আমাদের সেসময় পত্র মিতালি'র চলন ছিল৷ সেখান থেকেই চিঠি লেখার হাতেখড়ি হয়েছিল৷ কোন এক ছেলে, নাম তপন, বড়খালাকে মা ডেকেছিল, বড়খালাকে দেখতে বেড়াতেও এসেছিল, এলো বেড়ালো, চলে গেল৷ এরপর আর যোগাযোগ হয়েছিল কি না জানি না৷
আমাদের বাসায় এলেন একদিন মুহিদ মামা৷ অনেক দিন ছিলেন, চাকরির জন্য এসেছিলেন৷ আমাকে দিয়েছিলেন গল্পের বই৷ খুবই চমৎকার মানুষ ছিলেন৷ শুনেছি মেঝ মামার বন্ধু,পত্র মিতালির বন্ধু৷ মুহিদ মামার চাকরি হল, মামা চলে গেলেন৷ এরপর আর কোন যোগাযোগ হল না৷ কেন হল না জানি না! পর মানুষের এই আপন হয়ে ওঠার বিষয়টা আমার খুব চমৎকার লাগল৷ এরপর ম্যাগাজিন, কিশোর পত্রিকা ইত্যাদি থেকে ঠিকানা নিয়ে আমিও চিঠি লিখতে শুরু করলাম৷ লিখতে গিয়ে বুঝলাম, আমার লেখার অন্যরকম একটা আবেশ আছে, কেমন কল্পনা ছড়াতে সক্ষম! আমি নতুন নতুন মানুষকে চিঠি লিখেছি, কখনও কারো কাছ থেকে কোন উত্তর আসেনি৷ একজনকে বেশ সাজিয়ে গুছিয়ে মাধুরী মিশিয়ে চিঠি পাঠাই, উত্তর আসে না, তো আরেকজনকে পাঠাই, উত্তর আসে না৷ প্রথমে মেয়েদের পাঠাতাম, মেয়েরা চিঠি পেয়ে পাত্তা দিচ্ছে না, বিষয়টা লজ্জার! অতঃপর ছেলেদেরও পাঠিয়ে দেখলাম৷ কাজ হল না৷ একেকটা চিঠি মিস হয়, তো পরেরটা আরো সাজিয়ে গুছিয়ে লিখেছি! নতুন নতুন ক্রিয়েটিভিটি এ্যাপ্লাই করেছি, কাজ হয়নি৷ এরমধ্যে একদিন ডাকঘরে কী একটা কাজে গিয়ে আমার খালুজান দেখলেন আমার প্রেরিতব্য চিঠি!
বাড়িতে এসে বললেন, তোকেও চিঠি পাঠায় কে!
তখন জিনিসটা মাথায় এল, এমনও তো হতে পারে যেসব মেয়েদের চিঠি পাঠিয়েছি, সে চিঠি রিসিভ করেছে তাদের গার্জিয়ানরা! না জানি, অমুক তমুক ছেলের চিঠি আসছে দেখে কোন মেয়ে কয়বার পিটুনি খেয়েছে! বিষয়টা আর ভালো লাগল না, এরই মধ্যে একদিন চিঠি পোস্ট করতে গিয়ে ডাকপিয়ন রুহুল ভাইকে খাম দিলাম, উনি খাম নিতে নিতে মুচকি হাসছেন দেখলাম! তখন মাথায় এলো, চিঠি যে সঠিক ঠিকানায় যাচ্ছে, বা আদৌ যাচ্ছে, তার নিশ্চয়তা কী? এমনও তো হতে পারে, রুহুল ভাই চিঠি পাঠাচ্ছেই না, নিজেই বরং পড়ে পড়ে মজা নিচ্ছে, নইলে শালায় হাসছে কেন! তখন পড়ি মাত্র নাইনে, লাইনে ওঠার বয়সই তো৷ এ সময় এই জিনিস নিয়ে হাঙ্গামা করলে মানুষ হাসবে৷ অতএব, রুহুল ভাইকে আর কিছু বললাম না৷ চিঠি এখন পোস্ট করব না বলে ফেরত নিয়ে এলাম৷ এরপর আর চিঠি পোস্ট করার বিষয় মাথায় আনিনি৷ তবে লেখা ছাড়িনি৷ কাল্পনিক প্রেমিকার উদ্দেশ্যে চিঠি লিখতাম কখনও মুড এলে৷ একবার একটা চিঠি লিখতে বসলাম, প্রচণ্ড ব্যাকুলতায় ভরা! সেই চিঠি এতই আবেগে ভরা যে পড়ার পর আমার নার্ভাস লাগতে লাগল, আমার কে একজন আছে, যাকে আমি চাইলেও দেখতে পারছি না, তার সাথে কথা বলতে পরছি না- এই ভেবে আমার বুক মোচড় দিতে লাগল! চোখ ভিজে উঠতে লাগল৷ ভীষণ মন খারাপ করে ঘুমিয়ে পড়লাম৷ সকালে উঠে দুইটা জিনিস বুঝলাম, এক. লেখার মাধ্যমে আমার প্রচণ্ড আবেগ নিংড়ানো আবহ তৈরি করার ক্ষমতা আছে, দুই. অযথা এমন কাল্পনিক বিষয় নিয়ে ভেবে মনের মধ্যে এমন প্রবল আলোড়ন তৈরি করার কোন মানে হয় না৷
অতএব, এমন চিঠি আর লিখব না ঠিক করলাম৷ লিখলাম না আর অনেক বছর৷ কবিতা লেখার দিকে মন দিলাম, বিচিত্র প্যাটার্নের কবিতা৷ ততদিনে চতুষ্পদী সম্পর্কে জেনেছি৷ আমি চেষ্টা করলাম ওরচেয়েও ব্যতিক্রম কিছু লিখতে৷ দূর্বা নামের একটি কবিতা লিখলাম, এক লাইনের লেজের সঙ্গে অন্য লাইনের জটিল যোগাযোগ অনেকটা গণিতের মতন হিসাব করা যেন৷ দেখা গেল, এখন যে লাইনটা লিখলাম, তার অন্ত্যমিল ছয় লাইন পরে, মাঝখানে দুই লাইনের মধ্যে মিল আছে, অথচ তৃতীয় লাইনটি দেখা গেলে পেছনের তিন লাইন আগে যে ছন্দে শেষ হয়েছে, এটি তাকে ধরেছে৷ সরাসরি না দেখাতে পারলে বিষয়টা বোঝানো কঠিন হবে৷ কিন্তু সৃষ্টিটা অভিনব ছিল, চমৎকার ছিল৷ সেই কবিতা এখন আর আমার কাছে নেই, কোথায় কোন কাগজের সাথে পচে গেছে জানি না৷ সেই সাথে সময়ের হাত ধরে পচে গেল মনটাও, মানসিকতাটাও৷ অনেক পরে আবার কিছুদিন কবিতা ধরলে তখন একটা কবিতা লিখেছিলাম "চিত্রা" নামে৷ খুবই হাহাকার ভরা কবিতা৷ পড়তে গেলে গলা ভারী হয়ে আসে এমন৷ সেই কবিতাও রাখা হয়নি৷
যাইহোক, পত্র মিতালি দিয়ে লেখার শুরু করেছিলাম৷ চলে এলাম কবিতায়৷ পত্রের মধ্যে যে আবেগ, যে দীর্ঘ প্রতীক্ষার ইতিহাস মেশানো থাকে, তা না থাকে মেসেজে, না থাকে আজকালকার চ্যাটবক্সে৷ আজ হতে বিশ ত্রিশ চল্লিশ কিংবা দুইশো বছর আগের কারো উদ্দেশ্যে আমার চিঠি লিখতে ইচ্ছে করে৷ খোলা চিঠি৷ ইচ্ছেটা ইচ্ছেই রয়ে যায়৷ লেখা হয় না৷ একদিন হয়ত লিখব, পূর্ববর্তী এমন কারো কাছে, যার কাছে উজাড় করে বুকের ভেতরকার সব ভাঙন খুলে দেখানো যায়! একদিন ঠিকই লিখব৷
আমার রেলওয়েতে চাকরির ইন্টারভিউ লেটার আসে পত্র মারফত৷ আমার তখন কোন নির্দিষ্ট ঠিকানা ছিল না৷ এমন কেউ ছিল না, যার ঠিকানায় চিঠি আনা যায়৷ সেই ইন্টারভিউ'র চিঠি আমি পাই যেদিন পরীক্ষা, সেদিন সকালে৷ আমি চট্টগ্রাম, ইন্টারভিউ রাজশাহীতে৷ একমাস আগে চিঠি এসেছে আমি জানি না! চট্টগ্রাম সিআরবি অফিসে গেলাম, সরকারি চাকরি মানেই ঘুষ, অথচ তারা নিঃস্বার্থভাবে চার পাঁচজন অফিসার আমাকে নিয়ে এ টেবিলে ও টেবিলে দৌড়ালেন৷ উচ্চতর কর্মকর্তা দিয়ে রাজশাহী একের পর এক ফোন করালেন৷ কারণ তাঁরা কেন জানি দেখেই ধরে নিলেন, এই ছেলেই চাকরিটা ডিজার্ভ করে! ফোনে বলতে শুনলাম, আমার জেলায় নেওয়া হবে তিনজন, সেখানে সবচেয়ে বেশি মার্ক আমার পাওয়া৷ একটা দিন যদি সময় দেওয়া হয় ছেলেটা উপস্থিত হতে পারবে! রেলওয়ে পশ্চিম নিয়ম ভেঙে আমার জন্য আলাদা ব্যবস্থা করতে রাজি হলেন না৷ হবার কথাও না৷ সবকিছুরই তো নিয়ম থাকে৷
আমার কোন ঠিকানা ছিল না কখনও, আমার অনিশ্চিত সব ঠিকানায় চাকরির নোটিশ এসেছে কয়েকবার, কিন্তু কোন ব্যক্তির ব্যক্তিগত চিঠি আসেনি৷ চাঁদপুর যাবার সময় ট্রেনে এক ছেলের সাথে পরিচয় হল, ঠিকানা বিনিময় হল, চিঠি দিলাম, সে চিঠিও আসেনি৷
আমার তবু চিঠি লিখতে ইচ্ছে করে, খোলা চিঠি, আবেগে চোখে জল এসে যায়, হাউমাউ করে কাঁদতে ইচ্ছে করে এমন চিঠি৷ যে কথা তোমাকে বলতে পারিনি, ঠিকঠাক বোঝাতে পারিনি, সেই চিঠি!
একদিন লিখব, সুইসাইড নোটে হলেও একদিন লিখব৷ পূর্ববর্তী তোমার জন্য চিঠি, অবর্তমানের চিঠি৷ একদিন ঠিকই চিঠিটা লিখব৷
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জুন, ২০২৩ রাত ১২:১১

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




