somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বনপাহাড়ের মেয়ে

২৬ শে মে, ২০০৯ সকাল ৯:৩১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


আজ রবিবার স্কুল ছুটি। খুব ভোরে উঠেই ফুল কুড়াতে ছুটল দুভাইবোন মিশু আর খোকন। মিশুর বয়স সাত আর খোকনের পাঁচ বছর। দুটিতে একেবারে মানিকজোড়। ওরা থাকে পাহাড় জঙ্গলে ঘেরা মফস্বল শহরে। মা ব্যস্ত ঘরের কাজে। আঁকাবাঁকা পথের পাশে পাহাড়ি টিলায় মানুষের বাড়ীর আঙ্গিনায় লাগানো নানা রকমের ফুলের গাছ করবী, জবা, হাস্নাহেনা, রঙ্গন, গোলাপ আরো কত যে ফুলগাছ। নানারকম ফুলে ভরে গেল ফুলের সাজি। তারপর হঠাৎ মনে পড়ল বিলের ধারে কৃষ্ণচূড়া গাছের সারি। চলল দুজন বিলের ধারে।
দুজনের চক্ষু চড়কগাছ, বিলের বুকে অজস্র ভেলা। পাহাড় থেকে বাঁশ কেটে নিয়ে আসছে চাঁনমিয়া তার দলবলসহ। সে এক অপরূপ দৃশ্য। মাইলেখানেক জায়গা জুড়ে শুধুই বাঁশের ভেলা। কোনটাতে আবার রান্নাও হচ্ছে। নিমেষেই খুশির ঢেউ বয়ে গেল দুজনের মনে। আজ সকালে নাস্তার সাথে দইচিড়া চলবে। ফের ছুটল বাড়ীর দিকে। হাতমুখ ধুয়ে পড়তে বসে গেল। ঘন্টাখানেক পড়ার পরে খেতে ডাকলেন মা।
টিলার উপরে থাকত চাঁনমিয়া। বাঁশের ব্যবসা ছিল তার। দুর পাহাড়ের উপড় থেকে বাঁশ কেটে স্তুপ করে ভেলার মত একসাথে বাঁধত। উপড়ে নৌকার মত ছাউনী দিত। একে বাঁশের ভুর বলা হত। যখন নদীপথে নেমে আসত মাইলখানেক জুড়ে শুধু ভুরের ভর দেখা যেত। মহিষের দুধ বাঁশের চোঙায় ভরে নদীর পানিতে বেশিরভাগটা ডুবিয়ে রাখত। তিন চারদিন পরে যখন শহরের ঘাটে এসে ভিড়ত ৪/৫ কেজি মিস্টিদই বাড়ীতে দিয়ে যেত। উপড়ে ঘিয়ের স্তর আর মাখনের মত নরম দই খেতে কিযে অপূর্ব স্বাদ। মনে পড়লেই জিভে জল এসে যায়।সারাদিন ধরে ভাইবোন মিলে সেই দই খাওয়া হত।
আবার মাও ঘরে দই বসাতেন। ৮-১০ সের গরুর দুধ কিনে জ্বাল দিয়ে ৫ সের হলে চিনি দিয়ে আবার জ্বাল দিয়ে টকদই মাখানো মাটির হাঁড়িতে ঢেলে দিতেন। উপরেও কিছু টকদই ছড়িয়ে দেন মা। মিশু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে। পরদিন দুপুরেই তৈরী হত ঘরে পাতা দই।
নাস্তা শেষে চলল বাগানে। টুনটুনি পাখির বাসা ছিল বাড়ীর পিছনের ঝোঁপে। দুটো পাতা সেলাই করে তার ভিতরে তুলা দিয়ে তৈরী হত বাসা। রোজ সেখানে হানা দিয়ে ডিমের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করত দুজন। আর জল্পনা কল্পনা চলত কবে ডিম থেকে ছানা বেরুবে। তারপর পাশাপাশি ঠায় দাড়িয়ে থাকা পেয়ারা গাছে উঠে দুলতে শুরু করল দুজন। হঠাৎ লাফ দিয়ে মিশু খোকনের গাছে আর খোকন মিশুর গাছে চলে আসে। পড়ে গেলে হাত পা ভাঙ্গতে পারে সে ধারণাই নেই কারো। এটা ওদের একটা মজার খেলা। দস্যিপনা আর কাকে বলে।
কখনো ছোটে বিলের ধারে। জোঁকের ভয়ে পানিতে নামা হতনা। অন্যরা শাপলা শালুক তুলে দিত ওদের। সারাদিন বনবাদাড়ে দাবড়িয়ে বেড়ায় দুজন। কি সুন্দর মুক্ত স্বাধীন জীবন। মেলা থেকে ছুরি কিনে কোমড়ে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখে। সাথে লবন মরিচের গুড়া মেশানো পুঁটলি। গাছে উঠেই আম, জাম পেড়ে লবন মরিচ মাখিয়ে যত্ত খুশি খাও।
স্কুল খোলা থাকলে নাস্তা করে বই খাতা হাতে নিয়ে খালি পায়ে স্কুলে যাওয়া। স্কুলে কারো পায়েই জুতা ছিল না। জুতা শুধু বেড়াতে যেতে পরা হত। রাতে হারিকেনের আলোয় পড়ালেখা চলত। বাল্যশিক্ষা, ধারাপাত এইসব আরকি। ক্লাস ৫/৬ এ উঠার পর চার পাঁচজন মিলে স্কুলের লাইব্রেরী থেকে গল্পের বই এনে পাল্টাপাল্টি করে পড়া হত। টুকরা কাপড়, মাটি দিয়ে নিজেরাই পুতুল বানিয়ে জুতার বাক্সে ঘর বানিয়ে খেলত মিশু। মেলা থেকে মাটির হাঁড়ি পাতিল কিনে সারাবছর রান্নাবান্নার কাজ চলে যেত। খোকন বৃষ্টি নামলেই বন্ধুদের সাথে জাম্বুরা দিয়ে ফুটবল খেলত।

মাইলের পর মাইল ছিল আনারস কমলার আম কাঁঠালের বাগান। আরো কত রকমের ফলই না ছিল বাগানে। ভাইবোন সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে সারাদিন বাগানে পড়ে থাকত। দিনের মধ্যে কতবার যে পুকুরে সাতাঁর কাটত মা ভাবতেও পারতেন না। আজ এই ৬০ বছর বয়সে এসে ছেলেবেলার নানারঙের সেই দিনগুলির কথাই কেবল মনে পড়ছে মিশুর। এতগুলি বছর ধরে ইটসিমেন্টের এই শহরে থেকে হাঁপিয়ে উঠেছেন তিনি। নাতি নাতনিদের দিকে তাকালে বুকটা হুহু করে উঠে। ওদের কোন শৈশব বলে কিছুই নেই। স্কুল বাসা আর টিভি কম্পিউটার গেম। স্বাধীন জীবন কাকে বলে ওরা জানলোই না। এতকাল এসব কথা ভাবার সময় পাননি। স্বামী মারা যাবার পর বড্ড একা লাগে। ছেলেবেলার কথা কেবলই মনে পড়ে যায়। বুক চিরে একটা দীর্ঘনিশ্বাস বের হয়ে আসে।
৬টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×