আজ নিজের কিছু গল্প বলবোঃ
আমার শৈশব কেটেছে গ্রামে । সেসময় আমি নাকি ছিলাম ব্যাপক ইতর। মন চাইলেই যাকেতাকে মারতাম, ইচ্ছামতো পুকুরে ঝাপাঝাপি করতাম, অন্যের গাছের ফল চুরি করে খেতাম। আর এমন কিছু আকাম কুকাম করতাম, যাতে সে বয়সেই প্রচুর কুখ্যাতি অরজন করেছিলাম । যেমনঃ একবার কয়লা তোলার পিতলের চামচ এক ভাবীর পিঠে চেপে ধরেছিলাম । সেই দাগ নাকি এখনও আছে । আরেকবার এলাকার এক জ্যাঠাকে অযথাই ব্যাট দিয়ে এমন বাড়ি দিয়েছিলাম যাতে তার অজ্ঞান দশা। এইসব শয়তানির ব্যপারে আমার গুরু ছিলো, Md Rasu । আমার লাগাম টেনে ধরার জন্য অন্যান্যদের চাইতে অনেক আগেই স্কুলে ভর্তি করা হয়। তাতে তো কোন ফল হলোই না, বরং পুকুরের মাছ হয়ে যেন সমুদ্রে ছাড়া হলো । স্কুল থেকে এসে ব্যাগটা রেখেই মহিষের পিঠে চড়ে বাড়ির পাশের পাহাড়ে চলে যেতাম। মহিষের পিঠে চড়াটাতে এমনই অভ্যস্ত হয়েছিলাম যে, উপুড় হয়ে শুয়ে থেকেও অনেক দূর যেতে পারতাম। আরেকটা গোপন কথা বলিঃ সেই বয়সেই কাজের লোকদের কাছ থেকে #বিড়ি খাওয়ায় হাতেখড়ি হয়েছিলো। একবার মায়েরকাছে খেলাম ধরা। এটা দেখেতো মায়ের প্রাণ যায়যায়। সাথে সাথেই সিদ্ধান্ত নিলো, তুষার যদি এখানে থাকে তাহলে এক্কেরে শেষ। এটা চাসাভুসা ছাড়া আর কিছুই হবেনা ।
আমার ঠাই হলো নালিতাবাড়ীতে নানার বাসায় । সমুদ্রের মাছ আবার একুরিয়ামে পড়লে যা হয়, আমারও সেই দশা। গ্রামের ছেলে মফস্বল শহরে এসে এখানকার হাবভাব বুঝতে আর পরিবেশের সাথে এডজাস্ট করে নিতেই চলে গেল ২-৩ বছর । মা এবং গ্রামের শোকে প্রচুর কাদতাম। অনেকটা রবি ঠাকুরের ছুটি গল্পের ফটিকের মতো অবস্থা । তবে ধিরে ধিরে যখন অভ্যস্ত হয়ে গেলাম, তখন সেই আগের তুষার। নানার পকেট থেকে টাকা চুরি করে ভিডিও গেমস খেলা, মাটির ব্যাংক থেকে খুচিয়ে খুচিয়ে পয়সা বের করে সিঙ্গারা পেয়াজু খাওয়া, প্রিয় বন্ধু গালিব-ফারুক কিংবা রফিকুলের সাথে ভোগাই নদীতে ইচ্ছামতো ঝাপাঝাপি ইত্যাদি ইত্যাদি।
আজ হঠাত পুরনো কথা তোলার কারন কি? আমি আমার শৈশব কিংবা কৈশোরকালে সবই করতাম, একমাত্র লেখাপড়া ছাড়া। সবসময়ই পরীক্ষায় নুন্যতম মার্ক পেতাম, স্যারদের হাতে মার খেতাম, বন্ধুদের তাচ্ছিল্ল্যের শিকার হতাম। আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে এলাকাবাসী, নিকটাত্মীয়, স্কুলের শিক্ষক এমনকি আমার পরিবারের লোকজনও প্রচুর সংশয়ে ছিলো। শুধু দুইজন মানুষ মনে করতো, আল্লাহ তুষারকে নিশ্চয়ই সমাজে প্রতিষ্ঠিত করবে। আমার নানা আর নানী । যারা আমাকে ক্লাশ থ্রি থেকে এস.এস.সি অর্থাৎ দীর্ঘ ১০-১১ বছর নিজেদের কাছে রেখে লালন পালন করেছেন। আর বিনিময়ে তখন আমি তাদের এমন যন্ত্রনাই দিতাম, যা তাদের ৪ জন ছেলেমেয়েও দেয়নাই। ডিসেম্বর মাস হয়ে গিয়েছে, অথচ নানা কলেজ থেকে জুলাই মাসের বেতনই পায়নাই । এই অবস্থাতেও শুক্রবার এবং মঙ্গলবারে আমার জন্য মাংস আনা হতো। যেই মাংস সারা সপ্তাহ কাওকে না খাইয়ে শুধুমাত্র আমাকেই খাওয়ানো হতো। একবার যদি মাংস না পেতাম, ভাতের থালা ছেড়ে উঠে যেতাম । আবার রাতে লোডশেডিং এর সময় নানী হাতপাখা দিয়ে বাতাস দিতো যতক্ষন না আমি ঘুমাতাম। হাত লেগে গিয়ে বাতাস দেওয়া বন্ধ হলেই রাগারাগি আর চিৎকার করতাম। এরকম যত যন্ত্রনা দেয়া যায়, তাদের দিতাম । এরপরও উনারা আমার প্রতি আস্থা হারাননি । উনাদের সেই আস্থার সর্বশেষ ফল আজ পেলাম । BSC in CSE এর রেজাল্ট আজ দিয়েছে । যাতে সর্বশেষ সেমিস্টারের প্রজেল্টে A+ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছি । আর গড় রেজাল্ট সম্ভবত 3.30 এসেছে (এখনও হিসেব করিনি) ।
আমার নানা নানি যদি ক্লাশ থ্রি তে আমার দায়িত্ব না নিতো, তাহলে হয়তো এলাকাবাসীর কথামতো , “চাষাভুষা” ই থেকে যেতাম । আজ আমার রেজাল্টের দিনে বারবার শুধু এগুলোই মনে পড়ছে । আমার কি হওয়ার কথা ছিলো, আর আল্লাহ আমাকে কোথায় এনেছে । আল্লাহর দরবারে অশেষ শুকরিয়া । আর আমার নানা নানীর জন্য সবার কাছে দোয়া চাই। উনারা এখনও জীবিত কিন্তু রোগব্যাধী শরীরে বাসা বাধছে । আল্লাহ যেন উনাদের সুস্থ করে দেন । আর আমি যেন তাদেরকে এখন একটু প্রশান্তি দিতে পারি ।
পরিশেষে, সবার কাছে দোয়া প্রার্থী। নানান বাধা স্বত্বেও আরও কিছুদুর যাওয়ার ইচ্ছে আছে ।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে জুন, ২০১৮ রাত ৮:০৪