দৌলতদিয়া ঘাট থেকে আরো বেশ খানিকটা উত্তরে গিয়ে সেখান থেকে ট্রলারে করে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে ২৩-২৪ বছরের এক টগবগে যুবক। নাম শামীম। সাথে মানানসই বয়সের একজন মেয়ে, সীমা। মুক্তির উল্লাস, অজানা ভয়, ভবিষ্যত ভাবনা আর ট্রলারের ইঞ্জিনের শব্দ পদ্মার ঢেউয়ে মিশে কী এক অদ্ভুত আন্মনা ঘোরাবৃত করে রেখেছে সীমাকে।
জামালপুরের সীমা তখনো জগতের বৈরিতা সম্পর্কে জেনে-বুঝে উঠতে পারেনি, অথচ মা তাকে ছেড়ে চলে গেছে। শৈশবেই সৎ মায়ের সংসার। বছর কয়েকের মধ্যেই সংসারের সদস্য সংখ্যা বাড়ে। অযাচিত এক বোঝা হয়ে দাঁড়ায় সীমা। অগত্যা বাল্য বিবাহ।
সৎ মায়ের অবহেলার সংসার ছেড়ে এসে জুটল নেশাগ্রস্ত স্বামীর ঘরে। নেত্রকোনায়। বছর ঘুরতেই কন্যা সন্তানের মুখ। শান্তা নামের ফুটফুটে মেয়েটি যখন কেবল হাঁটতে শুরু করেছে ট্রাক ড্রাইভার স্বামী তখন একদিন রাতের অন্ধকারের হাইওয়েতে নিয়ন্ত্রণ হারায় জীবন গাড়ির। বাল্যকাল কাটেনি, বিধবা বেশে সীমা।
ফিরে যেতে হয় বাবার ঘরে ছোট্ট শান্তাকে নিয়ে। দিন যায়, সম্পর্ক অবনতির দিকে যায় স্বাভাবিকভাবেই। ছল করে সৎ মা তাকে পাঠিয়ে দেয় দৌলতদিয়া। বল এখন দৈলতদিয়ার এক সরদারনীর পায়ে। শান্তা পড়ে রয় এদিকে জামালপুরে সীমার বাবার বাসায়।
সন্ধ্যা পেরিয়ে তখন রাত জন্ম নিতে শুরু করেছে দৈলতদিয়ার নিষিদ্ধ পল্লীতে। দরজা খুলে এক যুবক ঘরে প্রবেশ করে। এক পলক দেখেই বিছানার কোণায় বসে থাকা সীমা হাঁটুর মধ্যে আবার মাথা গুঁজে দেয়। যে পুরুষটি এইমাত্র তার ঘরে ঢুকেছে সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। স্পর্শ করতেই ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে ফর্সা গাত্র বর্ণের তরুণী সীমা।
রাত কেটে যায় গল্প শুনতে শুনতে। শেষ রাতে এসে প্লান। ভোর হলেই তারা দুজন এসে দাঁড়ায় সরদারনীর সামনে। সীমা জানায় ছেলেটি তাকে খুশি হয়ে কিছু চুড়ি আর ফিতা কিনে দিতে চায়। তাই দোকান পর্যন্ত যেতে হবে। অনুমতি দেন সরদারনী।
তারপর চুড়ি-ফিতা কিনবার নাম করে লাপাত্তা। দৈলতদিয়া ঘাট অনিরাপদ হতে পারে এই শংকায় আরো উত্তরে গিয়ে ট্রলারে ওঠে মানানসই বয়সের দুজন, শামীম আর সীমা। যার একজনের চোখ ঘোরাবৃত হয়ে আছে উল্লাস আর আশংকায়।
লেখাপড়া শেখা হয়নি কিছু সীমার। তাই চাকুরীর সন্ধান একদিকে ব্যর্থ তো হয় বটেই, সাথে জোটে কুপ্রস্তাব। জগতে মানুষ হরেক রকম হয়, সীমা একথা জেনে গেছে। একজন যুবক সারারাত তাকে কিনে নিয়েও দ্বিতীয়বারটি স্পর্শ করেনি, বরং মুক্তির পথ সন্ধান করে দিয়েছে। অন্যদিকে নরপশুরা চাকুরীর লোভ দেখিয়ে তাকেই চাইছে।
সীমা বুঝে নেয় মুক্তি মেলেনি। শুরু করে বাসায় কাজ করা। কিন্তু শুয়োরের প্রলম্বিত কুপ্রবৃত্তি পিছু ছাড়ে না। গৃহিণী ঘরে নেই। পুরুষ কর্তা একা বাসায়। সীমা আগেও লক্ষ্য করেছে তার নজর ভাল না।
কর্তা শোবার ঘর থেকে ডেকে বলে এক গ্লাস পানি দিতে। সীমা ঘরে ঢুকতেই হাত ধরে বসে কর্তা। ছিটকে পড়ে কাঁচের গ্লাস মেঝেতে। হেরে যায় সীমা নামের নারীটি, সমাজ যাদেরকে অবলা হিসেবেই পরিচয় দিতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। প্রথমবারের মত অবৈধ কোন যোনাঙ্গ স্থাপত্য গড়ে তার শরীরে। মেঝেতে ছড়িয়ে থাকে ভাঙা কাঁচের টুকরা।
...
শান্তা এখন সীমার খালার বাসায় থাকে। এবার মেট্রিকে এ গ্রেডে পাশ করেছে। তবে এক্সাক্ট পয়েন্ট কত সীমা বলতে পারে না। শান্তা মাকে বলে সে চাকুরী করবে। সীমা জানে শিক্ষার গুরুত্ব। আরো জানে পৃথিবীর বৈরিতা। আর এত শীঘ্রই মেয়েরও বিয়ে নয়। সার্থকতা সেদিন যেদিন প্রতিষ্ঠিত হবে শান্তা।
অথচ শান্তা জানে না, ২০০-৩০০ টাকার সেই দিন থেকে শুরু করে আজ ১,০০০-১,৫০০ টাকার দিন পর্যন্ত প্রতিটা রাত কেটেছে তার মার অন্যের শয্যায় পিষ্ট হয়ে। সেও বছর দশেকের বেশী দিনের কথা।
মিরপুর-১১ তে টিনশেডের ভাড়া বাসায় থাকা সীমা বলে, আগের দিনের মানুষগুলো ভালো ছিল, এখন দুই নম্বর লোকে ভরা। আচ্ছা, শান্তা কি পারবে এই দুই নম্বর লোকেদের ভীড়ে জয়ী হতে ?? তার উপরেই যে নির্ভর করছে সীমা জিতল কতখানি।
সীমার ছলছল চোখ বারংবার বলে চলেছে, নারীরূপ বিকৃত হতে পারে, কিন্তু মাতৃরূপ কখনই না।
একটা সমাজ আমরা গড়ে তুলেছি। আমরাই বাধ্য করছি সমাজচ্যুত হতে। তারপর তাকেই ঘৃণা করছি।
...
লেখকঃ আপনার হাতটা একটু ধরে দেখতে পারি ??
সিএনজির গ্রিল খুলে বের করে দেয় হাত। লেখক ধরে দেখে। হাতে চুমু খেতে গিয়ে টের পায় মেকাপের আস্তরণের নিচে আস্ত একটা 'মা' বাস করছে। হাত তুলে নেয় নিজের মাথায় যেন আশীর্বাদ চায় সে।
সাথে সাথে ফিরে আসে একটা মাইক্রোবাস। ভেতর থেকে নেমে আসে হলুদ সালোয়ার-কামিজ পড়া স্বল্প বয়সী এক মেয়ে যাকে আনন্দ সিনেমার সামনে থেকে কিছুক্ষণ আগে তুলে দিয়েছিল তার সিএনজি চালক চাচাত ভাই। এখন টাকা ভাগাভাগি হবে।
আর সীমা অপেক্ষায় কখন ভোর হবে, একটা গাড়ি ধরে ফিরে যাবে মিরপুর-১১। সিএনজি চালক অনেকবার প্রস্তাব দিয়েছে, রাজি হয়নি সে। আজকের জন্য ১,২০০টাকাই যথেষ্ট...