঠোঁটে এখনও পানের দাগ বিদ্যমান। রিকসা এসে থামলো গেটের সামনে। রিকসাওয়ালার সাথেই উনার প্রথম বাক্যালাপ শুর হলো।
ঃ গেইট বন্ধ কেন?
ঃ বোধ হয় ইলেকশনের জন্যে।
ঃ ইলেকশনের সাথে ডাক্তারের কি স¤র্ক আছে।
ঃ বাসা কোথায় লোকটার?
ঃ বাসা এখানেই, তবে পাবেন না নিশ্চিত।
ঃ উনি কি একা থাকেন?
ঃ হ্যা!
ঃ তাহলে ঘুরাও।
কিছু কিছু মানুষ হুকুম তালিম করতে করতে এক সময় স্বীয় সত্ত্বা হারিয়ে ফেলে। স্বাধীন সত্ত্বার ইছানুযায়ী কোন কাজ করা তাদের পক্ষে তখন সম্ভব হয় না। বোধ হয় এ রিকসাওয়ালা তাদের মধ্যে এক জন। লোকটা বলা মাত্রই রিক্সা যেন অটোমেটিকভাবে ঘুরে গেল। মধ্যহ্ন সর্যের খরতাপের নিচে দাড়িয়ে একেবারে শুটকি বনে গেলাম। কয়েকটা নির্বাচনী কেন্দ্র খুঁজে লোকটাকে বের করতেও ব্যার্থ হলাম। অবশেষে নগর গেলাম এক আতিœয়ের বাড়ি।
উঠানের সামনের রা¯ায় এসে সাইকেল নিয়ে দাঁড়ালাম। এরকম বাড়ি খুব কমই দেখেছি। যেন সুন্দরবনের গহীন অরণ্যে আছি। বিচিত্র সব গাছগাছালি আর পাখির কলকাকলি শুনে সে কথাই মনে হলো। রোদের আলো মাটিতে পড়া দুস্কর। উঠানের সর্বশেষ প্রাšে খালি জায়গা। মাটি কোপা। তাতে পড়ে আছে অসংখ্য ছোট ছোট পাতা। যেন কেউ খুব যতœ করে কালো মাটিকে সাদা পাতা দিয়ে সাজিয়ে ফুটফুটে করে রেখেছে। সত্যিই এর তুলনা হয় না।
বনানীতে দেখেছি, কয়েকটা ফুলের টব আর ছোট খাট বাগান করে বাসার নাম দেন “ছায়াবীথিকা, অরন্যানী, ঘনশ্যাম” ইত্যাদি। কিন্তু এ বাড়ির সামনে কোন নাম নেই। যেন কেউ ভূলে দেয়নি এমন নাম। আসলে পল্লিতে এরকম নাম দেয়া নাকি বেমানান। কেন বেমানান সেটা আমি খুঁজে পেলাম না। কি জানি, হয়তো কখনও খুঁজে পাবো না।
আমার পরনের সার্ট পেন্টের যা অবস্থা, দেখে মনে হবে যেন এই মাত্র হাল-চাষ ছেড়ে জমি থেকে উঠেছি। এরকম ড্রেস পরে কারোও ঘরে যাওয়া বেমানান। মনে হবে আমি যেন খাঁটি সোনার চাইতেও খাঁটি চাষার ছেলে। বাধ্য হয়ে বাহিরে অপেক্ষা করতে হেছ। একজনকে গৃহকর্তার জন্য পাঠালাম। সে যে গেল আর ফিরে আসার নাম নেই। গেছে তো গেছে একেবারে নির্বাসনে গেছে। অপেক্ষা করতে করতে পা দুটি হিম হয়ে গেল। কারোর খবর নেই। এক সময় গৃহকর্ত্রী বেরিয়ে এলেন। ইনি হেছন আমার সিস্টার-ইন-লো। অনেক সাধলেন ঘরে যাবার জন্য। শেষে ব্যর্থ মলিন মুখে ফিরে গেলেন। তার পরপরই গৃহকর্তা এসে উপস্থিত হলেন। উনার ঐতিহ্যবাহী চৌত্রিশ দাঁতের হাঁসি উপহার দিলেন। অতিরিক্ত দাঁত দুটি কাল্পনিক। হাসির তোড়ে যে কেউ এরকম কল্পনা করবে তাকে দেখে। তারপর বাড়ির খবর জানতে চাইলেন। কুশল বিনিময়
শেষে বাড়ির পানে পা বাড়ালাম। যাবার বেলাকার দর্গতি পণরায় সাথী হল। দীর্ঘ কষ্টকর ভ্রমন শেষ করে দপুরে আমাদের ইলেকশন কেন্দ্রে পৌছলাম। পৌছেই মন্টুর সাথে দেখা। মন্টু জোর করে ধরে নিয়ে গেল। বললো ভোট তোকে দিতেই হবে। যাকে খুশি তাকে দে। পারলে গোলাপ ফুলে একটা ছাপ দিয়ে চলে আয়। রা¯ায় দেখা রিকশা ওয়ালার মতই আমি মন্টুর হুকুম তালিম করলাম। কিন্তু হিতে বিপরীত ঘটলো। দীপু আমার সাইকেল নিয়ে পগার পার। শেষে বাধ্য হয়ে মন্টুর সাথে হেটে হেটে বাড়ী ফিরলাম।
বাড়ি ফিরে দেখি হালুয়া টাইট। গাভী একেবারে নেতিয়ে পরেছে। সবাই আমার প্রতীক্ষায় বসে আছেন। আমাকে একা ফিরে আসতে দেখে সবাই নিরাশ হলেন। গাভীটাকে অনেক কষ্টে বাধঁলাম। বলদী থেকে পড়িয়ে আনা পাটের রশি গলায় দিলাম। মুল্লা সাহেবের পড়া পানি দিয়ে গোছলও করানো হলো। তবু গাভীর দৈহিক অবস্থার কোন পরিবর্তন ঘটলো না। বিকেলের দিকে এতই নেতিয়ে পড়ল যে আর উঠে দাড়াবার শক্তিটুকু পর্যš হারিয়ে ফেলল। দিনের পরিকল্পনাটাই ভে¯ে গেল। মনে মনে বিধাতাকে বেশ বকতে ইছা হল। কেন এমন হলো। তিনি কেন সব কিছু পাল্টে দিলেন। আমিতো সুক্ষ পরিকল্পনা করেছিলাম দিনটার। তাতে দু:খ কষ্ট স্থান পায়নি সারাদিনের জন্য। কিন্তু প্রায় সারা দিনটাই কষ্টে গেল।
উপন্যাস পরিচ্ছেদ ৩
এবার একটা কিছু আনন্দের দরকার। সারাটা দিন মরন পথ যাত্রী একটি পশুর জন্য মাটি করে দেয়া যায় না। জীবনে আনন্দের দরকার আছে। পতিদিন কিছুটা সময় আনন্দ উপভোগ করা প্রয়োজন। যে আনন্দ অনাবিল আনন্দ। প্রান খোলা হাসি উল্লাস। আমার এ মহর্তে এরকম একটা কিছু একাš প্রয়োজন। প্রয়োজন কারো সাথে প্রান খুলে কথা বলার।
হঠাৎ তমার কথা মনে পড়ে গেল। তমা আমার স্কুল লাইফের ক্লাসমিট। স্কুলের সেরা আকর্ষণীয় ও সেরা মেধাবী ছাত্রী। একবার ক্লাস নাইনে ওর প্রতি আমার দুর্বলতা বৃদ্ধি পায়। তখন আমি ওর ভূগোল গাইডে একটা ‘চিরকুট’ ডুকিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু লোকে যা বলে, যেখানে এলে বাঘের ভয় সেখানে এলে সন্ধ্যা হয়। ঠিক তেমনি আমারও সন্ধ্যা হলো । চিরকুট খানা গিয়ে পড়ল ভূগোলের স্যারের কাছে। তারপর আমার আর বিড়ম্ভনার অš নেই। শেষ পর্যš তিন চার দিন স্কুলে যাওয়া বন্ধ রাখতে হয়েছে। যাক আজকের পরিকল্পনাটা ছিল অন্য রকম। ভেবে ছিলাম ঘুম থেকে উঠেই তমাদের বাসায় যাব। শত শত কার্ডঘর ঘুরে পছন্দ করা কার্ডটা শুধু তমার জন্য নিজ হাতে ক¤িউটারে প্রিন্ট করে লিখেছি। সেই কার্ডটা বিতরনের মাধ্যমে দিবসের কর্মসচী শুর করার পরিকল্পনা ছিল। আমার সাধের পরিকল্পনাটা ভে¯ে গেল। প্রকৃতির ইঙ্গিতে আজকের সকালটাই অন্যরকম হয়ে গেল। ভোর বেলা হতে একটানা খাটুনি। গাভীটার তবুও কোন উন্নতি হলো না। এই ফাঁকে আমি সামান্য আনন্দ লাভের জন্য একা একা তমাদের বাাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। তমার বাড়িতে আমরা একা কেউ কখনো যাই না। যখনই যাই ঝাঁক বেধে যাই। তার মা, বাবা অবশ্য সবাইকে আদর করেন। এটা ওটা খেতে দেন। তাই যাই, যাওয়ার প্রয়াস পাই। আজ আমি প্রথম ওখানে একা যািছ। কেমন একটা মিশ্র অনুভূতি। তাছাড়া আজকের দিনটাই আমার বড় বাজে গেছে। কোথাও যেন আনন্দের এতটুকু রেশ নেই। নিজের ক্যাসেট প্লেয়ারটা পর্যš বিদ্যুতের অভাবে সারা দিনে একবারও অন করা হয়নি। অথচ আমি
সংগীতের মহাপ্রেমিক। সংগীতকে বলতে ইছা হয় “তোমায় একদিন কানে না শুনিলে, তোমার মধুর রস না শুকিলে, পরান আমার রয়না পরানে গো” কিন্তু সংগীত কারো কথা শুনে না। সে শুধু নিজেরটা শুনিয়ে যায়। তাই বাধ্য হয়ে মনের কথা মনে চেপে রাখতে হলো।
শুয়ে শুয়ে ইত্যাকার নানা চিšা মাথায় এসে গেল। একের পর এক চিšা মাথায় জট পাকাতে লাগলো। আর সহ্য করা যায় না। কিন্তু না। মসজিদ থেকে সুমধুর সুরে মুয়াজ্জিন আযান দিলেন। এ সুর আলাদা একটা আবেগ সৃষ্টি করতে পারে মুসলমান দের মনে। মনে হয় পৃথিবীটা সত্যিই নশ্বর। এখানে ক্ষনিকের জন্য এসেছি- এ মহান সত্য তখনি মনে পড়ে যখন “আাল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ” বলে মুয়াজ্জিন মধুর সুরে ডাকেন।
না! আর এভাবে বসে কাল ক্ষেপন করা যায় না। একটা কিছু তো করতে হবে। আনন্দের একটা কিছু। সারাটা দিনতো কষ্টে কাটানো যায় না। তাই গা ঝাড়া দিয়ে উঠলাম। তড়িঘড়ি করে পরনের কাপড়টা বদলে নিলাম। এবার যেতে হবে। ক’দিন অবধি তমাকে দেখিনি। এক সাথে দু’টি কাজ হয়ে যাবে। কার্ডটা ও দেয়া হবে আবার তমাকেও দেখা হবে। সর্বোপরি প্রান খুলে কিছুক্ষন গল্প করা যাবে। হঠাৎ মনে পড়ে গেল জুতোটা পুরোনো। কি আর করি ছোট বোনের সেন্ডেল পরেই রওয়ানা দিলাম। কি এমন আছে মেয়েটার মধ্যে যে আমাকে যেতে হবে সেজে গুজে। এ কি! আমি হঠাৎ নিজেকে কেন যেন প্রেমিক প্রেমিক ভাবতে শুর করেছি বলে মনে হেছ। টিন এজে ছেলেদের যে কয়টি রোগ হয় তার মধ্যে এটি হেছ প্রধান। আরে আমাকেও এ রোগে পেয়ে বসল নাকি। দুত্তুরি ছাই। আমি কি আজে বাজে ভাবছি। আমি তমার প্রেমিক হতে যাব কেন ? শুধু কষ্ট করে দামী কার্ড কিনে দেওয়ার জন্যই কি তা মনে হেছ। হয়তো হতে পারে। মানুষের মন বড়ই বিচিত্র জিনিস। সহজে একে বুঝা যায় না। পর্ণিমা‘র ভেতর থেকে কার্ডটা বেরে করে শেষ বারের মত দেখে নিলাম। গত ক‘দিন পর্বে ঢাকা থেকে ফেরার পথে ট্রেনে পর্ণিমা ম্যাগাজিনটির এই বৃহৎ সংখ্যা কিনেছিলাম। আটটি উপন্যাস সম্বলিত এ সংখ্যাটি সত্যিই আকর্ষনীয়। আমি জানি তমা কার্ড পাওয়ার সাথে এই ম্যাগাজিনটা পাওয়ার জন্য ব্যাগ্র হয়ে উঠবে। লোভ সামলাতে পারবে না। আর এ সংখ্যায় প্রকাশিত “রূপকথা” উপন্যাসটি পড়লেই ও বুঝে ফেলবে আমার মনোভাব। যা! আমি এসব কি লিখছি। মনে পড়ে স্কুলে যখন আমাদের চিরকুট নিয়ে ভীষণ উত্তেজনা শুর হলো তখন আমার প্রায় স্কুলে যাওয়া বন্ধ। সেদিন একা নামাজাšে বাড়ী ফিরছিলাম। পথে বি. এস. সি. স্যারের সাথে দেখা। তিনি অনেক করে আমাকে বুঝালেন। তবে শুরটা ছিল বেশ অদ্ভূত। অনেকটা এরকম-
“তুমি কি শুনেছ কেউ কখনও সোনার হরিণ পেয়েছে?” উত্তরে না সচক ভঙ্গি করলাম। মনে মনে তখনও রবীন্দ্র সংগীত বাজছে, “তোরা যে যা বলিস ভাই আমার সোনার হরিণ চাই।” স্যার তার গুরত্বপর্ণ উপদেশাবলী চালিয়ে গেলেন সাথে নানা উপমা, যুক্তি, প্রমান ও বিচিত্র উদাহরণ। আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না তমাকে কেন স্যার সোনার হরিণ বলে আখ্যায়িত করলেন। বললেন, সোনার হরিণের পিছু নিয়ে লাভ নেই। পৃথিবীর অনেক মানুষ চেষ্টা করেছে সোনার হরিণ লাভের জন্য অথচ তারা কেউ পায়নি। কি হবে এমন দুর্লভ জিনিসের পিছু পিছু দৌড়ে।
স্যারের কথা গুলোহঠাৎ কেন জানি আমার কাছে ধ্রবসত্য বলে মনে হলো। সত্যিইতো কি হবে এসব করে। সেদিকার মতো আর কথা না বাড়িয়ে বাড়ী ফিরি।
এ কি! ঘুরে ফিরে আবার তমাকে নিয়ে ভেবেই রা¯ায় নেমে পড়েছি। না! আর তমাকে নিয়ে ভাববো না। জীবন এখন ধসর পান্ডুলিপি। এ খাঁ খাঁ রোদ্দুরে হাতের পর্ণিমা দিয়ে রোদ আড়ালের ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালিয়ে যািছ। দরে এনামের বাড়ীটা নজরে এল। সত্যিই সে বেচারা বড় অদ্ভূত। একবার এদিকে তাকােছও না। নিভৃতে নিশ্চিš মনে গরগুলো নিয়ে ফিরে যােছ বাড়ীতে। অসংখ্য সুপারি গাছের ছায়ায় পুকুরপাড়ে সাদা গরগুলোর পিছনে বেশ লাগছে এনামকে। ফাল্গুনের হাওয়া ওর সাদা সার্টটিকেও দোলা দিেছ। মনে হেছ কাকতাড়ূয়া কোন বিশেষ অলৌকিক শক্তিতে হেটে যােছ। ছি! এনাম কে আমি কাকতাড়ূয়া বলছি কেন? ও তো আমার বজম ফ্রেন্ড। বজম ফ্রেন্ড আবার কি? কি জানি সবাই বলে, তাই আমিও বললাম। না! এখন এনাম আর কাকতাড়ূয়া নয়। হঠাৎ সে দৃষ্টি ফেরাল আমার দিকে। সজীব হয়ে উঠলো তার কন্ঠনালী। দর থেকে বাতাসে ভেসে আসলো কন্ঠস্বর,
ঃ কি রে মান্না কোথায় যািছস?
ঃ না ওই তো ওখানে।
ঃ মুচকি হেসে পা ফেলতে লাগলাম। যে হাসি কারও নজরে পড়বে না।
উপন্যাস পরিচ্ছেদ ৪
তথাকথিত বুড়িমড়া নদীর ভগ্নদশা পেরিয়ে সুন্দরবন তুল্য গহীন অরণ্যে তমার বাড়ীতে প্রবেশ করলাম। হাতে সেই কিখত কার্ডখানা সম্বলিত পর্ণিমা ম্যাগাজিন। কার্ডটার ভেতরে রয়েছে সদ্য তোলা তমার ছবি। আর আকর্ষণীয় ক¤িউটার প্রিন্টিং করা আমার ছাত্রাবাসের ঠিকানা।
কথায় বলে যেখানে এলে বাঘের ভয়, সেখানে এলে সন্ধ্যা হয়। সারা দিনটার সাথে মিল রেখে এখনও ঘটল অঘটন। ঢুকেই দেখি মা জননি কুরআন তেলাওয়াতে মগ্ন। কি মুশকীল। এসেছি মেয়ের সাথে কথা বলতে কিন্তু প্রথমেই মায়ের দর্শন। কি আর করি। পড়ি মড়ি করে মনটাকে শক্ত করলাম। প্রস্তুত হলাম কঠিন সব প্রশ্নের উত্তর দেয়ার জন্য।
মায়নাস পাওয়ারের সাদা মোটা ফ্রেমের চশমা তুলে তিনি তাকালেন। চশমার স্বছ কাচের মধ্য দিয়ে তার রক্তিম চক্ষু যুগল আমার গোচরীভূত হলো। প্রথমেই সরাসরি আক্রমন-
ঃ কাকে চাই?
ঃ তমাকে-নীরবে উত্তর দিলাম।
ঃ ওর সাথে কি প্রয়োজন? ও তো বই টই নিয়ে আসেনি?
ইতিমধ্যেই অন্দর থেকে তমা তার চিরাচরিত আকর্ষণীয় ঘিয়ে রংয়ের ফ্রক পরে হাজির। আমার মনে কিছুটা সাহসের সঞ্চয় হলো। জীবন নাটকের সবচেয়ে কঠিন পর্বটি স¤াদনের জন্য আ¯ে আ¯ে ওর দিকে এগিয়ে গেলাম। মা জননীর রক্ত চক্ষুর সম্মুখেই তমাকে কার্ডটি হ¯াšর করলাম। মুখে শুধু উচারণ করলাম, ভিতরে তোমার ছবি আছে।
তাই নাকি ? বসো -তমা সভয়ে বললো। আধো বসা, আধো দাড়ানো অবস্থায় আমি বাক্যলাপ শুর করলাম। মা জননী তখনও স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। তমার বিছানায় রাখা হুমায়ুন আহমেদের ‘কবি’ উপন্যাসটি আমার দৃষ্টি কাড়লো। ইতিমধ্যে তমা ও আমার ম্যাগাজিনটার প্রছদে চোখ বোলােছ। ওটা চাইতেই আমি ‘কবি’ উপন্যাসটি নিিছ বলে জানালাম। তমা সানন্দে রাজি হলে
১৮
ও মা জননী রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে তীব্র প্রতিবাদ জানালেন। কিন্তু কে শুনে কার কথা। আমি তড়িঘড়ি করে উপন্যাস নিয়ে ছুটে পালালাম।
বাড়ী ফিরেই আকাশ ভেঙ্গে মাথায় পড়লো। খনিক্ষন পর্বে ও যে ছোট আপাকে স¤র্ণ সুস্থ ও স্বাভাবিক রেখে গিয়েছিলাম এখন তার অবস্থা গুরতর। গত বছরও রমজানে আপা গুরতর মানসিক সমস্যায় ভূগেছেন। এখন আবার তার পণরাবৃত্তি ঘটলো। আপা অসম্ভব রকমের অস্বাভাবিক হয়ে গেছেন। অনর্গল যােছথা বকে যােছন। যাকে সামনে পােছন তাকে আঘাত করছেন। খাট, চেয়ার, টেবিল ভেঙ্গে ফেলতে উন্মাদ হয়েছেন। আবার মাঝে মাঝে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছেন। কখনও বা দেয়ালে মাথা দ্বারা আঘাতের পর আঘাত করছেন। কাউকে ঠিকমতো চিনতে পারছেন না। আর যে ভাষা ব্যাবহার করছেন তা পৃথিবীর কেউ কোন দিন শুনেনি।
মা-বাবা বাড়ীতে নেই। তদুপরি আপার এ অবস্থা। আমি একেবারে কিংকর্তব্যবিমড় হয়ে পড়লাম। কোন কিছু ভাবতে না পেরে উর্ধশ্বাসে ছুটলাম আদই নামের এক তথা- কথিত মুল্লার কাছে। আমি এসব এক অক্ষরও বিশ্বাস করি না। কিন্তু লোকে যা বলে তা মনে হয় পুরোপুরি মিথ্যে নয়। মানুষ যেমন সাগরে পড়লে খড় কুটোকে ও আকরে ধরে ঠিক তেমনি আমিও এ কাজটি করতে যািছ।
দর্ভাগ্য যাকে বলে। লোকটাকে পাওয়া গেল না। কোথায় গেছে তাও কেউ বলতে পারে না। বিপদের উপর বিপদ। আমার মুল্লা চাচাও বাড়ীতে নেই। তিনি থাকলে তবুও অনেক সময় সাহস থাকে। ছোট ছেলে মেয়েরা যেমন এই ঝগড়া করে আবার এই বিপদ দেখে এক হয় ঠিক তেমনি আমিও এই কিশোর বয়সে যখন খুশি যার সম্বন্ধে যােছথা মনোভাব প্রকাশ করি। তাই সকালে চাচাকে ব্যাঙ্গার্থে বিল ক্লিনটন ভাবলেও এখন অনেক আপনজন মনে হেছ। যাক শেষ পর্যš আবদুল্লাহ (আমাদের কাজের ছেলে) ও ভাবীকে নিয়ে ছোট আপাকে নি¯েজ করার ব্যর্থ প্রয়াস চালালাম এবং ব্যর্থ হলাম। সারা দিনের খাটুনিতে দেহটা একেবারে নেতিয়ে পড়েছে আমার। তদুপরি আমি ছোট বেলা থেকে মা-বাবা র আদরে বড় হয়েছি। তাই ভীষন কষ্ট হেছ। নিতাš নিরপায় হয়ে সেই বিখ্যাত সাইকেল নিয়ে গাঢ় অন্ধকারে ষ্টেশন গিয়ে ডাক্তার আনলাম। ঘুমের ইনজেকশন প্রয়োগের মাধ্যমে কয়েক ঘন্টা নি¯েজ রেখে আমি সহ বাড়ীর সবাই স্ব¯ির নিঃশ্বাস ফেললাম। ইতি মধ্যে দুলাভাই এসে পৌছেছেন। সে দিনকার মত খোদা আমাকে রক্ষা করলেন। আ¯ে আ¯ে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে আগামি দিনের হিসেব চালিয়ে গেলাম। এবার শহীদ দিবস ও ঈদুল ফিতর একই দিনে হবে। পরবর্তী শনিবারে যথারীতি ছাত্রাবাসে ফিরে যেতে হবে।
ইতিমধ্যে ঈদের খরচ, ফিতরা প্রভৃতি কার্য স¤ন্ন করতে হবে। মনটা নানা বিভীষিকায় বিমর্ষ হয়ে উঠলো। বাবা থকতে তিনি সংসার চালাতেন। নিজে আরাম করে বসে বসে শুধু খেয়েছি। এখন স¤র্ণ চাপ আমার উপর এসে পড়ায় মজাটা হাড়ে হাড়ে টের পািছ। বাব্বারে! কি ভয়ানক কষ্টেই দিনটা না কাটলো। মনে মনে পিতৃদেবের এত দিনকার সার্ভিসের জয়গান করলাম। এবার রাতের আহারটা স¤ন্ন করতে হবে। ভাবীকে বলায় আবদুল্লাহর বদৌলতে খাবার টেবিলে খাবার লাগানো হল। কিন্তু ভাগ্যের নিতাš পরিহাস। আপা তার ঐতিহ্যবাহী চিল্লাচিল্লী শুর করে টেবিল থেকে খাবার গুলো ফেলে দিলেন। অগত্যা দু’জনে উঠে পুণরায় উনাকে ধরে অনেক্ষনে আপাকে শাš করলাম। ভাবী পনরায় রান্না-বান্না করলে গভীর রাতে আহারে বসলাম। আপাকে বাবার রমে রেখে ভাবীকে সেখানে থাকতে বললাম। তার পর দুলাভাইকে নিয়ে কোন রূপে আহার সমাপন করলাম। ইতিমধ্যে চাচা এসে বাড়ী পৌঁছেছেন। তিনি ছোট আপার কাছে বসে কুরআন তেলাওয়াত শুর করলেন। আমি প্রায় নিশ্চিš হয়ে বালিশে মাথা রাখলাম। গভীর আবেশে দু’চোখ জোড়ে ঘুম আসলো।
উপন্যাস পরিচ্ছেদ ৫
‘কে?’
‘আমি, দরজাটা খুলুন।’
‘আমিটা কে?’
‘আমি মান্না।’
‘ও, ভেতরে আসো।’
আস্সালামু আলাইকুম বলে আমি ভিতরে গিয়ে ঢুকলাম। পাশের ঘরের দরজার পর্দার আড়ালে তমা দাড়িয়ে আছে লাজুক ভঙ্গিমায়। চোখ মুখ অদ্ভুত এক রহস্যময় হাসিতে ঘেরা। পিছনে খোলা, উদ্দাম এলো চুল। ঘিয়ে রঙা পুরোনো ধরনের একটা ড্রেস পরেছে তমা। তবুও ওকে দারুন মানাচেছ। কেউ হঠাৎ দেখলে হল্প করে বলে দিতে পারে যে ‘মিস বাংলাদেশ’ পদটা একমাত্র তমারই জন্যই যোগ্য। তমার মুখের রংটা অনেকটা পেকে যাওয়া সৈয়দী পেয়ারার মতো। আসলে আমার কাছে ওসব কোন তুলনাই তমার জন্য যথাযোগ্য নয়। তমার পাশ ঘেষেই দাড়িয়ে আছে তিথি, তমার ইমিডিয়েট ছোট বোন। তিথিও সুন্দর, তবে ঠিক তমার মতো না। যৌবনের সব রুপই যেন তমার উপরে একসাথে ঠিকরে পড়েছে। আর তাই তমা পরিণিত হয়েছে এক রহস্যময়ী নারীতে। তিথির ছোট বোনকে খুঁজলাম মনে মনে। দেখতে পেলাম না। তিথির ছোট বোন ইমা ।
‘দাড়িয়ে কেন? বসো।’ তমার মায়ের সম্বোধনে আমার সম্ভিত ফিরে এলো। আমি খুব আড়ষ্ট হয়ে খাটের এক কোণে বসলাম। মুখটা স্বাভাবিক রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছি। কিন্তু অতিরিক্ত কোন কিছুই ভালো নয়, তাই অতিরিক্ত চেষ্টা হয়তো আমার মুখটাকে অপরাধীর মতো করে তুলতে পারে। আমি নিজেই ভূলে গেছি কেন এখানে এসেছি। মনের অলিতে গলিতে অনেক খুঁজে শেষে একটা অজুহাত বের করলাম। কিভাবে কথা শুরু করবো ঠিক করতে পারছিলাম না। সব জড়তার মুখে লাথি মেরে হঠাৎ উঠে দাড়িয়ে সরাসরি বললাম, ‘তমা, আমি আসলে তোমার কাছে এসেছি, তোমার কি গণিতের
২১
সমাধান আছে? অর্থাৎ উচচতর জ্যামিতির। বিকাল থেকে একটা এক্সট্রা জ্যামিতি মিলাতে পারছি না।’ কথাগুলো বলতে বলতে আমি ঘেমে গেলাম। এই মাঘ মাসের শীতেও আমার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। আমি সচরাচর কখনও মিথ্যে বলি না, তাই আজ মিথ্যে একটা অজুহাত তৈরী করতে গিয়ে আমার এই অবস্থা। লাই ডিটেক্টর হলে এতক্ষণে আমার মিথ্য্রা কথা বলার ব্যাপারে সম্ভাবনা দেখাতো একশো ভাগেরও বেশী। কারণ সবগুলো সম্ভাবনা আমার মুখে ¯পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে। তমা, তিথির খুব হাসি পাচেছ, শুধু মাকে ভয় করে হাসতে পারছে না। আমি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হলাম, একটা অজুহাত দাড় করাতে পেরে অনেকটা আশ্ব¯ হয়েছি। তিথি হঠাৎ করে লাজুক হাসি হেসে ভেতরে চলে গেল। তমা ধীর পদে এগিয়ে এলো। মিষ্টি মুখের মধু বর্ষণ করে তমা তার কোকিল কন্ঠে বললো,‘সরি, আমার কোন জ্যামিতি সমাধান নেই। তা কোন এক্সট্রাটা মিলাতে পারছিলে না? আমি আবার থমমত খেয়ে বললাম ‘ছয় অনুশীলনীর বার নাম্বার’। বলতে না বলতেই তমা হাসিতে ভেঙ্গে পড়লো। আমি নিজের ভূলটা বুঝতে পারলাম। ছয় অনুশীলনীতে এক্সট্রার সংখ্যা মাত্র ১১টি। সুতরাং আমি দ্বিতীয় বারের মতো প্রমাণ করলাম যে আমি আসলে সমাধানের জন্য আসিনি এবং বিকেলে কোন এক্সট্রা নিয়ে মাথা ঘামাইনি। তবুও বুঝতে যখন পেরেছি তখন যতটুকু সম্ভব ঘটনাটা টেকাতে হবে। তাই আবারও বললাম-ভূল হয়েছে, ছয় অনুশীলনী না দুই অনুশীলণী। তমা এবার হাসিমুখে বলল ‘ও আচছা, এ অনুশীলনীর কয়েকটি এক্সট্রার একটি সীট আমার কাছে রয়েছে। আমি নিয়ে আসি।’
তমার মা আমাকে বসতে বলে নামাজে দাড়ালেন। আমি যেন নিজেকে অনেকটা তুলার মতো হালকা মনে করার সুযোগটা এই মাত্র পেলাম। তমা যেখানে দাড়িয়েছিলো সেদিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি, ঠিক যেন পৃথিবীর কোন দর্লভ দৃশ্য আমি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছি। শুধু তাই নয়, দৃশ্যের খুটিনাটি বিষয় যেন আমি অšদৃষ্টি দিয়ে অবলোকন করছি। আমি যেন এখন দাড়িয়ে আছি সমুদ্রের বালুতটে, দর থেকে আসা বাতাসের ঝাপটা এসে আমার কানে সমুদ্রের গর্জন পৌছাচেছ। সমুদ্র যেন নীরব ভায়ায় আমাকে আহ্বান জানাচেছ। এসো আমার কাছে আসো। সমুদ্রের নোনা জল এসে আমার পায়ে আছড়ে পড়ছে। আমি এক মুগ্ধ অনুভূতিতে চোখ বুজে ফেললাম। ঢেউ চলে যাবার পর পায়ের নীচ থেকে একটু একটু করে বালি কমে যাচেছ। পায়ের নীচে এক বিচিত্র অনুভূতির জন্ম নিচেছ। ইস্ কী মধুময় মুহর্ত! সমুদ্র আমাকে ঢেউয়ের মাধ্যমে আলিঙ্গন করতে আসছে, আবর ফিরে যাবার মুহর্তে পায়ের নীচ থেকে সামান্য বালুকণা পর্যš নিয়ে যাচেছ। অদ্ভুুত এক রহস্য। যে এত
২২
অকৃপনভাবে আবেগে বিহ্বলিত হয়ে আলিঙ্গন করতে আসে, সে আবার ফিরে যাবার সময় কত কৃপণভাবে স্বদানকৃত বালুকণাগুলো ক্রমে ক্রমে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। অবশ্য এর মধ্যেও একধরনের আনন্দ-অনুভূতি মানব হৃদয়ে জন্ম দেয় সমুদ্র। সমুদ্রের মহত্ত, উদারতা আর বিশালতা ছাপিয়ে তার এ স্বভাবটুকু আমাদেরকে বা¯ব জীবনের কথাই বারংবার মনে করিয়ে দেয়। পৃথিবীতে উদার মানুষগুলো তার বিশাল হৃদয়ের সকল মমতাকে ঢেউ রুপে উত্থিত করে যখন অন্যদেরকে আলিঙ্গন করে তখনও তাদের বিশাল হৃদয়ের বিশালতার মধ্যেও সীমাবদ্ধতা থাকে। তারা যখন একে একে সব মমতাগুলো ক্রমে সরিয়ে নেয়, তখন শন্য বালুতটে দাড়িয়ে মানুষ জীবনের এক নতুন রুপ উপলদ্ধি করে। আমি তমার মধ্যেও একসময় এক বিশাল সমুদ্রের সন্ধান পেয়েছিলাম। আজ কেন জানি আমার মনে হচেছ, এ সমুদ্রের বালুতট ছেড়ে ছোট্ট একটি তরণীতে করে সেই সমুদ্রের পানে পাড়ি জমাতে।
আমি যখন এ জাতীয় হাই থটের চিšা-ভাবনা করছিলাম, তখন কোন পলকে যে তমা এসে আমার পাশে বসেছে খেয়ালই করিনি। আমার চোখ যখন অন্য জগতের সব বিচিত্র দৃশ্য অবলোকনে রত ছিল, তমা তখন আমার এসব অতিন্দ্রিয়বাদীতা দেখে হাসি চাপতে না পেরে এক বিচিত্র শব্দ করে উঠলো, তাতেই আমার ধ্যান ভাঙ্গলো। ‘আমার শীট নেয়ার কোন প্রয়োজন নেই। শুধু দেখলেই চলবে’-বলে আমি শীটটি হাতে নিলাম। কিন্তু আসলে কি দেখলেই চলবে তা হয়তো আমার চেয়ে তমারই ভাল জানা ছিলো। স্কুলে প্রথম দিন থেকে সবার অলক্ষ্যে সারাক্ষণ যে তমার দিকে চেয়ে থাকতো, সেই ছেলেটি যে আমি তা বুঝতে তমার কষ্ট হলো না। আর আজ আমি যে কতটুকু সাহস সঞ্চয় করে তমার কাছে এসেছি তা হয়তো এতক্ষণে সে বুঝে গেছে।
আশ্চর্য! এ যে আমার নিজের হাতের করা এক্সট্রা জ্যা

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



