somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আরব ডায়েরি-৪৪ (অভিশপ্ত সামূদ জাতির দেশে-৪)

০২ রা মার্চ, ২০১৩ দুপুর ১:২১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



১ম পর্ব
২য় পর্ব
৩য় পর্ব

আল-দেরা
মাদায়েন সালেহ যাবার পথে একটি প্রাচীন ধ্বংসপ্রাপ্ত শহর আছে। এটা আল-দেরা নামে পরিচিত। আমরা যাত্রা বিরতি দেই। ত্রোয়দশ শতকের প্রাচীন এই শহরে ৮০০’র মতো বাড়ী ছিল। পাথর, মাটি আর খেজুরগাছে তৈরি বাড়ীগুলি এখনো দাড়িয়ে আছে, তবে কোনটারই ছাদ অবশিষ্ট নেই। এ শহর গোড়াপত্তনের সময়ে "দিদান"ও "লিহাইন"দের সময়ের পুরনো পাথর ব্যবহার করা হয়। বর্তমান সময়ের আগে আল উলা’র অধিবাসীরা এ শহরেই বসবাস করত। বিংশ শতাব্দীতে এসে নতুন শহর (এখনকার আল উলা) তৈরি হয় এবং পর্যায়ক্রমে সবাই পুরনো শহর ছেড়ে আসে। ১৯৮৩ সালে সর্বশেষ ফ্যামিলিটি চলে আসার সাথে সাথেই প্রাচীন এ নগরীটি পরিত্যাক্ত হয়ে যায়। এ শহরের ১৪টি ফটক এখনো অক্ষত আছে। কিন্তু তথ্যটি ভ্রমনের সময় না জানা থাকার কারনে আমরা ফটকগুলি খুঁজে বের করতে পারিনি।



আল-দেরা

আমরা বেশ কিছু সময় এখানে ছিলাম। সাঈদ দৌড়ে শহরের ভেতরে ঢুকে গেল। সাঈদের সাথে পাহাড় ট্র্যাকিং এ অভ্যস্ত শিমু তার সঙ্গ দিল। কিন্তু যেভাবে উচু জায়গা থেকে নীচে নামল, মনে হলো সে বড়ই ভীত। শাহরিয়ার ভাই আর মামুন বসে থাকতে পারল না। তারাও জয়েন করল। আমি ও মিলন রাস্তায় দাড়িয়ে রইলাম। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল যত তাড়াতাড়ি মাদায়েন সালেহ যাওয়া যায়। বিশাল একটা এরিয়া দেখে শেষ করতে হবে। ড্রাইভারও তাড়া দিচ্ছিল। ড্রাইভার ভেবে পাচ্ছিল না এইসব পুরনো বাড়িঘরের সামনে ছবি তুলে কি এত আনন্দ।

পুরনো এ শহরের পাশে একটি মসজিদ। মসজিদটি রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। কথিত আছে হজরত মোহাম্মদ (সাঃ) এখানে নামাজ পড়েছিলেন। আবুদ্দুল্লাহ ইবনে ওমর হতে জানা যায়, ৬৩০ সালের তাবুকের যুদ্ধে যাবার পথে তিনি এখানে থামেন। বাইজান্টাইনরা (রোমান) সিরিয়া থেকে অগ্রসর হচ্ছিল। হজরত মোহাম্মদ (সাঃ) বাইজান্টাইনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা পথে মাদায়েন সালেহ বিশ্রাম নেন। সাহাবিরা মাদায়েন সালেহের কুপ থেকে পান করার জন্য ও রুটি বানানোর জন্য পানি নেয়, যেখান থেকে সামূদরা পানি পান করত। হজরত মোহাম্মদ (সাঃ) তা দেখতে পেয়ে এই পানি ব্যবহার করতে মানা করেন। হজরত মোহাম্মদ (সাঃ) একটি কুপের কাছে যান যেখান থেকে হজরত সালেহ (আঃ) এর মাদী উট পানি পান করত (পরবর্তী পর্ব দ্রষ্টব্য)। তিনি সেই কুপের পানি ব্যবহার করতে বলেন। তিনি সাহাবিদেরকে এই অভিশপ্ত জায়গায় প্রবেশ করতে মানা করেন।

মসজিদটি

আর এ কারনেই এ জায়গাটি তেমন প্রচার পায়নি। অথচ সমসাময়িক জর্ডানের পেট্রা পৃথিবীর সপ্তম আশ্চার্যের একটি। এখনও সৌদিরা এখানে প্রবেশ করতে ভায় পায়। এ জায়গা তারা দ্রুত অতিক্রম করে।

মুসা বিন নাসের ক্যাসল
আল-দেরা’র পাশেই “মুসা বিন নাসের ক্যাসল”। মুসা বিন নাসের উমাইয়া খলিফা আল-ওয়ালিদের গভর্নর ও সেনাপতি ছিলেন। তিনি উত্তর আফ্রিকার মুসলিম প্রভিন্সগুলো শাসন করতেন। তিনি স্পেন, পুর্তগাল ও ফ্রান্স অভিযানও পরিচালনা করেন।

মুসা বিন নাসের ক্যাসল

দূর্গটি ৬ষ্ঠ শতাব্দীর। যদিও এর ভিত্তি প্রায় ২৫০০ বছরের পুরনো। বর্তমানে সংস্কার করা হয়েছে। আমরা সবাই মাদায়েন সালেহ হতে ফেরার পথে (বর্ণনাটি এখন দিয়ে দিচ্ছি) এর উপরে উঠি। উপরে উঠেই বুঝতে পারলাম কেন এখানে দূর্গ বানানো হয়েছে। দূর্গের উপর হতে সমস্ত মালভূমি দেখা যায়। উপর থেকে নীচের আল-দেরা আর বিস্তীর্ণ মালভূমি দেখতে দেখতে আমরা সবাই যেন অতীতে ফিরে গিয়েছিলাম। সবাই আমরা ফটোসেশনে নেমে যাই। এই ঐতিহাসিক স্থাপনা, মালভূমির সৌন্দর্য্য, পারিপার্শ্বিকতা আর সময়কে ফ্রেমবন্দী করার সুযোগ কেউই হারাতে চায় না।



২৫০০ বছরের পুরনো


উপর হতে দেখা

কৌশলগত কারনেই এখানে মুসা বিন নাসের অবস্থান করতেন। মুসা বিন নাসের ৭১৫ সালে এ দূর্গে মারা যান এবং এখানেই কোথাও তাকে সমাহিত করা হয়।

হিজাজ রেলওয়ে
আমরা যতোই মাদায়েন সালেহ’র কাছাকাছি হচ্ছিলাম, ততোই তাকে অনুভব করছিলাম। পাহাড়গুলো দেখে বিষ্ময়ের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছিল। আমাদের ড্রাইভার আলী শরীফ বারবার ভীত চোখে মাদায়েন সালেহ’র ভেতরে কিছু খেতে নিষেধ করল, তবে সাথে করে আনা পানি খাওয়া যাবে। এ শহর এখনো অভিশপ্ত। এর আশেপাশে কোন লোকালয় নেই। এখনও লোকে এ শহর এড়িয়ে চলে।

কিছুক্ষনের মাঝেই মাদায়েন সালেহ’র প্রবেশমুখে পৌছে যাই। পুলিশ আমাদের আইডি কার্ড দেখে ভেতরে যেতে দিল। বলে দিল, আমরা যেন বেশী ভেতরে না যাই।

শহরের কিছুদূর এগোতেই একটি রেল স্টেশন চোখে পড়ল। অনেক সাজানো গোছানো। আমরা ছাড়া আর কাউকেই দেখতে পেলাম না। এটা হচ্ছে হিজাজ রেলওয়ের অংশাবশেষ। অটোমান সুলতান দ্বিতীয় আব্দুল হামিদের নির্দেশে ১৯০১-১৯০৮ সালে এই রেললাইন তৈরি করা হয়।






সিঙ্গেল ট্র্যাকের ১১০০ মাইল দীর্ঘ এই রেললাইনটি দামেস্ক ও জেরুজালেমকে মদীনার সাথে সংযুক্ত করেছিল। এই রেললাইনটি মক্কার সাথে যুক্ত হবার কথা ছিল। কিন্তু ১ম বিশ্বযুদ্ধের কারনে তা আর হয়ে উঠেনি। মূলত রেললাইনটি হাজীদের জন্য বানানো হয়েছিল যাতে হাজীরা খুব সহজেই মক্কা/মদীনা আসতে পারে। মাদায়েন সালেহ’র এ স্টেশনটিতে রেল মেরামতের সুবিধা ছিল, রেল স্টাফদের জন্য ডরমিটরি ছিল। ১ম বিশ্বযুদ্ধে এই রেললাইনটি ব্রিটিশদের মাথাব্যাথার কারন হয়ে দাঁড়ায়। অটোমানরা খুব সহজেই এই পথের মাধ্যমে রসদ সরবরাহ করত। তাই লরেন্স (লরেন্স অব এ্যারাবিয়া) তার আরব গেরিলাদের নিয়ে হিজাজ রেললাইনটি ধ্বংস করে দেয়। ১৯১৮ সালে বিশ্বযুদ্ধ শেষে রেললাইনটি সম্পূর্ণ ধ্বংসপ্রাপ্ত অবস্থায় পাওয়া যায়। কালক্রমে রেললাইনটি পরিত্যাক্ত হয়ে যায়। হিজাজ থেকে মদীনা পর্যন্ত ১৬টি স্টেশন ছিল। এখনো কয়েকটি স্টেশন মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। আমরা আল-উলা আসার পথেই একটি স্টেশন দেখে এসেছি।

টি ই লরেন্স, পোস্টারে ঘটনাটি বর্ণনা করা হয়েছে।

মরুভূমির মাঝে একটি স্টেশন এখনও আছে।

রেল স্টেশনটি সাজিয়ে রাখা হয়েছে। সৌদিতে যা কল্পনা করা যায় না। ওয়াগনগুলো আগের মতোই আছে। পাশেই একটি জাদুঘর। সব কিছুর বর্ণনা দেয়া আছে, ঐ সময়ে ছবি আছে, বিভিন্ন রেলসংক্রান্ত জিনিসপত্র ও একটি ইঞ্জিন সাজিয়ে রাখা আছে। সব জায়গায় পরিচ্ছন্নতার ছাপ।






বিশ্বযুদ্ধ সময়কালীন ইরাকের শাসক ছিলেন কিং ফয়সাল। আমাদের ড্রাইভার আলী শরীফ আবু ফয়সাল জানালো কিং ফয়সাল ছিল তার পূর্বপুরুষ। আমরা অবাকই হলাম। তবে এ সুযোগ আমরা ছাড়লাম না। কিং ফয়সাল ও আবু ফয়সালকে একসাথে ফ্রেমবন্দী করলাম।

পোস্টারে কিং ফয়সাল, তার সাথে আমাদের ড্রাইভার আলী শরীফ আবু ফয়সাল

রেল স্টেশন হতে বের হয়ে ডানে তাকাতেই দেখতে পেলাম সামূদদের সেই অভিশপ্ত নগরী।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা মার্চ, ২০১৩ দুপুর ১:৪৭
৯টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

লুঙ্গিসুট

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:২৪



ছোটবেলায় হরেক রঙের খেলা খেলেছি। লাটিম,চেঙ্গু পান্টি, ঘুড়ি,মার্বেল,আরো কত কি। আমার মতো আপনারাও খেলেছেন এগুলো।রোদ ঝড় বৃষ্টি কোনো বাধাই মানতাম না। আগে খেলা তারপর সব কিছু।
ছোটবেলায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার মত মুফতি তাকি উসমানী সাহেবের কিছু কথা

লিখেছেন নতুন নকিব, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:২৫

স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার মত মুফতি তাকি উসমানী সাহেবের কিছু কথা

ছবি কৃতজ্ঞতা: অন্তর্জাল।

একবার শাইখুল হাদিস মুফতি তাকি উসমানী দামাত বারাকাতুহুম সাহেবকে জিজ্ঞেস করা হল, জীবনের সারকথা কী? উত্তরে তিনি এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

=মৃত্যু কাছে, অথবা দূরেও নয়=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:০৭



©কাজী ফাতেমা ছবি
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দিয়ে বলি, আমারও সময় হবে যাবার
কি করে চলে যায় মানুষ হুটহাট, না বলে কয়ে,
মৃত্যু কী খুব কাছে নয়, অথবা খুব দূরে!
দূরে তবু ধরে নেই... ...বাকিটুকু পড়ুন

সবুজ চোখের মানুষের ধাঁধা

লিখেছেন করুণাধারা, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২৯



এই ধাঁধার নাম সবুজ চোখের মানুষের ধাঁধা; নিচের লিংকে এটার ভিডিও আছে।

স্বৈরশাসকের বন্দী

এই ধাঁধাটি আমার ভালো লেগেছিল, তাই অনেক আগে আমার একটা পোস্টে এই ধাঁধাটি দিয়েছিলাম। কিন্তু সেই পোস্টে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসলামের চার খলিফার ধারাবাহিকতা কে নির্ধারণ করেছেন?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩৭




সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ২৬ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৬। বল হে সার্বভৈৗম শক্তির (রাজত্বের) মালিক আল্লাহ! তুমি যাকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব) প্রদান কর এবং যার থেকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব)... ...বাকিটুকু পড়ুন

×