ইসলামের নামে জঙ্গিবাদ: আলোচিত ও অনালোচিত কারণসমূহ পর্ব -১৫
খিলাফতে রাশিদার পর থেকে সকল ইসলামী রাষ্ট্রেই রাষ্ট্র পরিচালনায় ইসলামী বিধিবিধানের কমবেশি লঙ্ঘন ঘটেছে। শাসক নির্বাচন ও রাষ্ট্র পরিচালনায় জনগণের পরামর্শ গ্রহণ, জনগণের নিকট জবাবদিহিতা, মানবাধিকার ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা, নিরপেক্ষভাবে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও আইন প্রয়োগ ইত্যাদি অগণিত ইসলামী নির্দেশনা কম বা বেশি লঙ্ঘিত হয়েছে এসকল রাষ্ট্রে। রাষ্ট্রপ্রধান বা শাসকগণ নিজেদেরকেই আইন বা আইনদাতা বলে মনে করেছেন। কুরআনী বিধিবিধান ও আইনকে বেপরোয়াভাবে অবহেলা করেছেন। কিন্তু কখনোই এ জন্য কোনো মুসলিম ইমাম, ফকীহ বা আলিম এ সকল রাষ্ট্রকে ‘দারুল হরব’, ‘অনৈসলামিক রাষ্ট্র’ বা ‘জাহিলী রাষ্ট্র’ বলে মনে করেন নি। তারা তাদের সাধ্যমত সংশোধন ও পরিবর্তনের চেষ্টা করেছেন।
বর্তমান বিশ্বের মুসলিম দেশগুলির অবস্থা পূর্ববর্তী এ সকল মুসলিম দেশ থেকে মোটেও ভিন্ন নয়, বরং কিছুটা ভালই বলতে হয়। শাসক নির্বাচন ও রাষ্ট্র পরিচালনায় জনগণের পরামর্শ গ্রহণ, জনগণের নিকট জবাবদিহিতা, মানবাধিকার ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা, নিরপেক্ষভাবে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও আইন প্রয়োগ ইত্যাদি ইসলামী নির্দেশনা পালনের ক্ষেত্রে এ সকল রাষ্ট্র পূর্ববর্তী রাষ্ট্রগুলি থেকে কিছুটা হলেও উন্নত হয়েছে। এ সকল দেশের অধিকাংশ আইন-কানুন ও বিচার ব্যবস্থা ইসলামী আইন ও বিচার ব্যবস্থা থেকে গৃহীত। ইসলমী বিধানের পরিপন্থী কিছু আইন-কানুনও বিদ্যমান। শাসকদের পাপ, রাষ্ট্র ব্যবস্থার পাপ বা কিছু ইসলাম-বিরোধী আইন-কানুনের জন্য কোনো রাষ্ট্রকে অনৈসলামিক মনে করা, তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা বা অশান্তি সৃষ্টি করা ইসলাম বিরোধী ধ্বংসাত্মক বিভ্রান্তি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
من كره من أميره شيئا يكرهه فليصبر فإنه من خرج من السلطان شبرا (فارق الجماعة شبرا)، مات ميتة جاهلية
যদি কেউ তার শাসক বা প্রশাসকের মধ্যে এমন কোনো কিছু দেখতে পায় যা তার খারাপ লাগে, তবে সে যেন ধৈর্য ধারণ করে (আবেগতাড়িত হয়ে বিদ্রোহ বা অবাধ্যতার পথে না যায়।) কারণ, যদি কেউ রাষ্ট্রব্যবস্থার আনুগত্যের বাইরে এক বিঘতও বেরিয়ে যায়, বা ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র ও সমাজের সিদ্ধান্তের বাইরে এক বিঘতও বেরিয়ে যায় এবং সেই অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে তবে সে জাহিলী (অনৈসলামিক) মৃত্যু বরণ করলো।”
অন্য হাদীসে তিনি বলেন:
ألا من ولي عليه وال فرآه يأتي شيئا من معصية الله فليكره ما يأتي من معصية الله ولا ينزعن يدا من طاعة
“তোমরা হুশিয়ার থাকবে! তোমাদের কারো উপরে যদি কোনো শাসক-প্রশাসক নিযুক্ত হন এবং সে দেখতে পায় যে, উক্ত শাসক বা প্রশাসক আল্লাহর অবাধ্যতার কোনো কাজে লিপ্ত হচ্ছেন, তবে সে যেন আল্লাহর অবাধ্যতার উক্ত কর্মকে ঘৃণা করে, কিন্তু আনুগত্য থেকে হাত গুটিয়ে নেবে না।”
(৭) প্রতিপক্ষকে কাফির বলার প্রবণতা
জিহাদের নামে কাউকে হত্যা করতে হলে তাকে ‘কাফির’ ও ইসলামের শত্র“ প্রমাণ করা খুবই জরুরী। নইলে মুসলিম মানস সহজে এই হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণ বা সমর্থন মেনে নেবে না। এজন্য আমরা দেখেছি যে, প্রাচীন জঙ্গিবাদী গোষ্ঠিরা তাদের প্রতিপক্ষ মুসলমানদেরকে ঢালাওভাবে কাফির বলে ঘোষণা দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বা গুপ্ত হত্যা অভিযান পরিচালনা করত। বর্তমানে বিভিন্ন ইসলামী কর্মে লিপ্ত মানুষদের মধ্যে বিদ্যমান এই জাতীয় কিছু ধারণা জঙ্গিদের জন্য প্রতিপক্ষদেরকে ঢালাওভাবে ‘কাফির’ বা ধর্মত্যাগী বলার সুযোগ করে দিচ্ছে।
আমরা আগেই দেখেছি যে, খারিজীগণ সর্বপ্রথম পাপের কারণে মুসলমানকে ‘কাফির’ বলতে শুরু করে। কোনো কোনো বিভ্রান্ত মুসলিম গোষ্ঠি বা দল এরূপ মত পোষণ করেছেন। পক্ষান্তরে কুরআনের বিভিন্ন আয়াত ও অগণিত হাদীসের আলোকে সাহাবীগণের যুগ থেকে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত বা মূলধারার মুসলিম উম্মাহর দৃষ্টিতে ইসলামের মূলনীতি হলো, যে ব্যক্তি নিজেকে মুসলিম বলে দাবি করছেন, তাকে কোনো পাপের কারণে ‘অমুসলিম’, কাফির বা ধর্মত্যাগী বলে গণ্য করা যাবে না, যতক্ষণ না তিনি সুষ্পষ্টভাবে ইসলামী বিশ্বাসের পরিপন্থী কোনো বিশ্বাস পোষণ করার ঘোষণা দিবেন। ইসলামী আইন লঙ্ঘনকারী, বা আল্লাহর নির্দেশ অমান্যকারী মুসলিম পাপী মুসলিম বলে গণ্য হবেন। কখনোই তাকে পাপের কারণে ‘অমুসলিম’ বা ধর্মত্যাগী বলে গণ্য করা হবে না। তবে যদি তার এই পাপ বা অবাধ্যতাকে তিনি বৈধ মনে করেন বা ইসলামী বিধানকে বাজে, ফালতু, অচল বা অপালনযোগ্য বলে মনে করেন তবে তা কুফরী বা ধর্মত্যাগ বলে গণ্য হবে
মুলঃ ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর
পি-এইচ. ডি. (রিয়াদ), এম. এ. (রিয়াদ), এম.এম. (ঢাকা)
অধ্যাপক, আল-হাদীস বিভাগ,
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া