somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অফিসের গাড়ী ( ধারাবাহিক )

২৪ শে নভেম্বর, ২০১৪ রাত ৯:৫৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সাত –সে যে চলে গেল বলে গেল না

মতিয়র রহমান তাঁর পাগলাটে বউ আজমেরীকে নিয়ে সেই যে সেদিন চলে গেলেন তারপর থেকে রেহানার সংগে মতিয়র রহমানের আর দেখা হয়নি , কোন কথাতো নয়ই । কেননা সেই ঘটনার পর থেকে অফিসে আসার জন্য অন্য একটা রুটের গাড়ি ব্যবহার কোরছে রেহানা। কিন্তু, সেদিনের সে ব্যাপারটার পর থেকে ভেতরে ভেতরে কেমন যেন একটা অপরাধবোধে ভুগছিল সে । আহা , তার জন্যই বেচারা নির্বিবাদী মতিয়র রহমানের সংসারে এতো অনর্থক ঝামেলা !

কিন্তু সেই যে মানুষের মন বলে কথা ! তাঁকে আর মতিয়র রহমানকে নিয়ে আজমেরীর সেইসব পাগলামো বা সন্দেহের একটা সামান্য অংশ সত্যি হোলেও বোধকরি মন্দ লাগতো না রেহানার ।উহ, তাঁকে নিয়ে কেউ কোনদিন এমন সুন্দর সুন্দর কবিতা লিখতে পারে তা ভুলেও কোনদিন কল্পনা করতে পারেনি সে। শুনেছে বটে , কবিরা নাকি তাঁদের প্রিয়ার মুখকে কল্পনা কোরে দিস্তার পর দিস্তা কাগজ খরচ কোরে হিজিবিজি লিখে লিখে সারা জনম কাটিয়ে দেয়। কিন্তু তাঁর রুপের প্রশংসা কোরে রবি ঠাকুরের মতো এক ছত্রও লিখলো না কেউ আজ পর্যন্ত ! স্কুল কলেজে পড়ার সময় , তাঁর রুপে পাগল হোয়ে নাদান অনেক সহপাঠী পাতার পর পাতা প্রেমপত্র লিখেছে বটে কিন্তু কবিতা ? নাহ, আজ পর্যন্ত কেউ এমন সুন্দর সাহস দেখায়নি তাঁকে নিয়ে !

সেদিন বাসায় ফিরে আহাদকে সেই ঘটনার কথা বলি বলি কোরেও কিছুই বলতে পারেনি রেহানা ।আর এটা যে , মতিয়র রহমানের উপর সন্মান জানিয়ে তা যেমন ঠিক , তেমনি আহাদের ভয়েও । আসলে কেন জানি রেহানার মনে হয়েছে , এই তুচ্ছ ঘটনাটা স্বামীকে বললে , তার ফলাফল খুব একটা ভালো হবে না ।

প্রায় দু বছরের হয় বিয়ে হওয়ার পর, রেহানা তাঁর স্বামীকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ভেতরে ভেতরে অনেকবারই মূল্যায়ন করেছে । তাতে সে দেখতে পেয়েছে , স্বামী হিসাবে আর দশজন মানুষের চেয়ে বরঞ্চ একটু বেশীই ভালোবাসে সে রেহানাকে, তবে তাঁর দোষের মধ্যে রয়েছে এক মহাদোষ । আর তা হোল বউয়ের ছোটখাট ভুল ভ্রান্তি কিংবা বউকে উপলক্ষ্য কোরে ঘটে যাওয়া তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে বাড়ীর আর সবার সাথে মাতামাতি হাসাহাসি করা ।

এসব হালকা রসিকতা রেহানার তেমন ভাল্লাগে না । সে সবসময় একটু আলাদা ভাবেই মাথা উঁচিয়ে থাকতে চায় , অনেকটা উঁচু পাহাড়টার মতো । আর আহাদ যেন নদীর তরল জল। যে পাত্রে রাখা যায় , সহজেই সে পাত্রেরই আকার ধারণ করে । সে একটু বেশী ভালো । রাগ নেই । ক্রোধ নেই । আহাদের এই বেশী ভাল থাকা আর ছেলেমানুষিভাবটা রেহানার কোন কোন সময় ভালো লাগলেও সবসময় ভালো লাগে না !

আহাদের নিত্য অভ্যাস হোল অফিস থেকে ঘরে ফিরে কাপড় চোপড় ছাড়তে না ছাড়তেই চারদিকে বেশ একটা হৈ হুল্লোড় জমজামাট ভাব বাঁধিয়ে ফেলা । তাঁর সেই আনন্দ উচ্ছল চেঁচামিচিতে সেই মুহূর্তে বাড়ীতে বেশ একটা ঈদ ঈদ ভাব এসে যায় । যেন আহাদের অপেক্ষায় এতক্ষণে নিঝুম বাড়ীটা প্রাণ খুঁজে পেল । আর পাবেই না বা কেন । সে এ বাড়ীর একমাত্র ছেলে । আর বড় ছেলে । প্রশাসনে বড় পদে সরকারী চাকুরী করে । তাঁকে ঘিরেই আবর্তিত হয় এ বাড়ীর অনেকগুলো মানুষের জীবন ! আশা ! ভালবাসা !

বাড়ীতে আছেন রেহানার শ্বাশুরী , মালেকা ফেরদৌস । যিনি বেশ অল্প বয়সে স্বামীকে হারিয়েও তিন ছেলে মেয়েকে নিয়ে পুরো সংসারটা সুন্দরভাবেই ম্যানেজ কোরে চলেছেন । আহাদেরই কেবল লেখাপড়া চাকুরি বিয়ে এসবের পালা শেষ হোয়েছে । এরপর রয়েছে আহাদের ছোট দুই বোন , রিনি আর ঝিনি । দুজনেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করে । বলতে গেলে ওরাই দীর্ঘদিন হয় অনেক খুঁজেখুঁজে বড় ভাই এর বউ হিসেবে রেহানাকে বেঁছে নিয়েছে ।

চাকুরিজীবি বউই নাকি প্রথম থেকে পছন্দ ছিল এ পরিবারের । কিন্তু বিয়ের আগে পাত্রপক্ষের এহেন কথা শুনে রেহানাদের বাড়ীর আর সবাই না বুঝেই বুঝি বেশ শঙ্কিতই হোয়ে পড়েছিল । তার মানে কি ? বউয়ের টাকা ছাড়া চলতে পারবে না তাঁরা ? এসব শুনেটুনে রেহানার ছোট চাচা তো প্রথম থেকেই এখানে বিয়ে দিতে ঘোর আপত্তি জানিয়েছিলেন । আসলে রেহানাদের মতো ব্যবসায়ী পরিবারের মেয়েদের এত লেখাপড়া কিংবা চাকুরী করার চল নেই । রেহানাই অনেক ব্যতিক্রম । সেই জেদ ধরেই লেখাপড়ার শেষ না করার আগে বিয়ের কথা নেই –এই কথাগুলো সত্যি সত্যি বাস্তবে পরিণত করেছিল সে। এরপর কলেজের সরকারী চাকুরি । আর চাকুরীজীবি ছেলে যে তাঁর পছন্দ একথাও জানতো তাঁর পরিবারের লোকেরা । অতএব সব মিলিয়ে আহাদকে যোগ্য পাত্র হিসেবেই মনে হয়েছিল সবার ।

যাই হোক শেষমেশ রেহানার বাবা নিজে থেকেই সেই পাত্রপক্ষের চাকুরীজীবি মেয়ে পছন্দের ব্যাপারটা বাড়ীর সবাইকে বুঝিয়েছিলেন এভাবে – কি এমন দোষের কথা বলেছে ছেলে পক্ষ । টাকাপয়সা তো চায়নি তাঁরা । নিদেনপক্ষে একটা ফ্লাট কিনবা গাড়ী । চাকরিজীবি মেয়ে তো চাইতেই পারে তাঁরা । ভাগ্যিস বলেনি- চাকুরীজীবি মেয়ের সাথে ছেলেকে বিয়ে দেবে না । এমনই তো বলে বেশীরভাগ প্রতিষ্ঠিত ছেলের মাবাবা ।

আসলে লেখাপড়া , চাকরীবাকরি , ঢাকাতে ডেপুটেশনে পোস্টিং আর বেশী বেশী বাছাবাছি এসব কোরে কোরে বিয়ের বয়সটাও হু হু কোরে বেড়ে চলছিল রেহানার ! তাতে করে বাবা মা বেশ শঙ্কিতই হোচ্ছিলেন !

যা হোক বিয়ের পর , আহাদকে নিয়ে রেহানার মনে একটা আজে বাজে চিন্তাও ছিল । চাকরীজীবি বউয়ের মানেটা কি ? শুনেছে বটে সে, অনেক স্বামী নাকি বউয়ের কাছ থেকে বেতনের সব টাকা মাসের প্রথম সপ্তাহেই গুনে গুনে বুঝে নেয় । আহাদ তেমন নয় বটে , কিন্তু সে তাঁর স্যালারীর পুরো টাকাটাই মাসের প্রথমে মায়ের হাতে তুলে দেয় । এরপর হাত খরচের টাকা মায়ের হাত থেকেই চেয়ে চেয়ে নেয় । রেহানার ক্যামন যেন একটু কষ্ট হয় । সে হয়তো ভেবেছিলো একটু অন্যরকম । আহাদ তাঁর হাতে সব টাকা তুলে দেবে , আর সে তা শাশুড়ির হাতে দিয়ে দেবে । তার মানে গিয়ে দাঁড়াল , সে যে আহাদের বউ –এ দাবীটা জোরে শোরে রুপ দেয়া- এই আর কি । বউ হয়ে সে তো অবশ্যই আহাদের ভালোটা চাইতেই পারে ।

তবে ভালোটা যে কেবল স্বামীর মাস মাইনের টাকাটা হাতে নেয়া , তা অবশ্য নয় । তারপরও । তাঁরা দুজন যদি আলাদা ঘরসংসার করতো তাহলে তো আহাদ এই কাজটিই করতো । আর তা হোল মায়ের পরিবর্তে বউয়ের হাতে সংসারের ভারটা বুঝে দেয়া । এই শাশুড়ির হাতে প্রতি মাসের প্রথম সপ্তাহে বেতনের সব টাকা তুলে দেয়ার ব্যাপারটা রেহানাকে মাঝেমধ্যেই ভাবায় । আর কোনদিন সে এ ব্যাপারে মুখ ফুটে কিছু বলে না বটে , কিন্তু এ নিয়ে মনে মনে আহাদের উপর একটা চাপা ক্ষোভ কাজ করে তাঁর ।

বাড়ীতে এ ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলাতে , রেহানার মার তো উল্টো রাগ । বলিস কি । মায়ের হাতে টাকা তুলে দিচ্ছে ছেলে, এতো খুব আনন্দের কথা । এমন ছেলে কজনার হয় । তোর ভাইদেরই দেখনা , বাবার হোটেলে খায় , আর বউদের ফায়ফরমাশ খেঁটে খেঁটে মরে।

নাহ , মাকে কিছুতেই তাঁর সংসারের চিলতে দুঃখগুলো বোঝানো যাবে না । মাকে নয় , কাকেও নয় ! আহাদের উচিত ছিল নাকি , বিয়ের পরে অন্তত তাঁর সামনে সংসারের্ হিসেবের খাতাটা মেলে ধরা । সেখানে হাত দেবে না রেহানা । সে রুচিও তাঁর নেই । তারপরও জানলে কিবা ক্ষতি হতো। আর রেহানার নিজের স্যালারির কথা ! সে কথাও কোনদিন ভুলেও জানতে চায় না আহাদ। এতেও রেহানার আপত্তি । তাই বলে কি কিছুই জানতে চাইবে না সে নিজের বউয়ের উপার্জনের বিষয়ে । এসব মিলিয়ে রেহানার কেন জানি মনে হয় , আসলে আহাদ এখনও তাঁকে মন থেকেই নেয়নি ! কিংবা বুঝতেই পারেনি । পারলে তাঁকে নিয়ে নিদেনপক্ষে একটা কবিতাও তো লিখতে পারতো সে !

উল্টো সুন্দরী মেয়েদের নাকি ঘটে বুদ্ধি শুদ্ধি কম থাকে – এ কথাগুলো আহাদ প্রায়শঃ হেসে হেসে বউকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে । বুদ্ধি নাই তো কলেজের সরকারি চাকরিটা পেলাম কি করে? রেহানা অনেক ভেবেচিন্তে এ মোক্ষম কথাটা শোনাতে দেরী করে না । পড়ালেখার বুদ্ধি আর বৈষয়িক বুদ্ধি কি এক হোল ? তাই সে যে খুব কম বুদ্ধির আহাদের মুখ থেকে এহেন কথা শোনার পর এ বাড়ীর সবাই তাইই মনে প্রাণে বিশ্বাস করতে শুরু করছে বলেই মনে হয় রেহানার!

কোথাও যেতে হোলে , মালেকা ফৈরদৌস তাঁর দু মেয়ের কোন একজনকে রেহানার সঙ্গে পাঠিয়ে দেবেনই দেবেন । ওঁরা যেতে না চাইলে তিনি চড়া গলায় বলতে থাকেন – জানিস না বৌমার বুদ্ধি একটু কম । সরল । সে এতসব ঘোরপ্যাঁচ বুঝে উঠবে না । কিসের ঘোরপ্যাঁচ ? না দোকানীদের সাথে দরকষাকষি । কিংবা নতুন কারো ঠিকানা খুঁজে বের করা । আর তখনই কেন জানি , আহাদের উপর বেজায় রাগ হয় রেহানার । কে তাঁকে এমন কোরে রটাতে বলেছে তাঁর বুদ্ধি কম ! সে কি কাপড় চোপড় আর জিনিষ পত্রের দাম বোঝে না ? দরাদরি করতে জানে না একেবারেই ? ঢাকা শহরের অলি গলি কিছুই চেনে না ?

ঈদের কেনা কাটা করতে গিয়েই রেহানার সরলতা কিংবা এই বোকামির প্রশ্নটা ঘুরপাক খেতে খেতেই এবারেও অবশ্মভাবী ভাবেই আসলো । বিয়ের পর এই দ্বিতীয়বার স্বামী শ্বাশুরী আর ননদদের সাথে বাবামাকে ছেড়ে ঈদ করা । অবশ্য ঈদের পরের দিন রেহানা আর আহাদ চলে যায় কুষ্টিয়াতে , রেহানার বাপের বাড়ীতে !

তবে ঈদের কেনাকাটা করতে আহাদ যাবে না কিছুতেই । হাজার জোরাজুরি করলেও না । তাঁর নাকি এসব পোষায় না । মেয়েদের মতো অযথা এ দোকান , সে দোকান ঘোরা। তারপর এক সময় কিছু না কিনেই খালি হাতে বাড়ী ফেরা । অগত্যা রেহানাকে দু ননদ রিনি ঝিনিকে সঙ্গে করেই শপিং এ যেতে হয় ।শপিং এ যাওয়া মানেই বসুন্ধরা শপিং মল । মালেকা ফেরদৌস পই পই কোরে ছেলেবউ আর দু মেয়েকে বুঝিয়ে দেন , কেমন করে যেতে হবে । কি কি কিনতে হবে !কিভাবে কেমন কোরে দাম কমাতে হবে ! কোন ফ্লোরে কি পাওয়া যাবে তাও । ইদানীং মালেকা ফেরদৌসের কোমরে পেইন এর জন্য আগের মতো তাঁর শপিং এ যাওয়া হয়ে উঠে না ।

যা হোক , বেশী কিছু তো আর কিনতে হবে না । তাঁদের তিনজনের সালোয়ার কামিজ , আর সেই সাথে রেহানার জন্য বাড়তি আর একটা দামী শাড়ী । মালেকা ফেরদৌস অবশ্য বেশ হিসেব কষেই টাকা দিয়েছেন । ছেলের চাকরির হাতে গোনা টাকা । হোলই বা সে বড় চাকুরে । ঘুষ না খেলে কেইবা এত ফুটানি কোরতে পারে এই ঢাকা শহরে । মালেকা ফেরদৌস ছেলেকে মাথার দিব্যি দিয়ে আগে ভাগেই বলে দিয়েছেন- তাঁর উপরি পয়সার দরকার নেই ।

মোহন্মদপুরের এ বাড়ীটা মালেকা ফেরদৌসের বাবার কেনা জমিতে তৈরী করা। সাত কাঠার উপর ডেভেলপরকে দিয়ে বেশ প্ল্যান মাফিক বানানো । তাঁরা দু বোনের সবাই তিনটে কোরে বড় বড় এপার্টমেন্ট পেয়েছেন । বড় ভাইরা ছোট দু বোনকে একটু বেশী করেই ভাগ দিয়েছেন । এমন সচারাচর দেখা যায় না । আর তাতে ভাইয়ের বউরা বেজায় অখুশী । বাড়ী ভাড়া লাগে না আর সেই সাথে বাড়তি দুটো ফ্লাটের ভাড়া আর ছেলের বেতন – এসব দিয়ে তাঁদের চারটে প্রাণীর মন্দ চলে না ।

তবে অত্যন্ত বুদ্ধিমতী মালেকা ফেরদৌস নিজের ছেলের বিয়ের জন্য পাত্রী খুঁজতে গিয়ে বারে বারেই চাকুরীজীবি মেয়েই চেয়েছিলেন । আর তা এভেবেই যে ভবিষ্যতে ছেলে আর বউ যাতে নিজেদের সংসার ভালোভাবেই চালাতে পারে । তিনি আর কতদিন ! মেয়ে দুটোর প্রত্যককে একটা করে ফ্লাট দেবেন- তা আগে থেকেই ভেবে রেখেছিলেন তিনি । আর তাই তিন ছেলে মেয়ের নামে আলাদা আলাদা কোরে বাড়ীও লিখে দিয়েছেন। ক্যামন মেয়ে ঘরে আসে তা তো আর আগে থেকে বলা যায় না ! তাই আগে ভাগেই এই ব্যবস্থা ।

তবে নিজের ছেলে বউ রেহানাকে মালেকা ফেরদৌসের মন্দ লাগে না । দু বছর অনেকটা সময়ই । । এর ভেতর রেহানার আচার আচরণ বা ব্যবহারের বড় কোন অসঙ্গতি তাঁর নজরে পড়েনি । তবে মেয়েটা বেশ একটু চাপা স্বভাবের । আহাদ যেমন খোলা মেলা হৈ হুল্লুরে এ মেয়েটি ঠিক তাঁর উল্টোটা । চুপচাপ একাকী থাকতেই সে জেন বেশী ভালবাসে ।

এসব কথা মেয়েদের সাথে শেয়ার করলে তাঁরা উল্টো মায়েরই দোষ ধরে। এই যেমন বড় মেয়ে রিনি বলে , আর কত ভালো চাইবে মা পরের মেয়ের কাছ থেকে । সুন্দরী , ভাল সরকারি চাকুরি করে । ভাল ফ্যামিলি । কেবল চুপচাপ থাকাথাকিটা তাঁর দোষের হোল । এতো হোল গুন । মেয়েরা মাকে বুঝায় । তারপর ফোঁড়ন কেটেই বলে , তোমার বোনের মেয়ে মিনির সাথেই ভাইয়ার বিয়ে দিলেই তো ভালো কোরতে । ভাইয়ারও তো বেশ পছন্দ ছিল মিনি আপুকে !

নাহ, মিনি আপন বোনের মেয়ে হোলেও অত চঞ্চল আর ঝলমলে মেয়েকে ছেলের বউ হিসাবে কোনদিনই পছন্দ নয় মালেকা ফেরদৌসের । রেহানা মেয়েটি সাধারণের মাঝেও অনেকখানি অসাধারণ ! সবাই তো তাইই বলে। আসলে রেহানাকে বউ হিসেবে পেয়ে মালেকা ফেরদৌস যে আদৌ অখুশী তা কিন্তু নয় । কিন্তু কেবলি সেই যে কম কথা বলার ব্যাপারটা । এ বিষয়টা ভাবলে মনের মধ্যে কেমন যেন খচখচ করে তাঁর । রেহানার বাড়ীর সবার সাথে মিলেমিশে আর একটু খোলামেলা আনন্দ হাসাহাসি কোরলে কি এমন ক্ষতি হোত ?

যা হোক , বসুন্ধরা শপিং মলে ঈদের কেনাকাটা করতে যেয়ে হঠাৎ করেই রেহানার দেখা হয়ে গেল , মতিয়র রহমান তাঁর বউ আজমেরীর সাথে । রেহানা প্রথমে কেবল মতিয়র রহমানকেই দেখেছিল । অনেকদিন বাদে হারিয়ে যাওয়া একজন অতি চেনা মানুষকে দেখেলে যেমন একটা খুশী খুশী ভাব হয় , বহুদিন বাদে মতিয়র রহমানকে এমন একটা খোলা মেলা পরিবেশে হঠাৎ কোরে দেখতে পেয়ে রেহানার তাই বোধ হোচ্ছিল ।

হাড্ডিসার চেহারার তামাটে গায়ের একজন অতি সাধারণ মানুষ । কুচকুচে মোটা কালো দু’ঠোট । এলোমেলো একরাশ অবাধ্য চিরুনীবিহীন চুল । এমনতরো একজন নিরেট গদ্য মার্কা মানুষকেও এদ্দিনবাদে দেখতে পেয়ে মন্দ লাগছিল না রেহানার ! এর কারণ কি একটাই ? তাঁকে নিয়ে মতিয়র রহমানের সেই কবিতা লেখা । কিন্তু সে তো বোলেই দিয়েছে এসব সব কবিতা রবী ঠাকুরের । আজমেরী তা কপি করছে !

যা হোক মতিয়র রহমানকে অনেকদিন বাদে দেখতে পেয়ে আগ বাড়িয়ে কথা বলতে এগিয়েছিলও রেহানা । কিন্তু তাঁর পেছনে যে মতিয়র রহমানের বউ আজমেরী ছিল –তা সে আগেভাগে বুঝতে পারেনি । দেখেওনি । দেখলে না দেখার ভান করে সে ঠিক ঠিক কেটে পড়তো । এরপরও অনেকটা না দেখার ভাব কোরে চলে যাওয়ার চেষ্টা করলে , আজমেরীই এসে আগ বাড়িয়ে রেহানার ডান হাতটা সবলে চেপে ধরলো !

এই মেয়ে তুমি রেহানা না ? মানে সেই সুন্দরী রেহানা , যাকে নিয়ে আমার স্বামী লুকিয়ে লুকিয়ে কবিতা লিখতো । নির্ঘাত তুমি সেই মেয়ে । তো পালিয়ে যাচ্ছ ক্যানো । আমাকে দেখেই কি ?

উহ , কি সাংঘাতিক মহিলা । একেবারে যেন হাটে হাঁড়ি ভেঙ্গে দেবার জন্য মূর্তিমতী রুপে আবির্ভাব হয়েছে সে । রেহানা , চারপাশটায় দ্রুত চোখ বোলায় । রিনি আর ঝিনি পাশের দোকানে তন্ময় হয়ে সালোয়ার কামিজ দেখছে আর ইচ্ছেমতো দরদাম করছে । ভাগ্যিস এ মহিলার কথাগুলো কানে যায়নি তাঁদের । আহাদতো দু বোনের মুখে এসব শুনলেই হট কেকের মতো ব্যাপারটাকে লুফে নেবে । নাহ, কিছুতেই না । আহাদকে এ কথাটা কিছুতেই জানতে দেয়া যাবে না । রেহানা প্রবলভাবেই আজমেরীকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে চাইলো ।

কিন্তু আজমেরী থামছেই না । একের পর এক সেই একই কথা টেপ রেকর্ডারের মতো বাজিয়েই চলছে সে । শোন গো মেয়ে- থেমে নেই সে । থেমে নেই । সে কিন্ত তোমাকে নিয়ে কবিতা লিখেই চলছে । একদিন যাব আবার তোমাকে ঠিক ঠিক সেসব দেখাতে ।

উহ , আবার অফিসে যাবে এই মহিলা । বলেছে যখন , তখন সে নির্ঘাত যাবেই যাবে । আবার সেই বাজে সিন । চারপাশে অনেকগুলো উৎসুক মুখ । হাসি হাসি চেহারা । রেহানা যেন সার্কাসের ক্লাউন । গাড়ী বদলিয়েও কাজ হয়নি । এখনও তাঁকে ঘিরে স্বামীকে নিয়ে আজমেরীর সন্দেহটা চলছেই । আর তা বোধকরি চলবেও । এসবের সব –সবটা না হোলেও অন্তত কিছুটা সত্য হোলেও তবুও সহ্য হোত রেহানার । আহা , মতিয়র রহমান যদি সত্যি সত্যি তাঁকে নিয়ে সুন্দর একটা কবিতা লিখতো । মনে মনে একটা প্রজাপতি আনন্দ অন্তত খুঁজে পেত সে । কিন্তু তাতো হবার নয় ।

মতিয়র রহমান এতো কিছু জানে কিন্তু বেচারা একটা কবিতা লিখতে জানে না। হোক নিরেট গদ্য মার্কা । ছন্নছাড়া আধুনিক । ছন্দ , বৃত্ত , তাল লয় সুর ছাড়া । তারপর কবিতা তো কবিতাই । তাঁকে নিয়ে আর এ জীবনে যে কেউ কোন কবিতা লিখবে না , তা এতদিনে বেশ ভালো্ভাবেই বুঝতে পেরেছে রেহানা । তবে মিছেই কি তাঁর এত রুপ !

রিনি আর ঝিনি উঁকি দেয় বারে বার । এই আসলো বলে তাঁরা । হাতের ইশারায় তাইই তো বলছে । এখন কি করবে রেহানা ? আল্লাহই যেন বাঁচালেন তাঁকে ! শপিং করতে আসা একঝাক নরনারী এসে আজমেরী আর রেহানার মাঝখান দিয়ে ঢেউয়ের মতো বয়ে যেতেই , রেহানা দ্রুত হাঁটা দিয়ে এই দ্বিতীয় বারের মতো আজমেরীর হাত থেকে যেন পালিয়ে বাঁচলো ।

ক্ষণিক পরেই রেহানাকে দু চোখ মেলে দেখতে না পেয়ে বড়ই হতাশ হোল যেন মতিয়র রহমান । চলে গেল ! চলেই গেল সে । আর একটু থাকলে কি বা ক্ষতি হতো তার । আজ তো কেবল কবিতার ভাষা নিয়েই কথা হোচ্ছিল । আজমেরী তো তেমন কোন অসহ্য জ্বালাতন করছিলোও না তাঁকে । তবুও সে চলে গেল । একটা ক্ষণিক বসন্ত বাতাসের মতো দেখা দিয়েই মিলিয়ে যাওয়া আর কি ! কিন্ত তা তো চায়নি সে ! বেদনা আর ক্ষণিক ছুঁয়ে যাওয়া আনন্দে সেই মুহূর্তে মতিয়র রহমানের মন বারে বারে গেয়ে উঠলো ----- আহা , সে যে চলে গেল বলে গেল না ‼

** সব চরিত্রই কাল্পনিক






সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে নভেম্বর, ২০১৪ রাত ১০:১২
১০টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা সকলের দায়িত্ব।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৩৮



এগুলো আমার একান্ত মতামত। এই ব্লগ কাউকে ছোট করার জন্য লেখি নাই। শুধু আমার মনে জমে থাকা দুঃখ প্রকাশ করলাম। এতে আপনারা কষ্ট পেয়ে থাকলে আমি দায়ী না। এখনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাবলীগ এর ভয়ে ফরজ নামাজ পড়ে দৌড় দিয়েছেন কখনো?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:২৬


আমাদের দেশের অনেক মসজিদে তাবলীগ এর ভাইরা দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। তাবলীগ এর সাদামাটাভাবে জীবনযাপন খারাপ কিছু মনে হয়না। জামাত শেষ হলে তাদের একজন দাঁড়িয়ে বলেন - °নামাজের... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফেতনার সময় জামায়াত বদ্ধ ইসলামী আন্দোলন ফরজ নয়

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ১১:৫৮



সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ১০৩ নং আয়াতের অনুবাদ-
১০৩। তোমরা একত্রে আল্লাহর রজ্জু দৃঢ়ভাবে ধর! আর বিচ্ছিন্ন হবে না। তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ কর।যখন তোমরা শত্রু ছিলে তখন তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

=নীল আকাশের প্রান্ত ছুঁয়ে-৭ (আকাশ ভালোবেসে)=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:১৯

০১।



=আকাশের মন খারাপ আজ, অথচ ফুলেরা হাসে=
আকাশের মন খারাপ, মেঘ কাজল চোখ তার,
কেঁদে দিলেই লেপ্টে যাবে চোখের কাজল,
আকাশের বুকে বিষাদের ছাউনি,
ধ্বস নামলেই ডুবে যাবে মাটি!
================================================
অনেক দিন পর আকাশের ছবি নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

পানি জলে ধর্ম দ্বন্দ

লিখেছেন প্রামানিক, ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৫২


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

জল পানিতে দ্বন্দ লেগে
ভাগ হলোরে বঙ্গ দেশ
এপার ওপার দুই পারেতে
বাঙালিদের জীবন শেষ।

পানি বললে জাত থাকে না
ঈমান থাকে না জলে
এইটা নিয়েই দুই বাংলাতে
রেষারেষি চলে।

জল বললে কয় নাউযুবিল্লাহ
পানি বললে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×