এক সপ্তাহের ব্যবধানে বাংলাদেশের আরো একজন নারী পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ এভারেস্ট জয় করলেন। বাংলাদেশের দ্বিতীয় এই নারী এভারেস্ট জয়ীর নাম ওয়াসফিয়া নাজরীন। খবরে জানা যাচ্ছে, গতকাল শনিবার ভোরে তিনি হিমালয়ের দক্ষিণ প্রান্ত দিয়ে এভারেস্টে আরোহণ করেন। আগে গত সপ্তাহে এভারেস্ট জয় করেন বাংলাদেশের প্রথম নারী নিশাত মজুমদার।একই সময়ে নাজরীনও এভারেস্ট অভিযানে ছিলেন।
কিন্তু খারাপ আবহাওয়ার কারণে তার প্রথম উদ্যোগ ব্যর্থ হয়। এক সপ্তাহের মধ্যেই দ্বিতীয়বার আবার এভারেস্ট অভিমুখে যাত্রা করে সফলতার মুখ দেখলেন নাজরীন। নাজরীন গত বছর পৃথিবীর সাত মহাদেশের সাতটি সর্বোচ্চ চূড়ায় আরোহণের ঘোষণা দেন। তার এই কর্মসূচির নাম ‘বাংলাদেশ অন সেভেন সামিট’। শনিবার এভারেস্ট জয়ের মাধ্যমে তিনি সাতটি শৃঙ্গের তিনটি জয় করলেন। গত বছর অক্টোবর মাসে তিনি আফ্রিকার সর্বোচ্চ শৃঙ্গ কিলিমাঞ্জারো ও ডিসেম্বর মাসে দক্ষিণ আমেরিকার সর্বোচ্চ শৃঙ্গ আকোনকাগুয়া জয় করেন।
এভারেস্টে ডেথ জোনঃ
এখনো কেন এভারেস্টে আরোহণের সময় মারা যান এত পর্বতারোহী? এ বিষয়েই প্রথমবারের মতো চালানো হয়েছিল গবেষণাটি। ছয় সদস্যের দলটির নেতা অস্ট্রেলিয়ার ম্যাসাচুসেটস হাসপাতালের অ্যানেসথেসিয়া বিভাগের অধ্যাপক পল ফ্রিথ। বছর পাঁচেক আগে গবেষণা কাজে তাঁরা গিয়েছিলেন নেপালেও। চড়েছেন এমনকি এভারেস্টেও। পল বলেন, 'এভারেস্টের নেপাল অংশের অত্যন্ত বিপজ্জনক কুমবু হিমবাহ থেকে বরফ ধস এবং উচ্চতাজনিত ভীতি_এ দুটোই এভারেস্টে আরোহণকারীদের মৃত্যুর কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে এসেছে এত দিন। তবে আমাদের গবেষণা এগুলোর কোনোটাকেই সমর্থন করে না।'
১৯২০ সালের পর থেকে প্রায় আট হাজার ৫০০ মিটারের বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু এ পর্বতে চড়েছেন দুই হাজারের বেশি আরোহী। অনেকে বরণ করেছেন করুণ মৃতূ্য। কেন মরতে হয়েছে এসব দুঃসাহসীকে_এ প্রশ্নের জবাব খুঁজতে শুরুতেই তাঁরা ঘেঁটে দেখেছেন এভারেস্টে অভিযানের তথ্যভাণ্ডার। ১৯২১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত রেকর্ড করা হয়েছে ২১২টি মৃত্যু। এর মধ্যে ১৯২টি ঘটেছে বেসক্যাম্পের ওপরে। এভারেস্টের আট হাজার মিটার ওপরের অংশই সবচেয়ে বেশি বিপদসংকুল। এমন ভয়ংকর আবহাওয়া নেই আর কোথাও। গত ২৫ বছরের রেকর্ড অনুসারে জানা গেছে_প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র নিয়ে গেলেও অভিজ্ঞতার অভাবে বৈরী আবহাওয়ার সঙ্গে পুরোপুরি খাপখাইয়ে নিতে পারেন না অনেকেই। এ সময় কোনো কারণে আঘাতপ্রাপ্ত হলে তাতেই মরণ। এ ছাড়া কেউ কেউ মারা যান শরীরের অস্বাভাবিক কম তাপমাত্রার কারণেও। কোনো কোনো সময় সামনের ভয়ংকর বিপদ আঁচ করতে পারেন না, যদিও সঙ্গে থাকেন শেরপারা। তাঁদের বেশির ভাগই নেপালি এবং কেউ কেউ তিব্বতি। এসব মুটের কাজ আরোহণের যন্ত্রপাতি বহন এবং সামগ্রিক পরিবেশ সম্পর্কে পরামর্শদান। তবে হিমালয়ের সন্তান এসব মানুষও কখনো কখনো চির বৈরী আবহাওয়াকে বুঝে উঠতে পারেন না।
গত ৮৬ বছরে পর্বতারোহীদের মধ্যে মারা গেছেন ১ দশমিক ৩ শতাংশ। শেরপাদের মধ্যে এই হার ১ দশমিক ১ শতাংশ। আট হাজার মিটারের ওপর থেকে নামার সময় গত ২৫ বছরে হিমালয়ের তিব্বত অংশে মারা গেছেন মোট আরোহীর ৩ দশমিক ৪ শতাংশ এবং নেপাল অংশ দিয়ে নামার সময় মারা গেছেন ২ দশমিক ৫ শতাংশ। দলের অন্য সদস্যদের চেয়ে পিছিয়ে পড়া, অন্যদের অবস্থান নিয়ে মনের মধ্যে সন্দেহের সৃষ্টি এবং তীরে এসে তরী ডোবানোর মতো কিভাবে উঠব এত বিপজ্জনক পথ_এ কারণগুলোতেই মারা যান অনেক পর্বতারোহী। মনে হতে পারে, এত পথ উঠলে বাকি ৫০০ মিটার ওঠা কোনো ব্যাপারই না_এ কথাটি কেন মনে থাকে না? তাঁরা সবাই তো অত্যন্ত দক্ষ পর্বতারোহী, তাহলে কেন এমন হয়? প্রশ্নগুলো খুবই যৌক্তিক। তাহলে শুনে নিন জবাব_বিশ্বের যেকোনো পাহাড়ের তুলনায় এভারেস্ট বিপদসংকুল। এখানকার আবহাওয়া আজ কেমন থাকবে বলতে পারেন না সবচেয়ে দক্ষ শেরপাও। যত ওপরে উঠতে থাকবেন, আবহাওয়া হবে ততই বৈরী। যত ওপরে উঠতে থাকবেন, রেকর্ড গড়ার নেশায় আপনিও হয়ে যাবেন মরিয়া। এদিকে কমে যেতে থাকবে শরীরের তাপমাত্রা। ফলে স্বাভাবিকভাবেই হবেন অসচেতন। সামান্য চোখের ভুলেও যদি পা ফেলেন বেখেয়ালে অথবা শরীরের ভারসাম্য হারান সামান্য সময়ের জন্য, কোনো দিন খুঁজে পাবে না কেউ!
এভারেস্টে মরণের কারণের কথা বলতে গিয়ে গবেষক পল ফ্রিথ জানান_নিজের একটি অভিজ্ঞতা '২০০৪ সালে উত্তর দিক থেকে এভারেস্টে অভিযান চালিয়েছিল নরওয়ে-আমেরিকার একটি যৌথ দল। কোনো সমস্যা ছাড়াই আট হাজার ৩০০ মিটার উঠেছিল দলটি। তবে সাত হাজার ৯০০ মিটার নামতে না নামতেই দেখা দেয় চরম অক্সিজেন সংকট। দলের অর্ধেক সদস্য নামতে পেরেছিলেন ভালোভাবেই। যাঁদের মধ্যে ছিলেন নরওয়ের প্রথম এভারেস্টজয়ী নারী র্যান্ডি কংও। তবে বাকি সাত সদস্যকে মরণশয্যা নিতে হয়েছিল এভারেস্টের কোলে।'
[এভারেস্টের উচ্চতা প্রায় আট হাজার ৮৪৮ মিটার। বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু এ পর্বতের আট হাজার মিটার থেকে ওপরের অংশটিই 'ডেথ জোন'। তাপমাত্রা এখানে খুব কম। তুষারঝড় আক্রমণ করে নিয়মিতই। ঝড়ের কবলে পড়ে অথবা বরফে ভারসাম্য রাখতে না পেরে পাহাড় থেকে পড়ে যান অভিযাত্রীরা। মরণ ঘটে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা বাতাসে। অক্সিজেনের অভাবেও মারা যান অনেক আরোহী। কেউ কেউ পঙ্গু হয়ে যান। তখন তাঁদের বয়ে নিয়ে যাওয়া খুবই দুঃসাধ্য। ফেলে রেখে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকে না অন্যদের। প্রায় ১৫০ জন পর্বতারোহী ডেথ জোনে ঘুমিয়ে আছেন চিরকালের মতো।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে মে, ২০১২ রাত ৩:২৮

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




