somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

"মাদার টেরিজা": তার আপাতঃ মাহাত্ম্য

০৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১২ সকাল ৮:৪১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ধর্ম, ধার্মিক, আর ধর্ম মহাপুরুষদের/নারীদের নিয়ে আমাদের মুগ্ধতার শেষ নেই। দরিদ্র, অশিক্ষিত মানুষ, অর্থাৎ আমাদের কাছে এদের মূল্য অপরিসীম, তা নাহলে রাজারবাগের হাজার কেজি খাসী চোখে গোল্ড ফ্রেমের চশমা দিয়ে সিংহাসনে বসে থাকতে পারতো না আর আমরাও তার পায়ের নিচে গড়াগড়ি করতাম না।

তেমনি এক "মহাত্মা" তথাকথিত "মাদার" টেরিজাকে নিয়েও আমাদের মোহান্ধতার শেষ নেই। তাকে আমরা, যারা ধর্মান্ধ ক্যাথলিক মতের অনুসারীও নই, তারাও মাদার বলে ডাকি আর দরিদ্রদের জন্য তার "সেবার" কথায় আপ্লুত হই।

এত কথা বলার কারণ, গতকালকের এই পোস্ট । এখানে তাকে নিয়ে গতানুগতিক শ্রদ্ধাগদগদ কথার বুনন দিয়ে জানানো হচ্ছে তিনি কত মহান ছিলেন আর ১৪ জন এসে "ঠিকোই কইছুইন" বলে বাহবা দিয়ে যাচ্ছেন।

মৃত্যুর আগে পর্যন্ত টেরিজা কলকাতা শহরে মিশনারীজ অব চ্যারিটি নামের একটি প্রতিষ্ঠান চালাতেন। বলাবাহুল্য, এটি খৃষ্টান ক্যাথলিক ধর্মপ্রচারকদের একটি সংগঠন। ক্যাথলিকরা খ্রীষ্টধর্মের সবচাইতে কট্টর মতাবলম্বী। আর টেরিজা ছিলেন কট্টরদের মধ্যে কট্টর।
তার মৃত্যুর পর তখনকার পোপ জন পল তাকে সেইন্ট উপাধি দেয়ার জন্য উঠেপড়ে লাগেন। বলা প্রয়োজন, ভ্যাটিকান যখন কাউকে সেইন্ট বা সাধু/সাধ্বী উপাধি দিতে মনস্থ করে তখন দীর্ঘ এক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এই উপাধি দেয়া হয়। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় ক্যাননাইজেশান। টেরিজার ক্ষেত্রে পোপ জন শর্টকাটে কাজ সেরে দেয়ার ব্যবস্থা নেন।

ইতালিয়ান সংবাদপত্র ল'একো দি বারগামোতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা যায় যে সেসময় ভ্যাটিকানের পররাষ্ট্র মন্ত্রি জ্যেষ্ঠ কার্ডিনালদের কাছে এক চিঠিতে পোপের পক্ষে প্রশ্ন করে পাঠান যে তারা টেরিজাকে সরাসরি সেইন্ট করাকে অনুমোদন করেন কিনা। পোপের ইচ্ছা ছিল তার জীবদ্দশায় এই অনুষ্ঠান সম্পন্ন করার জন্য যথাশীঘ্রসম্ভব এই প্রক্রিয়া শেষ করা। এই প্রক্রিয়ার পক্ষে ওকালতি করা ক্যানাডিয়ান যাজক ফাদার ব্রায়ান কোলোদিচুকের ভাষ্যে, কার্ডিনালদের জবাব ছিল নেতিবাচক। কিন্তু ততদিনে এই প্রক্রিয়ার যে শুদ্ধতা ছিল তার যতটুকু ক্ষতি হবার তা হয়ে গেছে।

পোপ জন ১৩র নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় ভ্যাটিকান কাউনসিলের সময় যে কোন রকম সংস্কারপ্রস্তাবের চুড়ান্ত বিরোধিতাকারী ছিলেন টেরিজা। তার মত ছিল যে, মতাদর্শের কোনরকম সংস্কারের চাইতে বেশী প্রয়োজন আরো বেশী বিশ্বাস আর ধর্মপ্রচারের জন্য বেশী বেশী কাজ করা। যে কোন রকম সংস্কারের প্রশ্নে তার অবস্থান ছিল গোঁড়া ক্যাথলিকদের চাইতেও মৌলবাদী আর অতি-প্রতিক্রিয়াশিল। ক্যাথলিক মতবাদ গর্ভপাতকে ঘৃণা করতে শেখায় আর শেখায় গর্ভপাত কোন অবস্থায়ই গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু শান্তির জন্য নোবেল পুরষ্কার হাতে নিয়ে উপস্থিত হতবাক শ্রোতাদের সামনে তিনি ঘোষণা করেছিলেন যে গর্ভপাত "শান্তির জন্য সবচাইতে বড় হুমকি।"
একইভাবে বিশ্বাসীদের শেখানো হয় বিবাহাবিচ্ছেদকে ঘৃণা করতে আর এড়িয়ে চলতে কিন্ত তাদেরকে এমনটা শেখানো হয় না যে বিবাহবিচ্ছেদ আর পূনর্বার বিয়ে করাকে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করে রাষ্ট্রিয় সংবিধান সংশোধন করা হোক। ১৯৯৬ সালে আয়ারল্যান্ডে একটি গণভোট চলাকালে এমনটিই চেয়েছিলেন "মাদার" টেরিজা। তার এই দাবী খুব অল্প ভোটে হেরে যায়। কিন্তু তার কিছুদিন পরেই লেডিজ হোম জার্নাল পত্রিকায় দেয়া এক সাক্ষাতকারে তিনি তার বন্ধু প্রিন্সেস ডায়ানার বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ে সন্তোষপ্রকাশ করেন কারণ তার বিয়ে স্পষ্টতঃই একটি অসুখী দাম্পত্য ছিল। ভণ্ডামি আর কাকে বলে!

এখানে মধ্যযুগের চার্চের একটি দুর্নীতির কথা না বললেই নয়। তখন অর্থের বিনিময়ে ধনীদের পাপস্খলনের সুযোগ করে দিত চার্চ। অর্থাৎ, আপনি অন্যায় করে এসে চার্চকে কিছু টাকা দিলে তারা আপনার জাগতিক শাস্তি ক্ষমা করে দিতে পারতেন। আর আপনিও আবার সমাজে মাথা উঁচু করে দাবড়িয়ে বেড়াতেন। একে বলা হয় ইনডালজেনস। দরিদ্রদের জন্য তেমন কোন সুযোগ ছিল না। তাদের জন্য ছিল শুধু দোযখের আগুনের ভয় আর সবর করা। "মাদার" টেরিজা গরীবদের বন্ধু ছিলেন না। তিনি ছিলেন দারিদ্রের বন্ধু। তিনি বলে বেড়াতেন যে দুঃখ-কষ্ট ভোগ করা হচ্ছে ঈশ্বরের অনুগ্রহ, বা পুরষ্কার। দারিদ্র দূর করার একমাত্র প্রমাণিত পদ্ধতি হচ্ছে নারীকে ক্ষমতাশালী করা আর তাদেরকে বাধ্যতামূলক গর্ভধারণের মত পশুসুলভ জীবন থেকে মুক্তি দেয়ায়। "মাদার" টেরিজা তার সারাজীবন ব্যয় করেছেন এর বিরোধিতায়। তিনি পৃথিবীর জঘণ্যতম সব ধনীদের বন্ধু ছিলেন। তিনি নিঃসংকোচে হাইতির কুখ্যাত ডুভালিয়ের পরিবারের কাছ থেকে জনগণের চুরি করা টাকা হাত পেতে নিয়েছেন আর বিনিময়ে এই স্বৈরশাসকের দুঃশাসনের প্রশংসা করেছেন। তিনি টাকা নিয়েছেন আমেরিকার কুখ্যাত লিঙ্কন সেভিংস অ্যান্ড লোনস কেলেঙ্কারির হোতা চার্লস কিটিংয়ের কাছ থেকে। এই বিপুল টাকা, আর যত দানের অর্থ সব কোথায় গেল তার জবাব টেরিজার কাছ থেকে পাওয়া যায়নি। কোলকাতায় তার পরিচালিত হতদরিদ্র পুরোনো প্রতিষ্ঠানটির তার জীবদ্দশায় কোনরকম উন্নয়ন হয়নি যদিও তার নিজের চিকিতসার জন্য তিনি ক্যালিফোর্নিয়ার হাসপাতালে উড়ে গেছেন। এই প্রতিষ্ঠানের কোনরকম অডিট তিনি কোনদিন প্রকাশ করতে রাজী হননি। তিনি দাবী করেছেন যে সারা পৃথিবীর একশোটির বেশী দেশে ৫০০ কনভেন্ট খুলেছেন তার নিজের নামের প্রতিষ্ঠান। যদিও খৃষ্টধর্মের প্রচারিত দীনতা, হীনতার বাণীর সাথে তা মেলেনা।

ধনীরা অপরাধী বিবেক বয়ে বেড়ায় আর ধনীদের স্বভাব হলো নিজেদের বিবেকের দংশন থেকে মুক্ত থাকতে তারা দান-ধ্যান করে থাকে। তারা এই মহিলার কাছে টাকা পাঠাতো। তিনি নিজেকে "ফকিরের ফকিরদের" জন্য সংগ্রামী একজন কর্মী বলে প্রচার করতেন। কেউই স্বীকার করতে চায় না যে সে ঠকে এসেছে তাই এই কল্পকাহিনী গড়ে উঠতে দেয়া হয়েছে আর গণমাধ্যমে এমন একদল অলস কর্মী কাজ করে যারা শুধুই প্রেসরিলিজ দিয়ে রিপোর্ট করা গেলে আর কোন পরিশ্রম করতে চায় না। তাই গণমাধ্যমও কোন প্রশ্ন করেনি। বহু স্বেচ্ছাসেবক কলকাতায় মিশনারীজ অব চ্যারিটিতে কাজ করতে গিয়ে সেখানকার অতি কঠোর আদর্শ আর দারিদ্রপ্রেমী ভরং দেখে হঠাৎই বিতঃশ্রদ্ধ হয়ে ফিরে গেছেন, কিন্তু তাদের কাহিনী কোথাও জায়গা পায়নি।

টেরিজার ওপর দেবীত্ব আরোপের ফলে যা হয়েছে তা হলো অতিগোঁড়া, ধর্মান্ধ একজন অতিসাধারণ ব্যক্তিত্বকে উচ্চপদে আসীন করা হয়েছে। "মাদার" টেরিজার কারণে আরো বহু মানুষ দারিদ্র আর অসুস্থতা নিয়ে বেঁচে থাকবে। তার উদাহরন অনুসরণ করে আরো মানুষ দরিদ্র আর অসুস্থ হবে। তিনি ছিলেন অতি মৌলবাদী একজন ধর্মান্ধ প্রতারক। যে চার্চ এমন একজন মানুষকে তার শক্তি দিয়ে রক্ষা করে তাদের নৈতিক অবস্থান নিয়ে আর কোন কথা বলার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয়না।


সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১২ সকাল ৮:৪১
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের মুমিনী চেহারা ও পোশাক দেখে শান্তি পেলাম

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:৫৮



স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে স্টেজে উঠেছেন বত্রিশ মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের চব্বিশ জনের দাঁড়ি, টুপি ও পাজামা-পাঞ্জাবী ছিলো। এমন দৃশ্য দেখে আত্মায় খুব শান্তি পেলাম। মনে হলো আমাদের মুক্তিযোদ্ধা আমাদের মুমিনদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দুই টাকার জ্ঞানী বনাম তিনশো মিলিয়নের জ্ঞানী!

লিখেছেন সাহাদাত উদরাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ২:৫৯

বিশ্বের নামীদামী অমুসলিমদের মুসলিম হয়ে যাওয়াটা আমার কাছে তেমন কোন বিষয় মনে হত না বা বলা চলে এদের নিয়ে আমার কোন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু আজ অষ্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত ডিজাইনার মিঃ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×