বিধাতার কাছে ছিল এক ফোঁটা চাওয়া
স্বর্গের সুখ নয়, নয় কোন বর
ওরা শুধু চেয়েছিল এতটুকু পাওয়া
মর্ত্যের কুঁড়ে ঘরে স্বপ্ন বাসর।
১৯৭১ সাল। বাংলাদেশের শহরে বন্দরে গ্রামে গঞ্জে হত্যা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ আর ধর্ষণের মহোৎসবে মেতে উঠেছে মানুষ নামের একদল হিংস্র জানোয়ার। পাকিস্তানী সৈন্য আর রাজাকার আলবদর নামের এইসব জানোয়ারদের কবল থেকে জীবন বাঁচাতে বিপন্ন অসহায় মানুষ শহর ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে গ্রামে। সীমান্ত পার হয়ে তারা দলে দলে পালিয়ে যাচ্ছে ভারতে। বেছে নিচ্ছে মানবেতর শরণার্থী জীবন।
ষোল সতের বছর বয়সী এক কিশোর তার পরিবারের সাথে শহর থেকে পালিয়ে এসে আশ্রয় নিল গ্রামে। দুর্গম ও জনবিরল এই অজ পাড়াগাঁয়ে তের চৌদ্দ বছর বয়সী এক কিশোরীকে ভালবাসলো সে। গোলাপের ফুটন্ত কুঁড়ির মতো প্রাণবন্ত, হরিনীর মতো চঞ্চলা চপলা সেই কিশোরীও ভালবাসলো ছেলেটিকে।
লোকচক্ষুর অন্তরালে তারা দু’জন ঘুরে বেড়ায় এই পল্লী জনপদে। তারা ঘুরে বেড়ায় বনে জঙ্গলে, খালে বিলে, পুকুর পাড়ে, আমবাগানে, বাঁশের ঝাড়ে আর পানের বরজে। দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ ধানের ক্ষেতে আইলের ওপর দিয়ে হাত ধরাধরি করে তারা চলে যায় বহুদূর। বৈশাখী ঝড়ের সাথে সাথে আকাশ ভেঙ্গে নেমে আসা তুমুল বর্ষণে ওরা হারিয়ে যায় ভালোবাসার অজানা দেশে। নিস্পাপ, নিষ্কলুষ দুটি অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে মেয়ের ভালোবাসার গল্প নিয়ে এই উপন্যাস।
সত্য ঘটনা ভিত্তিক লেখকের এই আত্মজৈবনিক উপন্যাসে মানব মানবীর চিরন্তন প্রেম ভালোবাসার গল্প আপনাকে নিয়ে যাবে হারিয়ে যাওয়া সময়ের এক জাদুকরী জগতে। ভালোবাসার জন্ম আছে, মৃত্যু নেই। পড়ুন সেই অবিনশ্বর ভালোবাসার মর্মস্পর্শী কাহিনী।
‘স্বপ্ন বাসর’ নামের এই আত্মজৈবনিক উপন্যাসটি ২০১১ সালের অক্টোবর মাসে কেয়া পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। প্রথম সংস্করণের এক হাজার কপি মাত্র এক বছরের মধ্যেই শেষ হয়ে যায়। পাঠকদের প্রবল চাহিদার কারণে উপন্যাসটির দ্বিতীয় মুদ্রণ খুবই জরুরী ছিল। কিন্তু লেখকের স্ট্রোক এবং অন্যান্য নানাবিধ কারণে সেটা আর সম্ভব হয়নি। ব্লগারদের মধ্যেও অনেকে উপন্যাসটি পড়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। আমার হাতে কয়েকটি হার্ড কপি ছিল, যা তাদের কয়েকজনকে পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু এখন আর আমার কাছে কোন কপি না থাকায় কাউকে দিতে পারছি না। কিন্তু আমি চাই ব্লগার বন্ধুরা উপন্যাসটি পড়ুন। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি উপন্যাসটি ধারাবাহিকভাবে ব্লগে প্রকাশ করবো। মোট ১৬টি অনুচ্ছেদের একটি করে ক্রমানুসারে প্রতিদিন ব্লগে প্রকাশ করা হবে।
সাধারণত প্রিন্ট বা অনলাইন মিডিয়ায় ধারাবাহিকভাবে উপন্যাস প্রকাশিত হওয়ার পর বই আকারে প্রকাশিত হয়। কিন্তু ‘স্বপ্ন বাসর’-এর ক্ষেত্রে উল্টো ঘটনা ঘটতে চলেছে। আজ প্রথম কিস্তিতে শুধু উপন্যাসটির ভূমিকা প্রকাশিত হলো। উপন্যাসের পটভূমি ও প্রেক্ষাপট বুঝতে হলে ভূমিকাটি পাঠ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আগামী সোমবার (৪-১১-২০১৯) থেকে মূল উপন্যাসের প্রকাশনা শুরু হবে।
ভূমিকা
এটি একটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে লেখা আত্মজৈবনিক উপন্যাস। আমার নিজের জীবনের টিন-এজ প্রেমকাহিনী। একটি পত্রিকার জন্য প্রথমে এটি আমি গল্প আকারে লিখেছিলাম। কিন্তু লেখার পর পড়ে মনে হলো আসলে কিছুই বলা হয়নি। অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বাদ পড়ে গেছে। ফলে কাহিনীর মূল ভাবনাটাই লেখার মধ্যে আসেনি। ভেবে দেখলাম এটিকে যদি উপন্যাসের আঙ্গিকে পাঠকের সামনে তুলে ধরা যায়, তাহলে হয়তো সেটা আসতে পারে। যদিও বাস্তব ঘটনা অবলম্বনে লেখা গল্প বা উপন্যাসের ক্যানভাসে পুরোপুরি বাস্তবকে তুলে ধরা যায় না, তাতে লেখকের মুন্সিয়ানা যতই থাক না কেন। উত্তমপুরুষের জবানীতে লেখা গল্প উপন্যাসের কিছু সীমাবদ্ধতা থাকেই। অথচ এই উপন্যাসের বিষয়বস্তু পাঠকদের বহুল পরিচিত। অসংখ্যবার পঠিত প্রেম ভালোবাসার গল্প। দুটি অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়ের ভালোবাসার কাহিনী। কিন্তু এটি লিখতে গিয়ে আমার বার বার মনে পড়েছে কবিগুরুর সেই অমর বাণী, “সহজ কথায় লিখতে আমায় কহ যে / সহজ কথা যায় না লেখা সহজে”। উপন্যাসের বিষয়বস্তু সহজ সরল, অথচ লেখার সময় বড় কঠিন মনে হয়েছে। আত্মজৈবনিক কাহিনী না হলে হয়তো এই যন্ত্রণার হাত থেকে রেহাই পাওয়া যেত। উত্তমপুরুষের জবানীতে লিখতে গেলে লেখকের নৈর্ব্যক্তিকতা রক্ষা করা প্রায়শই কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে লেখার বিষয়বস্তু, গঠন কাঠামো ও ভাষা-শৈলীতে তার একটা প্রভাব পড়ে। এসব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও আমি চেষ্টা করেছি যতদূর সম্ভব লেখাটিকে পাঠকের আগ্রহের কেন্দ্রে রাখতে।
এই উপন্যাসের সময়কাল ১৯৭১ সাল। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের বছর। কিন্তু এটি কোনভাবেই মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস নয়। এটি একটি নিখাদ প্রেমের গল্প। কাহিনীর বাস্তবতা রক্ষা করতে গিয়ে অনিবার্যভাবে ১৯৭১ সাল এসে গেছে। কাহিনীর কাল ঠিক থাকলেও সঙ্গত কারণে কিছু কিছু স্থান ও পাত্র পাত্রীর নামে পরিবর্তন আনতে হয়েছে। দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে (প্রায় চল্লিশ বছর) লেখার কারণে পাত্র পাত্রীদের মধ্যেকার সংলাপগুলোর সবই অবিকল লিপিবদ্ধ করা সম্ভব হয়নি। তবে যে সংলাপগুলো আমার স্মৃতিতে অটুট ছিল, সেগুলো হুবহু সেভাবেই লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।
প্রেমের উপন্যাস হলেও মানুষের প্রতি মানুষের মমত্ব ও সহমর্মিতাবোধ, রক্ত সম্পর্কের বাইরে মা ও সন্তানের স্বর্গীয় ভালোবাসা, মানব মনের বিচিত্র গতি প্রকৃতি এবং তৎকালীন গ্রামীন সমাজের সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ উঠে এসেছে এ লেখায়। আশা করি, একটা হারিয়ে যাওয়া সময়কে পাঠকরা খুঁজে পাবেন এর মধ্যে।
যে অঞ্চলের ঘটনা নিয়ে এই উপন্যাসটি লেখা, সে অঞ্চলের মানুষের একটি স্থানীয় কথ্যভাষা রয়েছে। ওই ভাষায় সংলাপগুলো লেখা হলে কাহিনীটি আরো বেশি বাস্তবের কাছাকাছি থাকতো বলে মনে হয়। কিন্তু বৃহত্তর পাঠক সমাজের কথা মাথায় রেখে আমি ওই কথ্যভাষা পরিহার করেছি।
উপন্যাসের প্রচলিত কাঠামো অনুযায়ী একটি অনুচ্ছেদ থেকে আর একটি অনুচ্ছেদের মধ্যে খানিকটা ফাঁকা রাখা হয় অথবা অনুচ্ছেদগুলি নম্বর দিয়ে আলাদা করা হয়। আমি এখানে তা’ করিনি। প্রতিটি অনুচ্ছেদ শুরুর আগে আমি কবিগুরুর কবিতা ও গীতি কবিতার ছত্র বিশেষ উদ্ধৃত করেছি। প্রেমের কবিতা ও গানের স্বর্গীয় ভুবনে কবিগুরুর চেয়ে বড় মহীরুহ বাংলা সাহিত্যে আর কে আছেন? রবীন্দ্রোত্তর যুগে তাঁর কাছে ঋণী নন, এমন কোন কবি সাহিত্যিক দুই বাংলায় কেউ আছেন কী? তাঁর কাছে ধার করতে পারাটাও ভাগ্য।
সব শেষে, আমি মনে করি পাঠকই হলেন যে কোন লেখার সর্বোত্তম বিচারক। অনেক ত্রুটি বিচ্যুতি সত্ত্বেও এই উপন্যাস যদি পাঠকের মনকে সামান্য নাড়া দিতে পারে, তবেই আমার শ্রম সার্থক হয়েছে বলে মনে করবো। উপন্যাসটি প্রকাশের সাথে জড়িত সবাইকে ধন্যবাদ।
বিনীত
আবুহেনা মোহাম্মদ আশরাফুল ইসলাম
আত্মজৈবনিক উপন্যাসঃ স্বপ্ন বাসর (পর্ব-১)
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে নভেম্বর, ২০১৯ সকাল ৯:৩১