somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ফেউ

০২ রা মার্চ, ২০২০ বিকাল ৪:৪৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


একটা বিষয় আমি এখনও মেলাতে পারি না, গ্রাম ছেড়ে শহরে আসি যখন প্রথম, সে সময় শহরেও কেমন গ্রামীণ সবুজতার একটা ছাপ ছিল! আমরা একটা জংলা খালের পাড় ঘেঁষে নতুন ওঠা এক টিনশেড ঘর ভাড়া নিই! পরে অবশ্য জানতে পারি, ওই জংলা খালপাড়টা ভালো না, ওটা একপ্রকারের বধ্যভূমি, ওখানে নাকি মানুষ ধরে এনে জবাই করা হত (শোনা কথা, ভিত্তিহীন)! তার অপর পাড়েই ছিল শ্মশানঘাট!

বয়স তখন খুব বেশি না, দুই বছর বিরতি দেবার পর আবার তখন ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হই! ঘুম কম হবার দোষ সেই ছেলেবেলাতেও ছিল| চোখ বুজে পড়ে থাকতাম, রাত বাড়তে থাকত, মাথার মধ্যে আকাশকুসুম ফুটতে থাকত, কখন কোন গভীর রাতে ঘুম আসত জানাও হত না!

এমনই রাতগুলোতে কোনো কোনো দিন টের পেতাম দূর হতে দল বেঁধে যেন কিছু লোক আর্তনাদ করছে, হাউমাউ করে সাহায্য চাইছে! শব্দগুলো আবছা শোনা যেত, অনেকটা আহাজারির মত, এমন শব্দ আগেও শুনেছি গ্রামে যখন এমন ফাল্গুন চৈত্রে দূরের কোন বাড়িতে মাঝ রাতে আগুন লাগত, মানুষ হাউমাউ করে আর্তনাদ করে সাহায্য চাইত!

এই শহরে অমন গ্রামের মত আর্তনাদ, যার উৎসও জানি না, মাঝরাতে খুব ভয়ানক শোনাত, ওখানে শেয়াল ডাকবারও যো নেই!

ভয় পেতাম, পাশে দাদী ঘুমাত, কিন্তু চাপা স্বভাবের ছিলাম বলে দাদীকেও ডাকা হত না, ভেবে নিতাম মনের ভুল এটা! সব দিন এটা ঘটত না, মাঝে মাঝে, মাসে দু তিন বার! আমি মনের ভুল ভেবে পাত্তা দিতাম না, কিন্তু একদিন টের পেলাম, দাদী সজাগ, এবং কেন জানি মনে হল, দাদী ভয় পাচ্ছে!

আমি ফিসফিস করে বললাম, তুমিও কি শুনতেছ, বু?
দাদী ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল, কে এত চিল্লায় কিজানি, তুই ঘুমা, ওসব কিছু না, শয়তান ঘরের ভিতর ঢুকতে পারে না, ভয় নাই!

আমি এখনও মেলাতে পারি না, শব্দগুলো কিসের ছিল! শেয়াল যদি হত, দাদীর সেটা অবশ্যই বোঝার কথা, ভয় পাবার কথা নয়!


এই ঘটনা লিখতে গিয়ে আরেকটি ঘটনা মনে পড়ল। ছেলেবেলায় দৌড় ঝাঁপের খুব অভ্যাস ছিল। তার মধ্যে অন্যতম ছিল বাজি ধরে উঁচু বিল্ডিং থেকে লাফিয়ে নামা! একবার এমন এক বিল্ডিং থেকে লাফানোর সময় পড়ে গিয়ে পা মচকাই। শুক্কুরের বাপ নামে এক কবিরাজ ছিলেন এলাকায়, উনি এসে পা মালিশ করে দিতেন রোজ! সরিষার তেল এনে পায়ে মাখতেন, আর মন্ত্র পড়তে পড়তে মালিশ করতেন! বিড়বিড় করে কী পড়তেন জানতে খুব ইচ্ছে করত। আবছা আবছা শুনতাম, "যা রে ব্যথা সরে যা, যারে পাবি তারে খা!" এরকম কিছু ছড়ার মত বাক্য। সবটা বোঝা যেত না। সাহস করে একদিন বললাম একটু জোরে পড়েন না, কাকা!
উনি এমন চোখ রাঙিয়ে তাকালেন যে আর কিছু বলার সাহস পেলাম না!

আমার এসব মন্ত্রে তন্ত্রে কখনও বিশ্বাস ছিল না। বয়স কম হলেও যুক্তি চিন্তার ক্ষমতা বয়স অপেক্ষা বেশিই ছিল একটু! যখন মালিশ করতেন, আমি খেয়াল করতাম মন দিয়ে যে আসলে ঘটনাটা কী, ঝাড়ফুঁকে উপর দিয়ে ফুঁ দিলে কিভাবে ভেতরের ব্যথা ভালো হবে!
ভাবলাম, ফুঁ-তে কোন কাজ হয় না, এটা হতে পারে তেলের গুণে কিংবা মালিশের কৌশলে! আমি মালিশের কৌশলটা খেয়াল করার চেষ্টা করলাম, অসাধারণ কিছুও মনে হল না। এসব ঝাড়ফুঁক দেখেছি অনেক। যাইহোক, ঝাড়ফুঁকে আমার ব্যথা সারল না। দিন যেতে লাগল, একপর্যায়ে আর ধৈর্যে না কুলালে, ওভাবেই নেমে হাঁটা শুরু করলাম। বলাই বাহুল্য, খুঁড়িয়ে হাঁটতাম!

সেদিন বিকেলে খুঁড়িয়ে হাঁটতে দেখে সিলেটের এক মহিলা, যাঁকে আমরা মোশারফের মা বলে চিনতাম, তিনি মাকে জিজ্ঞেস করলেন ছেলের কী হয়েছে!
মা বলল, পা মচকেছে।
মহিলা কেমন মায়া নিয়ে তাকালেন আমার দিকে। তারপর মাকে বললেন আমাকে যেন মাগরিবের আযানের পর তাঁর ঘরে নিয়ে যায়।

অতপর মাগরিবের পর তাঁর ঘরে গেলাম। আধো আলো আধো ছায়ায় অনেকদিনের চেনা মোশাররফের মাকে কেমন অচেনা মনে হল সেদিন, তাঁর চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে, খুব মায়া নিয়ে আমার দিকে তাকালেন, যেন আমার ভেতর বাহির সব পড়ে ফেললেন। তাঁর মুখে মুচকি হাসি। হয়ত আমার ঝাড়ফুঁকে বিশ্বাস নেই বুঝেই হাসছিলেন তিনি! তারপর আমার ব্যথার অংশে হাত বোলালেন এবং জিজ্ঞেস করলেন, ব্যথা আছে?
আমার তখন ব্যথা আগের চেয়ে কম মনে হল। আমি বললাম, আছে এখনও!
উনি বললেন, বলো, ব্যথা নাই!
আমি বিরক্ত হয়ে মায়ের দিকে তাকালাম। ব্যথা আছে তো আমি নাই কেন বলব?
মা-ও সায় দিয়ে বলল, বল, ব্যথা নাই!
উনি এবার ব্যথার অংশে বেশ চাপ দিয়ে বললেন, ব্যথা আছে?
আমি দাঁত কিড়মিড় করে বললাম, ব্যথা নেই!
তখন আশ্চর্য হয়ে খেয়াল করলাম ব্যথা আসলে নেই। আমি দাঁত কিড়মিড় করেছি চাপ দেবার কারণে ব্যথা পাব এই ভয়ে!
তারপর ঘরে চলে এলাম, এবং পরদিন থেকে পা সম্পূর্ণ ভালো!

মোশাররফের মা দরিদ্র মহিলা, ইট ভাঙার কাজ করতেন, ছাপড়া ঘরে তিরিশ টাকা দিয়ে ভাড়া থাকতেন। আমার জানামতে তিনি কোন টাকা নেননি ঝাড়ফুঁক বাবদ, বা নিজের কেরামতি প্রচারের কোন চেষ্টাও করেননি। মাকে বলে দিয়েছিলেন, যেন তাঁর এই গুণ কাউকে না বলা হয়! কোন যে ধান্ধাবাজি ছিল এমনও মনে হয় না, শুধু আমি ভেবে পাই না, ব্যথা নেই বলতে বলাতেই কিভাবে একটা মচকানো পায়ের ব্যথা পুরোপুরি ভালো হয়ে যায়, ব্যথার কোন রেশ থাকা ছাড়াই!
এই হিসেব আমার এখনও মেলে না!


পরপর তিন না হলে কেমন যুত হয় না, তাই এই তৃতীয় ঘটনাটিও জুড়তে চাইছি। ঘটনা বিরাট কিছু না। এক সন্ধ্যায় সব গবাদিপশু যখন ঘরে ফেরা শেষ, বাইরের আকাশ কালচে আড়শির মত যখন গভীর আঁধারী হয়ে গেছে, তখন হঠাৎ আকাশ বাতাশ কাঁপিয়ে গম্ভীর একটা আওয়াজ এল। কোন একটা প্রাণীর চিৎকার! নানী রান্না ফেলে ঘরে দৌড়ে এলেন! ঘরের সবাইও মোটামুটি নড়েচড়ে উঠল, কীসের আওয়াজ ওটা!
নানার চোখে দেখলাম, গভীর পরখের হুঁশিয়ারি! কিছু একটা প্রাণী গম্ভীর শব্দে "ফেউ" করে লম্বা চিৎকার করছে!
মামারা বলে উঠল, ও কী!

নানা আঙুলের ইশারায় চুপ থাকতে বললেন। আওয়াজটা আবার এল, প্রথমে মনে হয়েছিল বেশ দূরে, তৃতীয়বার মনে হল যেন ঘরের একদম কাছেই! তার ডাকের গাম্ভীর্য থেকেই বোঝা যাচ্ছিল এটা কোন বড়সড় প্রাণীই হবে, কম হলেও একটা ষাঁড়ের কাছাকাছি সাইজ!

সবাই দরজা জানালা দিয়ে আমরা ঘরে বসে রইলাম, ওই রাতে কেউ আর বের হলই না ঘর থেকে। আওয়াজটা ঘুরে ফিরে অনেকবারই আসলো, অনেক রাত পর্যন্ত!
পরদিন সকালে নানাকে জিজ্ঞেস করলাম, নানো, কাল ওটা কী ছিল?
নানা বললেন, ফেউ!

সেই ফেউ সম্পর্কে আর কিছু জানা হয়নি আমার, আর কখনও কাউকে কিছু বলতেও শুনিনি।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা মার্চ, ২০২০ বিকাল ৪:৪৩
৫টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×