ছোটবেলায় শুনেছি উত্তর মেরুতে ছয় মাস দিন, ছয় মাস রাত! তখন শিশুসুলভ মনে অবাক হয়ে ভাবতাম সেখানে মানুষ কেমনে বাস করে! তারা কী এক নাগাড়ে ছয় মাস ঘুমায় ও ছয় মাস জেগে থাকে, রোজার দিনে কী ওরা একনাগাড়ে ছয় মাস না খেয়ে থাকে—অনেক রকমের প্রশ্ন জাগতো মনে। আমাদের (জেনারেশন এক্স) শিশুবেলা এমন একটা সময়ে কেঠেছে যখন এ ধরনের অনেক প্রশ্নের সঠিক উত্তর শিক্ষক বা অভিভাবক থেকে জানা সম্ভব হতো না। "মাথায় কত প্রশ্ন আসে দিচ্ছে না কেউ জবাব তার"–যার কারণে আমরা অনেক কিছু সম্পর্কে ভুল ধারণা নিয়ে বড় হয়েছি। এখন আমি নিজেই শিশুর পিতা এবং সুমেরু অঞ্চলে গিয়ে আমার ছোটবেলার সেইসব প্রশ্নের উত্তর স্বচক্ষে দেখার সুযোগ ও সামর্থ্যও আমার রয়েছে। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম জুনের শেষ সপ্তাহে নিশিত সূর্য্য দেখার জন্য উত্তর মেরুর কাছাকাছি কোনো দেশে ভ্রমণ করতে যাবো।
সুমেরু অঞ্চল
সুমেরু অঞ্চল বা আর্কটিক (ইংরেজি: Arctic) পৃথিবীর সর্ব উত্তরের অঞ্চলটির নাম। ইংরেজি নামটি এসেছে গ্রিক শব্দ arktos থেকে যার অর্থ "ভালুক"। সাধারণত সুমেরু অঞ্চলের সীমানা হিসেবে সুমেরু বৃত্তকে (Arctic circle) নির্ধারণ করা হয়, যা বিষুব রেখা থেকে ৬৬ ডিগ্রি ৩০ মিনিট উত্তরে কল্পিত একটি গাণিতিক রেখা। এই রেখার উত্তরের সকল স্থানে বছরে অন্তত একটি এমন সময় আসে যখন ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সূর্য একবারও অস্ত যায় না, এবং আরেক ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সূর্য একবারও উদিত হয় না। মোট ৮টি রাষ্ট্রের (কানাডা, রাশিয়া, ডেনমার্ক, নরওয়ে, যুক্তরাষ্ট্র, সুইডেন, ফিনল্যান্ড ও আইসল্যান্ড) সর্বউত্তরের স্থানগুলো সুমেরু অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত। ভৌগোলিকভাবে নরওয়েকে নিশীত সূর্যের দেশ বলা হলেও সুমেরু অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত যে কোনো এলাকা থাকেই নিশীত সূর্য দেখা যায়। তবে সবচেয়ে সুবিধাজনক স্থান হলো নরওয়ের উত্তর প্রান্ত অর্থাৎ ত্রমসো (Tromso), এরপর হলো সুইডেনের উত্তরাঞ্চল কিরুনা (Kiruna)। যোগাযোগ ব্যবস্থা, ভৌগোলিক অবস্থান ও ভূপ্রকৃতি বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিলাম সুইডেনের সর্বউত্তরের জেলা শহর কিরোনাতে গিয়েই অবস্থান করবো এবং সেখান থেকে গাড়ি নিয়ে আশাপাশে ঘুরে দেখবো এবং সড়কপথে নরওয়ের উত্তর প্রান্তে যতটুকু যেতে পারি যাওয়ার চেষ্টা করবো।
নিশিরাতের সূর্য এবং মেরুজ্যোতি
সুমেরু অঞ্চলের বিস্ময়কর নৈসর্গিক প্রপঞ্চ (natural phenomena) দুটি: নিশিরাতের সূর্য এবং মেরুজ্যোতি বা মেরুপ্রভা বা আরোরা। মেরুজ্যোতি বা আরোরা হলো আকাশে একধরনের প্রাকৃতিক আলোর প্রদর্শনী। প্রধানত উঁচু অক্ষাংশের এলাকাগুলোতে আরোরা'র দেখা মিলে। আরোরা দেখতে অত্যন্ত সুন্দর। আরোরা নিয়ে প্রাচীনকালে অনেক উপকথা চালু ছিল। আরোরা সাধারণত দেখা যায় দক্ষিণ ও উত্তরের দেশগুলোতে। নিশিরাতের সূর্য এবং মেরুজ্যোতি সাধারণতএকই সময়ে দেখা যায় না। নিশিরাতের সূর্য দেখার সবচেয়ে ভালো সময় হলো জুন - জুলাই মাস। মেরুজ্যোতি দেখার জন্য আকাশ অন্ধকার থাকতে হয়। তাই সাধারণত গ্রীষ্মের আগে বা পরে মেরুজ্যোতি দেখার জন্য সবচেয়ে ভালো সময়।
ভ্রমন পরিকল্পনা:
ভ্রমণের মূল উদ্দেশ্য নিশি রাতে সূর্য দেখা। তাই সময়টা বেছে নিলাম জুনের শেষ সপ্তাহ। যেহেতু পৃথিবীর উত্তর পার্শ্বে যাচ্ছি তাই উত্তরে মেরুর দিকে যতটুকু যাওয়া যাই যাওয়ার চেষ্টা করবো। উল্লেখ্য, উত্তর মেরুর অধিকাংশ এলাকা জুড়ে উত্তর সাগর ও বরফের পাহাড় (গ্লাসিয়র)। সড়কপথে নরওয়ের সবচেয়ে উত্তরের শহর থ্রমসো পর্যন্ত যাওয়া যায়। সেইসাথে ফিনল্যান্ড, সুইডেন ও নরওয়ের উত্তর প্রান্তে ঘুরেফিরে দেখবো। পরিচিতদের মধ্যে কাউকে পেলাম না যাদের এ এলাকায় ভ্রমণের অভিজ্ঞতা আছে। তাই ইন্টারনেট থেকে তথ্য সংগ্রহ করে ভ্রমণের একটা পরিকল্পনা করে ফেললাম।
ভ্রমণের সময়কাল পাঁচদিন। ভ্রমণের আগেই অনলাইনে কিরোনা শহরে কটেজের একটি রুম বুক করেলাম (রুমের সাথে বাথরুম, কিচেন অন্য রুমের বাসিন্দার সাথে শেয়ার করতে হবে)। সেইসাথে সেখানকার রেন্ট-এ-কার অফিসে চারদিনের জন্য একটি গাড়িও অগ্রিম বুক করে নিলাম। আকাশ পথে স্টকহোম এসে সেখান থেকে ট্রেনে যাবো কিরোনা। সেভাবে টিকেটও কনফার্ম করে ফেললাম। রেলপথে স্টকহোম থেকে কিরোনার দূরত্ব ১২০০ কিলোমিটার সময় লাগবে প্রায় ১৫ ঘন্টা। ট্রেনে যাওয়ার উদ্দেশ্য - চলার পথে ট্রন থেকে সুইডেনের শহর-গ্রাম-প্রকৃতি দেখতে পাবো। বিশেষ করে গ্রীষ্মকালে ইউরোপের সব দেশের প্রকৃতিই ফুলে-ফলে খুব সুন্দর দেখায়। আমার ভ্রমণসঙ্গী আমার একমাত্র কন্যা, বয়স ১০ বছর।
যাত্রা তব শুরু
স্টকহোম বিমানবন্দরে এসে ইমিগ্রেশনের সব কাজ সেড়ে আরলান্ডা বিমানবন্দর থেকে স্টকহোম সেন্ট্রাল স্টেশনের ট্রেনে উঠলাম। ট্রেনের নাম আরলান্ডা এক্সপ্রেস, সময় লাগে মাত্র ২০ মিনিট। এটি এয়ারপোর্ট ট্রানজিট ট্রেন কোনখানে থামায় না। এক টানে দ্রুত গতিতে স্টকহোম সেন্ট্রাল স্টেশন। এখানে এসে পৌঁছলাম স্থানীয় সময় বিকাল ২ টায়। আমাদের কিরোনাগামী ট্রেন ছাড়ার সময় আরো চার ঘন্টা বাকী। ভাবছি এই কয়েক ঘন্টা আশেপাশে একটু ঘুরে দেখি। তারপর খাওয়া-দাওয়া সেড়ে কিছু প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করে যথাসময়ে স্টেশনে ফিরে আসবো।
তথ্য ও ছবিসূত্র: ইন্টারনেট
--------------------------------
কিছু কথা: আমি একজন ভ্রমণপ্রিয় মানুষ। এর আগে ব্লগে ভ্রমণ বিষয়ক কোনো পোস্ট লেখি নাই। কারণ ভ্রমণ কাহিনী লেখার সময় ব্যক্তিগত কিছু তথ্য ও ছবি না দিলে পোস্টকে নিরামিষ ও কৃত্রিম মনে হয়। আমি আবার ব্যক্তিগত ছবি অনলাইনে দেওয়া পছন্দ করি না। যা-ই হোক, কিছুদিন আগে সুইডেন প্রবাসী ব্লগার ওমেরার '' একটি ক্রিয়েটিভ উপস্থাপনা : আইস হোটেল পড়ে আমার অনেক দিন আগের এই ভ্রমণ কাহিনীটির কথা মনে পড়লো। সেই মনোমুগ্ধকর ভ্রমণ অভিজ্ঞতা এখানে সবার সাথে শেয়ার করলাম। ভ্রমণ কাহিনী লিখতে পরোক্ষভাবে নিজে উৎসাহিত হওয়ার জন্য ওমেরার প্রতি রইলো কৃতজ্ঞতা।
সুমেরু অঞ্চলে নিশি রাতে সূর্য দর্শন - পর্ব ২ ►
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে আগস্ট, ২০২০ বিকাল ৩:০৫