somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

উত্তর মেরুতে নিশি রাতে সূর্য দর্শন - পর্ব ৮ (সমাপ্ত)

০৭ ই ডিসেম্বর, ২০২০ ভোর ৪:৪১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


গতকাল বাসায় এসে পৌঁছতে অনেক রাত হয়েছিল। তারপরেও সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয় নাই। কারণ ভোর ৪টায় বাইরে ঝকঝকে রোদ। এত আলোর মধ্যে আর ঘুম আসে না। এখানে আসার পর থেকেই আমাদের খাওয়া-দাওয়া, ঘুম, গোসল সব উল্টোপাল্টা হয়ে গেছে। এখানে প্রায় ২৪ ঘণ্টা সূর্যের আলোর কারণে আমাদের বায়োলজিক্যাল ক্লক ক্রাস করেছে অনেক আগে! দিনের বেশিরভাগ সময় ভ্রমণের মধ্যে থাকি। তাই ঘড়ির সময় দেখে সবকিছু নিয়ম মাপিক করা সম্ভবও নয়। অর্থাৎ যখন ক্ষুধা লাগে তখন হাতের কাছে যাই পাই তাই খাই। সম্ভব হলে চলার পথে লেক বা সৈকতে গোসলও সেড়ে ফেলি। সারাদিনে সময়-সুযোগ বুঝে একবার কয়েক ঘণ্টার জন্য ঘুমায়। এভাবেই চলেছে।

আজ আমাদের ভ্রমণের শেষ দিন। তল্পিতল্পা ঘুছাতে হবে, কটেজ পরিষ্কার করতে হবে, গাড়ি পরিষ্কার করতে হবে এবং কিছু কেনাকাটাও করতে হবে। ট্রেন নরওয়ের নেরভিক থকে বিকাল সোয়া ৩টায় ছেড়ে কিরুনা এসে পোঁছবে সাড়ে ছয়টায় এবং স্টকহোম গিয়ে পৌঁছবে পরের দিন সকাল সাড়ে ৯টায়। সকালে ঘুম থেকে উঠে লাগেজ গুছিয়ে ও ঘর পরিষ্কার করে ভাবলাম আর কোথায়ও যাওয়া যাই কিনা। এখনো হাতে প্রায় ৫ ঘণ্টা সময় আছে। কিরুনা থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে Esrange Space Center নামে একটি স্পেস সেন্টার রয়েছে। এই স্পেস সেন্টার থেকে মহাশূণ্যে গবেষনার জন্য স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করা হয়। তাছাড়া রয়েছে বড় বড় অনেকগুলো রাডার যেগুলো মহাশূন্যের বিভিন্ন স্যাটেলাইটের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে। ঝটিকা সফরে এটি পরিদর্শনের জন্য বেরিয়ে পড়লাম।

SSC – Esrange Space Center


Esrange Space Center-এর যাবতীয় কার্যাবলী পরিচালিত হয় সুইডেনের সরকারি মালিকাধীন Swedish Space Corporation সংস্থা। স্পেস সেন্টারে প্রবেশের গেইটের পাশে Esrange Visitor Center নামে আলাদা একটি ভবন আছে। এটি কাছের ও দূরের দর্শণার্থীদের জন্য সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৬টা পর্যন্ত খোলা। এখানে অনেকটা জাদুঘরের গ্যালারীর মতো রকেট ও স্যাটেলাইটের বিভিন্ন যন্ত্রপাতি সাজানো আছে এবং সাথে সব ধরনের তথ্যও দেওয়া আছে। তাছাড়া দর্শণার্থীরা স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের মাঠে গিয়েও ঘুরে দেখতে পারে। এখানে ঢুকতে কোনো টাকা বা টিকেট লাগে না। পাহাড়াদার, গাইডার বা কোন কর্মচারী নাই! যে কয়েকজন লোক দেখলাম সবাই দর্শণার্থী। একজন দর্শণার্থীর যা যা জানার দরকার সবকিছুই যথাযথ স্থানে লেখা আছে। এক জায়গায় টেবিলের উপর কয়েক রকমের বিস্কুট, বড় বড় থার্মোপ্লাস্কে চা ও কফি রাখা আছে। পাশেই বড় করে লেখা "এগুলো দর্শণার্থীদের জন্য"। Esrange Space Center-এর প্রশাসনিক কার্যালয় ও গবেষনাগার একটু দূরে আরেকটি ভবনে। আমাদের হাতে সময় কম, তাই বিস্তারিতভাবে সবকিছু দেখা ও পড়া সম্ভব হয়নি। সবদিক দিয়ে ঘুরেফিরে যখন গেট দিয়ে বের হতে লাগলাম তখন দেখি সব দর্শণার্থীদের চোখেমুখে একই প্রশ্ন, 'এই স্পেস সেন্টার যারা দেখাশুনা করে এবং যারা এখানে কাজ করে তাদের কাউকেই দেখলাম না! এরা সবাই গেল কোথায়?'

ফেরার পথে শেষ কেনাকাটা করার জন্য গেলাম সুপার মার্কেটে। মার্কেটের পাশেই চোখে পড়লো আমাদের গাড়ির রেন্ট-এ-কারের অফিস। প্রথম দিন কিরুনা রেল স্টেশনে গাড়ি রিসিভ করার সময় ওদের কর্মচারী আমাকে বলেছিল, ফিরে যাওয়ার সময় গাড়ি কিরুনা রেল স্টেশনে রেখে গেলেই চলবে। তবুও ভাবলাম, এভাবে গাড়ি রেখে গেলে সারাটা পথ আমার টেনশনে থাকতে হবে। কারণ পার্কিং-এ কেউ গাড়িটির কোনো ক্ষতি করলে আমার দোষ হবে। ওদের অফিসেই গাড়িটি ফেরত দিয়ে গেলে সবচেয়ে নিরাপদ। তাই রেন্ট-এ-কারের অফিসে ঢুকে রিসেপশনের মেয়েটিকে বললাম, 'আমরা তো আজ বিকালে চলে যাচ্ছি, তোমরা যদি চাও আমি তোমাদের গাড়ি এখন এখানে ফেরত দিয়ে দিতে পারি।' সে জিজ্ঞাসা করলো, আমরা কিরুনা থেকে ট্রেনে নাকি প্লেনে যাবো। আমি বললাম, ট্রেনে। সে জানতে চাইলো, আমরা হোটেল/কটেজ থেকে ট্রেন স্টেশনে কিভাবে যাবো। আমি একটু হেসে বললাম, হেঁটে বা ট্যাক্সি নিয়ে চলে যাবো, কোনো সমস্যা হবে না। মেয়েটি কিছুটা আশ্চর্য্য হয়ে বললো, 'তুমি শধু শুধু এত কষ্ট করতে যাবে কেন, গাড়ি তুমি বিকাল পর্যন্ত রাখতে পারো এবং যাওয়ার সময় স্টেশনে রেখে গেলেই হবে। এর জন্য তোমাকে তো অতিরিক্ত টাকা দিতে হচ্ছে না!' আমি সরলতার ভাব নিয়ে 'ঠিক আছে, তাই হবে' বলে ওকে ধন্যবাদ দিয়ে চলে আসলাম।

কিরুনা স্টেশনে এসে যথাস্থানে গাড়ি ও গাড়ির চাবি জমা রেখে ওয়েটিং রুমে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছি। ছয় দিনের ভ্রমণে যতটুকু ঘুরে বেরিয়েছি মোটামুটি মন্দ নয়। উল্লেখ্য, উত্তর সাগরের তীরে নরওয়ের উত্তর দিকের শেষ শহর Nordkapp (North Cape - ইংরেজি)। এখানে পৃথিবী তথা ইউরোপ মহাদেশের উত্তর দিকের মূল ভূখণ্ডের শেষ প্রান্ত। পৃথিবীর মূল ভূখণ্ডের একেবারে উত্তরের এই শেষ প্রান্ত পর্যন্ত যাওয়ার যে সুযোগটি ছিল তা আগে থাকে ধারণা না থাকা ও পূর্ব পরিকল্পনার অভাবে মিস্ করেছি। এই একটা আফসোস নিয়েই ফিরে যেতে হচ্ছে। যা-ই হোক, সেখানে যেতে না পারলেও স্থানীয় পর্যটন সংস্থা থেকে যা জেনেছি তার সাথে নেট থেকে নেয়া কিছু তথ্য যোগ করে ভবিষ্যতের পর্যটকদের সুবিধার্থে এখানে তুলে ধরলাম।

North Cape


North Cape (উত্তর অন্তরীপ) নরওয়ের উত্তরের শেষ প্রান্তে অবস্থিত একটি জেলা শহর। নেরভিক থেকে গাড়ি বা বাসে সেখানে যাওয়া যায়, দূরত্ব প্রায় ৮০০ কিলোমিটার, সময় লাগবে প্রায় ১২ ঘণ্টা। অর্থাৎ সেখানে একদিন একরাত থাকলে যাওয়া-আসাসহ কমপক্ষে মোট তিনদিন দরকার। নরওয়ের বন্দরনগরী বারগেন ও নেরভিক থেকে প্রমোদতরীতে নৌপথেও নর্থ কেপে যাওয়া যায়। নর্থ কেপের আয়তন ৯৯০ বর্গকিলোমিটার, জনসংখ্যা মাত্র ৩০০০। একটি শহর হওয়ার মতো যথেষ্ট জনসংখ্যা না থাকলেও ভৌগলিক গুরুত্ব ও পর্যটকের সংখ্যার ওপর ভিত্তি করে ১৯৯৬ সালে নর্থ কেপ শহরের মর্যাদা লাভ করে। উত্তর মেরুর কেন্দ্র বিন্দু থেকে নিকটস্থ শহর (২০০০ কিলোমিটার) নর্থ কেপ। উত্তর দিকে পৃথিবীর (ইউরোপের) স্থলভাগের এখানেই শেষ। এরপর উত্তর মহাসাগর। শীতকালে এই সাগরের বেশিরভাগ বরফে ঢাকা থাকে। উত্তর মেরুর বেশিরভাগ এলাকা জুড়ে সারা বছরই তুষার, বরফ আর হিমবাহ। নিশিরাতে সূর্য দেখার জন্য বিশেষ করে জুন - আগস্ট মাসে প্রচুর পর্যটক আসে এই শহরে। এই তিন মাস এখানে গ্রীষ্মকাল। যদিও তাপমাত্রা আমাদএর দেশের শীতকালর মতো। তবে এই সময় এখানে দিনরাত ২৪ ঘন্টা সূর্যের আলো থাকে। এই শহরটি আরো কয়েকটি কারণে বিখ্যাত: আটলান্টিক মহাসাগর উত্তর মহাসাগরের সাথে মিলিত হয়েছে এখানেই। তাছাড়া বরফে ঢাকা উত্তর সাগরে চলাচলের উপযোগী বিশেষভাবে নির্মিত আইসব্রেকার জাহাজে করে উত্তরমেরুর হিমবাহ পরিদর্শনের ব্যবস্থা এবং এখানকার ব্যতিক্রমধর্মী প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের জন্যও এটি বিখ্যাত। নরওয়ের উত্তরভাগের বেশিরভাগ উপকূলীয় এলাকা হচ্ছে fiord, fjord [ফিওড্‌] অর্থাৎ লম্বা, সরু ও পর্বতঘেরা উপসাগর বা সামুদ্রিক খাঁড়ি। এই সামুদ্রিক খাঁড়ি দিয়ে বিলাসবহুল প্রমোদতরীতে বিভিন্ন দেশ থেকে প্রচুর পর্যটক এই পথে উত্তর সাগরে ভ্রমণ করতে আসে।



Svalbard archipelago

আরো মজার বয়াপার হচ্ছে, নর্থ কেপ থেকে ১০০০ কিলোমিটার উত্তরে আর্কটিক সাগরে Svalbard নামে নরওয়ের একটি দ্বীপপুঞ্জ রয়েছে। এই দ্বীপপুঞ্জের মোট আয়তন ৬১,০২২ বর্গকিলোমিটার ও লোকসংখ্যা মাত্র ২৫০০ জন। দ্বীপগুলির মধ্যে সবচেয়ে বড়টির নাম ষ্পিৎসবের্গেন। এখানে একটি হাসপাতাল ও একটি স্কুল রয়েছে। প্রশাসনিকভাবে দ্বীপপুঞ্জটি নরওয়েজীয়ান সরকার কর্তৃক নিযুক্ত একজন প্রশাসক শাসন করেন। এই দ্বীপপুঞ্জের প্রধান তিনটি শিল্প হলো কয়লার খনি, পর্যটন ও গবেষণা কেন্দ্র। উত্তরমেরুর বরফ আচ্ছাদিত হিমবাহ অঞ্চল এখান থেকে বেশি দূরে নয়। তাই মেরু ভালুক (Polar bear) ও হিমবাহ (Glacier) দেখতে নর্থ কেপ থেকে জাহাজে করে হাজার হাজার পর্যটক এই Svalbard দ্বীপপুঞ্জে বেড়াতে আসে।


উল্লেখ্য, একটি কোম্পানী বিলাসী পর্যটকদের জন্য আগামী বছর সাগরপথে দক্ষিণ মেরু থেকে উত্তর মেরু পর্যন্ত দীর্ঘ এক নৌবিহার চালু করতে যাচ্ছে।
(উত্তর মেরু অভিযাত্রা সম্পর্কে জানতে চাইলে পড়ুন: উত্তরের যাত্রা - শেষ পর্ব : সুমেরুর ভৌগলিক কেন্দ্রবিন্দু অভিমুখে যাত্রার কিছু সচিত্র বিবরণ - ব্লগার এম এ আলী)

ট্রেনে ফিরতি যাত্রা

যথাসময়ে ট্রেন এসে হাজির। আমরা উঠে আমাদের নির্ধারিত সিটে চলে গেলাম। আসার সময় ট্রেন থেকে দুপাশের প্রকৃতিক দৃশ্য দেখা হয়েছিল। তাই এখন আর তেমন উৎসাহ নাই। তাছাড়া আমরা খুবই ক্লান্ত। তাই ঘণ্টা খানেক পরে ট্রেনের রেস্টুরেন্ট বগিতে খাওয়াদাওয়া সেরে ঘুমিয়ে পড়লাম। ক্লান্ত শরীরে শীততাপ নিয়ন্ত্রিত কামরায় ট্রেনের সামান্য ঝাকুনিতে ম্যারাথন একটা ঘুম দিলাম। ঘুম থেকে যখন জাগলাম তখন ট্রেন থেমে আছে। মনে হলো কোনো স্টেশনে থেমে আছে। রুমের মধ্যে সামান্য গরমও মনে হচ্ছে, লাইটের আলোও কম। জানালা দিয়ে দেখলাম গভীব বন। রুম থেকে বেরিয়ে করিডোরে গিয়ে দেখলাম ট্রেনের বেশিরভাগ যাত্রী এখানে, কেউ হাঁটাহাটি করছে কেউ জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের রুমের একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম, কী ব্যাপার, ট্রেন ছাড়ছে না কেন! সহযাত্রী কিছুটা অবাক হয়ে উত্তর দিলেন, 'ট্রেন এখানে থেমে আছে এখন এক ঘন্টা থেকে বেশি হয়ে গেছে, আরো দেড় ঘন্টা থেমে থাকবে।' আমরা এতক্ষণ ঘুমে থাকায় এসববের কিছুই বুঝতে পারি নাই। বিস্তারিত খবর নিয়ে জানলাম যে, ট্রেন চলার সময় এখানে রেল লাইনের উপরের বিদ্যুতের তাঁর স্পার্ক করে ছিড়ে পড়ে গেছে। লাইনে এখন বিদ্যুৎ নেই, তাই বিদ্যুৎচালিত ট্রেনটি থেমে আছে। এটা নাকি ১২০০০ ভোল্টের লাইন। তাই রেলওয়ের নিজস্ব টেকনেসিয়ান ছাড়া অন্য কেউ মেরামত করতে পারবে না। আজ আবার রবিবার, এই এলাকার কাছের শহরের রেলওয়েয়ে অফিস বন্ধ। ১০০ কিলোমিটার দূরের এক শহর থেকে রেলওয়ের ইলেক্ট্রিশিয়ান সহকারী ও যন্ত্রপাতি নিয়ে গাড়ি করে রওয়ানা দিয়েছে। এখানে এসে পৌঁছতে এক ঘন্টারও বেশি সময় লাগবে। ট্রেনের গার্ড কিছুক্ষণ পরপর ঘোষণা দিয়ে অবস্থার আপডেট জানাচ্ছে। তবে বারবার সাবধান বাণী দিচ্ছে কেউ যেন ট্রেন থেকে না নামে। কারণ ছেড়া তাঁরে হাই ভোল্টেজের বিদ্যুৎ রয়েছে। এই কয়েক ঘন্টায় কোন যাত্রী ট্রেন থেকে নামার চেষ্টাও করে নাই। এরমধ্যে আবার ঘোষণা দিলেন ক্ষুধার্থ যাত্রীদের জন্য রেস্টুরেন্টের খাবার ফ্রী। অন্যান্য যাত্রীদের সাথে আমরাও রেস্টুরেন্টের দিকে গেলাম। খাবারদাবার কিছু পেলাম। আধ ঘনন্টার মধ্যেই সব খাবার শেষ।


কয়েকজন যাত্রীকে বেশ উদগ্রীব মনে হলো। কারণ ট্রেন লেটের কারণে স্টকহোম থেকে তাদের অন্য শহরে যাওয়ার কানেকটিং ট্রেন/বাস মিস হবে। ট্রেনের কর্মচারীটি এইসব যাত্রীদেরকে আশ্বাস দিলেন স্টকহোম থেকে তাদেরকে গন্তব্যে পৌঁছার বিকল্প ব্যবস্থা করা হবে। বিদ্যুৎ না থাকায় ট্রেনের শীততাপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র বন্ধ, ট্রেনের রিজার্ভ ব্যাটারি দিয়ে লাইটগুলোকে সচল রাখা হলেও আলো অনেকটা কম। যা-ই হোক,অনেক প্রতীক্ষার পর টেকনিসিয়ানরা আসলেন এবং অনেক পরিশ্রম করে বৈদ্যুতিক তাঁরের সংযোগ আবার পুনস্থাপন করলেন। ট্রেন আবার হারানো যৌবন ফিরে পেয়ে চলতে শুরু করলো, আমরা যাত্রীরাও স্বস্তি ফিরে পেলাম। স্টকহোম পৌঁছার আগেই ট্রেনের মাইকে ঘোষণা এলো, যারা কানেকটিং ফ্লাইট/ট্রেন/বাস মিস করেছে তারা যেন স্টকহোম স্টেশনে ইনফরমেশন ডেস্কে যোগাযোগ করে। ট্রেনটি সোয়া তিন ঘন্টা দেরি করে স্টকহোম স্টেশনে এসে থামলো। এতে আমাদের ফ্লাইট মিস হবে না। স্টকহোমে কয়েক ঘন্টা ঘুরতে পারতাম সেটা এখন আর হবে না। তাই আমরা আর ইনফরমেশন ডেস্কে গেলাম না, গিয়ে হয়তো বলতে পারতাম - 'ফিরিয়ে দাও আমাদের সেই তিন ঘন্টা সময়।' আসলে সেটা ছিল একটা অনাঙ্খাকিত দুর্ঘটনা। তবে মেরামত করার জন্য তিন ঘন্টা সময় আমার কাছে একটু বেশি্ই মনে হলো।

বিকল্প ফিরতি যাত্রা

কিরুনা থেকে অসলো হয়ে স্টকহোমে ফিরে আসার রেলপথ

স্টকহোম থেকে কিরুনা ট্রেনে যে পথে গিয়েছি, আবার একই পথে ফেরত আসা ঠিক হয়নি। কারণ অন্য একটা পথ ধরে আসলে আসার সময় আরো কিছু নতুন জায়গা দেখতে পারতাম। ফিরতি বিকল্প পথটা হতে পারতো: কিরুনা থেকে ট্রেনে নরভিক, নরভিক থেকে বাসে বোধো, সেখান থেকে ট্রেনে নরওয়ের রাজধানী অসলো। অসলো থেকে আবার ট্রেনে স্টকহোম। শেষ মুহুর্তে পথ পরিবর্তনের চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। তাই সম্ভব হয়নি। সেভাবে আসতে পারলে ট্রেনের জানালা দিয়ে প্রায় পুরো নরওয়ে দেখা হয়ে যেতো! সেইসাথে সুইডেনের উত্তর অংশের কিছু এলাকাও দেখতে পারতাম। যাই-হোক এখন আর আফসোস করে লাভ নেই, তবুও ধারণাটি আগামী দিনের পর্যটকদের সুবিধার্থে এখানে উল্লেখ করলাম।

ট্রেন বিলম্বের কারণে স্টকহোম শহরে আর ঘোরাঘুরি করতে পারলাম না। স্টকহোম সেন্ট্রাল স্টেশনের পাশেই দুরগামী বাসের টার্মিনাল। সেখান থেকে এয়াারপোর্ট ট্রানজিট বাসে বিমানবন্দরে চলে আসলাম। সময় লাগলো ৩০ মিনিট। আমাদের প্লেন ছাড়বে আরো প্রায় তিন ঘণ্টা পর। দীর্ঘ ট্রেন ভ্রমণে শারীরিকভাবে বেশ ক্লান্ত হলেও সহি-সালামতে পুরো ভ্রমণটা শেষ করতে পারায় মানসিকভাবে বেশ রিলাক্স বোধ করছি। কিছুক্ষণের মধ্যে চেক ইন সেড়ে 'উত্তর মেরুতে নিশি রাতে সূর্য দর্শন' ভ্রমণের ইতি টেনে সুইডেনকে বিদায় জানিয়ে বিমানে উঠে পড়লাম।

আমার এই ভ্রমণের অভিজ্ঞতা দিয়ে পুরো সুইডেন সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করা ঠিক হবে না। কারণ আমি সুইডেনের কোনো বড় শহরে যাইনি বা যাওয়ার সময় হয়নি। তাছাড়া আমি যেখানে গিসেছি সরটি মূলত পর্যটক এলাকা। সেখানে প্রতিদিন যেসব লোক দেখেছি তার ৭০ ভাগই বিদেশি পর্যটক। আমার কাছে সবচেয়ে বেশি আকর্ষনীয় মনে হয়েছে এ দেশের বনশিল্প।

সুইডেনের বনজ সম্পদ (Forest)


আমার কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় মনে হয়েছে সুইডেনের বনাঞ্চল। যেখানে যাই না কেন সাজানো-গুছানো বনাঞ্চল চোখে পড়বেই। এমন কি শহরের আশেপাশেও! অর্থাৎ এরা বনকে সংরক্ষন করেই পাশাপাশি নগরায়ন করেছে। বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, বৃক্ষ নিধন ও জ্বালানী সংকটের কারণে ছোট হয়ে আসছে বনাঞ্চল। অথচ সুইডেনে ১০০ বছরেরও কম সময়ে বনজ সম্পদ বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে গেছে। যেহেতু বন সংকোচনের হার প্রবৃদ্ধির হারের তুলনায় কম, বনের পরিমাণ বার্ষিক নিট বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। সুইডেনের স্থলভাগের ৭০ শতাংশ এলাকা মূলত বন দ্বারা আচ্ছাদিত। সুইডেনের প্রায় সমস্ত বনকে cultured forest হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারে, যার অর্থ এই বনাঞ্চলে নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচর্যার মাধ্যমে গাছের চাষ করা হয়। কেবল উত্তরের পর্বতমালার অঞ্চলগুলিতে ভার্জিন বনাঞ্চলের অঞ্চল রয়েছে, যা কৃষি বা সিলিকালচার দ্বারা প্রভাবিত হয়নি। এগুলিকে বলা হয় প্রাকৃতিক বন। সুইডেনের বনাঞ্চলে উৎপাদিত বৃক্ষের মধ্যে প্রায় ৪৫ শতাংশ আসবাবপত্র তৈরির কাঠে, ৪৫ শতাংশ কাগজ তৈরির পাল্প শিল্পে এবং ১০ শতাংশ আগুনের কাঠ, খুঁটি ইত্যাদিতে পরিণত হয়।

বিভিন্ন রকমের গাছপালার ভিত্তিতে ভাগ করলে সুইডেনের বনভূমির ৮৩ শতাংশ coniferous forest (চোঙাকৃতি ফলবিশিষ্ট/ফলপ্রদায়ী), মিশ্র বন ১২ শতাংশ এবং খাঁটি deciduous বন (পাতা ঝরে যায় এমন; পর্ণমোচী) পাঁচ শতাংশ। বনের আয়তনে ৪২ শতাংশে রয়েছে ফার গাছ, তারপরে ৩৯ শতাংশে পাইন, ১২ শতাংশ বার্চ এবং ৭ শতাংশে অন্যান্য পাতলা গাছ রয়েছে। গাছের প্রজাতির ধরণ দেশের সর্বত্র এক নয়। পাইস শুকনো, দরিদ্র মাটি পছন্দ করে তবে ফারগুলি সমৃদ্ধ, স্যাঁতসেঁতে এবং উর্বর মাটিতে জন্মে। পাইন অরণ্য তাই উত্তর সুইডেন এবং গটল্যান্ড দ্বীপে আধিপত্য বিস্তার করে, অন্যদিকে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে ফার বন সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। বার্চ, অ্যাস্পেন এবং অলডার সারা দেশে জন্মায়। সুইডেন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম কাগজ, কাগজের মণ্ডা এবং কাঠের পণ্য রফতানিকারী দেশ (২০১১)। এর রফতানি মূল্য প্রায় ১৬ বিলিয়ন ইউএস ডলার। সুইডেনের বনশিল্পে ৬০,০০০ লোক সরাসরি কাজ করে এবং এর সরবরাহকারীদের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আরো ২ লক্ষ লোকের আয়-রুজি এই শিল্পের সাথে জড়িত। বিশেষ করে পার্বত্য অঞ্চলের পাথরের উপরে লম্বা লম্বা দীর্ঘ বৃক্ষের সবুজ বন দেখলে খুবই আশ্চর্য্য লাগে, পাথরের ওপরে এত বড় গাছগুলো দাঁড়িয়ে আছে! তাছাড়া পাথরের উপরিভাগে সামান্য মাটিতে এই গাছগুলো বেঁচে থাকে কেমনে! আমাদের ছাদ বাগানে ফুলের টবেও এর থেকে বেশি মাটি থাকে।

(সূত্র: Swedish wood)

তাছাড়া সুইডেনের যে কয়েকটা বৈশিষ্ট্য আমার চোখে পড়েছে তা হলো:

+ খুবই নিরিবিলি ও শান্তির দেশ
+ আয়তনের তুলনায় লোকসংখ্যা কম
+ পুরো দেশটাই সাজানোগুছানো ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন
+ এখানকার লোকেরা ভদ্র, সৎ এবং আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল
+ চুরি-ডাকাতি, খুন-রাহাজানি প্রায় নেই বললেই চলে
+ শহরের কেন্দ্রবিন্দু থেকে শুরু করে গভীর অরণ্য সবকিছুতেই পরিচর্যার ছাপ লক্ষণীয়
+ নির্জন সৈকত থেকে শুরু করে গভীর অরণ্য যেখানেই যায় না কেন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে হয় না
+ দেশের সরকার থেকে শুরু করে আপামর জনসাধারণ সবাই প্রকৃতির প্রতি যত্নশীল
+ বিশেষ করে গ্রীষ্মকালে (জুন - আগস্ট) প্রকৃতি খুবই সুন্দর

– স্থানীয় লোকেরা ইংরেজি বলতে চায় না, বিদেশিদের সাথেও সুইডিশ ভাষা বলতে আগ্রহী
– জিনিসপত্রের দাম তুলনামুলকভাবে বেশি
– জনবসতি খুব কম হওয়ার কারণে মফস্বল এলাকায় পাবলিক ট্রান্সপোর্ট তুলনামূলকভাবে কম
– আবহাওয়া খুবই পরিবর্তনশীল, ঝকঝকে রোদ দেখে ঘর থেকে বের হলেও মেঘ/বৃষ্টি/শীতের জন্য প্রস্তুতি নিয়ে বের হতে হয়।

ফটো গ্যালারি:

১।

থ্রমসো শহর নেরভিক থেকে ২৩০ কিলোমিটার উত্তর অবস্থিত। থ্রমসো একটি উপজেলা, আয়তন ২৫২১ বর্গকিলোমিটার, জনসংখ্যা ৭৭,০০০ জন।

২।

নরওয়ের গিরিখাত দিয়ে প্রমোদতরী চলার দৃশ্য

৩।

এই জাহাজটি নর্থ কেপ থেকে পর্যটক নিয়ে উত্তর সাগরের বিভিন্ন দ্বীপ হয়ে হিমবাহ পর্যন্ত যায়।

৪।

উত্তর সাগরে খুব কাছ থেকে স্বচক্ষে পর্যটকদের হিমবাহ পরিদর্শনের দৃশ্য

৫।

SeaDream Innovation নামে বিলাসবহুল প্রমোদতরীটি ৮৮ দিনে দক্ষিণ মেরু থেকে উত্তর মেরু পর্যন্ত সমুদ্রযাত্রা শুরু করবে ২০২২ সালে। এই জাহাজটিতে রয়েছে ২১০টি বিলাসী স্যুট, যেগুলোর প্রত্যেকটির জানালা দিয়ে বাহিরের দৃশ্য দেখা যাবে।

৬।

সুইডেনের দিগন্ত বিস্তৃত চোখ জুড়ানো বনাঞ্চল যা দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য ও অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করেছে।

_________________________________________
তথ্য ও ছবিসুত্র: কিছু নিজের, কিছু ইন্টারনেট থেকে নেওয়া

     ◄ পর্ব ৭ - উত্তর মেরুতে নিশি রাতে সূর্য দর্শন - পর্ব ১ ◄◄
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই ডিসেম্বর, ২০২০ রাত ৩:২৯
২টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:০২



ইউটিউব হুজুর বললেন, মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে। তখন নাকি নিজ যোগ্যতায় ঈমান রক্ষা করতে হয়। আল্লাহ নাকি তখন মুমিনের সহায়তায় এগিয়ে আসেন না। তাই শুনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×