somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

টিকা-বিরোধী আন্দোলন : একটি তিক্ত অভিজ্ঞতা

২৪ শে সেপ্টেম্বর, ২০১১ রাত ৯:৫৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

একটা অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন দিয়ে লেখাটা শুরু করা যেতে পারে। বিজ্ঞানমনষ্কতা কেন জরুরী? এই প্রশ্নের যথার্থতা আমাদের তৃতীয় বিশ্বের গরীব দেশে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। বাংলাদেশে জনগণের মাঝে বিজ্ঞানমনষ্কতা কম। বিপরীতভাবে, এমনটা ভাবার অবকাশ নেই যে উন্নত দেশে জনসাধারণের মধ্যে বিজ্ঞানমনষ্কতা বেশি। উন্নতদেশে সাধারণ মানুষজন উন্নত প্রযুক্তির সুবিধা পেয়ে থাকেন বলে যে তাদের বিজ্ঞানবোধও বেশি হবে – বিষয়টা এতো সরল নয়। প্রথমবিশ্বেও দরকার হয় বিজ্ঞান-জনপ্রিয়করণ এবং আধুনিক-কুসংস্কার বিরোধী আন্দোলন। তৃতীয় বর্ষ ফাইনাল পরীক্ষার প্রস্তুতী নেয়ার সময় পাঠ্যতে ঠিক এই প্রসঙ্গেরই একটা বাস্তব উদাহরণ দেখলাম। সেটাই এখন পাঠকদের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করছি।



অভিভাবকেরা যখন টিকার উপর আস্থা হারিয়ে ফেলেন

একটা সময়, হুপিং কাশি ভয়াবহ রোগ ছিলো। ছোট শিশুরাই এই রোগে বেশি আক্রান্ত হতো। হুপিং কাশির নামই কেবল শুনেছি। কোন রোগী দেখি নি। সম্ভবত, আমাদের আগের প্রজন্মও, মানে আমাদের পিতামাতারাও এই রোগ দেখে নি। কারণ ভ্যাক্সিন বা টিকার আবিষ্কার। পাঠক খেয়াল করবেন, সরকারী টিকা দেয়ার ক্যাম্পেইনে ডিটিপি জাতীয় ভ্যাক্সিন শিশুকে দেয়া হয়। এই টিকার একটা অংশ হলো পার্টুসিস বা হুপিং কাশির টিকা। এখনো অনেক দেশে এই টিকা দেয়া হয় না বলে হাজার হাজার শিশু মৃত্যুবরণ করে।

হুপিং কাশিতে আক্রান্ত হলে রোগী প্রথম প্রথম সাধারণ ঠান্ডার মতো উপসর্গ দেখাতো। রোগ জটিল হওয়ার সাথে সাথে বোঝা যেত, এটা সহজ কোন রোগ নয়। রোগী অত্যন্ত শ্বাসকষ্টে ভুগতো। তীব্র শুকনো কাশির দমকে দমকে বমিও বের হয়ে আসতো। এক নাগাড়ে কাশির ফাঁকের সময়ে রোগী দ্রুত বেশি শ্বাস নিতে গিয়ে এক ধরনের শব্দের সৃষ্টি করতো। ওই বৈশিষ্ট্যমূলক শব্দের থেকেই হুপিং কাশি রোগের নামকরণ। এই হুপিং কাশিই পরবর্তীতে অন্যান্য শারীরিক জটিলতা সৃষ্টি করতো – যার কোন উপশম থাকতো না। পরম আদরের সন্তানের এই পরিণতি কোন অভিভাবকই চান না।

তাই যখন ১৯৫০ সালের দিকে হুপিং কাশির ভ্যাক্সিন প্রচলিত হলো, উন্নত বিশ্বের অভিভাবক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা যেন সোনার চাবি হাতে পেলেন। ছোট শিশুদের জন্য পার্টুসিস ভ্যক্সিন দেয়ার নিয়ম করে দেয়া হলো। ফলাফল আশানুরূপ। শিশুদের হুপিং কাশি হয়ে গেল ইতিহাস।

কিন্তু, একটা ঝামেলা রয়েই গেল।

এই ভ্যক্সিনটা শিশুর দেহে সামান্য প্রতিক্রিয়া তৈরি করতো। ২০ শতাংশ শিশু ব্যাথা এবং শারীরিক-অস্বস্তি অনুভব করতো। আর ০.১ শতাংশ শিশুর ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের তীব্র, নিরাময়ের অযোগ্য ক্ষতি হতে দেখা গেল। যদিও কোন সরাসরি প্রমাণ পাওয়া গেলো না যে পার্টুসিস ভ্যাক্সিনের কারণেই মস্তিষ্কের এই ক্ষতি তৈরি হচ্ছে। হুপিংকাশি শিশুদের কতো ভয়াবহ রোগ তা সেই সময়ের অভিভাবক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা দেখেছেন। তাই তারা শিশুদের এই ক্ষতির সম্ভাবনাটুকু মেনে নিতেন।

১৯৭০ সালের দিকে উন্নতদেশগুলো থেকে হুপিং কাশি প্রায় বিলুপ্তই হয়ে গেল। তখন চিকিৎসক, অভিভাবকরা এই পার্টুসিস টিকার উপসর্গগুলো নিয়ে প্রশ্ন তোলা শুরু করলেন। এই টিকা ঝুঁকিপূর্ণ বলে প্রচারমাধ্যমগুলো জনমতকে টিকার বিরুদ্ধে উত্তেজিত করতে থাকলো। বিশেষ করে জাপানে এই টিকা-বিরোধী প্রচারণা তুঙ্গে উঠে গেল। চিকিৎসকরা তখন এই টিকা বর্জন করা শুরু করলেন। ১৯৭৬ সালে দেখা গেল জাপানে মাত্র ১০ শতাংশ শিশু পার্টুসিস ভ্যাক্সিন নিয়েছে। তারপরের কাহিনী অত্যন্ত করুন। ১৯৭৯ সালে জাপানে হুপিং কাশি মহামারী আকারে দেখা দেয়। সেখানে এক বছরে ১৩ হাজার রোগী হুপিং কাশিতে আক্রান্ত হয়। মারা যায় ৪১ জন।

পার্টুসিস টিকাটির বিরুদ্ধে ঠিক একই দৃশ্যপট দেখা গেল ইউরোপ ও তৎকালীন সোভিয়েই ইউনিয়নেও। প্রথমে টিকার বিরুদ্ধে আন্দোলন, টিকা বর্জন, পরিশেষে হুপিং কাশির মহামারী। সবচাইতে তিক্ত বিষয়টা কি জানেন? শিশুদের স্বাস্থ্যের কথা মাথায় রেখে যে পার্টুসিস টিকা উঠিয়ে নেয়া হলো, তার ফলাফল অজস্র শিশুর মৃত্যু, অগণিত শিশুর মস্তিষ্ক সহ অন্যান্য শারীরিক জটিলতা।

আবার নব্বইয়ের দশকে টিকা-বিরোধী কিছু ফ্যানাটিক-গ্রুপ মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। কারণ তারা ৭০-এর দশকের পর বিশ বছর সময় পেয়েছিলো হুপিং কাশি মহামারী ভুলে যাওয়ার জন্য। তবে তারা খুব কম অভিভাবককেই ভূল পথে পরিচালিত করতে সফল হয়েছে – যেই পথে একটি নতুন প্রজন্মকে কষ্টকর শারীরিক জটিলতার অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে হয়।

সুখের কথা, পরবর্তীতে এই রোগের বিরুদ্ধে ভ্যক্সিনটিকে আরো উন্নত করা হয়। পূর্ববর্তী সংস্করণের চাইতে এর উপসর্গ সামান্যই।


পূর্বে বিজ্ঞান ব্লগে প্রকাশিত

তথ্যসূত্র: Impact of the anti-vaccine movements on purtussis control: the untold story.
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে সেপ্টেম্বর, ২০১১ রাত ৯:৫৮
৩টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দাদার দাদা।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৫৫

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী।

আমার দাদার জন্মসাল আনুমানিক ১৯৫৮ সাল। যদি তার জন্মতারিখ ০১-০১-১৯৫৮ সাল হয় তাহলে আজ তার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১৮


আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×