somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শীতবুড়ির গল্প

০৫ ই মার্চ, ২০২০ দুপুর ১২:৪৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

খুব শীত। পান মুখে দিয়ে কাৎ হয়ে আধশোয়া হয়েছি মাত্র, এমন সময় গিন্নির আঁচল ধরে অনেকটা ঝুলতে ঝুলতে ঘরে ঢুকলো নাতনী দীহা। দাদী-নাতনীতে কিছু একটা খুনসুটি চলছে বোঝা যাচ্ছে। এবার দাদীর আঁচল ছেড়ে ধিনাক ধিনা তালে নূপুর বাজাতে বাজাতে আমার দিকে এগিয়ে এলো ছোট্ট দীহা। চোখে দুরভিসন্ধির স্পষ্ট উপস্থিতি। আমিও প্রস্তুত হলাম আধচিবুনো পানের ভাগ দিতে।
নাতনীটির বয়স ছয় হল। আমরা দুই বুড়োবুড়ির খেলার নিত্যসঙ্গী এই পুতুলবালিকা। ওর প্রিয় দস্যিপনার একটি হল মুখ থেকে আধচিবুনো পান কেড়ে নেওয়া। সামনে এসে চুম্বনের ভঙ্গিতে ঠোঁট এগিয়ে দেবেই। আমাদের পানে এটা ওর একরকম অলিখিত অধিকার।

পান নেবার কথা এবার বোধয় ভুলেই গেছে ও। এসে আমার হাত ধরে টানাটানি করতে করতে বলতে লাগলো, দাদু , ও দাদু , তুমি নাকি দীদার শীতের কাপড় আটকে রেখেছ? কেন রেখেছ বলো? আমার দীদার শীত লাগে না বুঝি?

আমি বাঁকা চোখে একবার গিন্নির দিকে তাকিয়ে দেখে নিলাম, ষড়যন্ত্রটা যে কোথায় এখনও ঠাহরে উঠতে পারছি না। বললাম, আলমিরার চাবি তো সব তোমার দীদার কাছে থাকে, আমি শীতের কাপড় আটকাবো কী করে?
আমি জানি না তো কিছু!

তবে দীদা কেন সোয়েটার পরে না বলো? তুমিও সোয়েটার পরেছ, আমিও পরেছি, আমরা সবাই পরেছি, তাহলে দীদা পরে না কেন? বাবা না সেদিনও একটা চাদর কিনে আনলো! দীদা সেটাও পরে না। আমাদের কি কাপড় নেই বলো?

পুতুলাবুড়ির কথা একদম মটরশুটির মতো ফোটে! ইচ্ছে হয় সারাক্ষণ কানের কাছে এরকম পটপট করে বলতেই থাকুক, কখনও যেন না থামে ও।

গিন্নি এতক্ষণ ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুলচর্চা করছিল। এবার ডাকলাম, কই গো, আমি নাকি তোমার কাপড় জব্দ করেছি? দুই সতীনে মিলে হঠাৎ এভাবে আমাকে ফাঁসাচ্ছ কেন?

গিন্নি মুচকি হেসে এবার এগিয়ে এল, সেই চিরচেনা হাসি! নাতনীকে কোলে করে বিছানায় উঠে বলল, শোনো দিদিভাই, তোমার দাদুর আমার জন্য একটুও মায়া নেই। সবটুকুন মায়া হল গে তোমার জন্যে।

পুতলাবুড়ি আমাদের দুজনের মাঝখানে সটান হয়ে শুয়ে বলল, কেন? দাদু তো কালও তোমার জন্য মর্নিং জুতো কিনে আনলো!
দাদু মায়া করে তো!

গিন্নি ভালোমতো গা এলিয়ে বলল, তবে এই যে আমাকে শীতের কাপড় পরতে দিচ্ছে না!

এ তো ভারি জ্বালা! তোমার শীত লাগলে তুমি কাপড় পরবে, তাতে আমি বাঁধা দেব কেন? —কপট রাগ দেখিয়ে বললাম আমি।
মনে পড়ল, দোষটা আমারই। যখন বয়স ছিল আমাদের, যখন যৌবন ছিল, তখনকার একটা পাগলামির কথা মনে পড়ে গেল। গিন্নি শীতের কাপড়ে নাকমুখ ঢেকে রাখায় একদিন গোমড়া মুখে বলেছিলাম, এতগুলো কাপড় গায়ে জড়িয়ে তুমি আমার চোখের তৃপ্তিতে ব্যাঘাত করছ! মন মিটিয়ে দেখতে পারি না তোমায়!

সেই থেকে গিন্নি মনে রেখেছে ব্যাপারটা। বটেই তো, প্রিয়জনকে দুচোখ ভরে দেখতে পারাও যে অসীম সুখের!

পুতলাবুড়ি নাতনীটি তড়াক করে শোয়া থেকে উঠে দাঁড়ালো। দুই হাত কোমরে রেখে বিচার করার ভঙ্গিতে গিন্নিকে বললো, ঠিকই তো, হাঁ, দাদু মানা করলেই তুমি শুনবে কেন? তোমার শীত করলে কষ্ট হয় না বুঝি? এখন থেকে রোজ সোয়েটার পরবে বুঝেছ?

গিন্নী বুকে টেনে নিল নাতনীকে। কপালে চুমু দিয়ে বলল, আমার তো শীত করে না দাদুভাই!
ঠোঁটের কোণায় তার কেমন এক গর্বের হাসি! আমি মুগ্ধ বিস্ময়ে দেখছি!

এম্মা! শীত করে না তোমার! আদুরে ঢঙে ফোড়ন কাটল নাতনীটা।

শোন দাদুভাই, তোমাকে একটা গল্প বলি, শীতবুড়ির গল্প।

শীতবুড়ি! এটা আবার কেমন বুড়ি গো?

গিন্নি বলে, এই আমার মতোনই এক থুত্থুরে বুড়ি।

এহ তুমি বুঝি বুড়ি? যাঃ!
নাতনীর ঘোর আপত্তি। তার দীদা মোটেও বুড়ি নয়! বটেই।

ওই হল আর কি! তা শোনো, অগ্রাহায়নের শেষে উত্তর হতে এক বুড়ি আসে প্রতিবছর এ দেশে। সেই বুড়িই হল শীতবুড়ি। সে আসা মানেই হল শীত আসা!

নাতনী ব্যস্ত চোখে বোঝার চেষ্টা করছে ঘটনাটা। আমিও উৎকর্ণ।

গিন্নী আরো ভেঙে দিল, এই শীতবুড়িই এ দেশে শীত নিয়ে আসে।

নাতনীর চোখ দুটো চকচক করছে। হয়ত কিছু ভাবছে।

গিন্নি একটু থেমে আবার শুরু করল, তা একবার তো শীতবুড়ি এল অনেক শীত নিয়ে। জল গেল একদম বরফ হয়ে! গাছের পাতা সব ঝরে গেল, খাল বিল সব গেল শুকিয়ে! গরীবেরা ভীষণ শীতে কাঁপতে কাঁপতে মরে গেল অনেকেই। কেউ ঘর থেকে বেরুতে পারে না এমন অবস্থা!
শীতবুড়ি ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে এগিয়ে চলেছে মাইলের পর মাইল! হেঁটে হেঁটে সে অনেক ক্লান্ত। খুব পিপাসা পেল তার। কিন্তু খাল বিল সব তো শুকিয়ে চৌচির! কোথাও এতটুকু জলও নেই যে সে তেষ্টা মেটায়!

শীতবুড়ি এ বাড়ি ও বাড়ি গিয়ে অনেক কড়া নাড়ল একটু জলের আশায়। কিন্তু কেই তাকে জল দিল না! সবাই তাকে অলক্ষ্মী বলে অভিশাপ দিয়ে তাড়িয়ে দিল! কারণ তার কারণেই এত শীত, এত দুর্ভোগ!

শীতবুড়ি কী আর করে! জল না পেয়ে তেষ্টায় সে তো একদম মরে মরে দশা! কাহিল শরীরে আর হাঁটতে না পেরে শেষমেশ পথের ধারে লুটিয়ে পড়ে কাঁতরাতে লাগল পানি পানি বলে!

নাতনীর অস্থির জিজ্ঞাসা, তারপর?

তখন এক দিনমজুরের বৌ, দিন আনে দিন খায়, এই হিম শীতেও যে তার কাজের আশায় বাইরে না বেরিয়ে উপায় নেই, সেই বৌটির বুড়িকে দেখে খুব দয়া হল। বৌটির পরনে পাতলা একটি শাড়ি, সে জবুথবু হয়ে কাঁপতে কাঁপতে কোনমতে আঁচল ভিজিয়ে জল এনে নিংড়ে খাওয়ালো বুড়িকে।

জল পেয়ে জীবন রক্ষা পেল শীতবুড়ির। সে অনেক খুশি হল বৌটির ওপর। আর খুশি হয়ে তাকে একটি আশীর্বাদ দিয়ে বলল, তুই আমার জীবন বাঁচিয়েছিস, যা আজ থেকে আমি তোর আঁচল ওমে ভরে দিলাম। পৃথিবীর সবাই শীতে কষ্ট পেলেও তোর মতো যার কেবল শাড়ীর আঁচলই সম্বল, সে তার আঁচল দিয়েই শীত মানাতে পারবে। এই আঁচল থাকতে কখনও কোন বঙ্গললনা শীতকষ্টে মরবে না!

বুঝলে দিদিভাই, সেই হতে বাঙালি মায়েদের শাড়ির আঁচলের মতো উষ্ণ আর কিছু নেই। শত শীতেও আমরা যারা শাড়ি পরে থাকি তারা কষ্ট পাই না। আমাদের সন্তানদেরও আমরা আজন্ম এই আঁচলে ঢেকেই সকল কষ্ট থেকে বাঁচিয়ে রাখি!

ওইটুকু মেয়ে, কী বুঝল কে জানে, এই গল্পের অনেক শব্দ আর উপমাই ওর কাছে দুর্বোধ্য ঠেকার কথা, কিন্তু নাতনীটি সেসব কিছুই জিজ্ঞেস করল না, কেবল আমার কাছ থেকে সরে গিয়ে ওর দীদার আঁচলের মধ্যে একদম সেঁধে গেল! দীদার গলা জড়িয়ে ধরে বলল, সত্যিই তো দীদা, তোমার আঁচল তো আমার সোয়েটারের চেয়েও গরম!

আমারও ইচ্ছে হল, গিন্নির আঁচলে সাঁধি। কিন্তু এই বয়সে তা.. ছিঃ ছিঃ!
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই মার্চ, ২০২০ দুপুর ১২:৪৩
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×