ঢাকা শহরের অদূরে একটি গ্রামের এক মসজিদে ঈমাম হিসেবে নিযুক্ত আছেন মোহাম্মদ ইউসুফ। বয়স ২৮ বছর, শিক্ষাগত যোগ্যতা কওমী মাদ্রাসা হতে মাওলানা পাস, তিনি বেতন পান তিন হাজার টাকা। এই এলাকায় যতো মসজিদ আছে সেসব মসজিদের সকল ঈমামদের মধ্যে তার বেতন-ই সবচেয়ে বেশী। স্ত্রী এবং ছোট দুটি বাচ্চা নিয়ে তিনি স্থানীয় একটি বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে থাকেন তিনি। এছাড়াও তার নিজের গ্রামের বাড়িতে তার বৃদ্ধ মা-বাবা আছেন। তার নিজের খাওয়ার ব্যবস্থা মসজিদ কর্তৃপক্ষ করে থাকে। বাবা-মায়ে’র একমাত্র সন্তান হওয়ায় তাদের ভরণ-পোষণের দায়িত্বও তার ওপর অর্পিত। তিনি যে বেতন পান তার অর্ধেক তাকে তার বাবা-মা’র জন্য পাঠাতে হয়। অবশিষ্ট ১৫০০ টাকা দিয়ে তার সারা মাস চারজনের সংসার চালাতে হয়।
আসুন দেখি গত এক সপ্তাহ আগের স্থানীয়* বাজার দর।
১ কেজি মোটা চালের দাম ৩৬ থেকে ৩৮ টাকা
১ কেজি আটার দাম ৩২ থেকে ৩৩ টাকা
১ কেজি ডালের দাম ৮০ থেকে ১০০ টাকা
১ লিটার সয়াবিনের দাম ১০০ থেকে ১০৫ টাকা
১ কেজি হলুদের দাম ২৮০ থেকে ৩০০ টাকা
১ কেজি শুকনা মরিচের দাম ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা
১ কেজি আদার দাম ১০০ থেকে ১২০ টাকা
১ কেজি রসুনের দাম ১৪০ থেকে ১৬০ টাকা
১ কেজি চিনির দাম ৫২ থেকে ৫৫ টাকা
১ কেজি পেয়াজের দাম ৪০ থেকে ৪৫ টাকা
১ কেজি আলুর দাম ২০ থেকে ২২ টাকা
১ কেজি শিমের দাম ৩৫ থেকে ৪০ টাকা
১ কেজি বেগুনের দাম ৩৫ থেকে ৪০ টাকা
১ কেজি কাচা মরিচের দাম ৪০ টাকা
১ কেজি করলার দাম ৫০ থেকে ৬০ টাকা
১ কেজি মুলার দাম ১৫ থেকে ২০ টাকা
১ কেজি নলা (চাষ করা ছোট রুই) মাছ ১২০ থেকে ১৪০ টাকা
১ কেজি পাঙ্গাস মাছের দাম ১০০ থেকে ১২০ টাকা
১ কেজি সিলভার কার্প মাছের দাম ৮০ থেকে ১০০ টাকা
১০০ গ্রাম কাচকি শুটকির দাম ৫০ টাকা
দুটো বাচ্চা, আর তার মায়ের জন্য যদি নুন্যতম হিসেব করা হয় তাহলেও অন্ততঃ-
চাল প্রয়োজন ২৪ থেকে ২৫ কেজি, দাম ৯০০ থেকে ৯৬০টাকা
ডাল প্রয়োজন ১.৫ কেজি, দাম ৮০ থেকে ১০০ টাকা
আলুর প্রয়োজন ৪ থেকে ৫ কেজি, দাম ৮০থেকে১০০ টাকা
পেয়াজ প্রয়োজন ৩ থেকে ৪ কেজি, দাম ১২০ থেকে ১৬০ টাকা
সয়াবিন তেল প্রয়োজন ২ থেকে ২.৫ লিটার, দাম ২০০ থেকে ২৫০ টাকা
হলুদ গুড়া প্রয়োজন ২০০ গ্রাম, দাম ৮০ থেকে ৯০ টাকা
মরিচ গুড়া প্রয়োজন ১৫০ গ্রাম দাম কমপক্ষে ৩০ টাকা
আদা প্রয়োজন ২৫০ গ্রাম দাম কমপক্ষে ৩০ টাকা
রসুন প্রয়োজন ২৫০ গ্রাম দাম কমপক্ষে ৪০ টাকা
লবন প্রয়োজন ১কেজি, দাম ১০ থেকে ২০ টাকা
এর বাইরে সব্জি হিসেবে শিম, বেগুন, করলা, মাছ, শুটকি হিসেবের বাইরে আছে এখনো।
তাহলে, তিনি চলেন কিভাবে?
সহজ কথায় তার সংসার চলেনা। জীবনটাকে কোনমতে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন তিনি। অন্যের দয়া, দান বা অনুগ্রহের ওপন নির্ভর করেই তাকে বেঁচে থাকতে হয়। মাছ কিনে খাওয়ার সামর্থ্য তাদের নেই। সারা মাসে একবার দুবার হয়তো গুড়োমাছ তারা চোখে দেখেন। একবেলা রান্না হয়, তা-ই দু’বেলা আধপেট করে খেয়ে কোনমতে জীবনকে টিকিয়ে রেখেছেন এরা। এই রান্না হওয়ার খাবারটির কি নাম দেওয়া যেতে পারে আমি ঠিক জানিনা। এটা না খিচুরি, না ভাত। খিচুরি রান্না করতে ডাল লাগে, লবন, তেল, মশলা, পেয়াজ লাগে। তাদের রান্না করা খাবারে তেল, লবন, ডাল থাকে তবে তা নামে মাত্র। সাথে থাকে রাস্তারপারে জন্মানো কচুর ডগা যা টাকা দিয়ে কিনতে হয় না । এই খাবারটিকেই তারা খিচুরি বলেন। সেদ্ধ হওয়া কচুর ডগা লবনে ডলে ভর্তা করে ‘খিচুরি’ খান তারা। আর এই খাবারটিই তাদের নিত্যদিনের খাদ্য।
তার দু’টো বাচ্চার মধ্যে একটি আট থেকে নয় মাস বয়সী ছেলে, অন্যটি অড়াই বছরের মেয়ে। বাচ্চা-ছেলেটি তার মায়ের দুধ ঠিকমতো পায়না, কারণ তার মা-ই ঠিকমতো খেতে পায় না। তাই বাচ্চাটিকে সিরিয়াল(cereal) খাওয়ানো হয়। হ্যাঁ সিরিয়ালই বটে, তবে তা মোটা চাল বেটে হাতে প্রস্তুত চালের সুজি। সেদ্ধ করা হয় কোন প্রকার দুধ ছাড়া, শুধুমাত্র লবন দিয়ে। আর এই খাবার খাওয়ার জন্যই বাচ্চাটি কান্নাকাটি শুরু করে, খাবার পেলে গোগ্রাসে গিলতে থাকে। আড়াই বছরের বাচ্চাটিও তাই। সে তার ছোটটির খাবারে ভাগ বসায়। ভাত খাওয়ার ভাত ই তার পান না, বাচ্চাকে দুধ, চিনি কিনে খাওয়ানোর বিলাসিতা তারা করতে পারবেন কোথা হতে?
এই ঈমাম একটা উদাহরণ মাত্র। সারাদেশে মুষ্ঠিমেয় কিছু ঈমাম ছাড়া সবার অবস্থা মোটামুটি একই রকম। একজন গার্মেন্টস কর্মীর চাকুরির নিশ্চয়তা আছে, একজন ঈমামের নেই। একজন গার্মেন্টস কর্মীর সরকার নির্ধারিত নির্দিষ্ট বেতন আছে, ঈমামদের নেই। আমি অনেক ঈমামকে চিনি যারা দুই হাজার টাকা বেতন পান। অনেকে প্রশ্ন করবেন তারা এত কম বেতনে চাকুরি করেন কেন? কারণ তাদের কোন উপায় নেই, অন্যকোন কাজ শেখেন নি, তাই অন্যকোন পেশাও তাদের বেছে নেওয়া সম্ভব হয় না।
দেশে তিন কোটির ওপর শিক্ষিত বেকার আছে। সবার গল্পই মোটামুটি একই রকম। আমাদের দেশের সরকারগুলো হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করতে পারে স্থাপনার নাম ফলক পরিবর্তন করার জন্য, মশা মারার জন্য কামান দাগাতে পারে, কিন্তু কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারে না। পারেনা অনাহারে, অর্ধাহারে বেচে থাকা মানুষগুলোর জীবনমান উন্নয়নের কোন কিছু করতে। ফলে আমরা যারা আম জনতা, আমরা আইজুদ্দিনরা চিরকালই অবহেলায় থেকে গেলাম। কষ্টে আছি আইজুদ্দিন।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা জানুয়ারি, ২০১১ রাত ১:০৪

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।





