৮ জানুয়ারি ২০২১ । দিনটি অন্যান্য ৮-১০ টা সাধারণ দিনের মতোই। আমি সেদিন বউ বাচ্চা সহকারে জামালপুরে ফুফুর বাসায়। উদ্দেশ্য, বিকালে জামালপুরের লুইস ভিলেজে বউয়ের ঘনিষ্ঠ বান্ধবী "আশিকা" এর বিয়ের অনুষ্ঠানে এটেন্ড করা। তখনও ঘুনাক্ষরেও জানিনা, কয়েক ঘন্টা পরেই আমার জীবনে কোন বিভীষিকা নেমে আসবে, যেটা আমার এবং আমার পরিবারের জীবনে অবর্ননীয় কষ্ট ও দুর্ভোগ বয়ে আনবে।
যাইহোক, বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিলাম, সবার সাথে দেখা হলো, খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ হলো। এরপর ফুফুর বাসায় চলে আসলাম ব্যাগ গোছাতে। ততক্ষণে বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যা। ফুফু বারবার বললো সেদিন উনার বাসাতেই থেকে যেতে এমনকি মোটরসাইকেলে চড়ার পরেও বললো যাতে এই সন্ধ্যাবেলার যাত্রাটা বাতিল করি। কিন্তু আমার হাতে কোন অপশন ছিলোনা। সেদিন ইহান এবং দোলনকে ইসলামপুর (আমার শশুড়বাড়ি) রেখেই পরদিন ভোরে বাড়িতে চলে যাওয়ার কথা। কেননা সকালেই বাড়িতে গিয়ে কাজের লোক সহকারে জমিতে নামবো, বানিজ্যিক ফলের বাগান করার উদ্দেশ্যে জমি মাপজোখ করবো। ফুফুর বাসা থেকে মোটরসাইকেলে রওনা দেওয়ার পরে ৩০০-৪০০ গজ দুরে মির্জা আজম চত্বরে কি ভেবে বউ বাচ্চাকে সিএনজিতে তুলে দিলাম এবং সিএনজিতে থাকা আমার শালাকে মোটরসাইকেলের পেছনে নিলাম। ওই সিএনজিকে আগে যেতে দিয়ে আমরা ধিরেসুস্থে পেছন পেছন যাচ্ছি। মোটরসাইকেলের গড় গতি ৪০-৪৫। কম্বপুর জোড়া ব্রীজের কয়েকশ গজ আগে হাইওয়ে রোডের ভেতর বিপরীত দিক থেকে আসা অটোরিক্সা হঠাৎ করেই কোন সিগন্যাল না দিয়েই ইউটার্ন নিয়ে ফেললো। দুর্ভাগ্যবশত আমি ছিলাম মাত্র ১০-১৫ গজ আগে। চোখের কোনে সেই অটোরিকশাকে ঘুরাতে দেখে অবচেতন মনেই গাড়ির দুইটা হাইড্রোলিক ব্রেক চেপে ধরলাম এবং গাড়িটা বামে কাত করে রাস্তা থেকে বের করে সংঘর্ষ এড়াতে চাইলাম। তখন আমার উদ্দেশ্য ছিলো, প্রয়োজনে রাস্তা থেকে ছিটকে বাহিরে যাবো কিন্তু সরাসরি সংঘর্ষ যেভাবেই হোক এড়াতে হবে। রাস্তাটার শেষ সীমানা অর্থাৎ সাদা দাগের উপর যেতে না যেতেই অটোরিকশাটি পূর্ন শক্তিতে আমার ডান উড়ুতে আঘাত করলো এবং তার ধাক্কায় আমি গাড়ি থেকে ছিটকে গিয়ে পাশে রাখা বড় কাঠের টুকরার উপর পড়লাম। কাঠের কোনা লেগে সঙ্গে সঙ্গেই আমার দুই চোখের মাঝখানে নাকের গোড়ায় বড় গর্ত হয়ে হাড় ঢুকে গেলো এবং নাকটাও ভেতরে সম্পুর্ন ঢুকে গেলো। আর ডান উরুর হাড় বের হয়ে একটু বের হয়ে থাকলো, আরেক টুকরা রাস্তায় ছিটকে পড়লো।
নিচে পড়ার সাথেসাথে উড়ুর তীব্র ব্যথা আমাকে কাবু করে ফেলতে চাইলো। সম্পুর্ন অন্ধকারে চিৎকার করে আমার শালা সনিকে ডাকলাম কিন্তু কেও জবাব দিলোনা। আমার এরমধ্যেই অনুভব করলাম আমি সম্পুর্ন বেকে আছি এবং ডান চোখে কিছুই দেখছিনা। আর কপাল বেয়ে গরম পানির লহর ফিনকি দিয়ে ছুটে আমার সমগ্র মুখমন্ডল এবং গলা ভিজিয়ে দিচ্ছে। সাথে সাথে কপালে হাত দিয়ে দেখি আঙ্গুল ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে এবং চোখের পর্দা ছিড়ে গালের উপর এসে আছে। আমি তখন ৯০% শিওর, কিছুক্ষনের ভেতরেই মারা যাচ্ছি। কালিমা পড়া শুরু করলাম আর খেয়াল আসা শুরু করল মাত্র ১ বছর বয়সী বাচ্চাটা রেখে আল্লাহ্ আজ দুনিয়া থেকে উঠিয়ে নিচ্ছেন। যাওয়ার আগে তাকে শেষবারের মতো দেখে যেতেও পারলামনা, কপালে চুমুটাও দিতে দিয়ে যেতে পারলামনা।
এরমধ্যেই শুনতে পাচ্ছি হাঁকডাক শুরু হয়ে গেছে। আশেপাশের বাড়ি থেকে চিৎকার করতে করতে মহিলারাও আশা শুরু করেছে। কয়েকজন পুরুষ এসে আমাকে উচু করে অটোরিকশার মেঝেতে শুইয়ে দিলো। পায়ের তীব্র ব্যথায় আবারও চিৎকার দিয়ে উঠলাম। আর বলতে চেষ্টা করলাম "আপনারা আমার শালাকে বাচান। তার অবস্থা হয়তো আরও গুরুতর। " অথচ আমি তখনও জানিনা, সে তেমন কোন আঘাতই পায়নাই। ততক্ষণে জামালপুর হাসপাতালের উদ্দেশ্যে অটোরিকশা ছেড়ে দিয়েছে। আমার লাশ যাতে বেওয়ারিশের মতো কিছুক্ষণের জন্যও পড়ে না থাকে, এজন্য তাদেরকে আমার পরিচয়টা দিলাম আর চাচার মোবাইল নাম্বারটা খুব কষ্টে বললাম। কিন্তু নাম্বার ভুল হওয়াতে আব্বুর নাম্বার বললাম এবং তারা আব্বুর সাথে কথা বললো। মোবাইলটা লাউড স্পিকারে আমার কানে ধরতে বলে আব্বুকে শুধু বলতে পারলাম, "আব্বু, মোটরসাইকেল এক্সিডেন্ট করে সামান্য ব্যথা পেয়েছি,আমাকে জামালপুর হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে। তুমি তাড়াতাড়ি আসো। " অথচ আমি তখনও শিওর ছিলামনা, এতোদুর থেকে এসে আমাকে জীবিত দেখতে পারবে কিনা।
জামালপুর হাসপাতালের জরুরী বিভাগে নেওয়া হলো, ততক্ষণে আমার প্রচন্ড ব্যথা হচ্ছে আর চোখ জড়িয়ে ঘুম পাচ্ছে। বাম চোখে খুবই সামান্য দেখতে পেলেও ডান চোখে কিছুই দেখছিনা। আমিই চিৎকার করে ডাক্তারদের ডাকার চেষ্টা করতেছি কিন্তু মুখের ভেতর রক্ত ভরাট হয়ে যাওয়াতে কথা বলতে গেলেই তাজা রক্ত গিলে ফেলছি। এক ডাক্তার পাশে আশার শব্দ শুনে মুখের রক্তগুলো 'থু ' করে ফেলে ডাক্তারকে বললাম, " আমার পায়ের চিন্তা পরে করেন আগে দেখেন কপালের গর্ত দিয়ে মগজ দেখা যায়? "
ডাক্তার বললেন, "মগজ দেখা যায়না কিন্তু মাথার খুলিটা খুব বাজেভাবে ইনজুরড হয়েছে। কিন্তু মনে হচ্ছে আঘাতটা খুলি পর্যন্তই গেছে। এর বেশি যায়নাই। "
একথা শুনে বাচার আশা আরও ২০%-৩০% বাড়লো। এখন যদি রক্তক্ষনে না মরি, আল্লাহ্ হয়তো এ যাত্রায় রেখে যেতে পারেন।
ডাক্তারকে বললাম, "সম্ভবত এই হাসপাতালে পুর্নাঙ্গ চিকিৎসা হবেনা। তাড়াতাড়ি প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে রেফার্ড করেন। আমার ভাঙ্গা পা সোজা করার আগে ডাবল ডোজ পেইন কিলার দেন কিন্তু দয়াকরে এখনই ঘুমের ওষুধ দিয়েননা। কেননা একবার চোখ বন্ধ করলে কবে চোখ খুলবো, নাকি চিরতরেই ঘুমিয়ে যাবো কিনা জানিনা। এজন্য আমার পরিবারকে দেখার আগে চোখ বন্ধ করবোনা। "
আমি অনবরত কথা বলছি দেখে ডাক্তার ধমক দিয়ে কথা বলতে নিষেধ করলেন। কিন্তু আমি এক মুহুর্ত কথা না বললেই সারা দুনিয়া অন্ধকার হয়ে আসতে ধরে। ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়তে ধরি। এজন্য মনোবলকে চাঙ্গা রাখতে, জীবনের এই সঙ্কটময় মুহুর্ত থেকে সারভাইভ করার জন্যই একের পর এক কথা বলেই যাচ্ছিলাম। আর কথার বলার জন্য নাকের আশেপাশের কাটা অংশ থেকে ছিটকে রক্ত ঝড়ছিলো। এছাড়া রক্তে জমাট বেধে নাক ভরাট হয়ে যাওয়াতে মুখ দিয়ে নিশ্বাস নিতে হচ্ছিলো। আবার মুখ দিয়ে নিশ্বাস নিলেও রক্ত ভেতরে চলে যাচ্ছিলো। এরই মধ্যে পায়ের যে হাড়টা মাংস ছিদ্র করে বের হয়ে ছিলো, সেটা দুই তিনজন ডাক্তার টেনে শরীরের ভেতরে আবারও ঢুকিয়ে দিয়ে প্রাথমিক ব্যান্ডেজ করে দিলো যাতে না বের হয়ে আসে। এই পুরো প্রসেসটার ব্যথার বর্ননা নাহয় না ই দিলাম। এরপরও অজ্ঞান হলাম না। মনের জোরে টিকে থাকলাম। এর মধ্যে কপাল আর চোখটাকেও পুরোপুরি ব্যান্ডেজ করে দিলো। এম্বুলেন্সে তোলার পরে আমার ফুফুও চলে আসলো। একটু পরে বউ বাচ্চাও চলে আসলো। আমার অবস্থা দেখে সবাই মিলে বিলাপ উচ্চস্বরে করা শুরু করেছে। উল্টো তাদেরই আমি মনোবল শক্ত করতে বলি আর এটা বুঝাই, তারা এভাবে ভেঙ্গে পড়লে আমাকে বাচানো যাবেনা। অনেক আগে থেকেই সিরিয়াস মুহুর্তে ইয়ার্কি করা আমার বাজে অভ্যাস। এই পা এবং চোখ বাধা অবস্থাতেও বউকে কাছে ডেকে বললাম, "তোমাকে বুচি ডাকলেতো রাগ করো। এখন আল্লাহ আমাকেই বোচা বানায়ে দিছে। এমন বোচাই বানাইছে, ধরে দেখো আমার নাকই নাই। " এই অবস্থাতেও আমার এই ইয়ার্কি শোনার জন্য কেওই প্রস্তুত । তারা আমাকে কি বলবে ভেবে পায়না। এই পরিস্থিতে কিছু ভেবে না পেয়ে কান্না একটু কমালো। যাইহোক আমার উদ্দেশ্য সফল। মাঝেমধ্যে ভিন্নপথে চললেও যে সফলতা আসে, এটাও একটা উদাহরণ হয়ে রইলো।
যাইহোক, আমাকে আর আত্মীয় স্বজন সহ এম্বুলেন্স ছোটা শুরু করলো। জামালপুর ব্রীজে আসতেই আব্বু আম্মু আর মুনা এসে পড়লো। তারা এম্বুলেন্সে উঠতেই শুরু হলো মুক্তাগাছা হয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে আমাদের যাত্রা। নান্দিনা পার হতেই আমার বাচ্চা এম্বুলেন্সে দুইবার বমিকরে ফেললো। সাথে সাথেই আমার স্ত্রী দোলনকে বললাম, " এমনিতেই আমার এই অবস্থায় বিপদের শেষ নাই, আমার বাচ্চা অসুস্থ হয়ে গেলে আমি আরও ভেঙ্গে পড়বো । দয়াকরে এম্বুলেন্স থেকে নেমে যাও। বাচ্চার অসুস্থ হলে আমাকে তোমরা বাচাতে পারবানা।"
বাচ্চা সহ আমার ফুফু, আমার শাশুড়ি এবং দোলন একেবারে নির্জন রাস্তায় নেমে গেলো। । যাওয়ার সময় চোখের ব্যান্ডেজের কারনে বাচ্চাটাকে শেষ দেখাও দেখতে পারলামনা। একটু পরে তার পরিচয়ের সাথে "এতিম" নামটাও যোগ হতে পারে। তাদের বিদায় দিয়ে এই প্রথম উপলব্ধি করলাম আমি কাঁদছি। ব্যান্ডেজের নিচেই হয়তোবা রক্ত এবং চোখের পানি একসঙ্গে মিশছে। আমি কাঁদতে কাঁদতেই আবারও আমাদের যাত্রা শুরু হল। যাত্রা যেই মুহুর্তে আমার জন্য সম্পুর্ন অনিশ্চিত ও অনন্তকালের যাত্রার মতোই লাগছিলো. .... (চলবে)
দ্বিতীয় পর্বঃ হাসপাতালের বিভীষিকাময় মুহুর্ত Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে আগস্ট, ২০২১ রাত ৯:৪৬